রাজস্তত্ত্ব! শব্দটা নতুন লাগছে? মানুষের চিন্তাভাবনাকে যেহেতু মনস্তত্ত্ব বলা হয়, তাই রাষ্ট্রের চিন্তাভাবনাকে রাজস্তত্ত্ব বলে সম্বোধন করলাম। এই লেখায় আলোচনা করা হবে রাষ্ট্রের রাজস্তত্ত্ব নিয়ে।
প্রতিটা রাষ্ট্রের কমন রাজস্তত্ত্ব হচ্ছে নিরাপত্তাহীনতা। প্রতিটা রাষ্ট্রই নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। চীন আমেরিকার নিকট নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে, আমেরিকা রাশিয়ার নিকট, রাশিয়া আমেরিকার নিকট, আমেরিকা চীনের নিকট, চীন ভারতের নিকট, ভারত পাকিস্তানের নিকট। এভাবেই বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র একে অপরের নিকট নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে থাকে।
সত্যি বলতে নিরাপত্তাহীনতা নামক শব্দটা অজুহাত মাত্র। প্রকৃতপক্ষে প্রতিটা রাষ্ট্রই নিজেকে পৃথিবীর সকল সম্পদের একমাত্র বৈধ দাবীদার মনে করে, এবং তা অর্জনে পৃথিবীর উপর একক আধিপত্য কায়েম করতে চায়।
কিন্তু চাইলেইতো আর তা সম্ভব না। আছে পদে পদে বাধা, রয়েছে একের পর এক প্রতিদ্বন্দ্বী। যারা প্রত্যেকেই অভিন্ন লক্ষ্য পূরণে ছুটে চলছে। তাই একক আধিপত্য বিস্তারের প্রথম শর্ত হচ্ছে প্রতিদ্বন্দ্বীর পতন ঘটানো। মূলত পৃথিবীর সকল সম্পদ দখলের লক্ষ্যে, একক আধিপত্য বিস্তারের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিকে ধ্বংস করতে 'নিরাপত্তা' নামক খোঁড়া যুক্তি উপস্থাপন করে শুরু হয় আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণ, একক শব্দে যাকে বলা হয় যুদ্ধ। যে যুদ্ধে মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়, আহত হয়, প্রাণ হারায়!
চীন সিকিমের দখল নিলে ভারত নিরাপত্তা হুমকিতে পড়বে, এমন যুক্তি দেখিয়ে ভারত নিজেই সিকিম দখল করেছে। এই যে ভারত সিকিম দখল করলো তাতে কি চীন নিরাপত্তা হুমকিতে পড়ে না? আবার চীনকে ঘায়েলের উদ্দেশ্যে সৃষ্ট আন্তর্জাতিক জোট 'কোয়াড' এর অন্যতম সদস্য ভারত। ভারত যেহেতু নিজের সার্বভৌমত্ব নিশ্চিতের অজুহাতে সিকিমের স্বাধীনতা লুন্ঠন করেছে, এখন চীন যদি নিজের সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করার জন্য ভারতের স্বাধীনতা লুন্ঠন করে, তবে ভারত কি তা সমর্থন করবে?
একমাত্র দেশ হিসেবে পারমাণবিক বোমা ব্যাবহার করে মানুষ হত্যার রেকর্ড সৃষ্টি করা আমেরিকা মনে করে তার পারমাণবিক বোমা পৃথিবীর জন্য আশীর্বাদ! এবং ইরান পারমাণবিক বোমা তৈরি করলে সেটা হবে বিশ্বের জন্য হুমকি। প্রকৃতপক্ষে ইরানের পারমাণবিক বোমা যে আমেরিকার আধিপত্য বিস্তারের পথে হুমকি, সেকথা বলতে আমেরিকার হয়তো সরম লাগে!
পৃথিবীর উপর একক আধিপত্য বিস্তারে ভারতের প্রথম বাধা চীন এবং পাকিস্তান। ধরুন এ বাধা দূর হলো, তবে সামনে আসবে আমেরিকা বা রাশিয়া। ভারত যদি প্রত্যেককে খতম করতে পারে তখন সে ইচ্ছে মতো পৃথিবীকে শোষণ করবে, এবং এটাই তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য। একইভাবে আমেরিকা, রাশিয়া, চীন, কিংবা যারা ভবিষ্যতে পরাশক্তি হবে প্রত্যেকের চূড়ান্ত লক্ষ্য এটাই। আবার পরাশক্তি হওয়ার স্বপ্ন প্রত্যেক রাষ্ট্রই দেখে। যতদিন পর্যন্ত শক্তি অর্জন না করতে পারে, ততোদিন হয়তো দাবার গুটি, না হয় দর্শকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে মন্তব্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতে হয়।
আজকে যদি চীন নিজেকে আমেরিকার নিকট সঁপে দেয় দেয়, আফ্রিকানদের মতো না খেয়ে তাদের সম্পদ আমেরিকার হাতে তুলে দেয়, তবেই আমেরিকা-চীন দ্বন্দ্ব মিটে যায়। তাইওয়ানের গনতন্ত্র? আমেরিকা নিজেই তাইওয়ানকে বলবে, 'আরে মিয়া ফালপারো ক্যান তুমিতো চীনেরই অংশ, যাও বিবাদ ভুলে মিলেমিশে থাকো'।
আমেরিকা যদি রাশিয়ার কথা মতো চলে, তবেই আমেরিকা-রাশিয়া দ্বন্দ্বের সুরাহা হয়। ভারত যদি বলে আজ হতে ভারত চীনের উপনিবেশ, চীন তার স্বার্থে ইচ্ছে মতো বিনা শর্তে ভারতকে ব্যবহার করতে পারবে, তবে আর চীন-ভারত দ্বন্দ্ব বলে কিছু থাকবে না। পাকিস্তান যদি নিজেকে ভারতের সাথে মিলিয়ে দেয়, তাহলে মিটে যাবে পাক-ভারত বিবাদ।
পৃথিবী দখলের এই প্রচেষ্টা এ যুগের কোন উদ্ভাবন নয়। হাজার হাজার বছর ধরেই এ প্রচেষ্টা চলমান। একটা সময় মানুষ যখন শাসকের প্রতি আনুগত্যশীল ছিল, তখন শাসকেরা বিশ্ব দখলের চেষ্টা করেছে। এককভাবে আলেকজান্ডার, তেমুজিনের মতো শাসকেরা এ দৌড়ে অনেক দূর এগিয়েছিল। বর্তমান যুগে মানুষ রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্যশীল, তাই কোন রাষ্ট্র যখনই শক্তিশালী হয়ে ওঠে তখন সে চায় পুরো পৃথিবী দখল করতে। এটাই রাষ্ট্রের রাজস্তত্ব।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই আগস্ট, ২০২২ দুপুর ২:৩৮