ইতিমধ্যে গত দুই পর্বে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যদের অযৌক্তিক ও অগণতান্ত্রিক সাংবিধানিক সুবিধা এবং শান্তি রক্ষার কিছু নমুনা আলোচনা করা হয়েছে, লিঙ্ক:পর্ব১ পর্ব২
শেষ পর্বে এসে দেখব নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য রাষ্ট্রের চরিত্র। নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য রাষ্ট্রের চরিত্র বেশ অদ্ভুত! সরাসরি ভাবে বললে, কেউ খুনি, কেউ চোর, কেউ বাটপার। তবুও ক্ষমতা তাদের হাতেই। আমাদের কিছু গ্রামের গ্রাম্য মোড়লদের মতো।
আমেরিকা: বর্তমান আমেরিকানদের দ্বারা আমেরিকান মূল আদিবাসীদের হত্যার করে আমেরিকা দখলের ইতিহাস তো প্রথম পর্বেই বলেছি। বর্তমানে এই আমেরিকা ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে মিডিয়ার দ্বারা ভুয়া প্রচারনা চালিয়ে ইরাক আক্রমন করে লক্ষ লক্ষ মানুষ হত্যা করেছে। এখন যখন সব ফাঁস হয়ে যাচ্ছে তখন স্যরি বলেই লক্ষ লক্ষ খুনের দায় মুক্তি নিচ্ছে।
কায়দা করে 'আল-কায়দা' নামক নাটক সাজিয়ে মিডিয়ার দ্বারা বিশ্ববাসীর মনে ভয় ঢুকিয়ে আফগানিস্তানে মানুষ খুন করার সার্টিফিকেট নিয়েছে, লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছে। আচ্ছা এখন কেনো আফগানিস্তান হতে সৈন্য প্রত্যার করছে? তালেবানকি এখন সাধু হয়ে গেছে, নাকি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে? কিছুই হয়নি, তালেবান আগের মতোই আছে। আসলে আমেরিকা যখন দেখছে খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি হয়ে যাচ্ছে তাই তালেবানে এখন আর সমস্যা নেই, এখন লেজ গুটাতে বাধ্য হচ্ছে।
এই খুনি হচ্ছে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য। জাতিসংঘ সনদ অনুযায়ী শান্তি এবং নিরাপত্তার প্রশ্নে সারা বিশ্বের মতামতের চেয়ে এই খুনির মত অধিক গুরুত্বপূর্ণ।
যুক্তরাজ্য: পলাশীর যুদ্ধের পর মুর্শিদাবাদে রাজকোষ ও রাজপ্রাসাদ লুণ্ঠন করে সরকারকে দেউলিয়া করে এই বিট্রিশরা। বিট্রিশদের চুরি নিয়ে গবেষণা করেছেন স্বনামধন্য অর্থনীতিবিদ ড. উষা পাটনায়েক। তিনি তার গবেষণায় দেখিয়েছেন ২০০ বছরের শাসনে ব্রিটিশরা ভারত উপমহাদেশ হতে ৪৫ ট্রিলিয়ন ডলারের (৩৭৮০ লাখ কোটি টাকা) বেশি অর্থ চুরি করেছে। সে সময়ে ৪৫ ট্রিলিয়ন ডলার, যেখানে যুক্তরাজ্যের বর্তমান জিডিপি ২.৮ ট্রিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ বিট্রিশরা তাদের বর্তমান জিডিপির ১৬ গুনেরও বেশি অর্থ সে সময়ে ভারত উপমাদেশ থেকেই চুরি করেছে। এখনকার সময়ে সেটা কতগুণ হতে পারে ভেবে দেখতে পারেন!! এই চুরির টাকায় গড়া তাদের আজকের শিল্পোন্নত ইংল্যান্ড! কিছুদিন আগে এক বন্ধু বলছিল, তাদের এলাকার চেয়ারম্যান একটা সময় চোর ছিল। চুরি করে টাকা কামিয়ে এখন এলাকার চেয়ারম্যান। ব্রিটিশদের অবস্থাও কি একই নয়? এই ব্রিটিশরা'ই জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের ৫ স্থায়ী সদস্যের একজন।
ভারতীয় লোকসভার সাবেক সদস্য 'শশী থারুর' বিট্রিশদের চুরির ব্যপারে অক্সফোর্ড ইউনিয়নে চমৎকার একটা বক্তব্যটা দিয়েছে। ইউটিউবে Dr Shashi Tharoor speech in Oxford union লিখে সার্চ দিলেই পেয়ে যাবেন ১৫ মিনিটের সেই বক্তব্য
ফ্রান্স: বাংলায় একটা প্রবাদ আছে, 'চোরের মার বড় গলা'। ফ্রান্স হচ্ছে এর উত্তম উদাহরণ। ফ্রান্সের মানসিকতা এতটাই নিচু যে, ঔপনিবেশিক আমলে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে নির্মিত স্থাপনা হতে এখনো ভাড়া আদায় করে। ব্যপারটা এমন যে, ধরুন, ব্রিটিশরা হার্ডিং ব্রিজ কিংবা কার্জন হল হতে বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে ভাড়া আদায় করছে।
ব্রিটিশরা তো চুরি শেষে বিনা শর্তে ভারত ছেড়েছে, কিন্তু ফ্রান্স আফ্রিকান দেশগুলোকে বিনা শর্তে স্বাধীনতা দেয়নি। চুক্তির মাধ্যমে ইচ্ছেমত শর্ত চাপিয়ে আফ্রিকানদের নিঃস করে স্বাধীনতা দেয়া হয়।
যেমন: আফ্রিকান রাষ্ট্র গুলোকে তাদের অর্জিত আয়ের সবটাই FCFA ( Franc for France African) নামক ব্যাংকে রাখতে হবে। ফলে স্বাধীনতা লাভ করেও ১৪ টি আফ্রিকান দেশকে এই FCFA তে তাদের জাতীয় আয় জমা রাখতে হয়। দেশগুলো হলো: টোগো, বেনিন, বুর্কিনা ফাসো, গিনি বিসাউ, সেনেগাল, আইভরিকোষ্ট, মালি, নাইজার, চাদ, ক্যামেরুন, মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্র, কঙ্গো, নিরক্ষীয় গিনি, গ্যাবন
শর্ত অনুযায়ী নিজেদের টাক'ই উত্তলনের ক্ষেত্রে জমাকৃত টাকার সব্বর্চ ১৫% উত্তলন করতে পারবে, এর বেশি দরকার হলে ঋণ নিতে হবে, তাও সব্বর্চ ২০% এবং সুদের হারও হবে বাণিজ্যিক রেটে।
ফ্রান্সের ঔপনিবেশিক থেকে স্বাধীনতা পাওয়া দেশগুলোর সকল খনিজ সম্পদ উত্তোলনেরও প্রথম দাবিদার হবে ফ্রান্স। যদি ফ্রান্স উত্তলনে আগ্রহ না দেখায় তবেই অন্য দেশ খনিজ সম্পদ উত্তোলন করতে পারবে!
শর্ত অনুযায়ী অবকাঠামো নির্মাণ কাজের ক্ষেত্রে ফ্রান্সকে প্রথম প্রায়োরিটি দিতে হবে। এর মাধ্যমে ফ্রান্স একতরফা ভাবে সরকারি স্থাপনা নির্মাণের সুবিধা ভোগ করছে। ফলে এমনও হয়েছে যে, আইভরিকোষ্টে এক বাঁধ নির্মাণে ফরাসী কোম্পানির অর্ধেক মূল্যে টেন্ডার জমা দিয়েও চীনা কোম্পানি কাজ পায়নি। দ্বিগুণ অর্থে টেন্ডার দেয়া ফরাসী কোম্পনিকেই কাজট দিতে হয়েছে।
ফ্রান্সের এই শোষণের বিরুদ্ধে দাড়ানোর কারণে এ পর্যন্ত প্রায় ২২ জন আফ্রিকান শাসককে হত্যা করেছে ফ্রান্স। প্রতিনিয়তই আফ্রিকানদের রক্ত চুষে খাওয়া ফ্রান্স জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদেন স্থায়ী সদস্য।
চীন: জিনজিয়াং প্রদেশের পূর্ব তুর্কিস্তানে একবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট মানবতা বিরোধী অপরাধ করে যাচ্ছে চীন।সেখানকার উইঘুর দের উপর নির্যাতনের কথা কারোই অজানা নয়। কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে আটকে রেখে চালানো হচ্ছে নির্যাতন। এটাকে সংশোধনাগার বললেও সাংবাদিক প্রবেশে রয়েছে নিষেধাজ্ঞা। এর মাধ্যমে চীনের বক্তব্য শতভাগ মিথ্যা প্রমানিত হয়।
যাইহোক সেখানে চীনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের কিছু চিত্র দেখা যাক --
সেখানে মুসলিম গর্ভবর্তী নারীদের জোরপূর্বক গর্ভপাত করানোর পাশাপাশি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ছেলেদের সাথে বিয়েতে বাধ্য করা হচ্ছে। এমনও শোনা যায়, ধর্ষণের মাধ্যমেও চীনাদের সন্তান গর্ভধারণে বাধ্য করা হচ্ছে। সেখানে নতুন মসজিদ নির্মাণতো দূরের কথা পুরনো মসজিদের সংস্কারও করতে দেয়া হয় না। কোনো প্রকারেই ধর্মিও শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ দেয়া হয় না। মুসলিম তরুণীদের নাচ-গানে বাধ্য করা হয়। পরিকল্পিক ভাবে উইঘুরদের নিজস্ব সাংস্কৃতিকে এবং ইসলামিক রীতিনীতি ধ্বংস করে দিচ্ছে। বিভিন্ন স্থানে মসজিদে নামাজে বাঁধা দেওয়া হচ্ছে। নষ্ট করে দেয়া হচ্ছে উইঘুর নারী-পুরুষের প্রজনন ক্ষমতা। পরিবেশের ভারসাম্যের কথা চিন্তা না করেই কিছুদিন আগে জিনজিয়াং প্রদেশের একটি শহরকে ভূগর্ভস্থ পারমানবিক পরীক্ষা ও বিষ্ফোরণের জন্য বাছাই করেছে। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রতিটা নাগরিকের উপর সব্বর্চ নজরদারি চালানো হচ্ছে। প্রত্যেকের বাড়িতে বাড়িতে লাগানো হয়েছে সিসিটিভি ক্যামেরা, মোবাইলে বিশেষ এ্যাপস ইন্সট্রল করানো হচ্ছে নজরদারীর জন্য। এগুলো হচ্ছে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের বাহিরের অবস্থা, ক্যাম্পের ভেতরের অবস্থা তো আরো ভয়াবহ!!
এছাড়াও একই কায়দায় হান চীনারা নির্যাতন করছে সেখানকার কাজাখ অধিবাসীদের। এই হচ্ছে স্থায়ী ভাবে বিশ্ব শান্তি রক্ষার দায়িত্বে থাকা চীনের চরিত্র।
রা শি য়া: আয়তনে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ দেশ রাশিয়ার সাম্রাজ্য বিস্তারের ইতিহাস লক্ষ লক্ষ বেসামরিক লোক হত্যা এবং নারী ধর্ষণের ইতিহাস।
১৫৮০ সালে সাইবেরিয়া দখল করার পর সেখানকার বিভিন্ন অঞ্চলের আদিবাসীদের হত্যা উৎসবে মেতে ওঠে রুশ সেনারা। এক কামচাটকাতেই ২০,০০০ স্থানীয় অধিবাসীর মধ্যে প্রায় ১২,০০০ জনকে হত্যা করে। ১৭৩০ হতে ১৭৩১ সাল পর্যন্ত চুকচিদের উপর চালায় গণহত্যা। এরপর ১৭৪২ সালে রাশিয়ার সম্রাজ্ঞী এলিজাবেথ চুকচিদেরকে তাদের বাসভূমি থেকে বিতাড়িত করার এবং তাদের সংস্কৃতি ধ্বংস করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। ১৭৫৩ থেকে ১৭৫৪ সাল পর্যন্ত কোরিয়াকদের উপর চালায় গণহত্যা।
১৭৩৬ সালে রুশ বাহিনী ক্রিমিয়ায় আক্রমন করে এ সময় ক্রিমিয়ান তাতার জনগোষ্ঠীর উপর নির্বিচারে হত্যাকান্ড চালায়। হত্যার পাশাপাশি জ্বালিয়ে দেয়া হয় মানুষের ঘরবাড়ি, শিক্ষা প্রতিষ্টান, মসজিদ গির্জা সহ বিভিন্ন স্থাপনা। ১৭৮৭ সালের রুশ অটোমান যুদ্ধে রাশিয়া যেসব অঞ্চল দখল করছে সেখানেই সাধারণ মানুষের উপর হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে।
১৮৬৪ সালে ককেশাস অঞ্চল দখল করে সেখান থেকে সার্কাশীয়দের বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেয়। এর ফলে রুশ সৈন্যের হাতে প্রাণ হারায় ৬ থেকে ১৫ লক্ষ সার্কাশীয়, এবং ১৫ লক্ষ বিতাড়িত হয় জন্মভূমি থেকে।
চেচনিয়দের উপর জার্মানদের সহযোগীতার অভিযোগ এনে ১৯৪৪ সালে জোসেফ স্টালিন পাঁচলক্ষ চেচনিয় মুসলমানকে সাইবেরিয়া, কাজাখস্তান ও কিরগিস্তানে নির্বাসিত করে। নির্বাসিত করাতে গিয়েও অত্যন্ত পৈশাচিক ভাবে হত্যা করা হয় অসংখ্য মানুষকে। খাইবাখ নামক অঞ্চলের নিকট নারী ও শিশু সহ অসংখ্য মানুষকে তালাবদ্ধ করে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। যারা পালিয়ে যাওযার চেষ্টা করে তাদের গুলি করে হত্যা করা হয়। জার্মানদের সহযোগীতার মিথ্যা অভিযোগে যে চেচনিয়দের উপর এমন নিষ্ঠুর আচরন করা হয় সেই চেচনিয়দের ৪০,০০০ যোদ্ধা রাশিয়ার পক্ষে যুদ্ধ করে, যাদের ৫০ জনকে 'হিরো অব সোভিয়েত' উপাধিও দেয়া হয়েছিল। এ জাতি যদি জার্মানদের সহায়তাই করতো তবে তাদের ৪০,০০০ সৈন্য নিশ্চই সোভিয়েতের পক্ষে যুদ্ধ করতো না, এবং ৫০ জন 'হিরো অব সোভিয়েত' উপাধিও পেত না।
পুরাতন হিসেব বাদ দিয়ে এখনকার কথা বলি, ১৯৯১ সালের গণভোটের রায়কে অগ্রাহ্য করে চেচনিয়ার স্বাধীনতা নস্যাৎ করতে ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত প্রায় ৮০,০০০ বেসামরিক লোককে হত্যা করে রুশ সৈন্যরা। শুধুমাত্র রাজধানী গ্রোজানিতেই বিমান হামলা করে প্রায় ৩৫,০০০ বেসামরিক নারী-পুরুষকে হত্যা করা হয়। হত্যাকাণ্ডের পাশাপাশি চেচনিয় নারীদের উপর চলতে থাকে গণধর্ষণ। পাঁচ লক্ষের অধিক চেচনিয় হয় উদ্বাস্তু।
বর্তমান প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনও এক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই, ১৯৯৯ সালে প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন হাজার হাজার চেচনিয় মুসলমানের রক্তে হাত রাঙ্গিয়েছে বর্তমান প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। এই খুনিদের হাতে বন্ধি আন্তর্জাতিক শান্তির চাবিকাঠি।
এতক্ষণ যা বললাম তা কোনো কাল্পনিক গল্প বা উপন্যাস নয়, অবশ্য গল্প বা উপন্যাস লেখার প্রতিভাও আমার নেই! যা লিখেছি তা ইতিহাস এবং বর্তমানের সমন্বয়। তুলে ধরেছি আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা ও শান্তি রক্ষার উদ্দেশ্যে গঠিত জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যদের সিভি, জীবন বৃত্তান্ত বা চরিত্র। এদের হাতে নিয়ন্ত্রিত জাতিসংঘ দ্বারা বিশ্ব কতটা শান্তিপূর্ণ হতে পারে বা হচ্ছে আজ দৃশ্যমান। জাতিসংঘ যে বিশ্বের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় গুটিকয়েক গডফাদার রাষ্ট্রের একটা ক্রীড়ানক তা পরিষ্কার। সুতরাং খুব জোর দিয়েই বলতে চাই, সময় এসেছে, বিশ্বের সকল শান্তিকামী মানুষের উচিত জাতিসংঘ নিয়ে ভাবা!
ছবি: গুগল
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই জুন, ২০২১ দুপুর ২:২২