প্রথম পর্বে জাতিসংঘের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় তুল্য 'নিরাপত্তা পরিষদের' স্থায়ী রাষ্ট্রের অযৌক্তিক ও অগণতান্ত্রিক সাংবিধানিক ক্ষমতা সম্পর্কে লিখেছি। প্রথম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন
এ পর্বে থাকছে স্থায়ী সদস্য সিলেকশনে জনসংখ্যা, ধর্ম ও ভৌগলিক অযৌক্তিকতা এবং অগণতান্ত্রিকতা, সাথে শান্তি রক্ষার কিছু নমুনা।
পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার ৭.৭৯% মানুষের উত্তর আমেরিকা মহাদেশ হতে একটি, এবং ৯.৯৪% জনসংখ্যার ইউরোপ মহাদেশ হতে তিনটি। অর্থাৎ জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচটি স্থায়ী সদস্য রাষ্ট্রের চারটিই নেয়া হয়েছে মাত্র (৭.৭৯+৯.৯৪) ১৭.৭৩% মানুষের মধ্য হতে। ইতিপূর্বে বলেছি বর্তমান আমেরিকানরাও মূলত ইউরোপিয়ান। তার মানে, পাঁচটি স্থায়ী সদস্যের চারটিই বলা যায় ইউরোপিয়ান।
অথচ আয়তনেও বৃহত্তর এবং পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার ৫৯.৬৯% মানুষের এশিয়া মহাদেশ হতে নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী রাষ্ট্র মাত্র একটি!! আরো আশ্চর্যের বিষয় হল, জনসংখ্যা এবং আয়তন উভয় দিকেই পৃথিবীর দ্বিতীয় (মোট জনসংখ্যার ১৬.৩৬% আফ্রিকা মহাদেশ হতে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে কোনো স্থায়ী সদস্য নেই!!
এতো গেল ভৌগলিক ভাবে জনসংখ্যার পরিসংখ্যানে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যের অবস্থা। এবার দেখা যাক ধর্মিও পরিসংখ্যান অনুযায়ী নিরাপত্তা পরিষদে স্থায়ী সদস্যের অবস্থান! জনসংখ্যায় পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তর ধর্ম 'ইসলাম' হতে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে কোনো স্থায়ী সদস্য নেই! নেই তৃতীয় বৃহত্তর ধর্ম 'হিন্দু' ধর্ম হতেও কোনো স্থায়ী সদস্য! পাঁচটি সদস্য রাষ্ট্রের চারটি'ই খৃস্টান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ। অর্থাৎ ঘুরেফিরে, জাতিসংঘ বলতে ঐ ইউরোপিয়ানরাই (খৃস্টান সহ সকল ধর্মের সাধারণ মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি)
স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে, শান্তি প্রতিষ্ঠার মুলা ঝুলিয়ে পঁচাত্তর বছর আগে জাতিসংঘ নামের যে সংগঠনটি তৈরি করা হয়েছে, তা মূলত সমগ্র বিশ্বে ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিজয়ী শক্তির একটি অপকৌশল ব্যতিত অন্য কিছুই নয়। পশ্চিমা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থে দেশে দেশে সংকট সৃষ্টি হবে, এবং তাদের যতদিন দরকার ততোদিন জিইয়ে থাকবে। আবার এই পশ্চিমারাই তাদের হাতে সৃষ্ট জাতিসংঘের খোলসে শরণার্থীদের খাওয়া-পরার ব্যবস্থার করিয়ে নিজেদের জাতিসংঘ নামক খোলসটাকে পৃথিবীর ত্রাণকর্তা হিসেবে তুলে ধরবে। এতে করে সাধারণ বিশ্ব জাতিসংঘের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করবে, আর ধূর্ত পশ্চিমারা জাতিসংঘকে ব্যাবহার করে নির্বিঘ্নে তাদের মানব শোষণকারী সকল এজেন্ডা বাস্তবায়ন করিয়ে নেবে। অর্থাৎ এরাই শরণার্থী সৃষ্টি করাবে, আবার এরাই তাদের অন্ন বস্ত্রের ব্যবস্থা করবে। মাঝখানে জাতিসংঘ নামক ইউরোপিয় খোলসটা মহৎ হবে, এবং এই খোলস পরে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত হতে পশ্চিমারা সহজেই নিজেদের স্বার্থ আদায় করে নেবে।
এজন্যই, জাতিসংঘ রোহিঙ্গাদের অন্ন-বস্ত্র দেয়, কিন্তু বছরের পর বছর পার হয়ে যায় মিয়ানমারে শক্তি প্রয়োগ করে রোহিঙ্গাদের নিজ ভূমিতে ফেরৎ যাওয়ার ব্যাবস্থা করে না, কেবল তর্ক-বিতর্ক নিন্দা আর আলোচনার মধ্যেই ঝুলিয়ে রাখে রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন। কারণ এখানে পঞ্চ মোড়লের একজন, চীনের স্বার্থ জড়িত।
এজন্যই, কাশ্মীরের স্বাধীনতা বিষয়ে গণভোটের রেজ্যুলেশন পাশ হয়, কিন্তু ৭০ বছর পেরিয়ে গেলেও জাতিসংঘ শক্ত কোনো ব্যবস্থা নিয়ে তা বাস্তবায়ন করায় না। কারণ এ সমস্যার সৃষ্টি করে গেছে পঞ্চ মোড়লের একজন, ব্রিটিশ। তাদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে ভারত উপমহাদের ১৮০ কোটি মানুষ তথা পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার ২২.৭০% মানুষের মধ্যে হানাহানিটা খুবই জরুরী ছিলো। এক্ষেত্রে বহুকাল ধরে চলে আসা ধর্মিও সম্প্রিতির মানুষগুলোর মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার বিষ ঢেলে হানাহানি টিকিয়ে রাখাটা সহজ ছিলো। ব্রিটেন তো দূরের কথা সমগ্র ইউরোপ মহাদেশের জনসংখ্যা বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্থানের সম্মিলিত জনসংখ্যার অর্ধেকও নয়। সুতরাং বিপুল জনসংখ্যার ভারত উপমহাদেশে বুদ্ধিবৃত্তিক ঐক্যবদ্ধ একটি জাতি মাথাচাড়া দিয়ে উঠলে তারাই একটা সময় বিশ্ব মোড়ল হতে পারে। মনে রাখা দরকার, ইউরোপিয়ানরা ১০০ বছর আগেই ভবিষ্যৎ ১০০ বছরের পরিকল্পনা করে। ভারতীয়রা যদি বুঝতো তবে অনেক আগেই কাশ্মীরকে স্বাধীনতা দিয়ে দিতো। কারণ, কাশ্মীরকে দখলে রাখতে গিয়ে সেনাবাহিনী এবং অস্ত্রসস্ত্রের পেছনে বাজেটের বিশাল একটা অংশ ব্যয় করতে হয়। এর প্রভাব যে জনগণের উপরেই পরে, ভারতের জণগনও সেটা বোঝে না। ভারত তার জণগনের খাদ্যের মজুদ নিশ্চিত না করলেও কাশ্মীর দখলে রাখতে অস্ত্রের মজুদ কিন্তু ঠিকই নিশ্চত করে।
মধ্যপ্রাচ্যকে অশান্ত রাখার উদ্দেশ্যে জাতিসংঘের খোলসে ইসরাইল নামক বিষফোঁড়ার বৈধতা দানকারী ইউরোপিয়ানরা রোহিঙ্গা কিংবা কাশ্মীরর সমস্যার সমাধান না করলেও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ৯০% খৃষ্টান অধ্যাসিত 'পূর্বতীমুর' নামের রাষ্ট্রটি ঠিকই স্বাধীন করে দিয়েছে।
বসনিয় মুসলমানদেন নিরস্ত্র করার ক্ষেত্রে প্রস্তাব পাশ এবং তা বাস্তবায়ন করলেও, নিরস্ত্র করার পর যুগোশ্লাভ সেনাদের মদদে সার্বদের হাতে বসনিয় মুসলমানদের গণহত্যা হতে বাঁচাতে শুধু প্রস্তাব পাশ পর্যন্তই শেষ, সেটা বাস্তায়ন করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপে বৃহত্তর গণহত্যা হতে বসনিয় মুসলমানদের রক্ষা করেনি।
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওযার পর রুশ দুঃশাসন থেকে মুক্তি পেতে গণভোটে মুসলিম অধ্যাসিত চেচনিয়ার স্বাধীনতার পক্ষে রায় আসে। জাতিসংঘ সে রায় কার্যকরে ব্যবস্থা গ্রহণ না করলেও খৃষ্টান অধ্যাসিত দক্ষিণ সুদানের গণভোটের রায় কয়েক মাসের মধ্যই কার্যকর করে দেয়।
ষড়যন্ত্র করে মিথ্যা অভিযোগ এনে ইরাকের বিরুদ্ধে প্রস্তাব পাশ হয় এবং শক্তি প্রয়োগ করে তা কার্যকরও করা হয়। নাটক সাজিয়ে আলকায়দার বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করে আফগানের বিরুদ্ধে সামরিক ব্যাবস্থা নেয়া হয়। ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির বিরুদ্ধে প্রস্তাব পাশ এবং তা কার্যকর হয়। কিন্তু শত শত ক্রাইম রিপোর্ট থাকা সত্তেও অবৈধ মোসাদি রাষ্ট্র ইসরাইলের বিরুদ্ধে প্রস্তাবই পাশ করা হয় না।
এই হচ্ছে জনসংখ্যা, ধর্ম ও ভৌগলিক ভাবে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী রাষ্ট্র সিলেকশনের চিত্র এবং জাতি,ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে জাতিসংঘের শান্তি রক্ষার নমুনা! পরবর্তী পর্বে, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী পাঁচ সদস্য রাষ্ট্রের চরিত্র তুলে ধরা হবে।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জুন, ২০২১ সকাল ১১:৪৮