যুদ্ধের ভয়াবহতা থেকে রক্ষা এবং আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা বজায় রেখে সকল প্রকার আগ্রাসন হতে বিশ্ববাসীকে মুক্তি দেয়ার মহান ব্রত নিয়ে ১৯৪৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের সানফ্রান্সিসকোতে জন্ম নেয় জাতিসংঘ নামক আন্তর্জাতিক সংস্থা। ন্যায়বিচার, মানবাধিকার রক্ষা,পরস্পর ভ্রতৃত্ববোধ এবং ভাষা, লিঙ্গ, জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যে জাতিসংঘের সৃষ্টি হয়েছিল তার সাফল্য ব্যর্থতার হিসাব এখানে মেলাতে চাচ্ছি না, বা মেলাবার প্রয়োজন বোধ করছি না। বরং যারা এর জন্ম দিয়েছে তারা কি আসলেই উপরোক্ত মহান উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত করেছে? নাকি মুলা ঝুলিয়ে পর্দার আড়ালে নিজেদের শাসন শোষণের পথ পরিষ্কার করতে সংস্থাটি জন্ম দিয়েছে সেটাই পরিষ্কার করতে চাই।
একটা দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় কোনটি জানেন? প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। হয়তো ভাবছেন জাতিসংঘ নিয়ে আলাপ করতে এসে প্রতিরক্ষা মন্ত্রনালয়ের কথা কেন বলছি, সে প্রশ্নের উত্তর এখনই পেয়ে যাবেন। বাংলাদেশের সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, ডিজিএফআই, এ সবই প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ। বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী কে জানেন? প্রধানমন্ত্রী নিজেই প্রতিরক্ষা মন্ত্রী। বুঝতেই পারছেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় কতটা গুরুত্বপূর্ণ এবং শক্তিশালী মন্ত্রণালয়।
জাতিসংঘের কোনো মন্ত্রণালয় নেই, শুধুমাত্র বোঝার সুবিধার্থে যদি বলি, জাতিসংঘের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় কোনটি? উত্তর হবে, Security Council বা নিরাপত্তা পরিষদ। সৃষ্টিকর্তাই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। তারপরেও পৃথিবীতে যার কাছে অস্ত্র আছে তাকেই বলা হয় ক্ষমতাবান, আর যে অস্ত্র দিয়ে মানুষ হত্যার আইনগত বৈধতা পেয়েছে সে তো আরো ক্ষমতাবান । জাতিসংঘের পক্ষে বিশ্বে শান্তি রক্ষার্থে কোনো দেশ বা গোষ্ঠির বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ নেয়ার ক্ষমতা এবং তা বাস্তবায়নের দায়িত্ব অর্থাৎ অস্ত্র ব্যবহারের আইনগত বৈধতা নিরাপত্তা পরিষদের। সাধারণ পরিষদে সংখ্যাধিখ্যতা থাকতে পারে, কিন্তু সামরিক ক্ষমতা নিরাপত্তা পরিষদের হাতে। সামরিক ক্ষমতার সাথে জাতিসংঘ সনদের পঞ্চম অধ্যায়ের ৩২ নং অনুচ্ছেদে নিরাপত্তা পরিষদকে নিজের মতো করে চলার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। সপ্তম অধ্যায়ের ৪১ নং অনুচ্ছেদে বিভিন্ন ধরনের অবরোধ আরোপ এবং ৪২ নং অনুচ্ছেদে সামরিক অভিযান চালানোর ক্ষমতাও নিরাপত্তা পরিষদকে দেয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে নিরাপত্তা পরিষদের ক্ষমতা সম্পর্কে নিশ্চই বুঝতে পারছেন। চলুন তাহলে জাতিসংঘের সবচেয়ে ক্ষমতাবান সংস্থা 'নিরাপত্তা পরিষদ' সম্পর্কে আরো দুএকটা বিষয় লক্ষ্য করা যাক।
জাতিসংঘ সনদ বা ইউএন চার্টারে ৫ম অধ্যায়ে অনুচ্ছেদ ২৩ হতে ৩২ পর্যন্ত নিরাপত্তা পরিষদের ব্যাপারে বলা হয়েছে। নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য সংখ্যা এবং কারা সদস্য হবে সে সম্পর্কে অনুচ্ছেদ ২৩ এর ১-এ বলা হয়েছে। অনুচ্ছেদ ২৩ এর ২-এ নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্যদের মেয়াদ সম্পর্কে বলা হয়েছে এবং ২৩ এর ৩-এ সদস্যদের ভোটিং ক্ষমতা উল্লেখ করা হয়েছে।
অনুচ্ছেদ ২৩ এর ১,২,৩-এ যা আছে তা যদি সহজ ভাষায় বলি--
নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য রাষ্ট্র পনেরোটি। এরমধ্যে পাঁচটি স্থায়ী সদস্য (আমেরিকা, রাশিয়া, চীন, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স)। খাঁটি বাংলায় বললে এরা পাঁচজনই গায়ের জোরে সিলেক্টেড। বাকি দশ সদস্য দুই বছর মেয়াদে গণতান্ত্রিক উপায়ে ভোটাভোটির মাধ্যমে নির্বাচিত হবে। এভাবে ৫+১০=১৫ সদস্য নিয়ে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ গঠিত হবে।
আগেই বলেছি বিশ্ব শান্তি রক্ষার্থে কোনো দেশ বা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অবরোধ আরোপ ও সামরিক পদক্ষেপ নেয়া এবং তা বাস্তবায়নের ক্ষমতা নিরাপত্তা পরিষদের হাতে।
এবার ৫ম অধ্যায়ে অনুচ্ছেদ ২৭ এর ২ এবং ৩ দেখা যাক--
অনুচ্ছেদ ২৭এর ২ এবং ৩-এ যা বলা হয়েছে খাঁটি বাংলায় তা হল, নিরাপত্তা পরিষদে প্রস্তাব পাশ কিংবা কোনো দেশ বা সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সামরিক ব্যাবস্থা নিতে হলে পনেরোটি সদস্যে রাষ্ট্রের মধ্যে নয়টি রাষ্ট্রের 'হ্যা' ভোট লাগবে। এই নয়টি 'হ্যা' ভোটের মধ্যে পাঁচ স্থায়ী সদস্য রাষ্ট্রের 'হ্যা' ভোট অবশ্যক। সাথে গণতান্ত্রিক ভাবে বিশ্বের সকল মানুষের ভোটে নির্বাচিত দশ সদস্য রাষ্ট্র হতে যেকোন চারটি 'হ্যা' ভোট হলেই প্রস্তাব পাশ হবে।
ভেঙ্গে বললে, অনুচ্ছেদ ২৭ এর ২ অনুযায়ী নিরাপত্তা পরিষদে প্রস্তাব পাশ হতে পনেরোটি রাষ্ট্রের নয়টির 'হ্যা' ভোট লাগবে। কিন্তু কলমের প্যাঁচ হচ্ছে অনুচ্ছেদ ২৭ এর ৩-এ। সেখানে যেহেতু নয়টি 'হ্যা' ভোটের মধ্যে স্থায়ী পাঁচ সদস্যের 'হ্যা' ভোটের অবশ্যকতার কথা বলা হয়েছে। সুতরাং পাঁচ স্থায়ী সদস্যের (আমেরিকা, রাশিয়া, চীন, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স) একজনও যদি 'না' ভোট দেয় তবে প্রস্তাব পাশ হবে না।
ধরুন কোনো প্রস্তাবে নিরাপত্তা পরিষদের পনেরোটি রাষ্ট্রের চোদ্দটি'ই 'হ্যা' ভোট দিলো, কিন্তু 'না' ভোট দেয়া একমাত্র রাষ্ট্রটি পাঁচ স্থায়ী সদস্যের একজন, তবে চোদ্দজন 'হ্যা' ভোট দিলেও ঐ প্রস্তাব পাশ হবে না!!!
মজার বিষয় হচ্ছে, ৫ম অধ্যায়ে অনুচ্ছেদ ২৩ এর ১-এ পাঁচটি রাষ্ট্রেকে স্থায়ী সদস্য পদ দেয়া এবং অনুচ্ছেদ ২৭ এর ৩-এ তাদের ভোটের একক গুরুত্ব প্রদানের মাধ্যমে জাতিসংঘ নিজেই তার গঠনতন্ত্রের প্রথম অধ্যায়ের অনুচ্ছেদ ২ এর ১ ভঙ্গ করেছে। কারণ প্রথম অধ্যায়ের অনুচ্ছেদ ২ এর ১-এ প্রত্যেক সদস্য রাষ্ট্রের সমান মর্যাদা দেয়া হয়েছে। কিন্তু অনুচ্ছেদ ২৩ এর ১ এবং অনুচ্ছেদ ২৭ এর ৩, অর্থাৎ পাঁচ রাষ্ট্রকে স্থায়ী সদস্যপদ প্রদান এবং তাদের ভোটের বিশেষ মর্যাদা কি প্রত্যেক রাষ্ট্রের সম অধিকার বা মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করে না???
এই হচ্ছে জাতিসংঘের গণতন্ত্র। পৃথিবীর সকল রাষ্ট্রের ভোটে নির্বাচিত দশটি রাষ্ট্রের ছয়টিও যদি 'না' বলে তাও প্রস্তাব পাশ হবে, কিন্তু বিনা ভোটে সিলেক্টেড পাঁচটি রাষ্ট্রের একটি রাষ্ট্রও যদি 'না' বলে তবে প্রস্তাব পাশ হবে না। অর্থাৎ সারা বিশ্বও যদি চায়, কিন্তু আমেরিকা একাই যদি বলে 'না', তাহলে জাতিসংঘে 'না'ই জয়যুক্ত হবে।
এর ফলে কি হয়েছে জানেন? এ পর্যন্ত বহুবার সন্ত্রাসী ইসরাইলের বিরুদ্ধে ব্যাবস্থা নিতে জাতিসংঘে প্রস্তাব উঠেছে, প্রতিবারই আমেরিকা ভেটো দিয়েছে। নিরাপত্তা পরিষদ এবং সাধারণ পরিষদ সবখানেই আমেরিকা নিজ সন্তানের মতো অবৈধ ইসরাইলকে রক্ষা করে এসেছে। পঁঞ্চ মোড়ল তাদের ইচ্ছেমত অযৌক্তিক এবং অগণতান্ত্রিক ভাবে জাতিসংঘের গঠনতন্ত্র তৈরি করে ক্ষমতার লাগাম নিজেদের হাতে রেখেছে। তাই আমেরিকার মতো খুনি রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় ইসরাইলের মতো সন্ত্রাসী রাষ্ট্র প্রতিবারই পার পেয়ে যায়।
আমেরিকাকে খুনি বললাম কারণ, ইসরাইল তো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই উচ্ছেদের মাধ্যমে ফিলিস্তিনের ভূমি দখল করছে, কিন্তু আজকের সভ্য মানুষের মুখোশধারী আমেরিকানরা মূল আমেরিকান অধিবাসী অর্থাৎ 'রেড ইন্ডিয়ানদের' হত্যা করে আমেরিকা দখল করছে। স্পেনের রানি ইসাবেলার অর্থায়নে পর্তুগীজ নাবিক কলোম্বাসের আমেরিকার সন্ধান লাভের পর থেকেই ইউরোপিয়ানরা গিয়ে গিয়ে সেখানকার অধিবাসীদের হত্যা করে আমেরিকার দখল নেয়। শুধু যে তলোয়ার বা আর্টিলারি দিয়ে হত্যা করেছে তা নয়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সংক্রামক রোগ ছড়িয়ে মূল আমেরিকান অর্থাৎ রেড ইন্ডিয়ানদের হত্যা করা হয়। সেই হত্যাকারি ইউরোপিয়ানরাই আজেকের সভ্য আমেরিকান। কলোম্বাস নিজেও ছিলেন এই খুনি দলের অধিনায়ক।
পরবর্তী পর্বে জনসংখ্যা, ধর্ম ও ভৌগলিক ভাবে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী রাষ্ট্র সিলেকশন কতটা অযৌক্তিক এবং অগণতান্ত্রিক সেটা তুলে ধববো। সাথে থাকবে শান্তি রক্ষার কিছু নমুনা।
ইউএন চার্টার বা গঠনতন্ত এখানে ক্লিক করে দেখে নিতে পারেন
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা জুন, ২০২১ সন্ধ্যা ৭:৫০