কলেজের পাঠ চুকিয়ে অতি আকাঙ্খার পর ঢাকায় গিয়ে উঠলাম।এর আগে কখনো ঢাকা যাইনি।ঢাকা শহরের অচেনা অজানা পরিবেশে সবেমাত্র প্রবেশ করলাম।ছোট ভাই আমাকে আগেই বলে দিয়েছে যে -ঢাকার জীবনযাপন কঠিন,সাবধানে চলতে হবে।
কথাটা শুনে আমি মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকলাম যেন যত কঠিনই হোক মানিয়ে নিতে পারি। সিট নিয়েছিলাম দুইজনের রুমে। রুমমেট আসল অনেক দেরীতে তাই অনেকদিন আমাকে একাই থাকতে হয়েছিল।রুমে একা থাকার কারণে পাশের রুমের বড় আপুরা প্রায়ই আমার রুমে এসে গল্প করত।ফোনে চার্জ দিত।ফোনালাপ করত।আমি সহজভাবেই নিতাম। অন্যরুমে আমার সমবয়সী দুজন থাকত।ওরাও কোচিং করত।মাইলস্টোন কলেজ থেকে পড়েছে।ততদিনে আমার সাথে ভাব হয়ে যায় ওদের।একদিন চুপিচুপি ডেকে নিয়ে আমাকে বলল,"তোমার রুমে যে আপুরা আসা যাওয়া করে উনারা ভালো না।"প্রস্টিটিউটের" কাজ করেন।তুমি আসতে দিও না।"
আমি বললাম,"ঠিক আছে।"
আমি চক্ষে কিছু দেখলাম না।বই পুস্তকে পত্রিকায় "প্রস্টিটিউট" শব্দটা পড়েছি।কিন্তু স্বচক্ষে জলজ্যান্ত এই প্রথম দেখলাম।এরপর থেকেই উনাদেরকে অন্য নজরে দেখতে লাগলাম যেন ভিন গ্রহের প্রানী।
দুইজন আপু আমার রুমে বেশি যাতায়াত করত।ডলি আর রিক্তা আপু।উনাদের বাস্তবের নামগুলো অনেক সুন্দর।লিখতে পারছি না বলে দুঃখবোধ হচ্ছে।রিক্তা আপুকে দেখে খুব বেশি খটকা লাগত না।উনি অবশ্য বিয়ে করে ফেলেছেন ততদিনে।কিন্তু ডলি আপুকে দেখে প্রথম থেকেই খটকা লাগত।কেমন চেহারা,কেমন চাহনি! আর হাঁটার সময় বুকের দুলনি ছিল সমুদ্রের ঢেউয়ের মত।কেন এভাবে হাঁটত কে জানে!!
ডলি আপু আমার রুমে এসে ফোনে কথা বলত প্রায়ই।উনার রুমে অনেকজন থাকেন তাই কথা বলতে সমস্যা হত।আর উনি কথা বলেন হাসব্যান্ডের সাথে।আমাকে এভাবেই বললেন।মাঝে মাঝে খুব অশ্লীল ভাষা ব্যবহার করতেন।কিছু মনে করেও করতাম না।
ওই কথা শুনার পর একদিন ভদ্রভাবে বলে দিলাম যে আপনি ফোনে কথা বললে আমার সমস্যা হয়।তারপর থেকে উনি আর আসেননি।দুঃখ পেয়েছিলেন হয়ত।
ডলি আপুর রুমে দোতলা বেড ছিলো।ভাড়া কম দোতলা বেডের।হোস্টেলে কম টাকায় থাকার জন্য চাকুরীজীবী মহিলাগণ দোতলা বেডে থাকেন।তবে আমার কাছে খুব সৌখিন মনে হত দোতলা বেড।সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে বিছানায় উঠব আবার সিঁড়ি বেয়ে নামব।ভাবতেই কেমন যেন রোমাঞ্চকর লাগে!
বিলি(ছদ্মনাম) আপু নামে একজন ডলি আপুদের রুমে থাকত।দোতলা বেডে।গার্মেন্টেস্ এ চাকুরী করতেন।উনার সাথে খাতির জমে অনেক পড়ে।মেসেজ পাঠানোর কাজে আপু আমার কাছে আসতেন।উনি মেসেজ লিখতে পারতেন না।প্রথমদিকে সম্পর্কটা ছিল ফরমাল।এসে শুধু বলতেন আমাকে একটা মেসেজ লিখে দাও।উনি বলতেন মুখে আর আমি লিখতাম।তারপর চলে যেতেন।
জীবনের চাপে পিষ্ট হয়ে অস্থি চর্মসার নিয়ে কোনরকম বেচেঁ ছিলেন।সর্বাঙ্গে যার ছিল অসৌন্দর্যের ছাঁয়া যেন মহাকালের মায়া ছেড়ে অন্তর্গমন করলেই বেচেঁ যান।ক্লান্ত পরিশ্রান্ত এক পথিক যে জীবনের কাছে দায়বদ্ধ হয়ে বেচেঁ আছেন।
এখন এই মুহূর্তে এই দুঃখবতী আপুটার ক্লান্ত চেহারার অবয়ব চোখের সামনে ভাসছে আর আমার মনেও বিষাদরেখা ছেঁয়ে যাচ্ছে।
এভাবেই মেসেজ লেখালেখি করতে করতে এক সময় উনার সাথে ভালরকম বন্ধুত্ব হয়ে যায়।এখন এসে গল্পও করেন।গার্মেন্টস্ থেকে এসেই ফ্রেশ হয়ে আমার রুমে চলে আসতেন।মন খুলে কথা বলতেন।সুখ দুঃখের গল্প।এ যেন ফুরায় না!
একদিন কিছু ছবি এনে আমাকে দেখালেন।ছবিতে দেখলাম এক রুপসী তরুণীকে।আমি খুব প্রশংসা করলাম ছবিগুলোর।
এক পর্যায়ে আপু বললেন যে এই ছবিতে যে অগ্নীঝড়া সুন্দরী তরুণীকে দেখলাম সে আর কেউ নন।উনি নিজেই!!
আমি থ হয়ে রইলাম।এ কিভাবে সম্ভব! এমন সুন্দর মানুষ কিভাবে এত অসুন্দর হতে পারে!!
তারপর উনার সাথে ঘটে যাওয়া হ্দয়বিদারক একটি ঘটনা আমাকে বলতে লাগলেন.....
"আমি গার্মেন্টসে এসে জয়েন করি ছোট এক পদে।তখন মাত্র গ্রাম থেকে আসলাম।কিছু বুঝি না জানি না।একদম অবুঝ ছিলাম।আমার সুপারভাইজর ছিলেন সজীব ভাই।উনি একটু বেশিই আমার কাছে ঘেঁষতেন।আমারও খারাপ লাগত না।এভাবেই অনেকদিন কেটে যায়।এক পর্যায়ে উনি আমাকে প্রপোজ করেন।
কেমন যেনো লাগছিল সেদিন।ফেরাতে পারলাম না উনাকে।তারপর শুরু হলো আমাদের নতুন পথচলা।একসাথে সবকিছু করতাম।গার্মেন্টেসে আসা যাওয়া করতাম।সজীবকে ভালো ভালো গিফট দিতাম।সেও আমাকে দিত।আমার বেতনের অনেকটা অংশ ওর জন্য খরচ করে দিতাম।বাড়িতে তেমন পাঠানো লাগত না।সজীবও আমার জন্য অনেক খরচ করত।এভাবেই চলতে লাগল।সবকিছু ভালই চলছিল।আমি দিন দিন আরও রুপবতী হয়ে উঠছিলাম।
সম্পর্ক গভীর হলো অনেক ততদিন।সজীব আমাকে একটা বাসা ভাড়া করে দিল সাবলেটে।বাসা ভাড়াসহ অন্য আনুসাঙ্গিক খরচ ও দিত।আমি একাই থাকতাম বাসায়।সজীব আসত বিকেলে।রাতে চলে যেত।আমি ভাল ভাল রান্না করতাম।সে তুষ্ট হয়ে খেত।আমি চেয়ে চেয়ে দেখতাম যেন দেবতা তুষ্ট করলাম।
এভাবে চলতে লাগল।বাসার আন্টির পরিবারের সাথেও আমাদের খুব ভালো সম্পর্ক হয়ে গেল।সজীব আসলে আন্টির ছেলেদের সাথে অনেক গল্প করত।আন্টি সব সময় দুষ্টুমি করে বলত তোরা বিয়ে করবি কবে।বিয়েটা এই বাসাতেই করবি।আন্টি আমাদের খুব স্নেহ করতেন।
একদিন বিকেলে বাসায় আসতে আমার দেরী হলো।এসে দেখি সজীব গল্প করছে আন্টির এক ছেলের সাথে।আমি আসতেই সজীব তেমন কথা না বলে চলে গেল।এক প্রকার এড়িয়ে চলে গেল আমাকে।আমি কিছু বুঝে উঠলাম না।
--
------
---------
তারপর আমি ওকে ফোন দিলাম ধরল না।একবার দুবার তিনবার অনেকবার ফোন দিলাম ধরল না।
গার্মেন্টেসে গিয়ে ওর সাথে কথা বলার চেষ্টা করলাম।সে আমার সাথে কথাও বলল না।
সেদিনের পর থেকে আজকে ছয় সাত মাস হলো সজীব আমার সাথে ঠিকভাবে কোন কথা বলে না।কেন সে এমন করছে কিছুই বলে না।"
আপু বলছে আর আমি চোখের সামনে ঘটনাগুলো দেখতে পাচ্ছিলাম।মানুষ এত রহস্যময় আচরণ কেনো করে!
--তুমি জানো সে এখন অন্য এক মেয়ের সাথে ঘুড়ে বেড়ায়।আমার গিফট করা ঘড়ি আর শার্ট এখনো পড়ে।শুধু আমার সাথেই কথা বলে না।
আমি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললাম।
--সজীবের এই রহস্যময় আচরণে কত যে কষ্ট পেয়েছি আর কত ট্রাক চোখের পানি ফেলেছি তা শুধু ওই বাসার আন্টি বলতে পারবে।
আমি শুধু অনুভব করে নিলাম।
বললাম,"আপনি তাহলে অন্য কোন গার্মেন্টেসে চলে যান?"
--নাহ!আমি যতদিন বেঁচে থাকি এখানেই থাকব।শুধু ওকে এক পলক দেখার জন্য।
কিছু বলার ভাষা ছিল না আমার।শুধু স্থিরদৃষ্টিতে আপুর দিকে তাকিয়ে ছিলাম কিছুক্ষণ।
এভাবেও কেউ ভালবাসতে পারে!যার বেঁচে থাকার অন্য কোন প্রয়োজন নেই।নেই কোন পিছুটান!
আপুর এই কথাটা মনে গেঁথে গিয়েছিল।এখনো স্মরনে আছে।হয়ত ভবিষ্যতেও থাকবে।
আরেকদিন গভীর রাতে আপু দৌড়ে আসলেন।তাড়াহুড়া করে বললেন আমাকে একটে মেসেজ লিখে দাও।ঘুম আসছে না।
তারপর উনার মোবাইলটা নিয়ে লিখলাম,"
"তুমিহীনা আমার হ্দয় হলো জলন্ত চুল্লী।তোমার কন্ঠস্বর বৃষ্টির মত।বৃষ্টির প্রবাহধারা চুল্লীর সংস্পর্শে আসতেই সমস্ত অগ্নীকুন্ড
নিমেষেই নিষ্প্রভ হয়ে যায়।"
----
আমি হয়ত ঢাকাতে বেশিদিন থাকব না তাই বিলি আপু বলেছিলেন ,"তুমি পরে কখনো ঢাকায় আসলে আমার সাথে যোগাযোগ করো।"
আমি এতই পাষাণ কুমিল্লা এসে অন্য ফোন নম্বর নিলাম।উনার সাথে আর কখনো যোগাযোগ করিনি।আমার পুরোনো ডায়েরিতে উনার ফোন নম্বর লেখা ছিল।কয়েকদিন আগে সেই নম্বরে কল দিতে গেলাম।সংযোগ বন্ধ পেলাম।
না হোক তথাকথিত যোগাযোগ।আপুর সাথে মনের যে সংযোগ তা বিচ্ছিন্ন হবার নয়।আমি আপনাকে স্মরণ করি আপনার দুঃখের জন্য নয়,আপনার ব্যক্তিত্বের জন্য।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই জুন, ২০১৮ রাত ১০:৪০