কোরআনিক ব্যাখ্যায় দয়াদর্শন
সুরা বাকারা, আয়াত : ৩ /৩
وَيُقِيمُونَ الصَّلاةَ
প্রসঙ্গ : ইকামতে সালাত
পবিত্র কোরআনে ‘ইউমিনুনা বিল গায়েব’ এর পরই বলা হয়েছে ‘ইউকিমুনাস সালাত’, অর্থাৎ সালাত কায়েম করো। আরবী ভাষায় ‘সালাত’ অর্থ : দোয়া, রহমত, ক্ষমা প্রার্থনা ইত্যাদি। সাইয়্যেদ মুফতি মুহাম্মদ আমীমুল ইহসান (র.) প্রমূখদের মতে, নির্দিষ্ট রুকন এবং যিক্র সমূহ বিশেষ পদ্ধতিতে নির্ধারিত সময়ে আদায় করাকে সালাত বলে। (কাওয়াইদুল ফিকহ, পৃ. ৩৫১)। ইমাম আবু জাফর মুহাম্মদ ইবনে জরীর তাবারী (র.) ফরয সালাতকে সালাত নামকরণের কারণ বলেছেন, যেহেতু মুসল্লি তার আমল দিয়ে আল্লাহর পুরস্কার ও সোয়াব আশা করে এবং তার প্রতিপালকের প্রয়োজনীয় সাহায্য সহানুভূতি প্রার্থনা করে। (তাফসীরে তাবারী)। কাযি ছানাউল্লাহ পনিপথির মতও এরকম, তিনি বলেন; ‘যেহেতু সালাতে দোয়া শামিল আছে তাই তাকে সালাত বলা হয়।’ (তাফসীরে মাযহারী)। সালাতের ফার্সী, উর্দু এবং বাংলা করা হয়েছে নামায। নামায অর্থ : উপাসনা বা ইবাদত। আমরা নামায শব্দ ব্যবহার করেই আলোচনা করতো। কারণ আমাদের অঞ্চলের মানুষ এই শব্দের সাথে অধিক পরিচিত এবং এই শব্দ ইসলামের সাথে কোন দিকেই সাংঘর্ষিক নয়। এই আয়াতে আমরা দেখছি নামায পড়ার কথা না বলে প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে। আমরা জানি, পড়া আর প্রতিষ্ঠা করা সমার্থক নয়। এখানে পড়া না বলে প্রতিষ্ঠার কথা কেন বলা হলো? প্রথম কারণ হতে পারে যাতে মানুষ দোয়া আর ফরয নামাযের ব্যবধান বুঝতে পারে। কাযি মুহাম্মদ ছানাউল্লাহ পানিপথী (র.) কারণ বলেছেন, ‘ইউকিমুনা’ অর্থ ‘ইউহাফিজুনা’, অর্থাৎ মুত্তাকি তাঁকে বলা যায় যে সালাতকে পূর্ণ হিফাযত করে। তার সীমা ও শর্তসমূহ পালন করে। আরকান ও বাহ্যিক বৈশিষ্ট্যসমূহ অর্থাৎ সুন্নত ও মুস্তাহাব সমূহ এবং অন্তর্নিহিত বৈশিষ্ট্যসমূহ অর্থাৎ বিনয়-নম্রতা এবং মনোযোগ ও একাগ্রতা সহকারে আদায় করে। (তাফসীরে মাযহারী)। হাকিমুল উম্মাত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (র.) এর মতে নামায প্রতিষ্ঠার অর্থ : সর্বদা সময় ও নিয়মানুবর্তিতার সাথে নামায আদায় করা এবং তার সাথে নামাযের আহকাম, আরকান, তথা বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীন অবশ্য করনীয় কাজ সমূহ পূর্ণভাবে আদায় করে। সুন্নাত, মুস্তাহাব ও আদবসমূহের প্রতি লক্ষ্য রেখে মনোযোগ সহকারে নামায আদায় করে। (তাফসিরে আশরাফি)। মুফতি শফি (র.)ও নামায প্রতিষ্ঠার ব্যাখ্যায় বলেছেন, নামাযের ফরয, ওয়াজিব, সুন্নত, মুস্তাহাব পরিপূর্ণভাবে আদায় করা। (তফসীরে মাআরেফুল কোরআন)। সাইয়েদ কুতুব (র.) ‘নামায প্রতিষ্ঠা কাকে বলে’ সে বিষয়ে সরাসরি কথা না বলে সাধারণভাবে নামাযের আলোচনার মধ্যে বিষয়গুলো নিয়ে এসেছেন। তিনি বলেন, নামাযের মাধ্যমে তারা এক আল্লাহর ইবাদত ও আনুগত্যের প্রকাশ ঘটায়। এ দ্বারা তারা বিভিন্ন বস্তু ও ব্যক্তি পূজার উর্ধ্বে ওঠে আল্লাহর দিকে মুখ ফেরায় এবং আল্লাহর সামনে নত হয়। নামায মুমিনের চিন্তা-চেতনা ও আচরণকে সর্বতোভাবে আল্লাহমূখী করে দেয়। (তাফসিরে ফী যিলালিল কোরআন)।
বিভিন্ন তাফসির গ্রন্থে নামায প্রতিষ্ঠার যে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে সবগুলোর মধ্যে সামান্যতম ভিন্নতার মধ্যে বেশিরভাগেই অভিন্নতাই আমরা দেখতে পাই। বিভিন্ন তাফসির গ্রন্থ পাঠে নামায কায়েমের অর্থ আমার মনে হয়েছে তাদের বক্তব্যের সাথে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে আরো কিছু কথা আমরা আলোচনা করতে পরি। যেমন, ১) ইসলামের আত্মিক এবং দৈহিক দুটি দিক রয়েছে। একজন মানুষের ইসলামের প্রত্যেক বিষয়কে সত্য মনে করে বিশ্বাস স্থাপনটা হলো আত্মিক বিষয়। ইসলাম শুধু আত্মিক বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত নয়, ইসলাম হলো আত্মিক বিষয়ের সাথে দৈহিক ও সামাজিক বিষয়াদির সমন্বয়ে। যে কেউ আত্মিকভাবে ইসলাম গ্রহণের পর তা দৈহিক আমলের মাধ্যমে বহিঃপ্রকাশ করতে হবে। এটাই নিয়ম। হযরত নবী করিম (স.) এর চাচা আবু তালেব জানতেন তাঁর ভাতিজা সত্য, তাই তিনি তাঁর তরুণ ছেলে আলীকে ভাতিজার সাথে দিয়েছেন। কিন্তু নিজে ঈমানের কথা মুখ দিয়ে ঘোষণা করেননি, তাই আর তাকে মুসলমান বলা যাচ্ছে না। কালেমার ঘোষণা অত্যন্ত একান্ত বিষয়। কিন্তু যখন কেউ নামায প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করলো তখন সামাজিকভাবে সবাই জানতে শুরু করলো- এ লোকটি মুসলমান। এ জানানোটা খুবই জরুরী। বিশেষ করে অমুসলিম সমাজে এই জানানোর গুরুত্বই পৃথক। একজন মানুষ নামাযই পড়লো না, সে যে মুসলমান তা অন্যরা বুঝবে কি করে? নিজে যে মুসলমান তা অন্যকে বুঝানোটাও খুব জরুরী। বৃটেনে অনেক মানুষ যারা বংশানুক্রমিকভাবে মুসলমান, আর বিয়ে করেছেন অন্যধর্মাবলম্বী নারী, জীবনে নামাযও পড়েন নি, তাদের মৃত্যুর পর দাফন-কাপনের ক্ষেত্রে তিনি কোন ধর্মের অনুসারী, এই প্রশ্নে সমস্যা হতে আমরা দেখেছি। যদি তিনি নামায আদায় করতেন তবে এই সমস্যা হতো না। বংশানুক্রমিক মুসলমানদের ক্ষেত্রেই যদি এমন হয় তবে যারা হঠাৎ অন্যধর্ম থেকে মুসলমান হয়েছেন তাদের ক্ষেত্রে তো আরো সমস্যা হওয়ার কথা।
২) মসজিদে গিয়ে জামায়াতের মাধ্যমে নামায প্রতিষ্ঠিত হলে একজন মানুষ ইসলামিক সমাজের স্পর্শ লাভ করে। তা দ্বারা এই মানুষের সামাজিক আচরণে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত এবং মুসাল্লিদের পরস্পরের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববন্ধন অটুট হয়।
৩) নামায কায়েম করলে মানুষ বিভিন্ন বিষয়ে, বিশেষ করে সময়, পরিবেশ, পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং স্বাস্থ্য ইত্যাদি বিষয়ে সচেতন হয়ে যায়।
৪) কায়েম বা প্রতিষ্ঠা বলা হয়েছে নিয়মিত করার জন্য। কোন জিনিষ নিয়মিত না হলে তা অভ্যাসে রূপান্তিত হয় না। নামাজের মাধ্যমে ইসলামি সংস্কৃতি মানুষের ব্যক্তিগত জীবন থেকে সামাজিক জীবন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠা লাভ করে। তাই নামায কায়েম বলতে ব্যক্তিগত ও সামাজিক সাধনাকে বুঝায়।
মোটকথা : নামায ঈমানের পরই ইসলামের অত্যন্ত গুরুত্ব একটি বিষয়। ইসলামী আইন সম্মত কারণ ছাড়া নামায বাদ দেওয়া বৈধ নয়। যা বৈধ নয় তা করা পাপের অংশ। সমাজে একদল পোশাকি সুফি আছেন যারা নামায নিয়ে বিভিন্ন বিভ্রান্তিকর বক্তব্য প্রচার করে থাকেন। তারা নামাযকে ওয়াক্তি এবং দায়েমীতে বিভক্ত করে তাদের নামায না পড়াকে বৈধ করার চেষ্টা করেন। তাদের বক্তব্য হলো যারা দায়েমী নামাযের যোগ্যতা অর্জন করেন নি তারা ওয়াক্তি নামায পড়বেন। নতুবা ওয়াক্তি নামায খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় না। তারা এমনও প্রচার করেন যে, যারা দায়মী নামাযি পীরের মুরিদ তাদেরও ওয়াক্তি নামায পড়তে হবে না। মুর্শিদই তড়াইয়া নিবেন সবকিছু। তারা আরো বলেন, মুর্শিদ সামনে থাকলে আর নামায পড়তে হয় না, সামনে না থাকলে মুর্শিদের চেহরা ধ্যান করলেই নামায আদায় হয়ে যাবে। এ থেকে আরও জঘণ্য বক্তব্য চালু আছে ওদের কারো কারো মধ্যে। যেমন কেউ কেউ নিজ মুর্শিদকে সামনে নিয়ে বলেন, কিসের নামাজ, কিসের রোজা, তুমি আল্লাহ, তুমি খোদা। (নাউযুবিল্লাহ)। স্মরণ রাখতে হবে, নামায ছাড়া কাউকে পীর কিংবা মুর্শিদ মানলে অবশ্যই তা ইবলিসের কর্ম হবে। যে-সব পির তাসাউফ বা আধ্যাত্মিকতার নামে নামাযের বিরুদ্ধে বলেন এবং নিজকে চিশতিয়া তরিকার বলে দাবী করেন তারা মূলত হযরত খাজা মুঈনুদ্দিন চিশতী (র.)-এর নামাজ সম্পর্কিত বক্তব্য মূর্খতাজনিত কারণে বুঝতে না পেরে বিভ্রান্ত হয়েছেন। নামাজের হকিকত বর্ণনায় হযরত খাজা মুঈনুদ্দিন চিশতী (র.) লিখেছেন-‘নামাজের হকিকত সম্বন্ধে রাসুল (স.) বলেছেন যে, হুজুরী কাল্ব ব্যতীত নামাজ সিদ্ধ হয় না। হাকিকি নামাজ দ্বারা মুমিন কামেল ও আরেফ-এ-এলাহি স্থায়ি হুজুরী লাভ করতে সমর্থ হয়।’ নামাজ সম্পর্কিত তাঁর বক্তব্যে কোথাও নামাজ পড়তে হবে না বলা হয়নি, বলা হয়েছে হুজুরী কলব ছাড়া নামাজ পড়লে তা রিয়া বা লোক দেখানো হবে। তিনি হুজুরী কালব দিয়ে হযরত নবী করিম (স.)-এর মতো রহমতি কলবে নামাজের কথা বলেছেন। তিনি নামাজকে জাহিরি এবং বাতিনি বলেছেন, তাঁর সময়ের মুসলমানেরা জাহেরি নামাজ বাদ দেওয়ার চিন্তা খুব বেশি করতো না, কিন্তু খুশু-খুজুর সাথে নামাজ অনেকে আদায় করতো না, তখন তিনি খুশু-খুজু বুঝাতে বাতিনি নামাজের উপর গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি যে জিনিষের উপর গুরুত্ব দিয়েছেন, মূর্খরা সে জিনিষকে মূল মনে করে মূল নামাজকেই বাদ দিয়ে ফেলছে। তারা চিশতিয়া তরিকার দাবীদার হয়ে নামাজ ছেড়ে হযরত খাজা মুঈনুদ্দিন চিশতী (র.)-এর মতো একজন আবেদের উপর বে-নাজির তহমত দিচ্ছে তারা নিজেই বুঝতে পারছে না। ওরা এতই মূর্খ, বুঝতে পরে না যে তাওরাত, যবুর, ইঞ্জিলে নামাজের কথা বলা হয়েছে, পবিত্র কোরআনে যেখানে সরাসরি ৮২ বার এবং পরোক্ষভাবে অসংখ্যবার নামাজের (সালাত) কথা বলা হয়েছে, যেখানে নবীদের সরাসরি গুরুত্বপূর্ণ আমাল হলো নামাজ, হযরত নবী করিম (স.) বা তাঁর সাহাবীরা কোনদিন নামাজ বাদ দেননি, হযরত আলী (রা.) থেকে হযরত হাসান- হোসেন (রা.) হয়ে খাজা মুঈনুদ্দিন চিশতী পর্যন্ত তাঁর মা কিংবা বাবার বংশের কেউ কোনদিন নামাজ বাদ দেননি, তিনি নিজেও না। অথচ তারা চিশতিয়া তরিকার দাবী করে নামাজ ছেড়ে দিয়েছে। তারা বলে আমরা শরিয়তি নয়, মারিফতি। মূর্খের দল তাও বুঝে না যে খাজা মুঈনুদ্দিন চিশতী (র.) শরিয়তের নিয়ম-নীতির মধ্যে মারিফত অর্জন করেছেন। তারা অনেকেই তাঁর সম্পর্কে সঠিক ধারণা রাখে না। তারা জানে না যে, কোরআন, হাদিস, শরিয়ত এবং খাজা মুঈনুদ্দিন চিশতীর মূল বক্তব্যে পূর্ণাঙ্গ সামঞ্জস্য রয়েছে। তিনি বলতেন-নামাজ কায়েমের বেলা কোন শর্ত নেই, তা সকলের জন্য সমভাবে পালনিয়। ব্যবধান শুধু হয় কলবে। কেউ নামাজ পড়ে জাহেরি এবং কেউ পড়ে হুজুরী কলবে। (দিওয়ান-ই-মুঈনুদ্দিন)।
হযরত নবী করিম (স.) বলেছেন,
‘বাইনাল আবদি ওয়া বাইনাল কুফরি তারকুস সালাত’
অর্থ : বান্দা ও কুফরের মধ্যে পার্থক্য হলো নামায ত্যাগ করা। (মুসলিম শরিফ)।
এই হাদিস দিয়ে প্রমাণিত হয়, যে বান্দা নামায বাদ দিলো সে কাফির। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (র.) মনে করেন যে নামায বাদ দিবে সে কাফের হয়ে যাবে। ইমাম মালিক ও ইমাম শাফি (র.) মনে করেন যে নামায বাদ দিবে তাকে হত্যা করা উচিৎ। ইমাম আবু হানিফা (র.) বলেন, নামায বাদ দিলে কাফির নয়, বড় পাপিষ্ট হবে। আর যদি কেউ নামাযকে অস্বীকার করে তবে সে কাফের হয়ে যাবে। নামায সম্পর্কি অনেক আয়াত সামনে আসবে, যখন যা আসবে তখন তা ইনশাল্লাহ আলোচনা করা হবে।
(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা জুলাই, ২০১৫ ভোর ৪:৫১