এক
২২ তম ফুটবল বিশ্বকাপের ফাইনাল ম্যাচ রাত ন'টায়। ফুটবল বিশ্বকাপের ৯২ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে ব্যয় বহুল এ আসরে আয়োজক দেশ কাতার যেমন আয়োজনের মাধ্যমে নানা চমক দেখিয়েছেন ঠিক তেমনি ভাবে আজ আর্জেন্টিনা ও ফ্রান্সের মধ্যকার ফাইনাল এ ম্যাচ নিয়েও এদেশের ফুটবল প্রেমিকদের মধ্যে রয়েছে টানটান উত্তেজনা ও অপরিসীম কৌতুহল। ভিনদেশী ফুটবল দলের প্রতি এদেশের মানুষের আবেক অনূভুতি ও ভালোবাসা বিস্ময়কর পর্যায়ে।
ঢাকা থেকে ফিরছি। ফাইনাল খেলা দেখার দাওয়াত পরেছে কলিগ ইলিয়াস সাহেবের বাসায়। অন্তত ফাইনাল খেলা সব কলিগ একত্রে দেখতে ইলিয়াস ভাইয়ের আন্তরিকতা অগ্রাহ্য করাটা অান্তরিকহীন হয়ে যায় বলে ফেরার তাড়া ছিল খুব। নিউমার্কেটে যানজটে খেয়ে নেয় বেশকিছু সময়। পথে গাড়ি হয়ে যায় নষ্ট। অন্য গাড়ি ধরতে লাগে আরও কিছু সময়। এই দেশে কিছুতেই সময় মেপে চলা যায় না। ভেবে রাখি এক। পথে গিয়ে দেখি আরেক। তাই যথেষ্ট সময় নিয়ে বের হই। সড়ক ও কাজের গুরুত্ব বিবেচনায় কখনও কখনও আধা ঘন্টার পথ যেতে দুই ঘন্টারও অধিক সময় নিয়ে বের হই। আজও তাই হয়েছিলাম। কিন্তু তারপরও মনে হচ্ছিল ন'টার মধ্যে ইলিয়াস ভাইয়ের বাসায় গিয়ে টিভি সেটের সামনে বসতে পারবো না।
মুক্তারপুর ব্রীজের এপার ওপার দু'পাড়েই প্রজেক্টে সর্বসাধারণের খেলা দেখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। শত শত মানুষের চিৎকার চেচামেচি!
গাড়ি থেকে নামি। রাস্তা একপ্রকার ফাঁকা। দোকানপাট খোলা তবে তাদের কোনো ব্যস্ততা দেখলাম না। সবাই দোকানের টিভিতে খেলা দেখায় মনোযোগী। পাশের প্রজেক্টের পর্দায় চোখ যেতেই দেখি খেলোয়াড়েরা মাঠে নেমে পড়েছে। জাতীয় সংগীত গাইছে। ইলিয়াস ভাইয়ের বাসা আরও বেশখানিকটা পথ। রাস্তায় যে কজন রিকশাওয়ালা পাই সবাই যাবে না জানায়। কিছুদূর হেঁটে যাওয়ার পর দেখি এক মুরব্বি রিকশা নিয়ে আসছে। ভাড়া মিটিয়ে চড়ে বসি। একটু এগিয়ে যাওয়ার পরেই বলে, আইজকা মেসিই কাপ নিব।
কথা প্রসঙ্গে জানি, রিকশাওয়ালা কাকা আর্জেন্টিনা চেনে না। অন্যকোনো খেলোয়াড়ও চেনে না। শুধু চেনে মেসিকে।
ইলিয়াস ভাইয়ের গিয়ে যখন পৌঁছাই তখন খেলা পনের মিনিট হয়ে গেছে। উত্তেজনার চরম পর্যায়ে আঘাত করে খেলা শেষ হয়। মেসির হাতে ও মেসিদের হাতে ওঠে ২২ তম ফুটবল বিশ্বকাপ ট্রফি।
শুধু রিকশাওয়ালা কাকা এক নয় এদেশের প্রকৃত ফুটবল প্রেমিকদের আকাঙ্খা ছিল বিশ্ব ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় মেসির হাতে এবারের ট্রফি দেখার। আকাঙ্খা পূরণ হয়েছে। এ ট্রফি মেসি নামের একজন ফুটবল শিল্পীর সারাজীবনের সাধনার ফসল। নির্ঘুম স্বপ্ন ও সাফল্যের অনন্য উচ্চতা। ইতিহাসে অমরত্ব।
দুই
গতরাতে সমাপ্তি হয়েছে ২২ তম ফুটবল বিশ্বকাপ। চরম উত্তেজনায় ও উৎকণ্ঠার ফাইনাল ম্যাচে ২১ তম আসরের চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্সকে পরাজিত করে ৩৬ বছর পর বিশ্বক্রীড়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় এ ট্রফি ঘরে তোলে ল্যাটিন আমেরিকার নন্দিত ফুটবল দল আর্জেন্টিনা।
হাটে ঘাটে মাঠে এককথায় চায়ের দোকান থেকে সচিবালয় পর্যন্ত আজ শুধু এ আলোচনা।
অফিসের বাহিরের চায়ের দোকানে গিয়েছি। এক ভদ্রলোক একলাই চায়ের দোকান গরম করে রেখেছে। ভদ্রলোককে আগেও কখনও দেখি নাই। প্রথম দেখায় চোখে চোখ পড়ে। এতেই সে আমাকে উদ্দেশ্য করে বলতে শুরু করে। আপনিই বলেন, তোরা দুইটা গোল দিছোস, সময় আছে মাত্র আষ্ট মিনিট। এগার জনের বাইশটা পা থাকতে ক্যান হাতে বল লাগবো? যে প্লেয়ার পায়ে একটা বল লাগাইতে পারে নাই সে নাম্মাই হাতে লাগায় ফাও ফাও পেনাল্টি করলো। এইডা কি কোনো খেলা হইল?
ভদ্রলোকের কথায় আমি কিছু বলি না। চোখাচোখির পরিচয়ে আলাপ জমাতে ইচ্ছা করলো না। তবে লোকটা বলে যায়, দুইডা গোলের পর আর গোল দিতে যাইতে অইবে ক্যান? তুই লাক টাকার বল পাইলি আমরা কি পাইলাম? ফাও ফাও রাত জাগাইলি। গোল ওই দুইডা থাকলে তো আর রাত জাগন লাগতো না।
ভাবি, একেই হয়তো বলে সাধারণ মানুষের অসাধারণ ভালোবাসা। কোনো স্বার্থ নাই। কোনো ভাবে যোগাযোগ হওয়ার সম্ভাবনা নাই। শুধু ক্রীড়া নৈপুণ্যে মুগ্ধ হয়ে ভালোবাসা। যে ভালোবাসার কোনো কূল কিনারা নাই।
-সোহাগ তানভীর
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২২ সন্ধ্যা ৭:২০