শীতের সকাল। সূর্যটা কয়েক দিন কুয়াশার আড়ালে থেকে আজ হাসিমাখা মুখে বের হয়েছে। পৌষমাসের মৃদু এই সূর্য কিরণ উষ্ণতার পরশ দিয়ে আজ প্রতিটা ঢাকাবাসীর মন-প্রাণে স্বস্থির সঞ্চার করছে। ছুটির দিন হওয়াতে, আজ প্রতিটা মহল্লার প্রতিটা মানুষ নিজ নিজ বাড়ির ছাদে গিয়ে গায়ে মাখছে পৌষমাসের এই মিষ্টি কাঁচা রোদ। মিষ্টি রোদের উষ্ণতা নিতে তাই মিসেস যুবাইদাও ছাদে এসেছেন। মাসুম আর শেফা নামের একটা ছেলে আর মেয়েকে নিয়ে মিসেস যুবাইদার সংসার। তাছাড়া বাড়িতে গোলাপি নামের একটা গৃহকর্মী রয়েছে তাঁর। মাসুম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিস্ট্রি বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। আর শেফা এ বছর সেকেণ্ডারী স্কুল শেষ করে হায়ার সেকেণ্ডারীতে পড়ছে। দু'ভাই বোনের খুনসুটিতে মেতে থাকে মিসেস যুবাইদার ফ্ল্যাট। কিন্তু সকাল বেলা দু'জন ঘুমিয়ে থাকার কারণে মিসেস যুবাইদার এই ছোট্ট ফ্ল্যাটটা একটু শান্ত থাকে। কারণ, দু'জনই সকালে দেড়ি করে ঘুম থেকে ওঠে। ভোরে ঘুম থেকে জাগরত হয়ে ফযর আদায় করে জায়নামাযে বসে কিছু সময় কোরআন তেলওয়াত মিসেস যুবাইদার নিত্য অভ্যাস। তারপর গোলাপীকে সাথে করে নাস্তা তৈরি করেন। কোনোদিন ছেলে-মেয়েকে সাথে করে সকালের নাস্তা করেন। আবার কোনোদিন তারা ঘুম থেকে না উঠলে নিজে একাকি নাস্তা সেরে অফিসে চলে যান। কিন্তু আজ সাপ্তাহিক ছুটির দিন হওয়াতে অফিসে যাওয়ার কোনো তাড়া নেই। নাস্তা তৈরি করে মিসেস যুবাইদা ছাদে গিয়ে এককাপ চা শেষ করে ছেলে আর মেয়েকে ঘুম থেকে জাগানোর জন্য দ্বিতীয় বারের তরে ডাকতে যায় প্রত্যেকের বেডরুমে। শেফার বেডরুমে উকি দিয়ে দ্যাখে ঘুম থেকে ওঠে সে রিডিং টেবিলে বই নিয়ে বসেছে। আর মাসুমের বেডরুমে উকি দিয়ে দ্যাখে ময়দার বস্তার মত শুয়ে মৃদু নাক ডাকিয়ে ঘুমাচ্ছে। রাতে পড়াশোনা করার পর ঘুমাতে গিয়ে ল্যাপটপে ফেসবুকিং মাসুমের নিত্যদিনের অপরিহার্য কাজ হয়ে গেছে বিধায় ঘুমাতে ঘুমাতে প্রায় ভোর হয়ে যায় তার। তাই সকালে দেড়ি করে ঘুম থেকে উঠে সে। তারপর বিকাল সেশোনে ক্লাস হওয়ার কারণে সকালে ঘুম থেকে ওঠার কোনো তাড়া নেই তার।
মিসেস যুবাইদা মাসুমের ঘরে গিয়ে তাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে ছাদে পাঠিয়ে তারপর ক্ষান্ত হয়। ছাদে গিয়ে অবাক হয়ে যায় মাসুম। কি সুন্দর ফুলের বাগান! প্রতিটা টবের প্রতিটা গাছে ফুল ফুটে আছে। সেই ফুলের মিষ্টি ঘ্রাণে চারিদিক মুখরিত। মাসুম ভাবে, নিশ্চয় পেঁচীর কাজ। শেফাকে ক্ষ্যাপাতে মাসুম কুৎসিত পাখির স্ত্রী বাচক নামটা এই পেঁচী নামটা ব্যবহার করে থাকে।
আশপাশের ভবনে কেউ ছাদে কেউ বা আবার বেলকনিতে শীতের এই ফুটন্ত সূর্যের স্নেহমাখা পরশ নিতে বসে আছে। চলতে ফিরতে মহল্লার সেসব লোকদের সাথে মাসুমের রাস্তায় মাঝে মাঝে দেখা হয় তাদের অনেকেই তাদের নিজ নিজ বাড়ির ছাদে এসে বসে আছে। ফ্যামিসহ এসেছে অনেকেই।
এদিকে মাসুমদের ফ্ল্যাটের অদূরে লাল খয়েরী রংয়ের বাড়ির ছাদে এসে একটা বাবু কোলে করে বসে আছে দীবা। দীবাদের থাকার এই বাড়িটির নাম "জোসনা বিলাস"। দীবা ভাইয়া-ভাবীর সাথে প্রায় মাসখানেক হয়েছে জোসনা বিলাসে এসেছে। দীবার ভাইয়া ওয়াসার কর্মকর্তা। বুয়া আজ না আসার কারণে ভাবী রান্না-বান্নায় ব্যস্ত। তাই দীবা তার ছোট্ট ভাইপোকে কোলে করে ছাদে গিয়ে বসে সূর্যের কোমল রোদ্রস্পর্শ সেই ছোট্ট সোনামণির তণুতে মেখে দিচ্ছে। কিছু সময় পর দীবার ভাবি এসে বাবুকে খাওয়ানোর জন্য নিয়ে গেলে দীবা একলাই ছাদে বসে দোলনায় দোল খায় আর মাঝে মাঝে হাঁটাহাঁটি করে। পৌষ শেষের কোমল সূর্য কিরণ দীবার মুখে মায়াবী এক অপূর্ব শ্রী সৃষ্টি করেছে। সবুজ ড্রেসে হালকা রোদে দীবার সেই লাবণ্যময়ী মুখটি গোলাপের মত ফুটে আছে। এমন অপূর্ব পরিবেশে মিষ্টি মেয়ে দীবাকে প্রথম দেখাতেই মাসুমের হৃদয়ের ঊর্বর ভূমিতে ভালোবাসা নামক বৃক্ষ অঙ্কুরিত হয়। এক সময় সেই বৃক্ষে প্রেমের ফুল ফোঁটে। দীবাকে সেই ফুলের পরশ দিতে নিয়মিত ছাদে আসে মাসুম। এদিকে মাসুমের হৃদয়ে ফোঁটা প্রেম নামক ফুলের ঘ্রাণে ব্যাকুল হয়ে দীবাও ঘরে থাকতে পারে না। সকাল দশটা বাজলেই সেও এক অদৃশ্য টানে ছাদে আসে। মাসুমের হাতের ইঙ্গিতে দীবা অনেক কিছু বুঝতে পারে। বুঝতে তার জন্য জমা হওয়া মাসুমের হৃদয়ের না বলা কথা। তবে দীবা মাসুমের হাতের ইশারায় মিষ্টি হাসি দেওয়া ছাড়া হাত নেড়ে প্রতি উত্তর দিতে পারে না। কারণ, দীবার ছাদ থেকে মহল্লার মোড়ের চায়ের দোকান স্পষ্ট দেখা যায়। যে চায়ের দোকানে মহল্লার বখাটে ছেলেরা সারাক্ষণ ক্যারাম খেলার নামে আড্ডা দেয়। সেই বখাটেদের মাঝে অনেকেই আবার দীবাকে পছন্দও করে। তাই দীবাকে এক পলক দেখার জন্য রোজ সকালে নিয়ম করে চায়ের দোকানে আসে অনেকে।
একদিন সকালে, দীবা ছাদে না গিয়ে তাদের বাড়ির সামনে গেটের ওখানে গিয়ে দাড়িয়ে মাসুমদের ছাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার কোলো ছোট্ট ভাইপোটি। মাসুম দীবাকে ওদের গেটের সামনে দেখে, ছাদ থেকে ওর রুমে এসে একটা চিরকুট কাগজে মুঠোফোন নাম্বারটা লিখে সোজা চলে যায় দীবাদের গেটের সামনে। মাসুম দীবার সামনে গিয়ে এক মুহূর্ত না দাড়িয়ে দীবাকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে কাগজটা ফেলে রাস্তা বরাবর সোজা হেঁটে চলে যায়। দাঁড়ালেই চায়ের দোকান থেকে ঐ বখাটেরা দেখে ফেলবে। মাসুম সেই সব কখাটে সম্পর্কে খুব ভালো করেই জানে। যাদের সম্মান নাই তারা সম্মান কি জিনিষ জানে না, তাই সম্মানী ব্যক্তিদের সম্মানহানী করতেও তারা দ্বিধা করে না। দীবা কাজটি তুলবে এমন সময় রাস্তা দিয়ে একটা প্রাইভেট কার যাওয়ার কারণে বাতাসে কাজটি উড়ে গিয়ে ড্রেনে পড়ে। দীবা যে সেই চিরকুটটি নিতে ব্যর্থ হয় সেটা মাসুম চলে যাওয়ার কারণে জানতে পারে না। তাই বাসায় এসে সে দীবার ফোনের অপেক্ষায় প্রহর গুনতে থাকে। তবুও দীবার ফোন আসে না। এদিকে মাসুমের আচরণে অস্বাভাবিক পরিবর্তনের কারণে ক্লাসের বন্ধুরাসহ ছোটবোন শেফা বিভিন্ন রসিকতা করে। মাসুম কাউকে কিছু বলতে পারে না। এমনকি শেফাকেও না। কারণ, শেফাকে কোনো কিছু বলা মানে ফেসবুকে রোমান্টিক কোনো কিছু আপলোড করা।
এদিকে বখাটেদের উত্তাপের কারণে ভাইয়ের আদেশে ছাদে যাওয়া কমিয়ে দেয় দীবা। মাসুম যখন আর নিয়মিত দীবাকে ছাদে পায় না তখন সিধান্ত নেয় যে, সে সরাসরি দীবাদের ফ্ল্যাটে যাবে। গিয়ে ওর সাথে সরাসরি কথা বলবে।
সারারাত বিভিন্ন জল্পনা-কল্পনার করে পরের দিন ঠিক সকাল দশটায় দীবাদের ফ্ল্যাটের সামনে গিয়ে কোনো রকম দুর্বলতা প্রকাশ না করে সরাসরি দারোয়ানকে বলে.....
- মামুন সাহেব কি বাসায় আছে?
মামুন সাহেব হলো মাসুমের একটা আনুমানিক বলা নাম। কিন্তু বলার ভঙ্গিটা এমন যেন মামুন সাহেব নামে কোনো ব্যক্তি এই ফ্ল্যাটের একজন বাসিন্দা এবং সে মাসুমের খুবই পরিচিত। বিষয়টা বুঝতে না পেরে দারোয়ানের সহজ উত্তর.......
- মামুন সাহেব, কইতে পারমু না। চাকরিতে নতুন আইছি, মালিকের নাম জানি না।
- হা রে তোমার মালিকের নামই তো মামুন সাহেব। ওনি কি বাসায় আছে?
- ঠিক কইতে পারমু না। আজ আসতে একটু লেট হইছে তো। আপনি ভেতরি গিয়া দেখতে পারেন।
মাসুম বাড়ির ভিতর গিয়ে কি করবে কোনো ডিসিশন নিতে না পেরে সিঁড়ি বেয়ে ছাদের দিকে যেতে থাকে। দ্বিতীয় তলা পার হলেই সিঁড়ির ল্যান্ডিংয়ের উপর দেখা হয় দীবার সাথে। চোখে চোখে মিলন হয় দু'জনের। আর চোখের নীরব ভাষায় হয় দু'জনের হৃদয়ের লেনাদেনা। চোখের ভাষায় এক মুহূর্ত দু'জনের অনেক কথা হয়। মাসুম তার প্যান্টের পকেট থেকে একটা গোলাপ আর একটা চিরকুট কাগজ বের করে দীবার হাতে দেয়। কাগজে তার মুঠোফোন নাম্বারের সাথে ইংরেজীতে ছোট্ট একটা বাক্য লেখা "I Love You"।
দীবা মাসুমের দেয়া গোলাপ আর চিরকুট কাগজটা স্বযত্নে রেখে দেয়। আর প্রতিদিন রাতে শুয়ে সেগুলো বুকের সাথে জড়িয়ে রাখে। ফুলের ঘ্রাণ যেমন লুকিয়ে রাখা যায় না। ঠিক তেমনি মাসুমকে ভালোবাসার কথা দীবা তার বুকের ভিতর লুকিয়ে রাখতে পারে না। কারণ, একদিন দীবার অজান্তে তার ঘর থেকে চিরকুটের সাথে মাসুমের দেয়া গোলাপটি শুকনো অবস্থায় পায় দীবার ভাবি। তারপর মাসুমকে ফোন করে বাসায় ডেকে এনে দীবার সামনে তার সম্পর্কে মাসুমের অজানা বিষয়টি জানায়। সবকিছু খুলে বলে দীবার ভাবি মাসুমের কাছে। দীবা কোনো কিছু বলতে পারে না। তার মনের কথাগুলো পানি হয়ে দু'চোখ দিয়ে অবিরত ঝরতে থাকে। তবে দীবার চোখের ভাষা মাসুমের বুঝতে বাকি থাকে না। তাই সে অদম্য সাহসের সাথে সিধান্ত নেয়, একজন জন্মগত বাকপ্রতিবন্ধিকে তার সারা জীবনের জীবন সাথী করার। দীবাকে কাছে পাওয়ার মাসুমের এই সাহসী সিদ্ধান্ত মিসেস যুবাইদা প্রথমে মেনে না নিলেও পরে বাকপ্রতিবন্ধি একটা মেয়ে পুত্রবধূ করে তিনিও দেখায় মমতাময়ী অসীম সাহস।
-সোহাগ তানভীর সাকিব
জানুয়ারী,২০১৫
রাধানগর,পাবনা
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে জানুয়ারি, ২০১৯ রাত ১১:২৩