বন্ধু তসলিম হাসান জীবুকে নিয়ে লেখার সময় আদৌ হয়েছে কিনা জানি না। তবে ভাবের যে উদয় আজ হয়েছে তাকে দমিয়ে ফেলাটা অনুচিত। ভবিষ্যৎ? সেটা ইতিহাস দায়িত্ব নিয়ে বুঝে নেবে। আজকের প্রেক্ষিতেই পূর্বাপর গল্পটা বলবো। আমার ব্যক্তিজীবনে দীর্ঘস্থায়ী বন্ধু নেই বললেই চলে। অনেকের সান্নিধ্যে গড়ে উঠেছে আমার ব্যক্তিসত্তা, আমি পেয়েছি ব্যক্তিভাষা কিন্তু সেই অনেকের অনেকেই স্থায়ী হয়েছে স্বল্পসময়ের পরিসরে। এই স্থায়ী না-হওয়ার কারণসমূহ এখানে বিবেচ্য নয়। তাই সে আলাপে যাবো না। বন্ধু তসলিম হাসান জীবু ব্যতিক্রম। দশটি বছর হয়ে গেল আমাদের বন্ধুত্বের। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সবচেয়ে নিকটবর্তী বন্ধু আমার।
সময়টা ২০১০। জানুয়ারির ২ তারিখ শুরু হয় বিশ্ববিদ্যালয় জীবন। বহু আকাঙ্ক্ষিত বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়ে আমি ধন্য। আর সাহিত্য? সে তো আজন্ম পছন্দের আমার। বেশ সানন্দেই যাত্রা শুরু হয় নতুন জীবনের। অসংখ্য নতুন সম্পর্কের দ্বার উন্মোচন হয়। জীবুর সঙ্গে বন্ধুত্বের শুরুটা হয় ক্লাস করতে যাওয়াকে কেন্দ্র করে। আমি হলে উঠি না বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে যাওয়া-আসা করেই ক্লাস করি। সকাল ৮টায় পৌঁছে যাই ক্যাম্পাসে। সাধারণত ঐ সময়টায় কিছু করার থাকত না। ক্লাস শুরু হতো আরো খানিকটা পরে। আমি লাইব্রেরিতে যেতাম অথবা ঘুরে বেড়াতাম একা একা। ক্যাফেটেরিয়া বসতাম কখনো কখনো বড় ভাইয়া-আপুদের সঙ্গে। জীবুর বাসা তখন ঢাকায়। ও-ও বাসে যাতায়াত করত। ওর বাসটাও এসে পড়ত ৮টার মধ্যে। আমরা দু’জনে বসে গল্প করতাম। ক্যাফেটেরিয়ায় মাউন্টেন ডিউ খেতাম দু’জনে। সকালের ঐ একান্ত সান্নিধ্যই আমাকে ওর বন্ধু হওয়ার সুযোগ করে দেয়। এমনিতে আমাদের মধ্যে মিলের বিপরীতে অমিলই ছিল বেশি। ও ক্যাম্পাসের দ্রুত পরিচয় পাওয়া মুখ। চমৎকার গানের কণ্ঠ এবং বক্তা হিসেবে অসাধারণ ও। সংস্কৃতিকর্মী, কবি এবং কর্মঠ ব্যক্তি। আমি তার বিপরীত। ডিপার্টমেন্ট-ক্লাস-লাইব্রেরি-সহপাঠী-ট্রার্ন্সপোট ঘিরেই আমার ছোট জগৎ। হাতে গোনা অল্প কিছু পরিচিত মুখের কাছে গ্রহণীয়। সুতরাং দুই ভিন্ন ধারার মানুষের বন্ধু হয়ে ওঠা কঠিন। ঐ সকালগুলোর চমৎকার অবসরই সেই বন্ধুত্বের স্রষ্টা। হঠাৎ জীবু অসুস্থ হয়ে পড়ে। দীর্ঘদিন ক্লাসে অনুপস্থিত। এদিকে গ্রীষ্মকালীন ছুটিও হয়ে যায়। ওর সঙ্গে যোগাযোগ হয় ফোনে। ওর বাসায় যাই। তখন ওরা কাফরুল থাকে। তখনও সুস্থ হয়নি কিন্তু চমৎকার একটা গান শোনায় আমাকে। ওরই লেখা ও সুর করা।
‘কুয়াশার ভেতর দিয়ে কাঁপুনি তোলা………………………………………’
পুরো গানটা মনে নেই কিন্তু সুরের মূর্ছনা এখনোও কাঁপুনি তোলে হৃদয়ের তন্ত্রীতে। এরপর ওরা বাসাই বদল করে চলে আসে সাভারে। আর নতুন ছন্দে, নতুন ঢঙে শুরু হয় আমাদের বন্ধুত্ব। ওর জীবনে হয়তো আমি অনেকের মতোই একজন কিন্তু আমার জীবনে ও অনন্য। মাঝেমধ্যে ওর বাসায় থাকা শুরু করি। আন্টির চমৎকার ব্যবহার ও আন্তরিকতা, আপ্যায়ন, আঙ্কেলের পিতৃসুলভ ব্যবহার আর সামির বন্ধুসুলভ আচরণ নিমিষেই আমার সমস্তটা দখল করে নেয়। ওর বাসায় যেতে, থাকতে কিংবা খেতে তাই কখনো কুণ্ঠাবোধ করিনি। ওর বাসায় গেলেই মনে হয় যেন আপনজনেরই বাসায় এলাম। এই যে বললাম ‘মনে হয় যেন’ এ উৎপ্রেক্ষা বাচণিক সীমাবদ্ধতায় প্রকৃতপক্ষে ও তো আপনজনই।
২০১১ এর এপ্রিল। ও আবার এক অসুস্থতায় পড়ে। জ্বর, ঠাণ্ডা ছাড়াও এ অসুস্থতা বোধ হয় আধ্যাত্মিক। যার যথাযথ ব্যাখ্যা হয় না। এরই মধ্যে ও রচনা করে ‘সাংখ্যপদ’ কাব্যটি। যদিও আজ ৯টি বছর অতিক্রান্ত হয়েও এ কাব্য পাঠক সমাজে প্রচলিত হয়নি কিন্তু আমি নিশ্চিত একবিংশ শতাব্দীতে এসে কবি তসলিম হাসান অনাগত কাব্যরসিকদের জন্য রেখে যাচ্ছেন অতীব মূল্যবান এক কাব্য যা কেবল কবিতাই নয় বরং জীবনদর্শনের এক মারফতি বার্তা। আমার সৌভাগ্য তার অধিকাংশ কবিতারই জন্মের সময় আমি পাশে ছিলাম। কবির সঙ্গে কাটিয়েছিলাম সারাটা দিন, সারাটা রাত।
বিভাগের সবগুলো ট্যুরে ওর সঙ্গ পেয়েছি। আমরা একসঙ্গে দেখেছি সমুদ্র, দেখেছি পাহাড়। ১৯ দিনে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের দর্শনীয় স্থান ঘুরেছি। গিয়েছি আজমীর শরীফ, তাজমহল। রাতে এক সঙ্গে হেঁটেছি ডাললেকের রাস্তা ধরে। এই এত এত সান্নিধ্য আমাকে বারবার শিখিয়েছে জীবনকে দেখার সূত্র, সাহিত্য-শিল্পের নানা তত্ত্ব এবং দর্শনের সহজপাঠ। গল্প লেখা আমার শখ। বন্ধু জীবু আমার গল্পের প্রধান সমালোচক। ও গল্পগুলোকে যথাযথ নিরীক্ষার মাধ্যমে আমাকে দেখিয়েছে সংশোধন কিংবা পরিমার্জনের পথ।
ব্যক্তি হিসেবে তসলিম হাসান চমৎকার মানুষ যদিও দীর্ঘসময় ওর পরিচিত মহলে ও বিতর্কিত ছিল ওর হুটহাট রাগারাগির জন্য। নিখুঁত কাজ ও বড় ভালোবাসে। অযৌক্তিক অথবা অপ্রাসঙ্গিক আচরণের ও কড়া সমালোচক। ও সত্যবাদী এবং নির্ভীক। স্পষ্টভাষী এবং যুক্তিবাদী। সুতরাং উদ্ভুত পরিস্থিতিতে শিক্ষক কিংবা সিনিয়র মেনে প্রতিবাদ করা ওর স্বভাব না। এতেই যত বিপত্তি ঘটে। আমাদের অনেকেই সমঝোতা এবং গোঁজামিল দেয়া জীবন-ব্যবস্থার সঙ্গে অভ্যস্ত এবং সেটাই স্বাভাবিক বলে মেনে নিতে শিখেছি কিন্তু ও নেয় নি। তাই বন্ধুত্ব কিংবা অন্য সম্পর্কে প্রায়ই বেঁধেছে সঙ্কট। ওর আরেক বড় দোষ তর্কে জেতা।ওর সঙ্গে তর্ক করে আমরা হেরেছিই সবসময়। বার বার হারটা মেনে নেওয়া তো ‘ব্যক্তিত্বহীনতা’ সুতরাং তর্কে না গিয়ে বরং এড়িয়ে যাওয়াটাই ভালো। এই যুক্তিতে ওর অনেক বন্ধুই ওর সঙ্গ ত্যাগ করেছিল। এসব বহু দিন আগের কথা। তসলিম হাসান এখন অন্যরকম মানুষ। রাগারাগি কম করে এবং অন্যকে নিয়ে মাথাব্যথাও এখন কম। গযল লিখছে গত আড়াই-তিন বছর ধরে। বাংলা গযল একবিংশ শতাব্দীতে এসে নতুন মাত্রা পাচ্ছে ওর হাত ধরে। প্রচারের অপেক্ষাটাই এখন। একটা স্কুলে শিক্ষকতায় রয়েছে। বড় চাকুরে হয়ে ওঠাটাও সময়ের ব্যাপার তবে শিল্পচর্চায় পিছিয়ে নেই। টুকটাক কবিতা লিখছে। পাঠ করছে বিশ্ব সাহিত্য নিয়ে। সঙ্গীত ও কাব্য বিষয়ক ওর পিএইচডি গবেষণাটাও আশা করছি নতুনত্বের মুখ দেখাবে। বিউপনিবেশিক সময়ে সেটা জরুরি অনেক তথ্য দেবে আমাদের।
করোনা উদ্ভুত পরিস্থিতিতে এক ব্যাপক রদবদলের মুখোমুখি পুরো বিশ্ব। অর্থনীতি, সমাজনীতি, সাহিত্য-সংস্কৃতি, মূল্যবোধ ও জীবন-ব্যবস্থায় আসন্ন মহা পরিবর্তনে আশা করছি তসলিম হাসানের আবির্ভাব ঘটবে মহাসমারোহে। চতুরতা, ভণ্ডামী আর সুযোগসন্ধানী বিপর্যস্ত শিল্প জগতে সূর্যের মতো দীপ্তি নিয়ে সৎ, পবিত্র আর কল্যাণের বার্তা নিয়ে তার প্রকাশ ঘটবে আশা করি। তার জন্য শুভ কামনা আজন্ম।
সুব্রত দত্ত
উত্তরখান, উত্তরা, ঢাকা
জুন ১৯, ২০২০ খ্রিস্টাব্দ।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে নভেম্বর, ২০২০ রাত ৮:৩১