প্রায়ই বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘বাংলাদেশের কৃষক’ প্রবন্ধটার কথা মনে পড়ে। বঙ্কিমচন্দ্র যে আমার প্রিয় লেখক ব্যাপারটা মোটেও তেমন না বরং তার উল্টোটা হওয়ার যুক্তি বেশি কিন্তু এই প্রবন্ধটা আমাকে বিস্মিত ও অভিভূত করেছিল। আমরা তো অর্থনীতি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলাপে কার্ল মার্কস, এ্যাডাম স্মিথসহ বড় বড় অর্থনীতিবিদের প্রসঙ্গ টেনে ফেলি অথচ এই বঙ্কিমচন্দ্রই যে আমাদের দেশীয় অর্থনীতির কত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ‘বাংলাদেশের কৃষক’ প্রবন্ধটিতে আলোচনা করেছেন তা আমাদের অনেকেরই জানা নেই।
গতকাল রাতে আপু-দুলাভাই বাসায় এসেছিলেন। ডিনার করতে করতে অনলাইন শপিং, ১১ নভেম্বরের অনলাইন শপিং-এর লেনদেন প্রসঙ্গ নিয়ে কথা হচ্ছিল। দুলাভাই মোবাইল ব্যাংকিং এর সঙ্গে কর্মরত, তিনি বললেন আগামি ২০১৯, ২০২০ এবং ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশে অনলাইন শপিং এবং লেনদেনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে। শুনলে ভালো লাগে সবার। পাঠাও, উবার নিয়েও কথা হচ্ছিল। সত্যিই তো কর্মের একটা বিশাল ক্ষেত্র সৃষ্টি হচ্ছে এভাবে। ইতিবাচক অনেক পরিবর্তনই আসছে। চাইলে বাসায় বসেই চাল-ডাল-তেল-মরিচ, নিত্যপ্রয়োজনীয় সব কিছু অনলাইনে অর্ডার করে হোম ডেলিভারির মাধ্যমে ঘরে বসেই পাওয়া যাচ্ছে। কষ্ট করে বাজারে গিয়ে, বুঝে-শুনে, দরকষাকষি করে সদাই কেনার দরকার পড়ছে না। বাঁচছে সময় এবং পরিশ্রম। আলিবাবা এক্সপ্রেস, ডরাজ- আরও কত কি তো আমাদের বৈশ্বিক বাজারের সঙ্গে যুক্ত করে দিচ্ছে। দুলাভাই বললেন কিছুদিন পর এগুলোর সঙ্গে দেশীয় ব্যাংকগুলো যুক্ত হয়ে লেনদেন সহজ ও দ্রুত করা হবে। তাহলে বিদেশি পণ্য কেনা আরও সহজ এবং দ্রুত হবে। নিঃসন্দেহে এই সব শুনলে আমরা বলব দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, তথ্য-প্রযুক্তির বিপ্লব আমাদের জীবন আরো উন্নত করছে। আমি দ্বিমত পোষণ করছি না। কিন্তু আমার একটা কিন্তু থেকে যাচ্ছে এখানে।
মনে পড়ে, ১৯৯৮-১৯৯৯ এবং ২০০১-২০০২ ও পরবর্তী বছরগুলোর কথা। নেহাৎ ছোটই ছিলাম তখন। স্কুলের গণ্ডিও পার হইনি। অথচ একটা কেমন যেন পরিবর্তন লক্ষ করতাম আমাদের জীবন ব্যবস্থায়। এই সময়টা জাতীয় জীবনে অদ্ভুত একটা জোয়ার এনেছিল। না, ঠিক সেই বছরগুলোতে না, তার আরো কিছু বছর পর তা দৃশ্যমান হয়েছিল। ২০০৭, ২০০৮ সালগুলোর কথা ভাবুন। ফেসবুক, টুইটার এলো, পেনড্রাইভ, মোডেম এলো, ভিসিয়ার, সিডি প্লেয়ার, অডিও ফিতার অ্যালবাম বাজার থেকে চলে যেতে শুরু করল। এক ঝটকায় বদলে যেতে শুরু করল আমাদের জীবনের অনেক কিছু। সময়টা ছিল তথ্য-প্রযুক্তির বিপ্লবের সময়। আমি হলফ করে বলতে পারি আমাদের তরুণ প্রজন্ম সে সময়টা বেশ মনে করতে পারছে। সত্যিই তো কতটা বদলেছে সবকিছু। সেগুলোর নেতিবাচকতার থেকে ইতিবাচকতাই কয়েকগুণ বেশি।
ঐ বিপ্লবের পর এবার অনলাইন জগতে ব্যবসা, লেনদেন ও শপিং-এর ক্ষেত্রে আরেক বিপ্লব ঘটা আসন্ন। আর তা ঘটলে ২০০২ এবং ২০২২-এ ২০ বছরে বাংলাদেশ বদলে যাবে আমূল। এটাকে আমি সভ্যতার বিপ্লব বলেই এখানে আখ্যা দিচ্ছি। এবার প্রশ্ন, এই বিপ্লব আমাদের জন্য কি নিয়ে আসছে? আমরা কি শঙ্কা মুক্ত? মানে এই বিপ্লব কি আমাদের কোনোভাবে হুমকির মুখে ফেলবে না?
হয়তো কথার ভাজে কথা ভাজ করতে করতে হারিয়ে ফেলছি অথবা গুলিয়ে ফেলছি। যদিও আমার তা মনে হচ্ছে না। এবার বঙ্কিমবাবুকে আনার পালা। বাংলাদেশের কৃষক প্রবন্ধটিতে তিনি দেশীয় অর্থনীতির উন্নতির জন্য করণীয় বিষয়গুলো খুব সুন্দর এবং স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর ভাষ্যমতে, দেশীয় অর্থনীতি তথা সামগ্রিক আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বিপ্লব প্রয়োজন কিন্তু সেটা বিজ্ঞানের আগে কৃষির। অর্থাৎ কৃষি বিপ্লব ঘটাতে পারে জাতীয় জীবনের আমূল পরিবর্তন। জীবনযাত্রার গুণগত মান বৃদ্ধি পাবে কৃষি বিপ্লবের মাধ্যমে। এই কথাটা হয়তো অনেকের বোধগম্য হচ্ছে না। একটু বিস্তারিত বলি। যে সকল রাষ্ট্র ধন-সম্পদ পূর্ণ আর যে সকল রাষ্ট্র ধন-সম্পদ পূর্ণ নয় তাদের গঠনগত বেশ কিছু বৈসাদৃশ্য রয়েছে। এখানে ধন-সম্পদ বলতে প্রাকৃতিক সম্পদ যেমন- কয়লা, হীরা, তেল ইত্যাদি বোঝানো হচ্ছে। তো যাদের এগুলো অনেক আছে যেমন আমেরিকা, তারা এবং যাদের এগুলো নেই যেমন বাংলাদেশ, আমরা- সহজাত ভাবে আলাদা এবং ভিন্ন। তো এই ধরনের ধন-সম্পদ না থাকা দেশগুলোর জন্য নিজস্ব উৎপাদন ব্যবস্থা জোরালো করা বেশি জরুরি। বাংলাদেশের সম্পদ একটাই মাটি। এ দেশের মাটিকে কবি সোনার চেয়েও খাঁটি বলেছেন নিরেট আবেগে ভেসে নয় বরং প্রখর বস্তুতান্ত্রিক অন্তর্দৃষ্টি থেকে দেখে। যেখানে-সেখানে একটু পানি, আলো-বাতাস পেলেই গাছ বেড়ে ওঠে, ফল-ফুল দেয়া শুরু করে। সেক্ষেত্রে কৃষি আমাদের সম্পদের মতো। মনে পড়ে ছোটবেলায় পড়তাম বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। এখানো হয়তো ছোটের বইতে এসব হাবিজাবি কথা লেখা আছে। আমাদের জাতীয় জিডিপিতে কৃষিখাতের অবদান বোধ করি ১৪%-১৫% এর বেশি না। আমরা ক্রমশ ধাবিত হচ্ছি সেবাখাতের দিকে। তার মানে দাঁড়াচ্ছে কৃষি জমি ধ্বংস করে সেখানে ট্রেড সেন্টার করাটা অনেকেই যৌক্তিক ভাবছি। আদৌও কি তা সত্য? বঙ্কিমচন্দ্র বাণিজ্যকেও কৃষির পরে স্থান দিয়েছিলেন। সেক্ষেত্রে সেবাধর্মী কাজগুলো তো আরো পরে। সেবাখাতের উন্নতি একটা পরনির্ভরশীলতা সৃষ্টি করে। আমরা যখন ক্রমশ সেবাখাতে যুক্ত হয়ে যাব তখন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমাদের ব্ল্যাকমেইল করা বেশি সহজ হবে? আমাদের নিজস্ব ভাবনা-চিন্তা বা সংস্কৃতিতে অন্যরা নাক গলাতে পারবে বেশি। সেবাখাতগুলো যেসব সেবা সরবরাহ করে সেগুলোর উপর কোন দেশ বা সংস্থা সাময়িক নিষেধাজ্ঞা দিলে আমরা পথে বসে যাব, কারণ আমাদের খাওয়ার মতো নূন্যতম খাদ্যটুকুও মজুদ থাকবে না। আবার কৃষিখাতে গুরুত্ব কম দেয়ায় আমাদের আমদানি নির্ভরতা বাড়বে, সেভাবেও আমাদের ব্ল্যাকমেইল করাটা সহজ হবে। কিছু হলেই চাল-ডাল-তেল বিক্রি বন্ধ করে দেয়ার হুমকি দেয়া যাবে। আমরা নিরুপায় থাকব। তথ্য-প্রযুক্তির বিপ্লব এমন পর্যায় যাচ্ছে যে সেবা সরবরাহে মানুষের প্রত্যক্ষ উপস্থিতির আর প্রয়োজন থাকবে না। তখন আমাদের কী হবে? আমরা তো জনবহুল এবং দরিদ্র দেশ। আমাদের তো কর্মহীন, বসে বসে খাওয়া সৌভাগ্যময় জীবন কখনোই আসবে না। তাহলে আমরা কী করব?
হুটহাট লিখছি, বিস্তারিত ব্যাখ্যাও করছি না। তবু জানি অনেকেই বুঝতে পারছেন আমি ঠিক কী বলতে চাচ্ছি। তথ্য-প্রযুক্তির বিপ্লব, অনলাইনে লেনদেন ভিত্তিক বিপ্লব সবই অর্থনীতির সেবাখাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, এর সঙ্গে কৃষিখাতের উন্নতির যোগসূত্র অনেক কম। এটা তথ্য আধুনিক প্রযুক্তি উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়ক এবং আমাদের উৎপাদনও বেড়েছে কিন্তু তার অনুপাত কোনো বৈপ্লবিক দৃষ্টান্ত হয়নি। একটু খেয়াল করলে দেখবেন আমাদের কৃষিজ পণ্য রপ্তানির অবস্থান ক্রমশ পিছিয়ে যাচ্ছে কিন্তু কৃষিপণ্য আমাদানিতে আমরা শীর্ষদের কাছাকাছি চলে যাচ্ছি। এটা কতটুকু স্বস্তির হতে পারে। আমি অর্থনীতির ছাত্র নেই, অর্থনীতি নিয়ে পড়ালেখাও নেই তেমন। সাহিত্য ভালোবাসি বলে বলে বাচ্চাদের ক্লাসে গিয়ে গুটিকয়েক সিলেবাসভুক্ত গল্প-কবিতা আর ব্যাকরণ পড়াই তবুও এসব ভাবনা আমাকে ভাবায়। দেশের অর্থনীতিবিদ, নীতি-নির্ধারক, পরিকল্পনা পর্ষদের জ্ঞানী-গুণী সুধীরা কি ভাবেন না? শঙ্কা কি শুধু আমার?
বি দ্র: পোস্টটা নিয়ে একটু ঝামেলা হয়েছিল। এটা দুপুরে পোস্ট করলাম কিন্তু প্রথম পাতায় এলো না। পরে কয়েকজনের পরামর্শে আবার পোস্ট করলাম। এবার এলো। এই পোস্টটা তাদের উৎসর্গ করলাম।
তারা- ঋণাত্মক শূণ্য, আবু তালেব শেখ, আরোগ্য এবং তারেক ফাহিম (ইনি চমৎকার আইডিয়াটা দেয়ার জন্য)।