চোখ মুদলেই আমার বড়মাস্বাবের ছায়া ভেসে উঠে মনের মনিটরে। হালকা-পাতলা গড়নের তেলচিক্য মায়াবীমুখের আলো ঝলকে পড়ে আমার চোখের পাতায়- মনের আয়নায়। আমি বিনম্র শ্রদ্ধায় দুলে উঠি। তিনি আমার প্রিয় প্রাইমারী স্কুলের হেড স্যার; আমরা সকলেই হৃদয়নিংড়ানো ভালবাসায় ডাকি "বড়মাস্বাব"৷ আমাদের বড়মাস্বাব এমন ছিলেন, আমাদের বড়মাস্বাব এমন করতেন, আমাদের বড়মাস্বাব এমন বলেছেন, আমাদের বড়মাস্বাব এভাবে করেছেন! আমরা আজও খুউব উচুগলায় এসব বলে বেড়াই কোন আড্ডায়, আলোচনায়। আমাদের বড়মাস্বাব নিয়ে আমাদের গর্বের অন্ত নেই। আজ তিনি নেই। গত হয়েছেন বিগত ক'বছর আগেই। তবুও তিনি তরতাজা আমার প্রাণে। উত্তরকালের কোন শিক্ষকই আর সে আসনে বসতে পারেন নি- যেখানে বসে আছেন আমার বড়মাস্বাব; আমার বটমাস্বাব।
কিভাবে হাসতে হয়, কিভাবে কাঁদতে হয় অথবা বাতাসের উজানে থুথু ফেলতে নেই, আর কাদামাটির প্রচণ্ড বৃষ্টিপড়া পথে কিভাবে কাপড় পরিচ্ছন্ন আর শুকনা রেখে পথ ডিঙ্গাতে হয়! ছাতা কিভাবে ধরতে হয়, বইয়ের পাতা উল্টাতে হয় কেমন করে, আর নতুন বইয়ে কলমের আঁচড় যে দিতে নেই এমন উপদেশমালায় জীবন আমার আজও টইটম্বুর৷বড়মাস্বাব আমাদের ভালবাসা, বড়মাস্বাব আমাদের অবচেতন মনের জিন্দাপীর!
শুধুই পঞ্চমের টিচারঃ
বড়মাস্বাব শুধু পঞ্চমেই ক্লাস নিতেন। অন্যান্য ক্লাসে দেখা যেত দৈব। মাঝেমধ্যে স্কুলের বারান্দায় পেছনে হাত বেঁধে কী এক ইঙ্গিতময় চেহারা নিয়ে পায়চারি করতেন আমরা শুধুই তাকিয়ে দেখতাম আর ভয় পেতাম ! চতুর্থ শ্রেণীর বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলে মনে ভয় জেগে উঠে আমাদের- "পঞ্চমে বড়মাস্বাবের ক্লাস!" তিনি প্রচণ্ড মেজাজী- যার উত্তাপ অবশ্য আমরা ক্লাস ফোর-এ থেকেই পেয়েছি। ফাইভের ছাত্রদের তিলকে তাল বানিয়ে ছড়ানো গুজব আরও ভয় বাড়িয়ে দিয়েছিল। পাস করলে যে উপরের ক্লাসে যেতে হয় এজন্যই বাধ্য হয়ে আমাদের পঞ্চম শ্রেণীতে উঠতে হলো, নয়তো আরও ক'বছর ক্লাস ফোর-এ থাকতে আমাদের যে কেউই রাজি ছিল বড়মাস্বাবের বেতের ভয়ে!
শুধু তিনিই পিঠবেন!
আমাদের বড়মাস্বাব পিঠানোর জন্য যতটুকু খ্যাত ছিলেন ততোটুকু কিন্তু আমাদের পিঠেননি- এ আমাদের নসীব। একটি কারণ হয়তো ছিলো; আমরা ছিলাম তার শেষ যামানার ছাত্র, হয়তো এজন্য আমাদের প্রতি ছিলেন অনেকটা দরদী। তবে আগুনের হান দেয়া কয়টি "জালিবেত" ঠিকই অফিসের আলমারিতে সাঝানো ছিল! বেতের চকচকে চেহারাই জানান দিত এগুলো কতো সুপারসনিক পাওয়ার নিয়ে আলমারিতে ঘুমায়! আমাদের প্রার্থনা ছিল, "আল্লাহ বেতেরা যেন চিরকাল এমনি ঘুমায়।"
ঘুম পাড়ানি মাসিপিসি আমার ঘরে এসো'- গানটি মনে হয় এজন্য আমার প্রাণের লুকানোচিপায় প্রিয় হয়ে রয়েছে আজও!
অন্য কোনও স্যার আমাদের পিঠুন- এ বড়মাস্বাব চাইতেন না। মাঝেমধ্যে স্কুলের কাজে তিনি থানা-সদরে চলে গেলে অন্য স্যারেরা 'একদিনের বাদশা' হয়ে যেতেন। বিশেষ করে ইবরাহিম স্যারের চোখ রাঙানি আর গলার উচ্চস্বরে মনে হতো ক্লাসে আমরা সবাই বধির, জন্মসুত্রে কানকালা! নানা অজুহাতে চলতো তাঁর পিঠানোর পায়তারা। কাউরে কানমলা কাউরে ডেক্সে হাত উপুড় করে স্কেল দিয়ে টাসটাস!
বড়মাস্বাবের অনুপস্থিতিতে এমনি এক পিঠাপিঠির খবর বড়মাস্বাব কিভাবে শুনে ফেলেন! সেদিন বড়মাস্বাবের রৌদ্ররূপ দেখে আমরা কেঁপে উঠি।
"কেন আমার ছাত্রদের পিঠলেন?"-
আগুনঝরা চোখে জিজ্ঞাসিত প্রশ্নের উত্তর ইবরাহিম স্যার দিতে চেষ্টা করলেন, কিন্তু আরও তীব্রবানে গুটিয়ে গেলেন।
এরপর হতে চিরকালের জন্য অর্ডার চলে এলো,
"আমার ছাত্রদের গায়ে আর যেন কারও হাত না উঠে।"
সেই থেকে আমাদেরকে অন্যান্য স্যারেরা সমীহ করে চলতেন! আমাদেরও রগে এসেছিলো রগরগে ভাব। শুধু পঞ্চমের প্রথম আর দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষা-পরবর্তী পেপার হাতে নিয়ে আলমারি'র সাঝিয়ে রাখা ফুলদানি'র হূলে গতরে বেশ কয়টি আঁকাবাঁকা ধনু জেগেছিল। আর খুব একটা মনে নেই, মনে হয় আর বেশি ব্যবহার হয় নি ওই লকলকে চিজটার।
বর্ষায় বিলে অথবা সুরমায় অনেক নৌকা বেয়েছি আমরা, নৌকা চালনায় আমার হাতও খুব ভাল। বন্ধুমহলের কেউই আমার মতো ভাল বাইতে পারে না। বৈঠার একটি বৈশিষ্ট্য ছিলো এমন, একবার পানিতে চাপড় দিলে নৌকা অনেকক্ষণ এগিয়ে যেতো বিনা চাপড়ায়; বিশেষ করে ভাটির দিকে। আজ হিসেব করে বৈঠার সাথে চমৎকার মিল পাই বড়মাস্বাবের! আমরা ছিলাম তার ভাটি-বয়সের ছাত্র। এজন্য তার গৌরবদীপ্ত পেঠানোর সুনাম আমাদের মাঝে চলে আসে সময়বৈঠা চড়ে।
নয়তো শুনে আসা তাঁর সেই রৌদ্ররূপ কোথায়?
চা'য়ের প্রীতিঃ
স্কুলে এসে শফই'য়ের এককাপ চা দিয়ে শুরু হতো বড়মাস্বাবের কর্মযজ্ঞ। উমরগঞ্জ প্রাইমারী স্কুল আর উমরগঞ্জবাজার গলাগলি করে দাঁড়িয়েছিল বলে রেডিমেড চা পানে আমরাও ছিলাম কচি বয়স থেকেই অভ্যস্ত। মাস্বাবের চা আনতে গিয়ে আমরাও এককাপ চা অথবা এটা-সেটা খাওয়ার, ঘুরার লোভে থাকতাম ওঁৎ পেতে। অবশ্য আমার সে সুযোগ খুব কমই হতো। হয় ফাস্টবয় নয় লাস্টবয়- দু'প্রান্ত সীমায় সচরাচর চা নিয়ে আসার ডাক পড়তো। আমি দু'টোর একটিও ছিলাম না। জনমভর আমার স্থান মধ্যবিত্তই। আজও সে-রেখা অতিক্রম করে উঠতে পারিনি।
অবশ্য এক হওয়ার লোভ আমার কোনকালেই ছিল না; আজও নেই। এজন্য মাস্বাবের চোখও আমায় এড়িয়ে যেতো বারবার চা-কলে! মধ্যবিত্তরা চিরকালই উপেক্ষিত সমাজ ব্যবস্থায়। মধ্যমগজি'রাও উপেক্ষিত বোধ হয় ক্লাসরুমে!
বাংলাময় ১২টা, আমাদের ১০টায়ঃ
আমাদের নিকটতম সব কটি স্কুলেই পঞ্চমের ক্লাস শুরু হতো দুপুর ১২টায়। শুধু আমাদের স্কুলে বড়মাস্বাব নিজস্ব ক্ষমতাবলে পঞ্চমের ক্লাস শুরু করে দিতেন সকাল ১০টায়। এ নিয়ে আমাদের মনে ছিল প্রচণ্ডক্ষোভ। এছাড়া সপ্তাহান্তে/পাক্ষিক-এ ম্যানেজিং কমিটির সভা ডাকতেন, আর সেদিন আমাদের ক্লাস জারি থাকতো প্রায় সন্ধ্যা অবধি। অতিরিক্ত পড়ার ছোবলে আমরা ভিতরে ভিতরে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠতাম আমাদের বড়মাস্বাবের প্রতি! আজ আকাশের অসীম শূন্যতায় বারবার তাকিয়ে ক্ষমা চাই।
সবাই চলে যায় কেউ ফিরে নাঃ
বড়মাস্বাবের দুঃখছিলো, সবাই নাকি হাই-স্কুলে উঠে গেলে কেউই আর তার কাছে আসে না। আমাদের ধারনা ছিলো; আমরা সবসময় বড়মাস্বাবের বাড়ি আসবো, স্কুলে আসবো!
কিন্তু আমাদেরও সেই শ্রুত বিমার ঠিকই ধরে ফেলে। আমারাও কেউ আর বড়মাস্বাবের বাড়ি যাই না। শুধু দূর হতে দেখি তার শান-শওকতময় ধুতি'র রুশনী! কী এক ভয় আর কী এক ভালবাসা তার প্রতি জেগে উঠে মনের কোণায়; তার ভাষা পড়তে পারি না শুধু ইশারা পাই।
রাস্তায়, বাজারে দৈব দেখা হয়ে গেলে কতদ্রুত কোন অজুহাতে তাঁর সম্মুখ হতে কেটে পড়ব তারই অপকৌশল খুঁজি। এ রোগ শুধু আমাদের ছিলো না। সুদূর অতীতের যারা আরোও বিশ/পঁচিশ বছরকাল আগেই ছেড়ে গেছেন প্রাথমিকের গা- তারাও বড়মাস্বাবের সামনে পারতপক্ষে পড়তেন না। স্পেন ফেরত আমার ছোটচাচা অনেক বছরের ব্যবধানে বাড়ী ফিরলে বড়মাস্বাব হঠাৎ একদিন ভোর বেলায় আমাদের উঠোনে প্রিয় ছাত্রকে দেখতে! সেদিন পঁয়তাল্লিশ উর্ধো আমার চাচার অস্বস্তি দেখে আমার স্বস্তি অনেকটাই বেড়ে গিয়েছিল এ ভেবে যে, বড়মাস্বাবের সামনে শুধু আমরাই দৌড়াই না! প্রায় ঘন্টা খানিকের সাক্ষাতকারে একটি সেকেন্ডের জন্যেও আমার চাচা তাঁর সামনে বসেননি। বড়মাস্বাবের অনেক অনুরোধেও না। আর কী অসীম শ্রদ্ধায় নত হয়ে গিয়েছি চাচার সমগ্রস্বত্ত্বা, তা দেখে আমার প্রাণে ফুঁৎকারে উঠেছিল শ্রদ্ধার্হস্লোগান,
"আমার বড়মাস্বাব।"
যে পথ দিয়ে হেটে যেতেন সে পথের ছোটবড় সবাই তাঁরে ছেড়ে দিত রাস্তার পুরাটাই। যে রাস্তার ধারে নীচে নেমে পথকরে দেয়নি, তার খেতাব একটাই 'বেয়াদব। '
পরবর্তী সবাই স্যার হয়ে গেলেনঃ
একেবারেই গ্রামীণ উচ্চারণে সকলেই তাকে আপন করে ডাকতো বড়মাস্বাব বলে। আমাদের বাবারা, আমাদের চাচারা, আমাদের মুরব্বিরা, আমাদের মায়েরাও। শেষতক আমরাও। এই প্রাণ নিঃসৃত আওয়াজ আর কোন কালেই কোন শিক্ষকের জন্যেই বাজেনি। আমি আমার সকল শিক্ষদের প্রতি অসীম শ্রদ্ধা রেখেই ক্ষমা চাচ্ছি! বাড়মাস্বাব তো আর কেউ হয়ে উঠেননি। আমি এই অন্ধত্বের জন্য ক্ষমা চাই।
পরবর্তী সকল শিক্ষকেরাই আমাদের স্যার ছিলেন। বিদেশি শব্দের উচ্চারণ কখনো সে স্থানে পৌঁছায়নি, যেখানে পৌঁছেছিল আমাদের অজো-পাড়াগায়ের গ্রামীণ উচ্চারণ "বড়মাস্বাব।" বাজান'কে ড্যাডি ডাকলে যেমন কেমনকেমন লাগে- ঠিক তেমনি মাস্বাব'দের স্যার ডাকলেও আমার যেন কেমন কেমন লাগে! সৎস্যার সৎস্যার মনে হয়।
আমি আপন করে নিতে পারি না ঐ ভিনদেশি আওয়াজ।
খাদক সুরমাঃ
সম্ভবত ৮৯'ইংরেজির দিকে আমাদের উমরগঞ্জ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের উপর সুরমার থাবা পূর্ণতা নিয়ে বিজয়ী হয়। কয়েকবছর ধরে চলে আসা ভাঙন পুরা স্কুলখেয়ে ফেলে। আমরাই ছিলাম নদীতীরে প্রতিষ্ঠিত শতাব্দীপ্রাচীন স্কুলের শেষ বেচ।
সুরমার হাওয়াঢল আর ওপারের রাখালিয়া বাঁশির সুর ঢেউয়ের মতো ভেঙ্গেভেঙ্গে উড়ে আসতো আমাদের কানে। যেখানে আমরা খেলেছি টাঙ্গোলবেঙ্গা, কিলকিল, কুটি, আর ফাস্টবয় হায়াত উল্লাহ'র ইরান ফেরত বাবার দেয়া রাবারের ফুটবলে লাথালাথি; আজ সে স্থানে নৌকা চলে, জেলেরা মাছ ধরে! বড়মাস্বাব আর স্কুল দুই-ই মহাকালের গহীন কূপে।
অন্তহীন শোকঃ
আজ এই দূরদেশে টিপটিপ জলচোখে যখন মোবাইলের বটম টিপছি, তখন বড়মাস্বাবের ছায়া প্রচণ্ডভাবে ভর করেছে দেহে-রুহে। বারবার মন বলছে,
"বড়মাস্বাব আপনি আবার আসুন, আপনার দু'টি পা মেলে দিন বিছানায়;
একটু টিপে দেই।"
কিন্তু বড়মাস্বাব আসেন না, স্কুলও আর আসে না- আসে শুধু বাঁধভাঙা অশ্রু'র ঢেউ!
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে মে, ২০১৬ রাত ৩:৩২