ঈদ মোবারক!! ঈদ উপলক্ষ্যে একটা হাসিখুশী গল্প দিলাম। ভালো থাকুন। সুস্থ ও নিরাপদ থাকুন পরিবারের সবাইকে নিয়ে।
বাকী রইলো আটটা
*******************
ঘড়ির দিকে তাকালো মন্টু। এক ঘন্টার ওপরে ও এই ঘরে বন্দী। দরজা ধাক্কানোর চেষ্টা করেনি। জানে খুলতে পারবে না। আর কেউ খুলেও দেবে না।
মন্টুর মনটা আজ সকাল থেকেই ভালো নেই। অথচ আজ শুক্রবার। ছুটির দিনে ভালমন্দ রান্না হয় ভেবে ঘুম ভাঙ্গতে মন্টু আনন্দে ছিলো। সকালের নাস্তা সেরে, দুধ খেয়েই পাশের বাসায় খেলতেও গিয়েছিলো।
মন্টু একটু চুপচাপ। খুব বেশী বন্ধু নেই। সমস্যা ওর নিজেরই। কাউকে যে সহজে ভালোই লাগে না। তবে পাশের বাসার মিনিকে ওর পছন্দ। মাঝে সাঝে ওর সাথেই খেলে। আজ গিয়ে শোনে মিনিরা নাকি পাড়া ছেড়ে চলে যাচ্ছে। যাচ্ছে তো যাচ্ছে তাও আবার অনেক দুরে। এই ধানমন্ডি থেকে সেই গুলশান। আর হয়তো দেখাই হবে না। পাশের গলির ওই হুতকো ছেলেটা, ঝন্টু, আবার মিনির গা ঘেঁষে পাশে বসে গল্প করছে। মেজাজ চড়ে গেলো মন্টুর।
বাসায় ফিরে সোফায় বসে টিভি দেখছিলো। চাচ্চু বাজার নিয়ে এসে চাচীমাকে ডাকলেন “শোন...ইলিশ এনেছি!! সস্তায় পেয়ে গেলাম!!” “ওমা!! কতো দাম পড়লো। পচা মাছ নয়তো?” “আরেহ না!! তাজা তাজা কয়েক টুকরো ভেজে ফেলো। দুপুরে খাবো...” ইলিশ মাছ মন্টুর খুব প্রিয়। তারপরেও মনভার কাটল না। কি একঘেয়ে একটা ছুটির দিন!!
টেলিভিশনে কার্টুন চলছে। টম আর জেরি!! সেটাও বড্ড বোরিং!! টমটা এমন উজবুক...একটা সামান্য নেংটি ইঁদুরের কাছে বার বারই মার খেয়ে যায়। মন্টুর মেজাজটা আবারো খারাপ হয়ে গেলো। চোখ বন্ধ করে ঝিমুচ্ছিলো। দাদু এসেই হুট করে ওকে কোলে নিয়ে বসলেন। চ্যানেল বদলে এখন খবর শুরু হলো। খবর গুলোও সেই গতানুগতিক...নির্বাচন সামনে রেখে নেতাদের পাল্টাপাল্টি কথা, দেশে কয়েকটা একসিডেন্টের খবর, বিদেশে বন্যা-ভূমিকম্প-প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ক্রিকেট খেলা...এই সব ছাড়া আজকাল আর খবর কোথায়?
খবর শুনতে শুনতে দাদুর ওপরেও একটু রাগ হলো মন্টুর। দেখতে দেখতে তো বয়স কম হলো না ওর...প্রায় পাঁচ বছর!! এখন বুঝি এভাবে হুটহাট কোলে বসতে ভালো লাগে। সুন্দর গন্ধে হঠাত ঝিমুনি কেটে গেলো মন্টুর। ইলিশ মাছ ভাজার ঘ্রাণ!! দাদুর কোল থেকে নেমেই রান্নাঘরের দিকে ছুট দিলো মন্টু।
আর তারপরেই ঝনাত ঝন ঝন!! কাঁচের ফুলদানী টুকরো টুকরো। যাওয়ার পথে তাড়াহুড়োতে ধাক্কা লেগে ফুলদানী শেষ!! অমন সরু করিডোরে তারের টেবিলে আবারো কাঁচের জিনিষ রাখার কি দরকার বাপু!! আর কি...বাসার সব্বাই সব কাজ ফেলে দৌড়ে এলো। সবাই মিলে খুব বকাঝকা...কি হম্বিতম্বি! চাচ্চু খুবই রেগেছে। এই লাল ক্রিস্টালের ফুলদানী নাকি তার কোন বন্ধু বিদেশ থেকে এনে দিয়েছিলো...অনেক দাম! চাচ্চুই মন্টুকে শাস্তি দিয়ে এই ঘরে আটকে রেখেছে।
মন্টু কি আর বোঝে না!! সবই বোঝে...কাজল যদি ফুলদানী ভাঙ্গতো, তাকে কি আর বাসার সবাই এতো বকতো, নাকি ঘরে এমন আটকে রাখতো। মন্টুর চোখে কষ্টে অভিমানে জল চলে এলো। বাবা মা নেই। কাকুর সংসারে আছে বলেইতো সামান্য ভুলেই শাস্তি, আর বকুনি। মন্টু কি ইচ্ছে করে ফুলদানী ভেঙ্গেছে? দৌড়ুতে গিয়ে সময় মতো থামতে পারেনি বলেই না...ওর গায়েও তো খুব ব্যথা লেগেছে...কেউ জিজ্ঞেসও করলো না।
জানালার বাইরে আকাশের দিকে তাকিয়ে মন্টুর ভারী মন খারাপ হয়ে গেলো। মিনিও চলে যাচ্ছে। বাড়িতে কেউ ওকে ভালোবাসে না। ও না থাকলেও কারো কিচ্ছু আসে যায় না। বিছানা ছেড়ে জানালার কাছে যেতেই দেখে নেট খোলা। মরে যাওয়াই ভালো। দোতলা থেকে লাফিয়ে পড়লে কেমন হয়? কিন্তু খুব কি ব্যথা লাগবে? হাত পা ভেঙ্গে পঙ্গু হয়ে যাবে না তো আবার?
পড়ন্ত দুপুরের ঝকঝকে আকাশে পেঁজা পেঁজা মেঘ। একটা মেঘ দেখতে ঠিক মাছের মতো। ইলিশ মাছের কথা মনে পড়লো। কেউ মন্টুকে খেতেও ডাকলো না। ও জানালা দিয়ে মাথা গলিয়ে নীচে দেখলো। বাসার সামনে একটু খানি সবুজ ঘাসের গালিচা। বাসার দেয়াল ঘেঁষে গোলাপের গাছ...গোলাপের ঝোপের ওপরে পড়লে কাঁটায় খুব ব্যথা পাবে। একটু হিসেব করে ঘাস তাক করে জানালা থেকে ঝাঁপ দিলো মন্টু।
বাহ!! ঝাঁপ দেবার পরে ভয় লাগছে না তো। মনে হচ্ছে বাতাসে ভেসে ভেসে নামছে। মাটিতে পড়ার আগেই চোখ বন্ধ...ছোট্ট শরীরটা ঝুপ করে ঘাসের সবুজে আছড়ে পড়লো। কই!! মন্টুর কোন ব্যথা লাগছে না তো!! তবে কি ও মরে গেছে...ভূতেদের কি ব্যথা লাগে? ভয়ে ভয়ে চোখ খুললো মন্টু। হাত পা চেটে নেড়েচেড়ে দেখলো...নাহ!! ব্যথা নেই শরীরের কোথাও...কোথাও কাটেওনি।
মন্টু বেশ বিভ্রান্ত...ও কি বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে? এমন সময় পাশে থেকে কে যেন খুব মিষ্টি স্বরে মিউ করে ডাকলো “এইইই শোন!!” তাকিয়ে দেখে মেঘের মতো নরম, ধবধবে শাদা একটা মেয়ে। চোখজোড়া সবজেটে...কি সুন্দর আর মায়াবী!!
ওর ভ্যাবাচ্যাকা অবস্থা দেখে সে বললো “আমি এ পাড়ায় নতুন। আমার নাম তুলতুল...”
“ওহ!! আমি মন্টু...তুমি আমাকে দেখতে পাচ্ছো?”
মেয়েটা এমন অবাক “ওমা!! দেখতে পাবো না কেন? তোমাকে দেখেইতো ভাব করতে এলাম...”
মন্টু একটু অপ্রস্তুত “না মানে...দোতলা থেকে ঝাপিয়ে পড়েছিতো...মরে গেছি কিনা বুঝছিলাম না...”
“আমাদের নয়টা জীবন...এতো সহজে তো মরে যাওয়ার কথা নয়...” তুলতুল খিলখিলিয়ে হাসছে।
আচমকাই মন্টুর মনটা খুব ভালো হয়ে গেলো। ভাগ্যিস নয়টা জীবন!! আরো বার আষ্টেক আত্মহত্যা করা যাবে।
© শিখা রহমান
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে মে, ২০২০ রাত ১০:০৩