১.
অনেক ভেবেছি। অনেকবার ভেবে দেখেছি। একটাই সমাধান…আত্মহত্যা!! মাসখানেক ধরেই মনের মধ্যে ঝড় বয়ে যাচ্ছে। চিন্তারা সব ওলটপালট।
মণিকাকে এড়ানো কঠিন। মেয়েটা বুদ্ধিমতী…চোখের দিকে তাকালেই বুঝতে পারে। ঘুমানোর আগে সেদিন হঠাৎ জিজ্ঞাসা করলো “তোমাকে আজকাল খুব অন্যমনস্ক দেখি? সব ঠিক আছে তো?” আত্মহত্যার চিন্তার কথা ওকে বলা যায় না। মেকি হাসি দিয়ে এড়িয়ে গিয়েছি “তেমন কিছু না…অফিসে কাজের চাপ!!”
ঘুমঘুম মণিকা আর কথা বাড়ায়নি। ঘুমের অষুধ কাজ করা শুরু করেছে। ওর ইনসমনিয়ার সমস্যা আছে। মাঝে মাঝে কড়া ঘুমের ওষুধ খায়। দিনের পর দিন না ঘুমিয়ে বিদেশে একাহাতে অফিস, সংসার সামলানো কঠিন।
অবশ্য ঘুম না এলেও মণিকা এর বেশী কিছু হয়তো জানতে চাইতো না। টের পাই ও অনেকটাই নিস্পৃহ হয়ে গেছে। পরবাসে দুজনেরই প্রচণ্ড ব্যস্ততা। গতানুগতিক কথাবার্তা বা ছুটির দিনে কাটানো দুর্লভ সময়টুকুর আঁচও মরে আসছিল ক্রমশ। মনে হয়েছিল, হয়তো এটাই স্বাভাবিক। একটা সময়ের পরে ভালোবাসা হয়তো শুধুই অভ্যেস বা রূপকথা। ভালোবাসা মানেই সংসার; বাসনকোসন, হাড়িপাতিল, চামচের টুংটাং, ফুলতোলা টিফিনবাক্স।
তাই হয়তো বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করেনি। ক্রিসমাস পার্টিতে মাইকের সাথে মণিকার শরীরের ভঙ্গীর নিষিদ্ধ কথা বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করেনি। চোখের মাতাল আমন্ত্রণ...মদের নেশা ভেবে নিয়েছিলাম। নিজেকে নিজেই ভ্রুকুটি করে বলেছি “ছি! ফরহাদ ছি! তোমার মন এতো কুটিল, এমন নীচ...ভালোবাসার ওপরে বিশ্বাস হারাতে হয় না!!”
মাসখানেক আগে তাড়াতাড়ি কাজ সেরে মণিকার অফিসে গিয়েছিলাম। নতুন একটা জাপানী রেস্তোরা খুলেছে। সারপ্রাইজ ডিনার। ও সুশি খেতে ভালোবাসে। গাড়ি পার্ক করতেই দেখি মণিকা হেঁটে আসছে; ফেব্রুয়ারীর মরে আসা গোধূলির আলোয় ওকে মোমের মূর্তির মতো দেখাচ্ছে। বাতাসে মুখের ওপরে এলোমেলো চুল...কি কোমল, কি মায়াময় একটা মুখ!! পাশে মাইক, ওর হাত মণিকার কোমর জড়িয়ে আছে। মাইক কি যেন বলতেই ও হাসলো...সেই আলো আলো হাসি যা একসময় আমার ছিলো। সন্ধ্যানামা আলোয় ওর মুখ ঠিক সেইরকম উজ্জ্বল লাগছে, যেমনটা আগে আমার দিকে তাকিয়ে থাকার সময় লাগতো ওকে। কিন্তু আজ সেই তাকিয়ে থাকা শুধুই মাইকের জন্য। গাড়িতে ওঠার আগে আবছায়ায় দু’জোড়া ঠোঁট পরষ্পরকে আটকে রেখেছিলো।
চোখ ঝাপসা হয়ে গিয়েছিলো। মণিকা চলে যাওয়ার পরেও অনেকক্ষণ পারকিং লটে চুপচাপ বসে ছিলাম। সেদিন শহরের সব ট্রাফিক সিগন্যাল লাল হয়ে গিয়েছিলো। ফেরার পথে হর্নের আওয়াজ, ব্যস্ত সড়কে ক্রুদ্ধ গাড়িচালকদের মুখ...সবকিছু ঝাপসা হয়ে জলের ধারা নেমেছিলো। বাসায় ফিরেও রাতের গভীরে কেঁদেছিলাম। শুধু সেদিন নয়...তারপরে অনেক দিনই।
মণিকা, আমার মণিকা। সেই মণিকা যাকে প্রথম দেখাতেই পাগলের মতো চেয়েছিলাম...লাল শাড়িতে একদলা আগুন! পাশের বাড়ীর মায়াবতী মেয়ে নয়। মণিকা অভিজাত, রাজকীয়। মেটেরঙ্গা ইটের টুকরো নয়; দুষ্প্রাপ্য খনিজ, বড্ড দামী চুনী পাথর।
ভালোবাসার বিয়ে নয়; প্রস্তাব পাঠিয়ে পরিবারের সম্মতিতে আমাদের বিয়ে। প্রবাসী সুযোগ্য পাত্র হিসেবে মণিকাকে সহজেই পেয়ে গিয়েছিলাম। হয়তো ও তেমনটা আমায় ভালোবাসতে পারেনি যেমনটা আমি ভালোবাসি। সবার ভালোবাসার ক্ষমতাও সমান হয় না। তারপরেও ওকে অসুখী মনে হয়নি তো...হাঁটি হাঁটি পায়ে আমার আঙ্গুল ধরে প্রবাসের নিয়মকানুন শিখে নেয়া মণিকা...ঘাড়ে মাথা রেখে সূর্যাস্ত দেখা আমার মণিকা...চিন্তা হলে ভিতু ভিতু মুখে বুকের কাছে ঘেঁষে বলা “সব ঠিক হয়ে যাবে, তাই না?”...আমার সেই মণিকা...
মণিকাকে চুমু দিতে শিখিয়েছিলাম। শিখিয়েছিলাম কিভাবে নাক এড়িয়ে ঠোঁটের ওপরে ঠোঁট রাখতে হয়। ও কি মাইককে তেমনভাবে আদর করেছে? ইদানীং চোখে জল আসে না...মাথায় আগুন জ্বলতে থাকে। আচ্ছা মাইক কি ওর বামবুকের লালচে তিলটার কথা জানে? মগজে নিরন্তর দৃশ্য তৈরী হতে থাকে..এ যন্ত্রনা থেকে মুক্তি নেই!!
মণিকাকে বলেও লাভ নেই। কেবলই কথা কাটাকাটি, তিক্ততা বাড়বে। ভালোবাসা জলের মতো। জল গড়িয়ে চলে গেলে তাকে ফিরিয়ে আনা অসম্ভব। মণিকা আমার মতো নদী হতে পারেনি...ও কেবলমাত্র পদ্মপাতা!! অনুনয়, বিনয়, চেঁচামেচি কোনকিছু দিয়েই আর মণিকাকে ধরে রাখা যাবে না। বরং সম্পর্কটা আরো বিষিয়ে উঠবে। তারচেয়ে ওকে চলে যেতে চেয়াটাই ভালো।
কিন্তু আমি? আমি যে ওদের দু’জনকে একসাথে দেখা মেনে নিতে পারবো না কখনোই। মণিকার ব্যাপারে যতোই উদার হই না কেন, নিজের ব্যাপারে এতোখানি কঠিন হতে পারবো না আমি। তাই অনেক ভেবেচিন্তে সিন্ধান্ত নিয়েছি...আত্মহত্যা। সমস্ত সমস্যার সমাধান এতেই হবে। কষ্ট হবে কিছুদিন হয়তোবা। তবে সময় সবই ভুলিয়ে দেয়।
নতুন করে নতুন জীবন শুরু হবে আবার…অনর্থক জটিলতা ছাড়াই। তবে যেখানেই থাকি, তোমাকে ছেড়ে থাকতে আমার ভালো লাগবে না মণিকা। কিন্তু উপায় নেই। উপায় নেই। আত্মহত্যাই ভালো…এতেই শান্তি!!
২.
আত্মহত্যার জন্য একটা বিশেষ দিন বেছেছি। আত্মহত্যা ব্যাপারটা একটু নাটকীয় না হলে মানায় না। আজ আমাদের বিয়ে বার্ষিকী। চার বছর একসাথে কাটালাম। মণিকার সাথে শেষবারের মতো একটু সুন্দর সময় কাটাতে চাই।
অফিস থেকে আগে বেরিয়ে ফুল কিনলাম। গোলাপ ওর পছন্দ নয়; লালরঙ্গা টিউলিপের তোড়া। ঝাল গরুর মাংস ভুনা রান্না করে ডিপফ্রিজে রেখে দিয়েছিলাম। মণিকার প্রিয়; সাথে খাওয়ার জন্য তন্দুরীরুটি কিনলাম। বাসায় ফিরে সালাদ কাটার সময়ে বাইরে মণিকার গাড়ির আওয়াজ। বাইরে চাবি ঝনঝন টের পেতেই ভেতর থেকে দরজা খুলে দিলাম।
“ওমা!! তুমি আজ এতো তাড়াতাড়ি বাসায়?” মণিকার অবাক প্রশ্নের উত্তরে হাসলাম। “আজ আমাদের অ্যানিভারসারি…” ওর মুখে একটু অপরাধী ভাব “শিট…কাজের ঝামেলায় ভুলে গিয়েছি…সরি!! তুমিতো জানোই আমাকে…” তা জানি…মণিকার এমনিতেই দিনতারিখ গুলিয়ে ফেলার অভ্যাস আছে। তবে এখন হয়তো অবচেতনে এই তারিখ মনে রাখার ইচ্ছেও নেই।
টেবিলের ওপরে ফুলদানিতে সাজানো টকটকে লাল টিউলিপদের দিকে তাকিয়ে ওর মুখে একটু আলো খেলে গেলো, সেই পুরোনো দিনের মতো। “সোফায় বসে একটু রেস্ট নাও… বড়জোর দশ মিনিট!! আর ফোনটা দাওতো!!” মণিকার চোখে একটু ভয়। পুলিশ এলে চোর প্রথমেই চুরির মাল লুকোনোর কথা ভাবে। আঙ্গুলগুলো একটু শক্ত করে পার্সটা এঁটে ধরলো। “আচ্ছা থাক…ফোন দিতে হবে না। শুধু ব্যাগটা শোবার ঘরে রেখে এসো। এখন থেকে এক ঘন্টা কোন ফোন না, কোন অফিসের কাজ না…তোমার পুরোপুরি মনোযোগ চাই!!”
বিয়ের সময়ে কেনা শাদার ওপরে নীল কারুকাজের ডিনার সেটে টেবিল সাজানো। পার্স রেখে ডাইনিংয়ে এসে মণিকা অবাক, একটু অভিভুতও। “ঝাল মাংস তুমি রেঁধেছো? কখন এত্তোকিছু করলে?” অনেকখানি মাংস নিয়ে খেলো ও “মজা হয়েছে। তুমি মাংস নেবে না?” “পেটটা একটু আপসেট…মশলাদার কিছু আজ না খাই। আর রান্নাতো তোমার জন্য করেছি মণিকা।“
রুটি ছিঁড়ে খেলাম সালাদ দিয়ে। কিভাবে আজ খাবো আমি? মণিকাকে আর দেখতে পাবো না। প্রশ্ন করার সময় ওর দু’ভুরুর মাঝে একটা ভাঁজ পড়ে…সেটা আর দেখতে পাবো না। খাওয়া শেষে মণিকাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে।
“খুব টায়ার্ড লাগছে…একটা লং শাওয়ার নিয়েই শুয়ে পড়বো। কাল খুব সকালে উঠতে হবে, মিটিং আছে। ডিনারের জন্য ধন্যবাদ ফরহাদ!“ চাতকের মতো চেয়ে থাকলাম…একটা চুমু কি পেতে পারিনা? মণিকা বুঝলেও এড়িয়ে গেলো। সম্পর্কটা এখন শুধুই কাগজে কলমে। তবে আজই তার মেয়াদ শেষ।
স্নানের ব্যাপারে মণিকা বেশ শৌখিন। বাসা কেনার সময়ে অত্যাধুনিক জ্যাকুজি বসিয়ে নিয়েছে। বিশাল জ্যাকুজি; দুজন সহজেই মুখোমুখি বসা যায়। জলের তাপমাত্রা, কাঁপুনিও নিয়ন্ত্রণ করা যায়। প্রতিরাতেই ঘুমানোর আগে বেশ কিছুক্ষণ জলে গা ডুবিয়ে বসে থাকে মণিকা…এটাই নাকি তার রিল্যাক্সেশন!!
মাংসের বাটিটা প্রায় খালি। দু’এক টুকরো মাংস বেসিনে ফেলে দিয়ে ধুয়ে মুছে বাটিটা তুলে রাখলাম। টেবিল, বাসনপত্র গুছিয়ে মিনিট পনের পরে বাথরুমে ঢুকতেই ল্যাভেন্ডারের সুগন্ধ!! মণিকার পছন্দের রং আর গন্ধ…ল্যাভেন্ডার। জ্যাকুজি্তে বসা মণিকা ঘুমাচ্ছে। সুগন্ধী মোমবাতির মায়াবী আলোতে ওকে দেখাচ্ছে জলকন্যার মতো।
বিছানার ওপরে ওর পার্স উপুর করতেই…ফোন, পেপার স্প্রে, ভাঁজ করা ধারালো পকেট নাইফ!! টিস্যু দিয়ে সাবধানে ধরে ফোনটা আনলক করলাম। মণিকার ফোনের পাসওয়ার্ড আমার জানা। মাইকের নম্বর বের করে টেক্সট পাঠালাম “Feeling extremely guilty…today was our anniversary. Have to end the affair with you. I am so sorry. Have to end all…can’t take it anymore.”
পকেট নাইফের ভাঁজ খুলতেই ধারালো চকচকে ফলা। আমিই কিনে দিয়েছিলাম ওকে…রাতেবিরাতে ফেরার সময়ে প্রোটেকশনের জন্য। নিঃসাড়ে ঘুমাচ্ছে মণিকা। ফর্সা দুটো কব্জি। বাম হাতে্র কব্জির মোলায়েম ত্বকে ধারালো ফলা টানতেই লালরক্তের ফিনকি। একটু মায়া লাগছিলো। একটা হাত কাটার পরে বামহাতে অন্যটা কাটা এলোমেলো, অশক্ত হয়। ডানহাতের কব্জিতে সেই হিসেব করেই একটু এবড়ো খেবড়ো করে কাটলাম।
কাজ শেষ…আলোড়িত গরমজলের ফেনার ভেতর ফেলে দিলাম পকেট নাইফটা… ঘুমের ওষুধের বোতলটার মুখ খুলে উপুড় করে দিলাম। চার পাঁচটা ওষুধ এমনভাবে জ্যাকুজির পাশে মেঝেতে ছড়ালাম যাতে মনে হয় খেতে গিয়ে পড়ে গেছে।
আমি পেরেছি…অবশেষে শান্তি!! বিদায় মণিকা…প্রিয়তমা আমার ভালো থেকো। আহ!! কি শান্তি…
হাতের টিস্যুটা টয়লেটে ফ্লাশ করে দিয়ে হালকা নীল জ্যাকেট চড়ালাম। মার্চের শেষ, রাত বাড়লে এখনো একটু শীত পড়ে। মাইলপাঁচেক দূরে গ্রোসারী শপ থেকে মণিকার পছন্দের ক্যারামেল ডিলাইট আইসক্রিম কিনতে হবে।
জ্যাকুজির পানির রং দ্রুত লাল হয়ে যাচ্ছে। মণিকার অচেতন শরীরটা থেকে রক্ত বেরিয়ে যাচ্ছে। কাজ করে যাচ্ছে মাংসের সাথে মেশানো ওরই ঘুমের ওষুধ…
© শিখা রহমান
(ছবি ইন্টারনেটে সংগৃহীত)
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই জানুয়ারি, ২০২০ বিকাল ৩:২১