ওরা তিনজন। সতেরো পেরিয়ে আঠেরোকে ছোঁয়ার অপেক্ষায়। সেই মায়াবী বয়স, যখন বাড়ির লোকেদের শাসন অসহ্য লাগে আর বন্ধুদের কথা বেদবাক্য। এই বয়স চকিত কটাক্ষের, নিজের কস্তূরীগন্ধে নিজেই উন্মনা হওয়ার সময়।
অরণী, বহ্নি আর রিমঝিম। একই স্কুলে পড়ার সুবাদে চেনা হলেও এক সেকশনে ছিলো না। কলেজে ভর্তি হওয়ার পরে বন্ধুত্ব গাঢ় হয়েছে। কলেজের প্রথম বর্ষ পেরিয়ে এখন ওরা দারুন ভালো বন্ধু। মেয়েদের স্কুলে পড়েছে; আর এই কলেজে ছেলেরাও পড়ে। তবে ছেলেরা পড়ার চাইতে মেয়েই দেখে বেশী। আর মেয়েরা কোন ছেলে কেমন, তাদের হাবভাব, স্মার্টনেস নিয়ে বান্ধবীদের সাথে গল্প করে, আর কখনো কখনো আড়ালে আবডালে পরস্পরের সাথে একটু ছেলেমানুষি প্রতিযোগিতাও করে। আসলে এই বয়সটাই যে এমন!! মনোযোগ আকর্ষণের আর আড়চোখে মুগ্ধতা লক্ষ্য করে উদাস ভাব করে এড়িয়ে যাওয়ার।
তবে এই ত্রিমূর্তির মাঝে তেমন প্রতিযোগিতা নেই। হয়তোবা তিনধরনের বলে ওরা পরস্পরের পরিপূরক। অথবা ওদের পাঠ্যরুচি, গান আর চলচ্চিত্রের পছন্দ অভিন্ন বলেই ওরা ভালো বন্ধু। অরণীর কিছু একটা ক্যারিশমা আছে। ছেলেরা পছন্দ করে আর সহজেই প্রেমে পড়ে, এক তরফা। অরনী দেখতে এমন কিছু নয়; তবে সারাক্ষণই হাসে। এক ঝলক দমকা হাওয়া। হাওয়া যেমন অনুভব করা যায়, অথচ ধরা যায় না তেমনটা।
কলেজে এক ছেলে একবার চিরকুট পাঠাল “You are like the Wind!!” অরনী বড্ড সরাসরি কথা বলে। “এই চিরকুট তুই দিয়েছিস?” চিরকুট পেয়ে কথা বলতেই ছেলে গদগদ “তোমাকে আমার খোলা হাওয়ার মতো মনে হয়।“ “তুই কি আদম?” ছেলে কথার সুরে ঢোক গিলে বলল “বুঝি নাই!!” “তুই আদম না আর তাই হাওয়ার তোর সাথে খোলামেলা হওয়ার কোন চান্স নাই!! খবরদার…আর চিরকুট পাঠাবি না!!” সেই থেকে অরনীকে ওরা ডাকে “হাওয়া বিবি’ বলে। ওদের ভাষায় “হাওয়া বিবির পেছনে বিশাল লম্বা লাইন!! কত্তো ছেলে যে ইটা পেতে রেখেছে!!”
বহ্নি ছটফটে; সারাক্ষণ কথার ফুলঝুরি তোলে। মধুরভাষী; কখনোই কারো মনে কষ্ট দিয়ে কথা বলতে পারে না। সে একটু রক্ষণশীল; নিয়ম মেনে চলে। চশমার কালো ফ্রেমের পেছনে উজ্জ্বল চোখে উদ্বিগ্নতা মেখে সে অরণীকে মাঝে সাঝেই সাবধান করে “তুই না এমন ডাকাবুকো…দেখিস বিপদে পড়বি!!” খোলা হাওয়াকে যে সে পছন্দ করে না তা নয়; তবে খোলা হাওয়াকে সে ভয় পায়।
রিমঝিম বড্ড লাজুক। খুব চুপচাপ; জানতে না চাইলে সে খুব কম সময়েই আগ বাড়িয়ে মতামত দেয় বা কথা বলে। অন্য দু’জনকে দু’একটা প্রশ্ন করলেই যা জানা হয়ে যায়, সেই একই কথা জানতে হলে রিমঝিমকে গোটা দশেক প্রশ্ন করতে হয়। সারাক্ষণ একজোড়া কোমল বিষন্ন চোখ মেলে সে দু’বন্ধুর উচ্ছল কথা শোনে আর ঠোঁট টিপে হাসে।
ওদের কারোরই প্রেম হয় না। অরণীর প্রেম হয় না। কারণ সে বুদ্ধিমতী আর যুক্তিবাদী। অরণী সবার সাথে খুব সহজেই মেশে। সবার কথাই মনোযোগ দিয়ে শোনে অথচ কেউ দাবী করতে পারে না অরণী তাকে বেশী মনোযোগ দিয়েছে। বড় সোজাসুজি কথা বলে; কিন্তু তাকে নিয়ে আড়ালে আবডালে কেউ কানাঘুষা করে না। সে রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় কেউ অসভ্য মন্তব্য করে না। ছেলেরা মেনেই নিয়েছে যে সে অধরা। বহ্নির প্রেম হয় না কারণ সে বাস্তববাদী এবং ভীতু। আর রিমঝিম? সে এতোই চুপচাপ যে যুবককুল তার অস্তিত্বই জানে না।
“এই শোন...চল ‘ঢাকা এটাক’ দেখতে যাই!” সিনেমাহলে রিলিজ হতেই “ঢাকা এটাক” দেখার জন্য অরণীর অস্থিরতা শুরু হলো। “শুনেছি তেমন ভালো হয়নি...প্লটে নাকি অনেক গরমিল!!” বহ্নি বলতেই অরনী বলে উঠলো “প্লট দিয়ে কি করবো? আমিতো যাচ্ছি শুভকে দেখতে...ওকে দেখলে আমার অস্থির লাগে। ওকে কি করতে ইচ্ছা করে বলবো?” রিমঝিম ঠোঁট টিপে হাসছে আর বহ্নির ফরসা গাল লালচে “মুখে লাগাম দে প্লিজ!! ঠিক আছে...কবে যাবি বল।“ টাকাপয়সা ম্যানেজ করার চাইতেও পড়াশোনা, কোচিংয়ের ফাঁকে সময় আর বাসার অনুমতি ম্যানেজ করতেই বেশী ঝামেলা। শেষে আসছে বৃহস্পতিবার কলেজ ছুটির পরপরই দেখার প্ল্যান হলো। সন্ধ্যে নামার আগেই বাসায় ফিরতে হবে।
“আমি যেতে পারবো নারে!! তোরা দু’জনে যা!” বৃহস্পতিবার টিফিনের সময়ে রিমঝিম বলতেই অরনী রেগে গেলো “এত্তো কষ্ট করে প্ল্যান করলাম...কেন যেতে পারবি না শুনি?” “একজন আসবে...” “কে আসবে? তোর ওই ছোট ফুপু...আবার কোন বিয়ের প্রস্তাব এনেছে নাকি? আমারতো মনে হয় ওনার নিজেরই আবার বিয়ে করতে ইচ্ছা করছে...আঙ্কেলকে বলে ওনার বিয়ের ব্যবস্থা করে দেই। যত্তোসব!!” অরনী ঝাঁঝিয়ে উঠতেই বহ্নি থামালো “আহা!! ওকে বলতে দে না..কথা শোনার আগেই এমন রেগে যাস কেন?” “হুহ!! রাগ হবো না...শুভ বলে কথা!!” “চুপ করতো!! এই রিমঝিম...কে আসবে রে?”
রিমঝিম লাজুক মুখে বললো “আকাশ!!” “সেটা আবার কে?” অরনী রাগ ভুলে ফ্রেঞ্চ ফ্রাইয়ে কামড় না দিয়ে জামায় কেচাপ মাখিয়ে ফেললো। “গত ডিসেম্বরে বাবা মায়ের সাথে কক্সবাজারে বেড়াতে গিয়েছিলাম না! তখন পরিচয় হয়েছে। ওর ফ্যামিলিও একই বাংলোতে উঠেছিলো।“ “ওমমা!! বলিসনিতো...নামওতো কি দারুণ মিলিয়েছিস!! আকাশ আর রিমঝিম!!” বলতেই রিমঝিমের লালচে মুখ লজ্জায় আরো নীচু হয়ে যায় “আসলে নামের কারণেই পরিচয়। দু’পরিবারের জানাশোনা হতেই ও বলেছিলো ‘আমাদের বন্ধু না হয়ে উপায় নেই...রিমঝিমের তো আকাশের সাথেই থাকার কথা।‘...” বহ্নি ভীষণ অবাক “তুইতো দেখি পুরোই ডুবে ডুবে জল খাচ্ছিস...জানতেই পারলাম না।“ “ডুবে ডুবে জল খাবে কেন? রিমঝিম তুই এই ছেমড়াকে ঝাড়ির ওপরে রাখবি...জলে কিভাবে সাঁতার কাটতে হয় আমি শিখিয়ে দেব!!”
ত্রিমূর্তির একজনেরতো প্রেম হয়েছে; প্রথম ভালোবাসা সর্বগ্রাসী। কলেজে সময় পেলেই এখন তিনমাথা একসাথে; ফিসফাস, লুকোচুরি গল্প..কোথায় গেলো দু’জনে, কি কথা হলো! উদভ্রান্ত যুবকের দল দীর্ঘশ্বাস ফেলে আশে পাশে ঘোরে; ওদের ভ্রুক্ষেপ নেই। সারাক্ষণ রিমঝিমের কাছে আকাশের গল্প শোনা। আকাশ ওদের বছর দেড়েকের বড়; এইচ এস সি শেষ করে ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ছেলেটা অনেকটাই রিমঝিমের মতো; লাজুক আর অন্তর্মুখী। অদ্ভুত সুন্দর সব কথা লিখে পাঠায় রিমঝিমকে...কাব্যিক গদ্যমালা!!
একটাই সমস্যা। ত্রিমূর্তির বাকী দু’জনের সাথে আকাশ আজও দেখা করেনি; তার নাকি লজ্জা লাগে। আকাশের একটা ছবিও এখন পর্যন্ত ওরা দেখেনি। দু’বাসায় জানে না। ভালো কোথাও ভর্তি হতে পারলে নাকি একসাথে দু’জনে সেলফি তুলবে...তার আগে না। ওরা দু’জন, বিশেষ করে অরনীতো, রেগে অস্থির। এতো কাছের বন্ধুর ভালোবাসার মানুষ, অথচ ওরা মানুষটাকে দেখলো না এখনো। দেখা করতে চাইলেই সে রিমঝিমের কাছে এলোমেলো সব অজুহাত দিয়ে এড়িয়ে যায়। ওদের জোরাজুরিতে অবশেষে আকাশ দেখা করতে রাজী হলো।
“ডুব” দেখতে যাবে ওরা তিনজন আর আকাশ। বহ্নি একটু আপত্তি জানিয়েছিলো “সিনেমা দেখার সময়ে আকাশের সাথে কথা বলবো কিভাবে?” “আরে ধুর!! রিভিউ পড়িসনি...খুবই ঢিমেতালের সিনেমা। চরিত্ররা নাকি পরস্পরের দিকে মিনিট কয়েক ধরে তাকিয়ে থাকে...তখন টুকটাক কথা হবে।“ অরনীর কথা শুনে বহ্নি বললো “তো এমন সিনেমা পয়সা খরচ করে দেখার কি দরকার?” “ইরফান কে দেখার জন্য...বুঝিয়ে বলবো কেন?” “না না...লাগবে না...সমঝদারকে লিয়ে ইশারাই কাফি!!” বহ্নি হড়বড়িয়ে উঠতেই অরনী আর রিমঝিম হেসে গড়িয়ে পড়ে।
“কিরে? কথা হলো?” রিমঝিম মাথা নাড়িয়ে মানা করতেই বহ্নি আর অরনী আর কথা বাড়ায় না। সিনেমার অর্ধবিরতিতে হলের বাইরে গিয়ে আকাশকে ফোন করে এলো রিমঝিম। অনেকক্ষণ আগেই জানিয়েছে যে রওনা দিয়েছে; অপেক্ষা করতে করতে শেষে সিনেমা শুরু হয়ে গেলো। এখন “ডুব” মাঝপথে, তাও আকাশের দেখা নেই। রিমঝিম কয়েকবার মেসেজ দিয়েছে, কল করেছে। মেসেজের উত্তর নেই, ফোনও ধরছে না।
সিনেমা শেষ হওয়ার পরে ফুডকোর্টেও ওরা বেশ কিছুক্ষণ থাকলো। কিন্তু সন্ধ্যা ছয়টার মধ্যে বাসায় ফিরতে হবে। রিমঝিম খুব মনখারাপ করেছে, মলিন মুখ। ওদের দু’জনেরও খুব খারাপ লাগছে। রিমঝিমকে এড়িয়ে অরনী ফাঁকতালে বেশ কয়েকবারই গজগজ করেছে “বদ পোলা!! বলে দিলেই হতো আসবে না!!” বহ্নির শাসানিতে চুপ করেছে।
পরেরদিন রিমঝিম কলেজে এলো না; ওরা একসাথে একটা কোচিংয়ে যায়, সেখানেও না। তার পরের দিনও রিমঝিমের খবর নেই। ফোন বন্ধ; মেসেঞ্জারেও চুপচাপ। দুজন ঠিক করে ফেলে যে আগামীকাল রিমঝিমের বাসায় যাবে। আজ কোচিংয়ে গিয়ে দেখে রিমঝিম সেখানে। পড়া শেষে ধারেকাছেই একটা ক্যাফেতে বসলো ওরা তিনজন; এখানে মাঝেমাঝে কফি বা মিল্কশেক খেতে আসে ওরা।
রিমঝিমকে দেখে মনে হচ্ছে ওর ওপরে ঝড় বয়ে গেছে। একটু উস্কোখুস্কু চুল; মলিন মুখ; সেই ঠোঁটটেপা নীরব হাসি নেই; দুচোখে বিষন্ন শুন্যতা। দুজনে উৎসুক চোখে তাকাতেই “ও নেই!!” “কে?” “আকাশ নেই। সেদিন রওনা দিয়েছিলো ঠিকই। বাস থেকে নামার সময়ে এক্সিডেন্ট করেছে।“ ওর খুব কাছের বন্ধুরা আমার কথা জানতো...সেদিন রাতে জানিয়েছে।“ রিমঝিমের গলা কান্নায় বুজে এলো “দেখতেও যেতে পারিনি জানিস? বাসায় জানে না...আর দেখেই বা কি হবে বল!!”
রিমঝিমের হাতের আঙ্গুল আঁকড়ে ধরলো ওদের আঙ্গুল। রিমঝিমের মাথা নীচু; টুপটাপ ঝরে পড়া জল শুষে নিচ্ছে ম্যাটম্যাটে বাদামী নিউজপ্রিন্টের খাতা; ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে নীল বলপয়েন্টের অক্ষরেরা। তিনটা শরীর পরষ্পরকে পরম মততায় ছুঁয়ে থাকলো অনেকক্ষণ। শব্দেরা যা বলতে পারে না, স্পর্শ তা বলে দেয় অনেক সময়েই।
বিকেল মরে আসছে; বাসায় ফিরতে হবে। “এগিয়ে দেই কিছুদূর...আমার বাসাতো তোর বাসার দিকেই।“ অরনী বলতেই রিমঝিম মানা করলো “নাহ!! আমি একাই যাই আজ।“ রাস্তায় নেমে রিক্সা ঠিক করে দু’জনে রিমঝিমকে তুলে দিলো।
রিমঝিমের চোখে নোনাজলের বর্ণহীন কাজল। “আমাকে ক্ষমা করে দিও আকাশ!! ক্ষমা করে দিও। তোমাকে কখনো দেখিনি; অথবা কে জানে দেখিনি বলেই হয়তো আসলেই দেখেছি। অরণীর এতো ভক্ত, এতো গুণমুগ্ধ!! খুব ইচ্ছে করেছিলো কেউ থাকুক, কোথাও কেউ থাকুক আমার জন্যেও। মিথ্যে বলিনি…কল্পনাতে তো ছিলে আকাশ!
ঠিক আর ভুল…এই বিস্তীর্ণ হিসেবী প্রান্তর পেরিয়ে যে তিতিরকান্নার মাঠ আছে, যে অরুণ বরুন কিরণমালার দেশ আছে…সেই রূপকথার রাজ্যের দেশের বাসিন্দা হয়ে আছি আমরা। সে মাঠের সবুজ মখমলী ঘাসে রেশমী রুমাল বিছিয়ে চিনেবাদামভাজা, ঝালমুড়ি আর মাটির ভাঁড়ের চায়ে চুমুক দিয়েই তো আমাদের যত অন্তহীন কথোপকথন, শব্দমালার রিনরিন আর বন্ধুত্বের রোদ্দুররেখা।
বুঝিনি যে কল্পনার জগত বাস্তবকে এমন এলোমেলো করে দেবে। ক্ষমা করে দিও!! আমার অহংকার নেই, জেদ নেই, মান অভিমান নেই, রাগ নেই, হিংসে নেই!! আমার তো সবই আছে, কমতি পড়েনি কিছুর। শুধু কোথাও নিজে ওড়ার একটা আকাশ ছিল, শুধু আজ সেটাই নেই হয়ে গেছে।“
© শিখা রহমান
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই নভেম্বর, ২০১৯ দুপুর ২:২৩