ভুমিকম্প হচ্ছে নাকি? শরীর ঝাঁকি দিচ্ছে; সৌম্য ঘুমের চোটে চোখ খুলতে পারেছে না। অনেক কষ্টে চোখ খুলতেই দেখলো একটা ছায়ামূর্তি ওর ওপরে ঝুঁকে আছে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই মানুষটা ওর কাঁধ ঝাকিয়ে উদ্বিগ্ন স্বরে বললো “বাবু...এইইই বাবুউউ...”
- উফফ!!! বাবা...কি হলো? দিলেতো ঘুমের বারোটা বাজিয়ে...এখন কটা বাজে?
- রাত পোনে তিনটা!! ওঠ শিগগীরই ...এই বাবুউউ!!!
- ইশশ্ রে ...মাঝ রাতে কেন উঠবো? যাওতো...একটু ঘুমাই।
- তুই বুঝতে পারছিস না...একটু পরেই গোলাগুলি শুরু হবে...আমাদের রান্নাঘরের পাশের করিডোরে শেল্টার নিতে হবে...
- বাবা...যাওতো তুমি...যত্তোসব!! প্রতিদিন রাতে ঘুম নষ্ট!!!
- বাবু...লক্ষী বাবা আমার...এভাবে জানালার পাশে শুয়ে থাকলে পাকিস্তানীদের গুলি খেয়ে মরবিতো...
- বাবা!!! কত্তো বার বলবো? এটা ২০১৬ সাল... ১৯৭১ না...
- তুই ছাড়া আমার কে আছে বলতো!!! স্বাধীন কথা শুনলো না... দ্যাখ না ওকে রাজাকাররা ধরে নিয়ে গেলো...
বাবাকে ও আজ নিজের হাতে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে শুতে এসেছে; ডাক্তার যে কি প্রেসক্রাইব করলো? নাকি মানুষগুলোর মতো ওষুধেও ভেজাল...কে জানে!! সৌম্য জানে এখন ওকে উঠতেই হবে; না হলে বাবাকে শান্ত করা যাবে না। গত একমাস ধরে বাবা না নিজে ঘুমাচ্ছে না ওকে ঘুমাতে দিচ্ছে। জেগে থাকলেই সৌম্যর প্রচন্ড রাগ হতে থাকে; অনেক কষ্টে রাতে যখনি একটু চোখ লেগে আসে তখনি বাবার স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু। শালা!! কি যে একটা বাঞ্চোত জীবন!! শ্বাসের নীচে বিড়বিড় করে নিজেকে অশ্রাব্য কিছু গালি দেয় ও; রাগের চোটে মুখে থুতু জমে গেছে। সৌম্য বিছানায় উঠে বসে; গ্রীলের ফাঁক দিয়ে তীব্র ঘৃনা নিয়ে থুতু ফেলে।
বাইরে ল্যাম্পপোষ্টের আলো; জানালার বাইরে তাকাতেই গলির মাথাটা আলো আঁধারিতে চোখে পড়লো। মাসখানেক আগে ঠিক ওই খানটাতে লাল আর লাল; স্বাধীনের শরীরে এত্তো রক্ত ছিলো!! গলায়, ঘাড়ে কি গভীর জখম!!! আর একটু হলেই মাথাটা শরীর থেকে আলাদা হয়ে যেত!! সবাই বললো চাপাতির দাগ; কি ভাবে জানবে সৌম্য? ওতো কোনদিন মানুষকে চাপাতি দিয়ে জবাই করতে দেখেনি। তবে গরুকে দেখেছে; ভাইয়াকে কি ওরা গরুর মতোই মাটিতে ফেলে কুপিয়ে ছিলো? উহহহ্...এই জন্যই সৌম্য জেগে থাকতে চায় না...এই জন্যই!! এখন ওর ইচ্ছা করছে কোপাতে; একটা চাপাতি থাকলে সৌম্যও কোপাতো। জানতে ইচ্ছা করে চাপাতি যখন মাংসের মাঝে ঢোকে কেমন শব্দ হয়? ঘচাৎ? নাকি মোলায়েম নরম ঝপ? ফিনকি দিয়ে রক্ত ছোটা দেখতে কেমন লাগে? সৌম্যর তীব্র রাগ হচ্ছে। কোপানোর পরে কি শান্তি লাগে? রাগ কমে?
“বাবুউউউ...কি ভাবিস...ওঠতো...” সৌম্য উঠলো; করিডোরে বাবার হাত ধরে বাকিরাত মেঝেতে বসে থাকা। বাবা এসময়টা ফিসফিস করে এলোমেলো গল্প করে; মায়ের সাথে বিয়ের গল্প; স্বাধীনের গল্প; মুক্তিযুদ্ধের গল্প; সব হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলো অন্ধকারে ভিড় করে। এসময়টা সৌম্যর খারাপ লাগে না; মনে হয় সব কিছু আগের মতোই আছে। বছরখানেক আগে হারিয়ে যাওয়া মা এক্ষুনি রান্নাঘরে হাঁড়ি পাতিল নাড়বে “বাবুউউউ...আজ তোর পছন্দের বুটের ডাল রেধেছি...বাইরে খেয়ে আসিস না যেন!!” পাশের ঘর থেকে ভাইয়া বেরিয়ে এসে বলবে “কিরে সমু...আজ শেভ করলি যে...কারো সাথে দেখা করবি নাকি? তোকেতো হেব্বি জোশ লাগছে রে!! পাত্তি লাগবে? লাগলে বল...”
ভোরের আলো ফুটলেই বাবার ভয় কমে যায়। বাবা ঘুমিয়ে পড়ে কিন্তু সৌম্যর ঘুম আসে না; খালি রাগ হতে থাকে; ইচ্ছা করে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে সব ফালা ফালা করে দেয়। দুপুরের দিকে কলিং বেলের আওয়াজ; সৌম্য দরজা খুলতেই পাশের বাসার খালাম্মা দাঁড়িয়ে।
- আজ গরুর মাংস রান্না করেছিলাম...ভাবলাম তোমাদের একটু দেই...তোমাদের ছুটা বুয়াতো কয়েক দিন ধরে আসছে না...”
গরুর মাংস শুনতেই সৌম্যর মনে পড়লো; চাপাতি, গরু, চাপ চাপ রক্ত।
- আমাদের লাগবে না...বাসায় খাবার আছে।
- তাতে কি হয়েছে? ফ্রিজে রেখে দাও...পরে খেয়ো!
- প্লিজজ!! আপনি যানতো! বল্লাম না লাগবে না!!
সৌম্যর আবারো প্রচন্ড রাগ হচ্ছে। খালাম্মার মুখ ওর কথার ভঙ্গীতে লালচে হয়ে গেলো; বোঝাই যাচ্ছে উনি খুব অপমানিত হয়েছেন। ফিরে যেতে যেতে বিড়বিড় করে বললেন “এইসব কাফেরদের খাবার দিতে আসাই ভুল হইছে...এমনি এমনিতো কেউ খুন হয় না...ইন্টারনেটে আজে বাজে কথা লিখলেতো এরা মরবেই...”
সৌম্যর হঠাৎ করেই খুব ক্লান্ত লাগছে; এইসব কথা যে ও কতোবার কতো মানুষের কাছে শুনলো। ও, বাবা, ওরাতো আর বিচার চায় না। আইনের কাছেতো কখনোই কিছু আশা করেনি; কিন্তু মানুষের আদালত যে ওদের অপরাধী করবে সেটা হিসাবে ছিলো না!!! মানুষগুলো কেমন অচেনা হয়ে গেছে; একরাতে এক মুহূর্তে চেনা পৃথিবী বদলে গেছে। সৌম্য শুধু স্বাধীনকে হারায়নি; বাবাকে হারিয়েছে; চেনা মানুষগুলোকেও। চাপাতির কোপ থামেনিতো...ঝপাঝপ... ঝপাঝপ...এখনো চলছে!!
বিকেলের আলো মরে আসছে; সারাদিন ও বাসায়। ইদানিং কোথাও যেতে ইচ্ছা করে না; কোথায় যাবে? কার কাছে? মানুষগুলো কেমন অদ্ভুত চোখে ওর দিকে তাকায়...মনে হয় সৌম্যর হাতেই চাপাতি। ফোন বাজছে; কে করলো? তাও আবার বাসার ফোনে? ইদানিংতো ল্যান্ড ফোনে কেউ কল করে না!! বাবা ঘুমাচ্ছে, উঠে না যায়!! সৌম্য তাড়াতাড়ি ফোন ধরলো। ওপাশে বড় চাচার গলা।
- কে সৌম্য? কেমুন আছো? চাচা বলতেসি...তুমার বাবা কই? তারে ফুন দাও...
- বাবা ঘুমাচ্ছে...এখন দেয়া যাবে না।
সৌম্য ওর বড় চাচাকে খুবই অপছন্দ করে; অত্যন্ত ধুরন্ধর লোক; উপজেলা চেয়ারম্যান। বাবার মাঝে মাঝে কথা হলেও উনার সাথে সৌম্যর সাথে খুব একটা কথা হয়না।
- ডাইকা দেও...একটু দরকারী কথা আসিলো...
- ঘুম ভাঙ্গানো যাবে না...বাবার শরীর ভালো নেই...
- অ...তা হইলে তুমারেই বলি...শরীরের আর দোষ কি? এমুন একটা ঘটনা হইলেতো শরীর মন সবই খারাপ হবার কতা...
সৌম্যর আবারো রাগে মুখ তিতা লাগছে...ঘটনা!! একটা ঘটনা? ভাইয়াকে ওরা কুপিয়ে মেরে ফেললো...সবাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলো...এটা নিছকই একটা ঘটনা? গরু জবাইয়ের মতো খুবই সাধারন প্রত্যাহিক ঘটনা!!
- কি বলবেন তাড়াতাড়ি বলেন...আমার একটু কাজ আছে...
- শোন...আমি শুনলাম যে তোমরা নাকি বলতেসো যে বিচার চাও না...ক্যান বলতো? ভিতরের ঘটনা কি?
- ভিতরের ঘটনা মানে কি?
- মানে নিজের দলের লুকেরাই কি মারছে নাকি? বিচার চাইলে কি নিজেরাই ফাসবা? এই নিজেরা নিজেরা মারামারি কইরাই দ্যাশটা শেষ হইলো!!
সৌম্য ঠাস করে ফোন রেখে দিলো; ফোন সেটটা মেঝেতে আছড়ে ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে ভাবলো একটা চাপাতি না কিনলেই নয়।
মাঝরাতে বাবা আবারো ডেকে তুললেন “জানিস বাবু...মিলিটারীরা ট্যাঙ্ক নিয়ে শহরে ঢুকে পড়েছে.....এক্ষুনি গোলাগুলি শুরু হবে...তাড়াতাড়ি ওঠতো!!” সৌম্য আজ বাবাকে বকলো না; ক্লান্ত স্বরে বললো “বাবা দেশটা কবে স্বাধীন হবে? আর যুদ্ধ ভালো লাগছে না...একাত্তরে জানতাম কাদের সাথে লড়ছি...এখন যে শত্রুদের চিনতে পারছি না...”
© শিখা রহমান
বিঃদ্রঃ সবাইকে বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা। গল্পটা বছর দুয়েক আগে লেখা। আমার নিজের প্রিয় এই গল্পটা। আর এই গল্পটা নাটক হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে মঞ্চস্থ হয়েছে ২০১৬ সালে।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ বিকাল ৩:৩৪