দিনটা সবে আড়মোড়া ভেঙ্গেছে। নাস্তার টেবিলে বসে মায়ের দিকে তাকিয়ে মনে হলো মন খুব খারাপ; চোখের কোল একটু ফুলেও আছে; কান্নাকাটি করেছে মনে হয়। স্কুলড্রেস পরে বিদায় নিতে যেতেই মা বললেন “সেঁজুতির মা মারা গেছেন।“ “কি বলো!!! কখন?” “কাল রাতে।“ বনানী থেকে আজিমপুরে স্কুল পর্যন্ত পুরোটা সময় আমি অবিশ্বাসের দোলাচলে। এইটে পড়া সদ্য কিশোরী হওয়া এই ক্ষুদ্র জীবনে আমার সব বন্ধুদের জীবন ছবির মতো সাজানো। ক্লাসের ফাঁকে যখন জানালা দিয়ে বাইরের সবুজ মাঠে চোখ রাখি অনেক দূরে তেপান্তর পেরিয়ে আসা অশ্বারোহী রাজপুত্র ধুলো ওড়ায়; স্কুলের পাশে পুকুরের টলটলে জলের দিকে তাকালে মনে হয় এই জলে ডুব দিলে পাওয়া যাবে লালকমল আর নীলকমলের সেই কৌটা যেখানে সব প্রিয় মানুষদের প্রানভোমরা লুকানো আছে। জীবনটা রুপকথার মতো সুন্দর ছিলো; হঠাৎই সুর কাটলো।
স্কুলে সেদিনটা অন্যসব দিনের মতোই ছিলো; ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে বন্ধুদের সাথে গল্প; টিফিনের সময় মাঠে গোল হয়ে বসে পিছনের গেট দিয়ে কেনা কদবেল কাঠি দিয়ে খাওয়া। শুধু আমারই বার বার ছন্দপতন হচ্ছিল; বোঝার চেষ্টা করছিলাম মাকে ছাড়া একজন মানুষ কিভাবে থাকবে। সেঁজুতি সেদিন স্কুলে আসেনি। সেঁজুতির কথা আমাকে কেউ জিজ্ঞাসাও করেনি। ভালো বন্ধু হলেও স্কুলে আমাদের বন্ধুদের দল আলাদা; সেঁজুতি বা আমি স্কুলে কখনোই কাউকে বলিনি যে আমরা কতো কাছের বন্ধু...কেন কে জানে?
ক্লাস সিক্সে ওঠার পরে আমি বনানীতে চলে গিয়েছিলাম, যদিও স্কুল বদলাইনি। সেঁজুতিদের বাসা সেন্ট্রাল রোডে যে বাড়িতে ভাড়া থাকতাম তার দু’বাড়ী পরে। বাড়ীওয়ালার তিন মেয়ে, লিপি, লিজু আর মুন্নি, আমার সার্বক্ষণিক খেলার সঙ্গী। তারপরেও মাঝে মাঝে সেঁজুতিদের বাসায় খেলতে যেতাম, যখন বাড়ীওয়ালার মেয়েগুলোর সাথে কনেআঙ্গুল ছুঁইয়ে আড়ি হতো বা ওদের পড়া, পরীক্ষা থাকতো অথবা মাঝে মাঝে যখন ওদের সাথে খেলা একঘেঁয়ে লাগতো।
সেঁজুতিরা তিন ভাই বোন; তিন বছরের বড় সৌরভ ভাইয়া, মাঝে সেঁজুতি আর দু’বছরের ছোট স্নিগ্ধা। ওদের বাসাটা অন্যরকম ছিলো; বড্ড বেশী চুপচাপ আর ছিমছাম। আন্টি খুব গোছানো; ওরা কখন খাবে, ঘুমাবে, পড়বে সব ঘড়ি ধরে ঠিক করা। আমি বড় হয়েছি একটু রুটিন ছাড়া, বন্ধনহীন, বন্য ভাবে। বাবা মা দু’জনেই চাকরী করতেন; আমি সারাদিন কোথায় কি করছি এসব নিয়ে ওনাদের তেমন মাথাব্যথা ছিলো না। সূর্য ডোবার পর বাসায় ফিরলে আর পড়াশুনোয় ভালো করলেই সব ঠিক আছে।
সারা পাড়া আমার জ্বালায় অস্থির থাকলেও আন্টি আমাকে বেশ আদর করতেন; আসলে আমি যে সবসময় ক্লাসে প্রথম তিনজনের মধ্যে থাকতাম। দেখা হলেই জানতে চাইতেন কখন পড়ি, দিনে কতক্ষন পড়ি, কোনদিন কি সাবজেক্ট পড়ি। আমি বানিয়ে বানিয়ে উত্তর দিতাম; কাউকে বুঝি বলা যায় যে আমি পরীক্ষার আগে ছাড়া বা মায়ের বকা না খেলে একদমই পড়ি না!!! ওদের বাসায় খেলতে যেতে হতো বিকেল চারটার পরে। তার আগে ওরা দু’বোন স্কুল থেকে এসে খাবে, ঘুমাবে, রোদ পড়ে এলে তারপরে খেলা। সূর্য ডোবার আগে পর্যন্ত খেলা যেতো, তবে মাঝে মাঝে আন্টি সেঁজুতি রেজাল্ট ভালো না করলে পড়ার জন্য খেলার সময় কেটে নিতেন।
আন্টি ওনার জীবনের মতোই খুব সাজানো গোছানো ছিলেন। আংকেল বিজনেস করতেন; বিকেলে বাসায় ফেরার সময় হলেই আন্টি শাড়ী বদলে টিপ দিয়ে চা নাস্তা ঠিকঠাক করতে ব্যস্ত হয়ে পড়তেন। আন্টিকে দেখলে আমার সবসময় প্রাচীন আমলের ঝাড়লন্ঠনের কথা মনে পড়তো বা খুব সুন্দর কারুকাজ করা পুরোনো রাজবাড়ীর কথা। খুব সুন্দর ছিলেন উনি; বড় বড় চোখ, একটু চাপা রং, পাতলা ঠোঁট, অভিজাত নাক; দেখলে মনে হতো মানুষটা ষাটের দশকের, ভুল করে এ সময়ে জন্মেছেন। সামান্য পৃথুলা; ওনার রাজকীয় ভাবের সাথে সেটা মানিয়ে গিয়েছিলো। কথাও বলতেন বেশ সুন্দর করে থেমে থেমে, মনে হতো প্রত্যেকটা শব্দ খুব যত্ন করে ভেবে বলছেন। এই হড়বড়িয়ে কথা বলা আমি ওনার সাথে কথা বলার সময় সুন্দর করে শ্বাস নিয়ে বলতাম। কে জানে উনি হয়তো সেই সব মানুষদের মধ্যে যারা আশেপাশের সবকিছুই সুন্দর করে দেয়!!
আর সেঁজুতি!! ও সুন্দর ছিলো, তবে অন্যরকম সুন্দর। মায়ের মতোই বড় বড় পাপড়ি ঘেরা চোখ, একটু পুরু ঠোঁট, মাথা ভর্তি ঘন কালো পিঠ ছোঁয়া চুল। তেল দিয়ে মোটা মোটা দুটা বেনী করে ফ্রক পড়ে যখন মাঝে মাঝে আমাদের বাসায় খেলতে আসতো কি যে মিষ্টি দেখাতো। সেঁজুতি বেশ শ্যামলা ছিলো, কালো ঘেঁষা। কিন্তু আলো আলো বা গম রঙ্গা হলে ওকে মানাতো না। ওর দিকে তাকালেই আমার ছায়াঘেরা টলটলে শান্ত দিঘীর কথা মনে পড়তো। আন্টির চোখে এক ধরনের প্রখরতা ছিলো; বড্ড বনেদী, কাছে যেতে ইচ্ছে করতো না; মনে হতো দূর থেকে দেখতে বেশ লাগছে। কিন্তু সেঁজুতিকে দেখলেই ওর পাশে বসতে ইচ্ছা করতো; কি যে ছায়াময় মায়াময় দুই চোখ!!!
সেঁজুতিকে আমি আমার মতো করে ভালোবেসেছিলাম। কিছু কিছু মুখ আছে যাদের দিকে তাকালে না জেনেই হৃদয় হেঁটে যায়, ওর ঠিক তেমনটা গ্রীষ্ম-ময় ত্বকে তরমুজের মত সুশীতল মুখ। মাঝে মাঝে মনে হতো ইশশ্ কেন যে ওর মতো মিষ্টি আর শান্ত হলাম না। পরক্ষনেই এসব ভুলে গিয়ে বন্ধুদের সাথে ছাদের কার্নিশে লাইন ধরে হাঁটা, চুপিচুপি পাশের বাসার ছাদে উঠে রোদে শুকাতে দেয়া আচার খেয়ে শেষ, বাসার পেছনের দেয়াল টপকে মাঠে গিয়ে যে ছেলেটা কাল লিপিকে ধাক্কা দিয়েছে ওকে গুলতিতে ইটের টুকরো মেরে ভোঁ দৌড়।
ক্লাস ফাইভে তখন ষান্মাসিক পরীক্ষা শেষ; গরমের ছুটি চলছে। যথারীতি আমরা চার পান্ডব ছাদে মহা তুলকালাম করছি; সেদিন আবার আমাদের সাথে আয়েশা খেলতে এসেছে। পেছনের মাঠের ডানপাশে একটা কুৎসিত নীলসবুজ পাচঁতলা বিল্ডিং আছে, সেখানে আয়েশা থাকে। ওর বাবা এই অট্টালিকার মালিক বলে উঠতে বসতে শুনতে হয় যে ওরা খুব বড়লোক; মেয়েটা একটু ঝগড়াটি আর হিংসুটে কিন্তু বোকা বলে ঝগড়া করতেও আমাদের মজা লাগতো।
বাবা সেদিন বাসায় কাজ করছেন; ড্রয়িংরুমে মস্ত সাদা টেবিলের ওপরে কাগজ বিছিয়ে আকাঁবুকি। টেবিলটার দু’পাশে সুতো টানা; সে সুতোর ওপরে ভর করে স্কেল ওপর নীচ করে। কয়েকদিন বকা খেয়েছি ওই স্কেল টানাটানির জন্য। বাবা বেশ ব্যস্ত; একটু পরে ছাদ থেকে ডেকে পাঠালেন। দোতলায় আমাদের বাসার ওপরেই ছাদ; খুবই দুপদাপ আওয়াজ করছি; খেলতে মানা করলেন। একটু মন খারাপ করে ঘরে যেয়ে ভাবছি কি করবো।
যখন মোটামুটি ঠিক করে ফেলেছি যে এখন রান্নাঘরে যেয়ে বুয়াদের বিরক্ত করবো তখনই বাইরের দরজায় কলিংবেলের আওয়াজ; উঁকি মারতেই দেখি বাবা দরজায়, আমাকে ডাকলেন। আয়েশা কেঁদে কেঁদে বিচার দিচ্ছে যে আমি ওকে ছাদে আটকে রেখে চলে এসেছি; ছাদের দরজার ছিটকিনি বাইরে থেকে আটকে দিয়েছি। এমন না যে এই কাজটা করতে আমার আপত্তি থাকতো বা আগে করিনি কিন্তু বাবা যখন আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন তখনতো ওরা চারজন ছাদে খেলছে। কিছু বলার আগেই গালে চড়; বাবা কাজে বারবার ব্যাঘাত হওয়ায় বেশ বিরক্ত।
চড় খাওয়া আমার জন্য প্রত্যাহিক ব্যাপার; গতকালইতো গাছ বেয়ে উঠে পাশের বাসার টিনের চালে নেমে ধুমধাম আওয়াজ করার জন্য মার খেয়েছি। কিন্তু চড় খেয়ে চোখ তুলেই দেখি সিঁড়ি দিয়ে সেঁজুতি আর স্নিগ্ধা উঠছে। বড্ড অপমান লাগলো; ওদের ঘরে নিয়ে গেলাম। ওরা আসলে বাইরে কম খেলা হয় আর ছাদেতো একদমই না; আন্টি ছাদে খেলা পছন্দ করেন না। সেদিন এতো মন খারাপ ছিলো যে হাসতে পারছিলাম না। সেঁজুতি বুঝতে পেরেছিলো; ও কথা না বাড়িয়ে বললো “শিখা...আসো ক্যারাম খেলি।“ মেঝেতে ক্যারাম বোর্ড পেতে খেলা শুরু; আমি আর সেঁজুতি খেলছি; স্নিগ্ধা পকেটে পড়া গুটির হিসাব রাখছে।
চুপচাপ মাথা নীচু করে খেলছি; একসময় বোর্ডের কালো কিনারার ওপরে ফোঁটা ফোঁটা জল। নিঃশব্দে কাঁদছিলাম; এতো মন খারাপ হয়েছিলো যে অনেক চেষ্টা করেও কান্না থামাতে পারিনি। স্নিগ্ধা একটু পরে খেয়াল করলো “ওমা!! পানি কেন? শিখাপু তুমি কি কাদঁছো?” কান্না না থামাতে পারার লজ্জায় আমার মাথা আরো নীচু হয়ে গেলো। “আহ্ স্নিগ্ধা...চুপ করো...শিখার মন খারাপ দেখছো না!!!” মাথা তুলতেই দেখি কি মায়াময় দুঃখী দুঃখী দুটো চোখ আমার দিকে তাকিয়ে আছে; সে চোখে ভৎসনা নেই, করুনা নেই। সেঁজুতিকে আমি শুধু সেই মুহূর্তটার জন্য ভালোবেসেছিলাম; কারো চোখে যখন আমার কষ্টে পাতলা জলের পর্দা তিরতির করে কাঁপে তাকে কি ভালো না বেসে পারা যায়?
আন্টি মারা যাওয়ার পরে সেঁজুতি আর স্নিগ্ধা বনানীতে আমাদের বাসায় এসে মাঝে মাঝেই থেকেছে। প্রথমবার থাকতে এলো আন্টি মারা যাবার মাস তিনেক পরে। আমি খুব ব্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম কিভাবে ওদের দুজনের মন ভালো রাখবো; এক মুহূর্তও একা থাকতে দেইনি; সারাক্ষন বকবক করেছি। সেঁজুতি বারবার ঠোঁট চেপে হাসছিলো; মনে হচ্ছিল ও বুঝতে পারছে যে আমি বড্ড বেশীই হাসিখুশী ভাব করছি। দুজনেই জানি যে সবকিছু ছাপিয়ে কারো না থাকাটাই বারবার মনে পড়ছে।
সেদিন রাতে খুব জোছনা ছিলো। সারা বিছানায় ফিনকি ফোঁটা জোৎস্না; গরমের রাতে বৃষ্টি শুরুর আগে ঠান্ডা হাওয়ায় মশারী উড়ছিলো সমুদ্রগামী জাহাজের পালের মতো। স্নিগ্ধা ঘুমিয়ে গেছে; আমরা দুজন এটা সেটা এলোমেলো গল্প করছিলাম, মাঝে মাঝে টুকরো হাসি। সেঁজুতি হঠাৎই বললো “আম্মুর জন্য খুব কষ্ট হচ্ছে!!!” কাচভাঙ্গা চাঁদের আলোয় ওর অদ্ভুত সুন্দর চোখ দিয়ে নিঃশব্দে কষ্ট ঝরছিলো। হাত ধরতেই ও আঙ্গুলগুলো জড়িয়ে নিলো; সেঁজুতি আর একটা শব্দও বলেনি। তরল পারদে ডুব দিয়ে আমরা দু’কিশোরী সেদিন চুপচাপ কষ্ট ভাগ করে নিয়েছিলাম।
আমি এখনো কিশোরীবেলার মতোই অভিমানী। আহত বাঘ যেমন তার ক্ষতস্থান বসে বসে চাটে ঠিক তেমনি অবসরে বা রাতের অন্ধকারে আমি আমার দুঃখ আর অভিমান গুলোর পসরা খুলে বসি। এখনো কারো সামনে আমি কাঁদতে পারি না। রাতের আধাঁরে যখন চুপচাপ বালিশ ভেজাই এক মায়াবতী কিশোরীর আঙ্গুল আমার হাত জড়িয়ে থাকে; শ্যাওলা সুশীতল এক কিশোরী মুখ তার দুটো চোখে আমার কষ্টে দুঃখের ছায়া ফেলে।
আমি সেঁজুতিকে হারিয়ে ফেলেছি। সেঁজুতি তোকে বলা হয়নি, হয়তো কখনোই বলা হবে না যে তোকে আমি কেমন ভালোবেসেছিলাম, কতো ভালোবেসেছিলাম। তুই আমার ছায়াময় অতীত যে আমার সঙ্গে বাস করেনা; কিন্তু সেখানে বসত করে আমার অনুভব, আমার অভিমান, আমার কষ্ট।
© শিখা রহমান
বিঃ দ্রঃ লেখাটা যখন লিখেছিলাম তখন তোমার সাথে পরিচয় হয়নি। কোন কোন মানুষকে মনে হয় অনেক আগে থেকে চিনি, তুমি তেমনটাই। শব্দে-লেখায়-কবিতায় মনে হয়েছিলো তোমাকে চিনি, মুখোমুখি দেখা হওয়ার পরে নিশ্চিত হলাম যে তোমাকে জানি। আদরের মিথীমনি এই লেখাটা তোমাকে দিলাম। তুমি নিশ্চয়ই পড়ে বুঝতে পারবে কেন এই জীবনের গল্প তোমাকে মনে করিয়ে দেয়। ভালো থেকো ভালবাসায় প্রিয় মিথীমনি। এত্তো আদর!!
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই নভেম্বর, ২০১৮ সকাল ১১:০০