আজ থেকে পাওয়া যাচ্ছে জসিম বুক হাউজ আম্বরখানা পয়েন্ট সিলেটে। মাহমুদুল হাসান উজ্জ্বল এর রচনায়। সিলেটের নিজস্ব ভাষা ও নিজস্ব নাগরি বর্ণে #গানে_গানে_ছিলটি_ভাশার_নাগরি_আনদোলন শিরোনামের গীতিগ্রণ্হ।
এই গীতিগ্রন্থটি নিয়ে আমার কিছু আলোচনা।
মনের ভাব প্রকাশের জন্য বাকযন্ত্রের সাহায্যে উচ্চারিত অপরের বোধগম্য ধ্বনি বা ধ্বনি সমষ্টির নাম ভাষা। মনের কথা লিখে প্রকাশ করার জন্য যে সকল সাংকেতিক চিহ্ন ব্যবহার করা হয় সেগুলোকেই বর্ণ বলা হয়।সাধারণ'তো আমরা সকলেই ভাষা ও বর্ণ কাকে বলি এভাবেই জানি।বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত একটি বৃহৎ বিভাগের নাম হলো সিলেট বিভাগ।আমরা জানি এই সিলেট বিভাগের মানুষদের একটা মাতৃভাষা আছে যার নাম সিলেটি ভাষা।এবার আশ্চর্যের বিষয় হলেও সত্য এই সিলেটি ভাষার একটি লিখিত লিপি আছে আর তা হলো নাগরি লিপি।
সিলেটিরা তাদের ভাষায় কথা বলে লিখতেও পারে তাদের নিজস্ব লিপিতে। দুঃখজনক ব্যাপার হলো এই লিপিটির ইতিহাস ছয় কিংবা সাত'শো বছরের পুরনো হলেও এই লিপিটি প্রায় বিলীনের পথেই ছিল।হারিয়ে গিয়েছিল কালের গহব্বরে।অথচ এই লিপিতে সিলেট অঞ্চলে জন্ম নেয়া অনেক বড় বড় কবি, দার্শনিকদের প্রাচীনতম লেখা পাওয়া যায়।যা পূর্বে ও বর্তমানে অনেক প্রসিদ্ধ। তার মধ্যে পুঁথি অন্যতম। যুগে যুগে একটি দেশ বা জাতির ইতিহাস ঐতিহ্যের অনুপ্রেরনা ঐ জাতিকে নিয়ে গেছে সাফল্যের চরম শিখরে । আর একটি সফল জাতির কোন মূল্যবান ইতিহাস বা ঐতিহ্য বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া ঐ জাতির জন্য চরম লজ্জা ও অপমানজনক ব্যাপার। ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতা যুদ্ধে বিজয়ী এক গৌরবান্বিত জাতি হিসেবে আমরা সিলেটিরা কখনো হারিয়ে যেতে দিতে পারিনা আমাদের সমৃদ্ধ কোন ঐতিহ্যকে। কিন্তু এটি চরম সত্য যে সিলেট তথা পুরো বাংলাদেশের ইতিহাসের এক অন্যতম সম্পদ নাগরি বর্ণ বা নাগরি লিপি প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে । ডঃ সুনীত কুমার চট্রোপাধ্যায় ও প্রমুখের মতে বিখ্যাত ধর্মীয় পরিব্রাজক হযরত শাহজালাল (রঃ) ত্রয়োদশ-চতুর্দশ শতাব্দীতে যখন সিলেট আগমন করেন তখন তিনি এই লিপি সাথে করে নিয়ে এসেছিলেন । পর্যাক্রমে এটির বিস্তার ছড়িয়ে পড়ে বাংলাদেশের ময়মনসিংহ , নেত্রকোণা কিশোরগঞ্জ , ভারতের আসাম , কাছড়া ও করিমগঞ্জে ।৫টি স্বরবর্ণ ও ২৭ টি ব্যাঞ্জনবর্ণে চমৎকার সাজানো এই লিপিতে লেখা হয়েছিল বহু চিটি , হিসাবপত্র , ও সরকারী দলিল দস্তাবেজ । সাহিত্যের ক্ষেত্রে রেখেছিল বিশেষ অবদান , এই লিপিতে লেখা হয়েছিল শতাধিক বই । তৎকালিন প্রসিদ্ধ হালাতুন্নবী , মহব্বত নামা ,নূর নছিহত তালিব হুছন সহ অসংখ্য গ্রন্থ এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কবিতা ।
পৃথিবীর ৮ হাজার ভাষার মধ্যে ৩ হাজার ভাষার বর্ণমালার উল্লেখ রয়েছে , তন্মধ্য রয়েছে বাংলাদেশের দুটি ভাষা যথা বাংলা বর্ণমালা ও সিলেটি ভাষার নাগরি বর্নমালা । ফ্রান্সের ভাষা যাদুঘরের সংরক্ষিত বর্ণমালায় উল্লেখ রয়েছে বাংলাদেশের এই দুটি বর্ণের । এই বর্ণ আয়ত্ত করা এতই সহজ যে তৎকালিন
একটি প্রবাদ ছিল এই রকমঃ
“কাজির ঘরর বান্দিয়েও যেমন আড়াই হরফ জানে অলান নাগরিও হিকা যায় মাত্র আড়াই দিনে” ।অত্যান্ত আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে এতকাল এই সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের সম্পদ কেবলই ইতিহাসের অন্ধকার প্রকোষ্টে নিমজ্জিত ছিল । তবে আশার বিষয় যে এটিকে ইতিহাসের পাতা থেকে বের করে আনতে কাজ করছে এক ঝাক তরুন ।
তরুনদের হাতে আলোর মর্শাল থাকলে অন্ধকার ঘোচে যাবে এটাই নিশ্চিত , আর নাগরি বাঁচাও আন্দোলনের মধ্য দিয়ে অন্ধকারের বদ্ধ খাঁচা থেকে বের করে “ইতিহাসের পাতায় নয়, নাগরি থাকবে আমাদের অন্তরে ঘরেঘরে” এই স্লোগানকে সামনে রেখে কাজ করছে এই তরুনেরা ।২০০৫ সালের মার্চ মাসে Unicode Consortium এর সহায়তায় সিলেটের নাগরি লিপি ইউনিকোডের (ISO 15924,Sylo-316) মাধ্যমে ISO স্বীকৃতি লাভ করেছে , কিন্তু অত্যান্ত দুঃখের বিষয় এর কোন জাতীয় স্বীকৃতি নেই । নাগরির ইতিহাস তুলে ধরে এর জাতীয় স্বীকৃতি আদায়ের লক্ষ্যে ৭ মে ২০১৫ সালে সিলেটের কৃতি সন্তান ইতিহাসবিদ , ইতিহাসারত্ন ডঃ মুমিনুল হক গঠন করেন ‘নাগরি বর্ণে সিলটি ভাষা স্বীকৃতি পরিষদ’ আর ইতিহাসবিদ হিসেবে রচনা করেন ৬ টি মূল্যবান গ্রন্থ যথাঃ বাংলার ইতিবৃত্ত , সিলেট বিভাগের ইতিবৃত্ত , মৌলভীবাজারের ইতিহাস ,রাজনগরের ইতিবৃত্ত , The History Of Bangladesh এবং শুধু মাত্র নাগরীর অতিথ ও বর্তমান প্রেক্ষাপটে রচনা করেছেন সিলেটি ভাষার নাগরি বাঁচাও আন্দোলন শিরোনামের একটি গ্রন্থ । তাঁর পরিষদের ডাকে সাড়া দিয়ে সিলেটের বিভিন্ন জেলা , উপজেলা , ইউনিয়ন কলেজে গঠন করা হয়েছে উক্ত পরিষদের কমিটি । শুধু সিলেট নয় পরিষদের ব্যাপ্তি ছড়িয়ে দিতে গঠন করা হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় , লিডিং ইউনিভার্সিটি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় কমিটি , কাজ চলছে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিটি গঠনের । প্রধানমন্ত্রী বরাবর প্রদান করা হয়েছে স্মারক লিপি ।
কমিটির প্রতিটি সদস্যই ভালবাসার টানে অক্লান্ত শ্রম,অর্থ ও ভালবাসা দিয়ে নাগরি পৌছে দিয়েছেন শহর পাড়া ও গ্রামগঞ্জের প্রত্যন্ত অঞ্চলে । ড. মুমিনুল হকের অর্থায়নে ইতিমধ্যে বের হয়েছে নাগরি বর্ণের ক্যালেন্ডার ,ম্যাগাজিন ও ত্রৈমাসিক পত্রিকা সিলেটি খবর।আর তাঁকে সার্বিক সহযোগীতা করছেন দেশ-বিদেশের সহস্রাধিক তরুন । উল্লেখযোগ্যদের মধ্যে রয়েছেন ইফতেখার আহমদ , মিসবাহ উদ্দিন , শ্যামল চন্দ্র ,আনোয়ার হোসেন , তাঁরা জৈন্তাপুর , গোয়াইনঘাট , কানাইঘাট উপজেলা , এম.সি কলেজ , সরকারি কলেজ , লিডিং ইউনিভর্সিটি শাহজালাল কলেজ সহ বেশ কয়েকটি উপজেলা ,কলেজ ও ইউনিয়নে কমিঠি গঠন করে স্ব-অর্থায়নে লিফলেট বিতরণ ও পরিষদের উপকরণ সকলের হাতে হাতে পোছে দিচ্ছেন , বিপ্লব কান্তি আবিষ্কার করেছেন নাগরি ফন্ট ।
সংগঠনের দৃড় বিশ্বাস এই তরুনদের হাতকে শক্তিশালী করতে এগিয়ে আসবে দেশের সচেতন সমাজ , সকল স্তরের দেশপ্রেমী নাগরিক । সংগঠনের সকলের একটাই প্রত্যাশা এই আলোর মর্শাল জ্বলে উঠবেই , একদিন স্বীকৃতি পাবে প্রাণের সম্পদ সিলেটি নাগরি । যা শুধু সিলেট নয় বস্তুত এই দেশরই এক অমূল্য সম্পদ।
সেই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় সিলেটিদের প্রাণের ভাষা সিলেটি ও প্রাণের বর্ণ নাগরিকে আরও একধাপ এগিয়ে নিতে এই গ্রন্থটি অনেকটাই সহায়ক ভুমিকা পালন করবে বলে আমি মনে করি।
এই গানগুলো সিলেটি ভাষা ও বর্ণের আন্দোলনে গতি ও ইতিহাসকে বাঁচিয়ে রাখতে কিছুটা হলেও সহযোগীতা করবে।
এই গীতিগ্রন্থটি রচনা করেছেন সিলেটের কৃতি সন্তান তরুণ লেখক ও গীতিকার মাহমুদুল হাসান উজ্জ্বল। গ্রন্থটি প্রকাশ করেছেন সিলেটের স্বনামধন্য প্রকাশনী প্রতিষ্ঠান জসিম বুক হাউজ, আম্বরখানা পয়েন্ট, সিলেট।
বইটি সংগ্রহ করতে যোগাযোগ করুনঃ 01734921135 (প্রকাশক জসিম উদ্দিন)
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই অক্টোবর, ২০২০ রাত ৯:৫৩