বাংলাদেশে ১৯৭২-এর শাসনতন্ত্র বা সংবিধানও রচনা করা হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে গভীর প্রজ্ঞার আলোকে। বিশ্বের মহৎ- সব সংবিধান বিশ্লেষণ করে তাদের শ্রেষ্ঠ অর্জনগুলো চয়ন করা হয়েছিল বাংলাদেশের সংবিধানে তা দেশোপযোগী, যুগোপযোগী করে। এই সংবিধান গ্রহণ করার সময় বঙ্গবন্ধুর মনে বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাস, তার ওপর নির্মম শোষণের ইতিহাস যেমন তীব্রভাবে কাজ করেছিল, তেমনি জাগ্রত ছিল তা থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা। বাঙালির ওপর বহু শতাব্দীব্যাপী যে অর্থনৈতিক-শোষণ অব্যাহত ছিল মোগল আমল থেকে, তা তার অন্তরে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছিল। তাই তিনি এই শোষণের কথা বলেছেন গভীর বেদনায়, যদিও তা মাত্র সংক্ষিপ্ত কয়েকটি বাক্যে- "দুনিয়ার সেই সব লোভীরা এবং তদানীন্তন ভারতবর্ষের যারা শাসক ছিল, তারা বাংলার অর্থ, বাংলার সম্পদ লুট করে নিয়ে গেছে অন্যত্র। গৃহহারা, সর্বহারা, কৃষক, মজুর, দুঃখী বাঙালি যারা সারাজীবন পরিশ্রম করেছে, দু'বেলা পেট ভরে খেতে পায়নি, তাদেরই সম্পদ দিয়ে গড়ে উঠেছে কলকাতার বন্দর, বোম্বাই, মাদ্রাজ; তাদেরই সম্পদ দিয়ে গড়ে উঠেছে করাচি, ইসলামাবাদ, লাহোর, গড়ে উঠেছে ডান্ডি, গ্রেট বৃটেন। এই বাংলার সম্পদ ছিল বাঙালির দুঃখের কারণ" (ঐ ভাষণ)।
বাংলাদেশের সার্বিক সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য বাংলাদেশের সংবিধানে বা শাসনতন্ত্রে চারটি মূল পন্থা বেছে নেওয়া হয়েছিল; সেগুলো হলো, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। শাসনতন্ত্রের এই মূল বা স্তম্ভগুলোকে বঙ্গবন্ধু তাঁর অনন্য ভাষায় ব্যাখ্যা করেছিলেন ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বরের সেই ভাষণে।
অতি সাধারণ ভাষায় তিনি জাতীয়তাবাদের যে গভীর ব্যাখ্যা দিয়েছেন তা সত্যিই অনন্য। তিনি প্রথমেই বলেছেন, জাতীয়তাবাদ না হলে একটি জাতি এগোতে পারে না। এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ আমরা জানি, পলাশীর যুদ্ধে জয়ী হয়ে ক্লাইভ সামান্য সংখ্যক সৈন্য নিয়ে মুর্শিদাবাদে প্রবেশ করেছিলেন, তাকে কেউ বাধা দেয়নি। ক্লাইভ ব্রিটিশ সংসদীয় কমিটির কাছে ব্যাখ্যা করে বলেছিলেন, মুর্শিদাবাদের অধিবাসীরা যদি সাধারণ অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তাঁকে বাধা দিত, তাহলে তাঁর পক্ষে টিকে থাকা সম্ভব হতো না। বস্তুত পলাশীর যুদ্ধ যখন চলছিল তখন আশপাশের কৃষকরা নিরুদ্বিগ্নভাবে চাষ করে যাচ্ছিল। জনগণের মধ্যে কোনো চাঞ্চল্যই পরিলক্ষিত হয়নি। তারা ভেবেছে এক রাজা যাবে, আরেক রাজা আসবে তাতে তাদের কি। তারা বুঝতেই পারেনি দেশের জন্য কী বিরাট ক্ষতি হচ্ছে। জাতীয়তাবাদ হলো তাই, যখন সাধারণ লোকের মধ্যেও এই অনুভূতি জাগে যে, দেশের স্বার্থই সবার স্বার্থ, দেশের মঙ্গল-অমঙ্গলই প্রতিটি ব্যক্তির মঙ্গল-অমঙ্গলের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। এই একাত্ম অনুভূতিই জাতীয়তাবাদ। বিভিন্ন আরব দেশে যেমন- সিরিয়া, ইরাক, মিসর, সৌদি আরবে জনগণের ভাষা ও ধর্ম এক, কিন্তু তারা ভিন্ন ভিন্ন জাতি। কারণ তাদের জাতীয়তাবাদের অনুভূতি ভিন্ন। একইভাবে ইংল্যান্ড, আমেরিকা-যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াও ভিন্ন; কারণ তাদের জাতীয়তাবাদের অনুভূতি ভিন্ন। বঙ্গবন্ধু জাতীয়তাবাদের মূল যে অনুভূতিতেই নিহিত, সহজ-সরল ভাষায় তারই অসাধারণ ব্যাখ্যা দিয়েছেন।
তাঁর গণতন্ত্রের ব্যাখ্যাও সাধারণ ব্যাখ্যা নয়। তিনি গণতন্ত্রের ব্যাখ্যা করেছেন এই বলে- "আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। গণতন্ত্র- সেই গণতন্ত্র যা সাধারণ মানুষের কল্যাণ সাধন করে থাকে" (ঐ ভাষণ)। আজ ধনতান্ত্রিক বিশ্বে যে গণতন্ত্র প্রচলিত রয়েছে তা হলো বুর্জোয়া গণতন্ত্র। ইংল্যান্ডের ১৬৪৪ এবং ১৬৮৮ সালের বিপ্লব, ফ্রান্সের ১৭৮৯ সালের বিপ্লব এবং ইউরোপের অন্যান্য দেশে ১৮৪৮ সালের বিপ্লবগুলো ছিল মুখ্যত, সামন্ততন্ত্র ও স্বৈরাচারী রাজন্যবর্গের বিরুদ্ধে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব। এসব বিপ্লবের মাধ্যমে সব মানুষ আইনের দৃষ্টিতে সমানাধিকার পেয়েছিল, অর্থাৎ রাষ্ট্রের কাছে আইনত সবাই সমান। কিন্তু আজ কে না জানে, আইনের দৃষ্টিতে সমান হলেও একজন দরিদ্র ও একজন ধনী কোনোদিনই রাষ্ট্র থেকে সমান মর্যাদা পায় না। আমাদের মতো দেশে প্রতিদিন বিচারের বাণী কীভাবে নীরবে-নিভৃতে কাঁদে তা কি বলার অপেক্ষা রাখে? সাধারণ মানুষ বিত্ত ও ক্ষমতার কাছে প্রতিদিন যে অসংখ্য পরাজয় মেনে নিচ্ছে, তাদের ম্লান মুখে শত শতাব্দীর যে বেদনা তা কি আমরা প্রতিনিয়ত দেখি না?
বঙ্গবন্ধু গভীর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে বুঝেছিলেন অন্যান্য সমাজ-বিন্যাসের মতো সমাজতন্ত্রও নানা পতন-অভ্যুদয়ের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে যাবে; এর পথ মসৃণ নয়, বন্ধুর। মনে রাখা উচিত, কোনো সমাজ-বিন্যাসই একদিনে পরিপূর্ণতা পায়নি। ধনতন্ত্রের পরিপূর্ণতা পেতে সাতশ বছর লেগেছে, দ্বাদশ শতক থেকে ঊনবিংশ শতক। দেশে দেশে ধনতন্ত্রের ভিন্ন ভিন্নভাবে বিকাশ হয়েছে। ইংল্যান্ডে যেভাবে বিকশিত হয়েছে; জার্মানি বা ফ্রান্সে সেভাবে হয়নি। দীর্ঘ-সংগ্রামে, সাতশ বছরের সংগ্রামে ধনতন্ত্র কিছুটা এগিয়ে আবার পিছু হঠেছে, সামন্তরা কিছুদিনের জন্য হলেও কোনো কোনো দেশে জয়ী হয়েছে। সমাজতন্ত্রও সেভাবে এগোবে। দেশে দেশে দৈশিক অবস্থাভেদে এর রূপ হবে ভিন্ন। কিন্তু এক জায়গায় এর এক মৌলিক লক্ষ্য থাকবে, তা হলো শোষণহীন সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা, যা বঙ্গবন্ধু উল্লেখ করেছেন। সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্রের পতনের পর জাপানি-আমেরিকান ঐতিহাসিক ফুকায়মা বিশ্বব্যাপী ধনতন্ত্রের সার্বিক জয়ে ইতিহাসের পরিসমাপ্তি হয়েছে, ঘোষণা করেছিলেন। এর ঠিক অব্যবহিত পরেই জাপানে ও দক্ষিণ-পূর্ব-এশিয়ার দেশগুলোতে অভূতপূর্ব বিরাট অর্থনৈতিক মন্দা বা ধস নামে। এ ধসের এক দশক অতিক্রান্ত হওয়ার আগেই ২০০৮ ও ২০০৯-এ মুখ্যত উন্নত বিশ্বে ধনতন্ত্রের মূল কেন্দ্র যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপজুড়ে যে প্রচণ্ড অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিল তা কি ১৯৩০-এর মহামন্দার পরে আবার ধনতন্ত্রের ভিতেই-কি বিরাট ফাটল বা কাঁপুনি সৃষ্টি করেনি? অর্থনৈতিক ধস থেকে যে দুটি বড় দেশ অক্ষত থেকে তাদের অগ্রগতি অব্যাহত রেখেছে তারা হলো চীন ও ভারত। এ দুটি দেশই সমাজতন্ত্রকে কাম্য সমাজব্যবস্থা হিসেবে গণ্য করে তাদের ব্যাংক ও শিল্পপুঁজির বৃহৎ খাতগুলোকে রাষ্ট্রখাতে রেখেছে। ফলে লগ্নীপুঁজির লাগামহারা লোভের করাল গ্রাস তাদের অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করতে পারেনি। গত দুই দশক ধরে ধনতন্ত্রের যে অব্যাহত অবক্ষয় চলছে তার ফলে সমাজতন্ত্রই কী আবার সাধারণ শোষিত মানুষের সামনে বাঁচার পথ হিসেবে নতুন-আলোকে উদ্ভাসিত হচ্ছে না? লাতিন আমেরিকায় ব্রাজিল, ভেনেজুয়েলা, চিলি, বলিভিয়া ইত্যাদি দেশ সমাজতন্ত্রের পথেই হাঁটছে তাকে যতটুকু সম্ভব দেশভিত্তিক ও যুগোপযোগী করে। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের জন্যও তাই চেয়েছিলেন চার দশক আগে। তার কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছিল বাংলার মানুষের জন্য শোষণহীন সমাজের আকাঙ্ক্ষা, প্রতিটি মানুষকে তার মানবসত্তার মর্যাদায় অভিষিক্ত করার আকাঙ্ক্ষা। এ কারণেই সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার মূল নীতিতে ঘোষিত হয়েছিল এই অঙ্গীকার, "প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হইবে" (সংবিধান)। অঙ্গীকারে আরও বলা হয়েছে, "রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হইবে পরিকল্পিত অর্থনৈতিক বিকাশের মাধ্যমে জনগণের জীবনযাত্রার বস্তুগত ও সংস্কৃতিগত মানের দৃঢ় উন্নতি সাধন" (সংবিধান)। আরও যুক্ত করা হয়েছে, "মেহনতি মানুষকে-কৃষক ও শ্রমিককে- এবং জনগণের অনগ্রসর অংশসমূহকে সকল প্রকার শোষণ হইতে মুক্তি দান করা" (সংবিধান)।
বাংলাদেশকে একটি প্রকৃত গণতান্ত্রিক অসাম্প্রদায়িক আধুনিক জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য 'ধর্মনিরপেক্ষতা'কে করা হয় রাষ্ট্রের সংবিধানের অন্যতম মূল ভিত্তি। বঙ্গবন্ধুর ৪ নভেম্বরের এই ভাষণটি একটি অসাধারণ ভাষণ- ওজোগুণ, দার্ঢ্য ও অর্থগৌরবের জন্য। ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু বাংলার মানুষের স্বাধীনতার কথাই কেবল বলেননি, মুক্তির কথাও বলেছিলেন; সেই মুক্তির অঙ্গীকারই ৭২-এর সংবিধানের চারটি মূল স্তম্ভে রূপ পেয়েছে।
বাংলাদেশের সংবিধানের সংশোধনীসমূহ
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে অক্টোবর, ২০১৬ সকাল ১১:২০