লাদাখ ভ্রমণ - সবগুলো পর্ব
লেহ শহরে দুই দিন তিন রাত অলসভাবে কাটিয়ে আমাদের আজকের গন্তব্য নুব্রা ভ্যালী, পথে বোনাস হিসেবে পৃথিবীর সর্বোচ্চ গাড়ির রাস্তা খারদুংলা পাস অতিক্রম করব। মানালি থেকে লেহ অথবা লেহ থেকে শ্রীনগর যেতে কোনও অনুমতি প্রয়োজন হয় না। এমনকি লেহ শহরের বিভিন্ন স্পট এ ঘুরতেও কোনও অনুমতি দরকার হয় নাই। কিন্তু যদি বিদেশীরা লাদাখ এর প্রত্যন্ত অঞ্চল যেমন নুব্রা ভ্যালী, টুরটুক, প্যাংগং লেক, সো-মো-রিরি লেক, প্যানামিক যেতে চায় তাহলে তাকে লেহ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট অফিস থেকে অনুমতি নিতে হবে।
আমি আর সোহাগ আগেরদিন একটা ট্রাভেল এজেন্সি থেকে নুব্রা ভ্যালী এবং প্যাংগং লেক যাওয়ার অনুমতি পত্র করে রেখেছিলাম। এতে খরচ হয়েছিল ৭০০ রুপি করে জনপ্রতি, যদিও সরকারি ফি ৪৬০ রুপি। খোকন আমাদের সাথে অনুমতি নেয় নাই কারণ ও যেতে পারবে না। ঢাকা থেকে জরুরি ফোন আসার কারণে খোকন লেহ থেকে ফ্লাইটে দিল্লী হয়ে দেশে চলে যাবে। তাই আমরা তিনজন থেকে যখন দুইজন হয়ে গেলাম একটু বিপদে পরে গেলাম। কারণ আমাদের প্ল্যান ছিল লেহ থেকে নুব্রা ভ্যালী গিয়ে, এক রাত থেকে নুব্রা থেকে সরাসরি প্যাংগং লেক যাব, এবং প্যাংগং লেক থেকে লেহ ফেরত আসব। এভাবে গেলে গাড়ি ভাড়া পরবে প্রায় ১৮০০০ রুপি করে। কিন্তু খোকন চলে যাওয়ার পর আমাদের দুইজনে পক্ষে পুরো গাড়ি ভাড়া করা সম্ভব না। আমরা কয়েকটা ট্যুর অপারেটর এর কাছে খোঁজ নিয়েছিলাম যে তাদের নুব্রা যাওয়ার কোনও প্যাকেজ আছে কি না, আমরা যেভাবে যেতে চাই। কিন্তু কারো কাছেই আমাদের প্ল্যান মত প্যাকেজ পেলাম না। এবং সেইসাথে তারা জানালো যে, তাদের কাছে যদি আরও কেউ আসে তাহলেই গাড়ি দিতে পারবে অন্যথায় পুরো গাড়ি ভাড়া নিতে হবে। সন্ধ্যায় একবার খোঁজ নিতে বলেছিল। এবার আমরা গেস্ট হাউজ এর হাসান ভাই এর শরণাপন্ন হলাম। তার এক ভাইয়ের এজেন্সি থেকে খোঁজ নিয়ে তিনিও আমাদের একই তথ্য দিলেন, যে যদি শেয়ার করার মত লোক পাওয়া যায় তাহলে আমাদের জানাবেন। লেহ শহরে ঘোরাঘুরি করে আমরা যখন সন্ধ্যায় গেস্ট হাউজ এ ফিরে আসি তখন হাসান ভাই আমাদেরকে জানালেন যে একটা গ্রুপ হয়েছে কিন্তু শুধু নুব্রা ভ্যালী যাওয়ার জন্য, আমরা যেতে রাজি আছি কি না। আমি আর সোহাগ রাজি হয়ে গেলাম। লেহ শহরে যেখানেই যাওয়া হোক না কেন ট্যাক্সি ভাড়া বছরের শুরুতেই ফিক্সড করা হয়। আমাদের গাড়িটা ছিল মাহিন্দ্রা জাইলো এবং আমরা মোট যাত্রী ছিলাম ৬ জন। হাসান ভাই চার্ট থেকে মোট ভাড়া বের করে ৬ দিয়ে ভাগ করে আমাদেরকে জন প্রতি ১৮০০ রুপি করে দিতে বলল। আমরা তাকে দুইজনের জন্য ৩৬০০ রুপি দিয়েছিলাম। আমার একটু মন খারাপ হয়েছিল যে, নুব্রা থেকে প্যাংগং লেক যাওয়ার প্ল্যানটা বাতিল হল।
সকাল ৭ টায় ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে ব্যাগ গুছিয়ে রুম ছেড়ে দিলাম। খোকন আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এয়ারপোর্ট এর উদ্দেশ্যে চলে গেল এবং আমরা গেস্ট হাউজে নাস্তার অর্ডার দিয়ে রাস্তার ওপারের একটা অক্সিজেন সিলিন্ডার এর দোকানে একটু ঢুঁ মারতে গেলাম। অক্সিজেন দোকানের লোকটা প্রথমে আমাদের দুইজনের শরীরে অক্সিজেন এর পরিমাণ মেপে নিল। একজন সুস্থ মানুষের দেহে অক্সিজেন এর পরিমাণ থাকে শতকরা ৯৫ ভাগ। সেখানে সোহাগ এর ছিল ৮৫ ভাগ এবং আমার ৭১ ভাগ। তারপর আমাদের দুইজনকে অক্সিজেন এর মাস্ক পরিয়ে ১ মিনিট রাখার পর আবার মাপল, এবার দুইজনেরই ৯৬-৯৭ ভাগ। কিন্তু আমার যে সুবিধাটা হল, অক্সিজেন নেয়ার সাথে সাথে গত তিন ধরে মাথার ভেতরে যে ঝিম ঝিম ভাব ছিল তা দূর হয়ে গেল। ফলে আমি আর সোহাগ ১০০০ রুপির বিনিময়ে সিলিন্ডারটা তিন দিনের জন্য ভাড়া নিলাম। কিন্তু এই সিলিন্ডারটা আমাদের কোনও কাজেই আসে নাই। তিন দিন ধরে লাদাখ এ থাকার ফলে আমাদের শরীর পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিয়েছিল। এবং কোথাও আমরা অক্সিজেন এর প্রকট সমস্যা বোধ করি নাই। তিন দিন পর প্রায় সম্পূর্ণ অক্সিজেন সিলিন্ডারটিই আমরা ফেরত দিয়েছিলাম।
গুগল থেকে ধার করা একটা ছবি
সিলিন্ডার নিয়ে আমরা গেস্ট হাউজ এর ছাদ এ গেলাম নাস্তা করার জন্য। ছাদ এ হালকা ঠাণ্ডার মধ্যে গরম গরম চা আর টোস্ট খেতে বেশ ভালই লাগছিল। চা খেতে খেতে আমাদের গাড়ি চলে আসল। আমরা হাসান ভাই কে বলে রেখেছিলাম গাড়ি যেন আমাদেরকে সবার আগে নেয়, তাহলে আমি আর সোহাগ সামনের সিট এবং মধ্যের সাড়ির জানালার পাশের সিট দখল করতে পারবো। আমরা দ্রুত নাস্তা শেষ করে গাড়িতে গিয়ে জায়গা দখল করলাম। আমাদের আজকের ড্রাইভার এর নাম শরীফ। আমি আর সোহাগ চিন্তা করতেছিলাম যে আমাদের সহযাত্রী কারা হবে, কারণ সহযাত্রীরা যদি মনঃপুত না হয় তাহলে ভ্রমণ সুখকর হয় না।
প্রথমে আমরা মার্কেট এর পাশ থেকে আমাদের সমবয়সী দুইজন ভারতীয় ছেলেকে তুললাম। ওদের সাথে পরিচিত হলাম। একজন এর নাম ভাস্কর পেশায় আমাদের মতই ইঞ্জিনিয়ার, আর একজন এর নাম মঞ্জুনাথ সে রিলায়েন্স গ্রুপ এ চাকরি করে(ডিটেইলস ভুলে গেছি)। ওরা ওঠার পর আপার থুচকা রোড এ এক হোটেল এর সামনে থেকে উঠল পঞ্চাশ বছর বয়সী এক শ্রীলঙ্কান নাম সঞ্জয়। সব শেষে উঠল এক মধ্যবয়স্ক ইসরায়েলি নারী। এর মধ্যেই ভাস্কর এবং মঞ্জুনাথ এর সাথে বেশ ভাল গল্প জুড়ে দিয়েছি। পিছন থেকে সঞ্জয় ও আমাদের সাথে যোগ দিল। তো আমরা গল্প করতে করতে খারদুংলা এর পথে যেতে থাকলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে আমাদের গল্প এমন স্তরে পৌঁছাল বাইরে থেকে কেউ বলবে না যে মাত্র আধা ঘণ্টা আগেই আমরা পরিচিত হয়েছি।
ভিনদেশী ৬ জন
ভাস্কর নামক ছেলেটা অসম্ভব ট্যালেন্ট। মঞ্জুনাথ ছিল অনেক উচ্চ লেভেল এর মজার মানুষ এবং সঞ্জয় ছিল আমাদের আনন্দের খোরাক। ইসরায়েলি নারী সহযাত্রীর সাথে আমাদের তেমন কথা হয় নাই, কারণ উনি খারদুংলা তে নেমে কোনও এক কারণে আবার লেহ তে ফিরে গিয়েছিল। অবশ্য আমরা চারজন বলতেছিলাম যে, সঞ্জয় এর বকবকানি সহ্য করতে না পেরে চলে গিয়েছিল আর কি। সঞ্জয় কে কিছু বললেই ওর মুখ থেকে একটা বাক্যই বের হত, ও মাই গড। যেমন ও আমাকে জিজ্ঞেস করল আমাদের দেশে কয়টা টিভি চ্যানেল অথবা কয়টা এয়ারলাইন্স এর কোম্পানি আছে। প্রতিটা উত্তরের বিপরীতে সঞ্জয় একটা কথা অবশ্যই বলত যে ও মাই গড, তোমাদের দেশ এত এগিয়ে গেছে। এরকম আরও অনেক মজার মজার ঘটনা আছে যা বলতে গেলে অনেক লম্বা হয়ে যাবে। সঞ্জয় এর আরও একটা মজার ঘটনা না বললে হবে না, ওর আরও একটা কথা ছিল যে, তার যে জায়গা পছন্দ হয় সেখানে সে ১৫ বার যায়, তার সব কিছু ১৫ বার করতে হয়, এমনকি সে যখন তার মেইল আইডি আমাদেরকে দিচ্ছিল যে, সে বলতেছিল তার আইডি ১৫ বছর আগের। কিন্তু আইডি টা ছিল গুগল এর জিমেইল। সোহাগ সাথে সাথে জিজ্ঞেস করল যে, ১৫ বছর আগে তো জিমেইল ছিল না। এর জন্য আমরা চারজন ওকে চাপাবাজ ও বলতে শুরু করলাম। আমি, সোহাগ, ভাস্কর, মঞ্জুনাথ সমবয়সী হওয়ার কারণে আমাদের মধ্যে অতি অল্প সময়েই খুব ভালো বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেল।
আমি, মঞ্জুনাথ, সোহাগ এবং ভাস্কর
ফেলে আসা লেহ শহর
আমরা লেহ শহরকে পিছনে ফেলে পাহাড়ি রাস্তা ধরে ক্রমান্বয়ে উপরে উঠতে লাগলাম। এই রাস্তাটা খুবই ভালো ছিল এবং অসম্ভব সুন্দর ছিল। আসলে প্রতিটা রাস্তার সৌন্দর্য বর্ণনা করার মত আলাদা ভাষা আমার কাছে নেই। কিন্তু একটি রাস্তা অন্য আর একটি থেকে সৌন্দর্যের দিক থেকে আলাদা এবং কোনটাই অন্যটার থেকে কম নয়। এ যেন এমন এক প্রতিযোগিতা যা রাস্তার আরোহীদের সৌন্দর্য বিচার করতে মধুর সমস্যায় ফেলে দেয়। চলতে চলতে এক সময় আমরা সাউথ পুল্লু নামে একটা চেক পোস্ট এ চলে আসলাম। সাউথ পুল্লুর উচ্চতা ১৫৩০০ ফুট। এখানে শরীফ আমাদের বিদেশি চার জনের কাছ থেকে পাসপোর্ট ও অনুমতি পত্রের ফটোকপি এবং ভাস্কর ও মঞ্জুনাথ এর আইডি নিয়ে গেল চেক পোস্ট এ দেখাতে। আমরা গাড়িতেই বসে রইলাম।
সাউথ পুল্লু চেক পোস্ট
বিশেষণ শেষ হয়ে গেছে
চেকিং শেষে শরীফ আমাদের পাসপোর্ট ফেরত দিল এবং আমরা আবার চলতে শুরু করলাম। সাউথ পুল্লুর পর রাস্তা বেশ কয়েকটা লুপ দিয়ে উপরে উঠে গেছে এবং একটা লুপ পার হওয়ার পরই রাস্তা খারাপ পেলাম। আরও দুইটা লুপ পার হওয়ার পর আমাদের গাড়ির মাঝের সিটটা ভেঙ্গে গেল। অল্পের জন্য ভাস্কর সঞ্জয় এর উপর পরা থেকে রক্ষা পেল। আমরা গাড়ি থেকে নামলাম। এখানে প্রচণ্ড বাতাস। শরীফ সিট ঠিক করার চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু সিট কি আর এই পাহাড়ের উপর ঠিক করা যায়। ও ট্রাভেল এজেন্সি তে ফোন দেয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হল নেটওয়ার্ক সমস্যার কারণে। শেষ পর্যন্ত সিটটাকে দড়ি দিয়ে বেঁধে আমরা আবার যাত্রা শুরু করলাম।
সোহাগ সামনে, আমি মাঝের একমাত্র ভালো সিটে, ভাঙা সিটে ভাস্কর ও মঞ্জুনাথ এবং শেষের সিটে সঞ্জয় এবং ইসরায়েলি নারী। কিন্তু আমাদের ভাগ্য এত সুপ্রসন্ন ছিল না।
রাস্তা ঠিক করার কাজ চলছে
মিনিট দশেক চলার পর এবার গাড়ি নষ্ট হয়ে গেল। আমরা হতাশ হয়ে বাইরে এসে গল্প করতে থাকলাম। শরীফ এবং ভাস্কর মিলে গাড়ি ঠিক করার চেষ্টা করতে লাগল। সোহাগও মাঝে মাঝে গিয়ে সাহায্য করতে চেষ্টা করল। গাড়ি সম্পর্কে আমার কোনও আইডিয়া নাই। তাই আমি বাকিদের সাথে কথা বলতে থাকলাম আর ছবি তুলতে শুরু করলাম। মনে মনে একটাই দোয়া করতে থাকলাম যেন গাড়িটা ঠিক হয়ে যায়। আমাদের গাড়ি যেখানে নষ্ট হল তার আনুমানিক উচ্চতা প্রায় ১৬০০০ ফুট এর উপরে। ঠাণ্ডা বাতাস এর কারণে হাতমোজা খুলে ছবি তুলতে গেলেই হাত ঠাণ্ডা হয়ে যেত। প্রায় এক ঘণ্টা পর অন্য আর একটা গাড়ির সহায়তায় আমাদের গাড়ি ঠিক করা গেল।
গাড়ি নষ্ট হবার পর
ঐ পাহাড়ের পিছনেই খারদুংলা
আমরা আনন্দচিত্তে আবার গাড়িতে উঠে বসলাম। মঞ্জুনাথ ফাজলামোর স্বরে শরীফ কে বলতেছিল যে এরপর গাড়ির কি নষ্ট হবে তা আগে বলে দিলে আমরা সাবধান থাকতে পারবো। গাড়ি নষ্ট হয়ে যাওয়ার ফলে যে এক ঘণ্টা সময় আমরা ঐখানে ছিলাম এক মুহূর্তের জন্যও খারাপ লাগে নাই, একটুও বিরক্ত লাগে নাই। লাদাখ এমনই এক মায়াবী রাজ্য যেখানে কোনও কিছুতেই খারাপ লাগে না। অতঃপর আমরা বাকি পথটুকু নির্বিঘ্নে পার হয়ে চলে এলাম খারদুংলা টপ এ যার উচ্চতা ১৮৩৮০ ফুট। যা কিনা মাউন্ট এভারেস্ট এর বেস ক্যাম্প এর থেকেও উঁচু। হাজার বছরের পুরনো সিল্ক রুট এই পথেই ছিল। আমার ভাবতে অবাক লাগে যে পথে এখনও গাড়ি দিয়ে যেতেও অনেক কঠিন সেই পথে হাজার বছর আগে মানুষজন উট, ঘোড়া এগুলো নিয়ে বাণিজ্য করতে যেত দেশ থেকে দেশান্তরে। মনে হল একটিবারের জন্য যদি সেই সময়ে চলে যেতে পারতাম।
খারদুংলা এর চূড়া থেকে
এই লোক সাইকেল চালিয়ে লেহ থেকে খারদুংলা এসেছে
লাদাখ ভ্রমনঃ(১১দশ পর্ব) – নুব্রা ভ্যালীর মায়াবী পথে
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা সেপ্টেম্বর, ২০১৭ রাত ১২:৪৯