লাদাখ ভ্রমণ - সবগুলো পর্ব
লেহ শহরে প্রবেশমুহূর্ত
লেহ ভারত শাসিত জম্মু এবং কাশ্মীর এর অন্যতম বৃহৎ একটা শহর। যা পূর্বে লাদাখ রাজ্যের রাজধানী ছিল। এখন অবশ্য লাদাখ রাজ্যের নাম কোথাও নাই, কাগজে-কলমে নাম লেহ। লেহ শহরের আবহাওয়া চরমভাবাপন্ন। দিনে প্রখর সূর্যের আলো আর রাতে অতি নিম্ন তাপমাত্রা, সেই সাথে মরুভূমির শুষ্কতা এবং বাতাসে অক্সিজেন এর স্বল্পতা।
কিলং থেকে সকাল ৭ টায় রওনা দিয়ে আমরা যখন লেহ শহরের প্রবেশদ্বার এর সামনে এলাম তখনও দিনের আলো নেভে নাই। তাশি আমাদের জিজ্ঞেস করল যে কোন হোটেলে যাবে। কিন্তু আমরা তো কোনও হোটেল বুক দেই নাই এবং লেহ এর হোটেল নিয়া রাজ ভাই এর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা শুনেছিলাম, তাতে আগেই ঠিক করে রেখেছিলাম যে পোলো গ্রাউন্ড এর আশেপাশে থাকতে হবে। আমি তাশি কে বললাম পোলো গ্রাউন্ড এর কাছে যেতে। কিন্তু পুরো পোলো গ্রাউন্ড ঘুরে আমরা যখন পিছনে চলে এলাম তখনও কোনও হোটেল চোখে পরল না। আরও কিছুদূর এগিয়ে আমরা পোলো গ্রাউন্ড এর ঠিক উল্টো দিকে আসার অর একটা গেস্ট হাউজ দেখে খোকনকে পাঠালাম রুম দেখার জন্য। ঐখানে দিন প্রতি ১০০০ রুপি তে তিনজনের জন্য এক রুম পেয়ে গেলাম। তাশিকে বিদায় দিয়ে আমরা রুম এ চলে এলাম।
গেস্ট হাউজ এর জানালা থেকে লেহ প্রাসাদ এবং পর্বতচূড়া
আমাদের রুম ছিল দোতলায়, এবং গেস্ট হাউজ এর নাম ছিল Palace View Gest House. একদম নামের সাথে সার্থকতা রেখে আমাদের জানালা থেকে লেহ প্রাসাদ পুরো স্পষ্ট দেখা যায়। আসলে শহরের যে কোনও জায়গা থেকেই লেহ প্রাসাদ এবং সংকর গোম্পা নামে একটা মন্দির দেখা যায়। আমরা যখন হোটেলে নাম এন্ট্রি করতে গেলাম তখন বাংলাদেশ থেকে এসেছি শুনে সবাই খুবই অবাক হলো। আমরা কিছুক্ষণ বাংলাদেশ নিয়ে কথা বলে বের হয়ে এলাম। তাদের ঐখানে এর আগে কখনো বাংলাদেশী কেউ থাকে নাই। এই ব্যাপারটা আমরা লেহ এর অনেক জায়গায় পেয়েছি, বাংলাদেশ থেকে গিয়েছি শুনে খুবই অবাক হত অনেকে।
সন্ধ্যার মেইন মার্কেট চত্বর
রাতের জামে মসজিদ
আমরা গেস্ট হাউজ থেকে বের হয়ে প্রথমেই মেইন মার্কেট এ গেলাম, উদ্দ্যেশ্য সারাদিনের ক্ষুধার্ত পাকস্থলীটাকে শান্তি প্রদান করা। কাশ্মীরী খাবার খাওয়ার উদ্দ্যেশে আমরা কাশ্মীরী ওয়াজওয়ান নামক একটা রেস্টুরেন্ট এ গেলাম। এটা লেহ শহরের খুবই বিখ্যাত একটা রেস্টুরেন্ট। আমরা কাশ্মীরী বিরিয়ানি, রোগান জোস আর নান অর্ডার করলাম। কিন্তু কোনও খাবারই আমার কাছে ভাল লাগে নাই। বাকি দুইজনের কাছে অবশ্য বিরিয়ানি ভাল লেগেছিল। আমার কাছে কেন যেন এখন পর্যন্ত ভারতের কোনও বিরিয়ানিই ভাল লাগে নাই, আমার দেশের বিরিয়ানিই অসাধারণ লাগে। খাবার পর্ব শেষ করে আমরা মেইন মার্কেট এ রাত ১০ টা পর্যন্ত ঘুরে রুম এ চলে আসলাম। রুম এ আসার পর শুরু হলো মাথা ধীরে ধীরে ব্যাথা শুরু হলো। প্রথমে মনে করছিলাম শুধু আমার হচ্ছে, কিন্তু পরদিন সকালে ঘুম থেকে দেখলাম সবার ই একি অবস্থা। এই মাথা ব্যাথা তিনদিন ছিল।
পরদিন এর কোনও প্ল্যান নাই। তাই ঘুম থেকে উঠলাম সকাল ১১ টায়। ফ্রেশ হয়ে আমরা গেলাম নাস্তা করতে। আসলে নাস্তা না দুপুরের খাবার। গতকালের রাতের খাবার ভাল লাগে নাই। তাই এবার গেলাম জামে মসজিদ এর কাছে খোঁজ নিতে যে মুসলিম দোকান আছে কিনা। এবং জামে মসজিদ এর পাশের গলিতে হোটেল দিলশান নামে একটা রেস্টুরেন্ট খুঁজে পেলাম। আমরা যে কয় দিন লেহ তে ছিলাম প্রতিবেলাতেই এখানে খেয়েছিলাম। এই রেস্টুরেন্ট এ দুইজন পারভেজ ছিলেন। উনাদের রান্না অসাধারণ, প্রতিবেলায় আমরা একটি একটি করে সকল প্রকার কাশ্মীরী মাংসের আইটেম খেয়েছিলাম। সেই রান্নার স্বাদ আমার মুখে আজো লেগে আছে। পরবর্তীকালে গুলমার্গ, সোনমার্গ, পাহালগাম, শ্রীনগরের নামীদামী সব রেস্তোরাঁয় খাবার সৌভাগ্য হয়েছিল, কিন্তু ঐ রকম স্বাদ আর কোথাও পাই নাই। ধন্যবাদ পারভেজ ভাই, আপনাদের এত মজাদার খাবার এর জন্য।
দিলশান রেস্টুরেন্ট
দুই পারভেজ ভাই এর সাথে আমি আর সোহাগ
দুপুরে খেয়ে আমরা আশে পাশে ঘুরতে বের হলাম। আশেপাশে বলতে মেইন মার্কেট এর রাস্তা ধরে এলোমেলো হাঁটতে থাকলাম। গেস্ট হাউজ এর মালিক হাসান ভাই এর সাথে কথা বলতেছিলাম যে, নুব্রা ভ্যালী আর প্যাংগং লেক এ যাওয়ার পারমিশন পাওয়া যাবে কি না। কিন্তু উনি সন্দিহান ছিলেন যে বাংলাদেশী পাসপোর্ট এ পারমিশন দিবে কি না। এই ব্যাপার এ বিভিন্ন ট্রাভেল এজেন্সিতে খোঁজ নিতেছিলাম। যেখানে এক এক জনের কাছ থেকে এক এক রকম তথ্য পেলাম। কেউ বলে বাংলাদেশী পাসপোর্ট এ অনুমতি দিবে না, আবার কেউ বলে অতিরিক্ত টাকা দিলে পাওয়া যাবে, আবার কেউ কেউ বলল যে পাওয়া যাবে কোনও সমস্যা হবে না। অতঃপর আমরা দেখলাম যে জামে মসজিদ এর সামনে একটি ট্যুর এজেন্সি যেখান থেকে অধিকাংশ বিদেশীরা অনুমতি নেয়ার জন্য পাসপোর্ট জমা দিচ্ছে, আমরাও ঠিক করলাম যে কাল এখানেই অনুমতি নেয়ার জন্য পাসপোর্ট জমা দেব, জনপ্রতি ৭০০ রুপি করে লাগবে।
আমাদের আরও একটা চিন্তার বিষয় ছিল। আমাদের প্ল্যান ছিল মানালি দিয়ে গিয়ে শ্রীনগর হয়ে ফিরব। সেইভাবে শ্রীনগর থেকে আমাদের দিল্লীর এয়ার টিকেট করা ছিল। এবং খরচ বাঁচাতে আমরা প্রায় দুই মাস আগে এয়ার টিকেট করেছিলাম। কিন্তু জুলাই মাসে শ্রীনগর এ রাজনৈতিক গণ্ডগোল শুরু হয় এবং শ্রীনগর এবং এর আশেপাশের এলাকাসমূহতে কারফিউ চলছিল। প্রতিদিন ই ঐখানে মারামারি হচ্ছিল। আমরা এইটা নিয়াও অনেক দ্বিধাগ্রস্ত ছিলাম, যে এয়ার টিকেট বাতিল করে দিব নাকি, সে ক্ষেত্রে আমরা যে রাস্তায় এসেছি সেই রাস্তা দিয়েই আবার ফেরত যেতে হবে। আমরা এটা চাইতেছিলাম না, তাই যেখানেই একটু কথা বলার সুযোগ পেয়েছি, এই ব্যাপারে কথা বলেছি। এবং তাদের কথা শুনে আমরা আরও বেশি বিভ্রান্ত হয়েছি। কেউ যদি বলে শ্রীনগর নিরাপদ না তবে অন্য কেউ হয়ত বলে টুরিস্টদের জন্য কোনও সমস্যা নাই। তবে সবাই একটা কথা বলেছে যে এয়ার টিকেট ক্যান্সেল করার দরকার নাই। আমরা তবু আশ্বস্ত হতে পারছিলাম না। এভাবেই সারাদিন রাস্তায় রাস্তায় হেঁটে, মার্কেট এর বিভিন্ন দোকানে কিছু কেনাকাটা করে আর গল্প করে কাটিয়ে দিলাম। এই গল্পগুলোর বেশিরভাগই ছিল শ্রীনগর আমাদের যাওয়া নিয়ে। সবার উপদেশ, নির্দেশনা আর সাহায্য করতে চাওয়ার অপশন গুলো বলতে গেলে শেষ হবে না।
উদ্দ্যেশ্যহীন ঘোরাঘুরির কিছু মুহূর্ত
আমরা রাতে দিলশান রেস্টুরেন্ট এ খেয়ে রুম এ ফিরে আসলাম ১০ টা বাজে। এসে ওয়াইফাই দিয়ে বাসায় যোগাযোগ করে আমি ঘুমিয়ে পরলাম। পরদিন সকালে আমি যথারীতি ঘুম থেকে উঠলাম ১০ টা বাজে। খোকন সিদ্ধান্ত নিল যে ও আর আমাদের সাথে যাবে না, ওকে দেশে ফিরতে হবে। কাল সকালে ও লেহ থেকে সরাসরি দিল্লীর ফ্লাইট ধরে চলে যাবে। আমরা ১১ টা বাজে রুম থেকে বের হয়ে খাওয়া দাওয়া করে আমি আর সোহাগ পাসপোর্ট জমা দিলাম নুব্রা এবং প্যাংগং এর অনুমতি এর জন্য। আমাদেরকে বিকালে এসে পাসপোর্ট নিয়ে যেতে বলল। এরপর সোহাগকে হোটেলে পাঠিয়ে দিয়ে আমি আর খোকন গেলাম এয়ারপোর্ট এর উদ্দেশ্যে, খোকন এর জন্য এয়ার টিকেট করতে। মাইন মার্কেট থেকে লেহ এয়ারপোর্ট ১০ রুপি + ১০ রুপি শেয়ারড জিপ ভাড়া জনপ্রতি।
আমি আর খোকন যখন এয়ারপোর্ট এ গিয়ে নামলাম আমাদের অনেকক্ষণ সময় লাগল যে আসলে কোনটা এয়ারপোর্ট। পর একজনকে জিজ্ঞেস করায় সে আমাদের কে একটা তালা মারা গেট দেখিয়ে দিল। যেখানে কিছুক্ষণ দাড়িয়ে থাকার পর একজন আর্মি এসে জানতে চাইল কি চাই। খোকন টিকেট এর কথা বললে বলল যে, এয়ারপোর্ট শুধুমাত্র সকাল ১১টা পর্যন্ত খোলা থাকে, কারণ সকল ফ্লাইট ১১টার মধ্যে চলে যায়। এরপর আর কোনও ফ্লাইট নাই। আর এখানে টিকেট পেতে হলে সকাল ১১টার আগে আসতে হবে। আমি আর খোকন রুম এ ফিরে আসলাম।
আমাদের আজকের প্ল্যান হল শহরের আশেপাশে বিভিন্ন ট্যুরিস্ট স্পটগুলো ঘুরে দেখব। সেই জন্য হাসান ভাই একটা মিনি ভ্যান এর ব্যবস্থা করে দিলেন ৪০০০ রুপিতে। আমরা যাব থ্রি ইডিয়টস স্কুল, থিকসে মনেস্টারি, স্পিটুক মনেস্টারি, ম্যাগনেটিক হিল, পাথর সাহিব, সঙ্গম, শান্তি স্তুপা ইত্যাদি। এই ভাড়া অনেক বেশি মনে হলেও লেহ এর তুলনায় বেশ কম। লেহ তে যেখানেই যাওয়া হোক না কেন ট্যাক্সি এর মডেল ভেদে ভাড়া বছরের শুরুতেই নির্দিষ্ট করে দেয়। আমরা যতগুলো স্পট এ গিয়েছি এগুলো সব ঘুরতে আমাদের ৫৫০০ রুপি লাগত। ২ টার দিকে আমাদেরকে নিতে ভ্যান চলে আসল, আজকের চালক এর নাম হায়দার বাট। খুবই চমৎকার একজন লোক, তবে উনার তুলনায় গাড়িটা একটু ছোট হয়ে গেছিল আরকি।
আমার ডান পাশেরজন হায়দার ভাই(অসম্ভব ভাল এবং অমায়িক একজন ভদ্র লোক)
র্যাঞ্চোর স্কুলের সামনে
আমরা প্রথমেই গেলাম থ্রি ইডিয়টস এর সেই বিখ্যাত র্যাঞ্চোর স্কুলে। স্কুলটার মূল নাম Druk Padma Karpo School. কিন্তু সেদিন আমাদের ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল না। লেহ তে তখন তিব্বতের দালাইলামা এসেছিলেন এবং বিকালে তিনি এই স্কুল এ যাওয়ার ফলে তার নিরাপত্তার জন্য প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। আমরা দরজা থেকে ঘুরে চলে এলাম। এরপর আমরা গেলাম থিকসে মনাস্টারিতে। থিকসে লেহ শহরের সব থেকে বড় মনেস্টারি। প্রায় ৩০০ বছরের পুরনো ভবনটাকে রাস্তা থেকে দেখলে অসাধারণ মনে হয়। আমি মূলত মনেস্টারিগুলো পছন্দ করি এর স্থাপত্য সৌন্দর্য এর জন্য এবং কাঠামোগত ভাবে এগুলো এত বছর কিভাবে টিকে আছে তা বোঝার জন্য। লেহ-মানালি হাইওয়ে এর পাশে মনেস্টারি টা পাহাড়ের উপর অবস্থিত। অবশ্য ওখানে যেতে হলে কাউকে হাঁটতে হবে না। গাড়ি নিয়ে ওঠার রাস্তা আছে যা একেবারে মনেস্টারির দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়।
থিকসে মনেস্টারি
হায়দার ভাই আমাদেরকে একেবারে উপরে নিয়ে এসে এক ঘণ্টা সময় দিল ঘুরে আসার জন্য। আমরা অনেকক্ষণ বাইরেই বসে রইলাম, কারণ এখান থেকে চোখের সামনের দৃশ্যগুলো অসাধারণ ছিল। বাঁ দিকে রুক্ষ ধূসর পাহাড়ের উপর মেঘের ছায়া, ডান দিকে সবুজ মাঠের মধ্য দিয়ে এঁকেবেঁকে সিন্ধু নদের বয়ে চলা এবং পিছনে লেহ শহর। একটা নদী যে একটা জনপদকে কিভাবে বদলে দিতে পারে তা সিন্ধু নদ কে প্রথমবারের মত দেখে উপলব্ধি করতে পারলাম। রুক্ষ মরুভূমির মধ্যে শুধু মাত্র নদীর দুই পাড়েই সবুজের সমারোহ। যেন সমগ্র পৃথিবীর সাথে রাগ করে সবুজ বৃক্ষগুলো নদীর কাছে দুঃখ প্রকাশ করতে গিয়েছে। একারণেই প্রাচীনকালে সভ্যতাগুলো নদীর দুই পাশেই গড়ে উঠেছিল।
থিকসে মনেস্টারির উপর থেকে
রাস্তার পাশ থেকে শে প্যালেস
মহান আল্লাহ তাআলার বৈচিত্র্যপূর্ণ সৃষ্টি
থিকসে থেকে বের হয়ে আমাদের যাওয়ার কথা ছিল শে প্যালেস। কিন্তু রাস্তার পাশ থেকে দেখেই সন্তুষ্ট থাকতে হল, কারণ শে প্যালেস কোনও কারণে তখন বন্ধ ছিল। আমরা একদিনেই অনেকগুলো স্পট দেখেছিলাম। তাই সময়ের অভাবে হেমিস এ যেতে পারি নাই। আমাদের পরবর্তী গন্তব্য ছিল সঙ্গম। এতক্ষণ যেসকল জায়গাতে গিয়েছি তার সব ই ছিল লেহ-মানালি হাইওয়েতে, আর এখন যে সকল জায়গাগুলোতে যাব তার অধিকাংশ লেহ-শ্রীনগর হাইওয়েতে। আমরা আবার লেহ শহরের দিকে চলতে শুরু করলাম। শহরের কাছাকাছি এসে রাস্তা দুইভাগ হয়ে গেছে। ডানের রাস্তা লেহ শহরের দিকে এবং বামের রাস্তা শ্রীনগর এর দিকে চলে গেছে। আমরা বামের রাস্তা দিয়ে লেহ এয়ারপোর্ট ক্রস করে যেতে থাকলাম। কিছু সময় পর হায়দার ভাই রাস্তার এক পাশে গাড়ি থামিয়ে আমাদেরকে ছবি তুলতে বলল। ঐ জায়গাটা আসলেই অনেক সুন্দর ছিল।
রাস্তার ধার থেকে সিন্ধু নদ
আমরা কয়েকটা ছবি তুলে আবার রওনা দিলাম। এদিকের রাস্তা টা চমৎকার, অনেকটা মোর প্লেইন্স এর মত। আমি রাস্তার দুই পাশ দেখতে লাগলাম। এখানে একটা ব্যাপার দেখে খুবই অবাক হলাম, রাস্তা থেকে ডান দিকে প্রায় ৬-৭ কিলোমিটার দূরে একটা গ্রাম তারু। সেই গ্রামে যাওয়ার জন্য এত উচ্চতায়ও সম্পূর্ণ পিচ ঢালাই করা রাস্তা বানিয়ে রেখেছে। প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা পর আমরা সঙ্গম এর সামনে চলে আসলাম। সঙ্গম হল সিন্ধু নদ আর জান্সকার নদের মিলনস্থল। জান্সকার নদ এখানে সিন্ধু নদের সাথে মিশে সিন্ধু নাম ধারণ করে সোনমার্গ এর দিকে এগিয়ে গেছে। আমরা পাহাড়ি রাস্তার পাশে গাড়ি থেকে নামলাম। এখানে প্রচণ্ড বাতাস এর কারণে দাঁড়ানো খুব ই কষ্টকর ছিল। মনে হচ্ছিল বাতাস উড়িয়ে নিয়ে যাবে। হায়দার ভাই আমাদের কে জিজ্ঞেস করল যে, নিচে যাব কি না। কিন্তু আমাদের হাতে সময় কম থাকার কারণে নিচে গেলাম না। ফেরার পথ ধরলাম।
সঙ্গম(সিন্ধু নদ আর জান্সকার নদের মিলনস্থল)
সঙ্গম থেকে ফেরার পথে
পিছনের পাহাড়টাই ম্যাগনেটিক হিল নামে পরিচিত
লেহ থেকে সঙ্গম যাওয়ার রাস্তায় ম্যাগনেটিক হিল এবং গুরুদুয়ারা পাথরসাহিব নামে আরও দুইটা স্পট আছে। আমরা প্রথমে সব থেকে দূরে গিয়েছিলাম। এবার লেহ ফেরার পথে আমরা ম্যাগনেটিক হিল নামক জায়গায় নামলাম। রাস্তার পাশের পাহাড় নাকি গাড়ি গুলোকে চুম্বকের ন্যায় আকর্ষণ করে। কিন্তু আমার কাছে তেমন কিছু লাগল না। তবে অনেকে বলল যে এইজন্য বাইক বাঁ গাড়ি নিয়া নাকি পাহাড়ের কাছে যেতে হবে। আমরা ১০-১৫ মিনিট ওখানে থেকে আবার রওনা দিলাম। আমার কাছে এইসব স্পটগুলোর থেকে এই রাস্তাতে চলতেই ভাল লাগছিল। এরপর গাড়ি পাথরসাহিব এ চলে আসল। সোহাগ এর আবার এইসব ব্যাপারে খুব আগ্রহ, তাই ও নেমে ভিতরে গেল, আমি রাস্তার পাশে দাড়িয়ে ছবি তুললাম। কিছুক্ষণ পর সোহাগ বাইরে এসে বলল যে, এইখানে আসলে কিছুই নাই। আমরা আবার লেহ শহরের দিকে চললাম।
নীল আকাশ, অসাধারণ মসৃণ রাস্তা, পাহাড়ের গায়ে মেঘের আলোছায়ার খেলা
আমার খুব ইচ্ছা করছিল ঐ একটা ছোট রাস্তা দিয়ে তারু নামক গ্রামটা ঘুরে আসতে। কিন্তু আমাদের অত সময় ছিল না, এবং হায়দার ভাইকে আগে বলাও হয় নাই। শহরের কাছাকাছি আসতেই আমরা চলে গেলাম স্পিতুক মনেস্টারিতে। এই মনেস্টারিটাও শহরের ঠিক বাইরে, এয়ারপোর্ট এর পিছনে একটা পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত। এখান থেকে লেহ শহর খুব কাছ থেকে দেখা যায়। স্পিতুক তৈরি করা হয়েছিল দ্বাদশ শতাব্দীতে। এটি লেহ শহরের অন্যতম পুরনো একটা মনেস্টারি। আমরা সিঁড়ি বেয়ে একেবারে চূড়ায় গিয়ে বসলাম। আধা ঘণ্টার মত ছিলাম ওখানে। সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে বিধায় তাড়াতাড়ি চলে আসলাম। শেষ বিকালে ঐ চূড়ায় বসে থাকতে ভালই লাগছিল।
স্পিতুক এর উপর থেকে লেহ শহর
আজকের আমাদের শেষ স্পট ছিল শান্তি স্তূপা। হাসান ভাই বলেছিল যে শান্তি স্তূপা তে নাকি সন্ধ্যায় গেলে সব থেকে ভাল লাগবে। তাই সবার শেষে আমরা এইটা রেখেছিলাম। শান্তি স্তূপা যাওয়ার পথে হায়দার ভাই আমাদের কে একটা পুরনো কেল্লায় নিয়ে গেল। এটার নাম ছিল zorawar fort. কেল্লা হিসেবে খুবই ছোট। কিন্তু একটা পুরনো কেল্লার আবহ আছে এর মধ্যে। আমরা ভিতরে ঘুরে দেখলাম। একটা জাদুঘরও ছিল এর ভেতরে। ওখানে লেহ এর অনেক ইতিহাস লেখা ছিল। আমার কাছে বেশ ভালই লেগেছে। এদিকে সন্ধ্যাও হয়ে আসছিল, তাই সোহাগ কে তাড়া দিলাম। এরপর আমরা চললাম শান্তি স্তূপার দিকে। একটা প্ল্যান ছিল যে, সিঁড়ি বেয়ে শান্তি স্তূপাতে উঠবো। কিন্তু দিনের শেষ বেলায় আর অন্ধকারে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে মন চাইল না। তবে সব থেকে বড় কারণ মনে হয় ছিল হাঁপিয়ে যাওয়ার ভয়, আর তিন দিন ধরে মাথার ভিতরে চিন চিন ব্যথা তো ছিলই।
হায়দার ভাই এর পক্ষ থেকে বোনাস হিসেবে লেহ শহরের ছোট একটা কেল্লা
আমরা পাহাড়ি পথ ধরে যখন শান্তি স্তূপায় চলে এলাম সূর্য ততক্ষণে ডুবে গেছে, এবং আকাশে রক্তিম আভা বিরাজ করছে। সেইদিন আবার ছিল পূর্ণিমা। আকাশে চাঁদটা জ্বলজ্বল করে সব দিকে আলোয় ভরিয়ে দিচ্ছিল। শান্তি স্তূপায় গিয়ে সন্ধ্যার এত স্নিগ্ধ পরিবেশ সেই সাথে হাল্কা একটা শীতল বাতাস মনে হচ্ছিল সত্যি সত্যি শান্তির কোনও দুনিয়ায় চলে এসেছি। এ অনুভূতি লিখে প্রকাশ করার মত নয়। মনে আলাদা একটা প্রশান্তি চলে আসল। শান্তি স্তূপা ১৯৯১ সালে জাপানিজদের দ্বারা স্থাপিত। কেউ যদি সিঁড়ি দিয়ে এখানে উঠতে চায় তাহলে তাকে প্রায় ৫০০ সিঁড়ি টপকাতে হবে। আর সাদা রঙের মন্দিরটিকে কৃত্রিম বিভিন্ন রকমের লাইটিং করা ছিল, যার প্রতিফলিত আলো জ্যোৎস্নার আলোর সাথে মিশে পুরো চত্বরকে এক মায়াবী রূপ প্রদান করেছিল। জীবন কত নির্ঝঞ্ঝাট, শান্তিময়। আমরা প্রায় এক ঘণ্টার মত ছিলাম ঐখানে।
সন্ধ্যায় অনন্য শান্তি স্তূপা
পূর্ণিমার আলোয় লেহ শহর(ক্যামেরায় চার্জ শেষ হয়ে যাওয়ার ফলে মোবাইল এ ধারণ করা)
শান্তি স্তূপা থেকে আমরা সরাসরি গেস্ট হাউজ এ ফিরে এলাম। খোকন অবশ্য মার্কেট এর সামনে নেমে গিয়েছিল। আমি আর সোহাগ ফ্রেশ হওয়ার জন্য গেস্ট হাউজে ফিরলাম। গেস্ট হাউজের সামনে গাড়ি থেকে নামতেই আমার মোবাইলে একটার পর একটা নোটিফিকেশন আসতে থাকল। হায়দার ভাই কে ভাড়া মিটিয়ে আমি রিসিপশনেই মোবাইল নিয়া বসে রইলাম। কিন্তু সেইদিন নেট অনেক স্লো ছিল। সোহাগ ফ্রেশ হয়ে এসে কিছুক্ষণ গল্প করে খেতে চলে গেল। আমি বসে রইলাম মোবাইলের স্ক্রিন এর দিকে তাকিয়ে। প্রায় ১০ মিনিট পর যখন ওয়েবপেজ লোড হল, আনন্দে আমার ভিতরের হৃদপিণ্ডের প্রতিটা স্পন্দন যেন আমি শুনতে পাচ্ছিলাম। গেস্ট হাউজ থেকে বেরিয়ে আসলাম। জ্যোৎস্নার আলোয় পোলো গ্রাউন্ডের পাশের নিরিবিলি রাস্তা দিয়ে যখন একা একা হেঁটে যাচ্ছিলাম, আর নিজেকে পৃথিবীর অন্যতম সুখী মানুষ মনে হচ্ছিল।
লাদাখ ভ্রমনঃ(১০ম পর্ব) – নুব্রার পথে পৃথিবীর সর্বোচ্চ (দাবীকৃত) গাড়ির রাস্তা খারদুংলা পাস
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা সেপ্টেম্বর, ২০১৭ রাত ৯:৩৫