১৯৯২ এর অক্টোবরের এক রাতে শ-দেড়েক ঘুমের ওষুধ খেয়ে ফেলেন শামশের ভাই। বেশ কয়েক মাস কোমায় থাকার পর ১৯৯৩ এর ১২ জুন কলকাতার পি.জি. হাসপাতালের বেডে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেন। কিন্তু ঘুমের ওষুধগুলো মুখে নেবার আগের সময়টায় কেমন ছিল তাঁর মানসিক অবস্থা। কী ভাবছিলেন তিনি। তাঁর হৃদয়-মনের ভিতর দিয়ে কোন ঝড় বয়ে যাচ্ছিল কি? এটা তো এক মুহূর্তের বিষয় নয়। দীর্ঘদিন ধরে এমন মনোবস্থার ভিতর দিয়েই তো যাচ্ছিলেন তিনি। ভিতরে ভিতরে প্রচণ্ড অবদমন কাজ করছিল তাঁর। হয়তো খাঁচায় বন্দী পশুর মতোই অস্থির হয়ে উঠেছিলেন। প্রচণ্ডভাবে গোটা সমাজব্যবস্থাকেই অস্বীকার করছিলেন। অস্বীকার করছিলেন সমসময়কে, চারপাশকে। আবার অবশ্য আমাদের মাঝে মাঝে এটাও মনে হয় যে শামশের এই অন্ধকূপ থেকে আদৌ মুক্তি চান নি। রিপু নিয়ে খেলতে খেলতে, ধ্বস্ত হতে হতে তারই নেশায় পড়ে গেছিলেন। মাদকের মত নিষিদ্ধ নেশা। আত্মপীড়নের সুখ। নইলে কেউ কেনই বা লিখবে : “এ জটিল পুজো ছেড়ে কীভাবে তোমাদের কাছে যাব?/ হে অখন্ড মন্দির! হে পতাকা!” (ব্যক্তিগত কাটামুন্ডের পুজো/ মা কিংবা প্রেমিকা স্মরণে)। আসলে তিনি বোধহয় জানতেন মুক্তি বলে কিছু হয়না। জানতেন এভাবে চলতে চলতেই দুম করে একদিন শেষ হয়ে যাবে খেলা। আর তাই বোধয় মেতে ওঠেন আত্মধ্বংসের খেলায়। আমরা পাঠ করতে পারি— আমি তোমাদের মুখের ওপর ছড়িয়ে দিই থুতুর নক্ষত্রমালা।— এইভাবে কবিতায় তাঁর অকপট আত্ম উন্মোচনে অবাক হয়ে যাই আমরা। যেন আপন অস্তিত্বের নিংড়ে দেওয়া সারাৎসারের ওপর দিয়েই হেঁটে যায় তাঁর কবিতা—
টমাটোয় থাকে ঘনীভূত বীর্যের খোয়াব,
সূর্য ও নারীর শ্রেষ্ঠতা এনে দেয় যা আমাদের
টমাটোর পাতার ধারাল চাবুকের গন্ধ অনুভূতিকে প্রখর করে —
আমাদের এনে দেয় লাল ও টাটকা ভোরের আস্বাদ,
টমাটো যুবতীদের হাসি, যুবতীদের পাছা ও যুবতীদের স্তনের গোল সারাৎসার
টমাটোর স্বপ্ন ও প্রতিভায় ফুলে ওঠে আমাদের প্রত্যেকের অন্ডকোষ:
কেননা টমাটোতেই থাকে লাল ও পরিপক্ক মৃত্যু।
(টমাটো/ মূর্খ স্বপ্নের গান)
কিংবা—
ব্যর্থতা ও গ্লানির ক্ষুধায় হস্তমৈথুনের সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়েই
আমি পুনরায় ব্যর্থতা ও গ্লানির নিঃসীম তটে ফিরে আসি
খোলা ব্লেড দেখলেই তৃষ্ণায় আমার গলা জ্বলে
পাখার হুক দেখলেই মনে পড়ে যায় সোনালী ফাঁসের কথা...
(কলকাতা আর আমার নিঃসঙ্গ বিছানা)
আহ্নিক বসু তাঁর এক গদ্যে শামশের আনোয়ারের কবিতাকে এক শব্দে অভিহিত করতে গিয়ে বলেছেন, ‘অস্বস্তিকর’। বলেছেন, ‘ভদ্রলোক আমাদের সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে অনেকটা দূর হেঁটে গেছেন। সেসব শুভ্র মেরুর দেশ খালি চোখে দেখা যায় না।’ দূরবীন প্রয়োজন। কিন্তু কেন ‘অস্বস্তিকর’ বলছেন। কী আছে তাঁর কবিতায়? সেই দূরবীনে যদি আমরা দেখতে চাই তিনি দূরের কোন কোন পথে হেঁটে গেছেন, তাহলে কি প্রথমেই আমাদের মনে পড়ে না সেই ঈদিপাসের কথা?
ঈদিপাস কমপ্লেক্স
গ্রীক নাট্যকার সফোক্লিস তার “ঈদিপাস রেক্স” নামক নাটকটির (৪২৯ খ্রীস্টপূর্বাব্দ) কাহিনীতে বর্ণনা করেছেন, থিবস্ নামের এক দেশের রাজা ঈদিপাস নিজের অগোচরে অথবা পূর্বের অভিশাপ অনুযায়ী নিজের পিতাকে হত্যা করে তার রাজ্য অধিকার করেন এবং নিজের মাকে বিয়ে করেন। এই ঈদিপাস নামক রাজার নামানুসারে সিগমুন্ড ফ্রয়েড পুত্র সন্তানের মায়ের প্রতি থাকা এক ধরনের অবচেতন যৌনকামনার নাম রাখেন ঈদিপাস কমপ্লেক্স। ফ্রয়েডের মতবাদ অনুসারে, শৈশবকালে পুত্র সন্তানদের মায়ের প্রতি এক ধরনের অনুরাগ অথবা আকর্ষণ গড়ে ওঠে এবং এই অনুরাগ জন্ম নেয় সন্তানের অকালজাত যৌন চেতনার প্রভাবের ফলে। এর সমান্তরালভাবে পুত্রসন্তানদের মনে পিতার প্রতি এক ধরনর বিরাগ বা বিকর্ষণও ঠাঁই নেয়।
তোমার স্তনের উৎসে মুখ রেখে শুষে নিয়েছিলাম দুঃখের কালো দুধ
সেই থেকে আমি বৃক্ষহীন নিজের ছায়ার গায়ে কুঠার মারি
তুমি ক্রোধে আজো আমাকে অভিশাপ দাও
আমি বারবার তোমার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করেছি
প্রত্যেকবার নিজেরই চক্রান্ত আমাকে লজ্জা দিয়েছে
আমি বুঝতে পেরেছি তোমার কাছে আমার পরাজয় চিরকালের
অপমান-বোধ আজ আমার দৃষ্টিশক্তি ধ্বংস ক’রে ফেলেছে
মগজের কোষ থেকে ঝ’রে পড়ছে ঠাণ্ডা অসহায় রক্ত
শরীরের দুঃখের ঋণ কি শোধ করা যায়
আমিই তো কিশোরীর ভয়ংকর স্তনে মুখ রেখে
শুষে নিয়েছিলাম দুঃখের বিষাক্ত ক্ষুরধার কালো দুধ
(মাতৃবন্দনা)
ফ্রয়েডের এই মতবাদ অনুসারে বলা যায় মায়ের প্রতি ছেলে শিশুর ভালোবাসার মতো পিতার প্রতি মেয়ে শিশুর ভালোবাসাও বিদ্যমান। তবে, ঈদিপাস কমপ্লেক্সের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে মাতার প্রতি শিশু পুত্রের দৈহিক আসক্তি। পিতার প্রতি শিশু পুত্রের ঈর্ষাবোধ এই আসক্তির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। আমরা জেনেছি, মানুষের ব্যক্তিত্ব বিকাশ সর্বমোট পাঁচটি স্তরের মধ্যে দিয়ে সম্পূর্ণ হয়।– ১)মৌখিক অবস্থা (oral stage), ২)পায়ু অবস্থা (anal stage), ৩)শিশ্ন অবস্থা (phallic stage), ৪)সুপ্তযৌন অবস্থা (latency stage), ৫)উপস্থ অবস্থা (genital stage)। ঈদিপাস কমপ্লেক্স সংঘটিত হয় এর তৃতীয় স্তরে শিশ্ন অবস্থায় (৩ - ৬ বছর বয়সে) নিজ দেহের যৌন-সংবেদী অঞ্চলগুলির সুখদায়ক অনুভূতির সময়। এই ঈদিপাস কমপ্লেক্সেই কি ছেয়ে আছে শামশের আনোয়ারের অনেক কবিতাই?
মা, তোমারই চতুর আঙুল বাজিয়ে দেয় স্বেচ্ছাচারী বাঁশি
আর দ্যাখো, ঐ সবুজ পতাকা কী ভীষণ হিংস্র গর্জন ক’রে ওঠে
দূরে একনিষ্ঠ জিঘাংসায় জ্বলে হারিকেন
যেন বা অন্ধকারে
ওৎ পেতে আছে দৃপ্ত রোষায়িত স্তন, অথচ তোমার স্তনে
আঘাত ছিলো না, কোমলতা ছিলো, আশীর্বাদ ছিলো
আমি কতদিন তোমার স্তনের মতো দুটি সেবাপরায়ণ
স্তন খুঁজেছি, তবু
মা, তোমার আঙুলে বাজে বাঁশি,
সবুজ পতাকা গর্জন ক’রে ওঠে, দূরে লাল হিংসায়
জ্বলে হারিকেন, গোটা বধ্যভূমি দুলে ওঠে।
তিন মিনিটের ফুর্তির বিনিময়ে তোমার চিৎকার ও রক্তপাত
চিৎকার ও রক্তপাতের বিনিময়ে তোমার কামনা ছিলো
আমার সংহার ও সফলতা
(তুমি নারী, মা কিংবা প্রেয়সী)
অনির্দেশ্য ঈর্ষা
মনে আছে, সেই কবে, সবে মাত্র কবিতা লিখতে শিখছি। নতুন কোনো কবিতা লিখেই বন্ধুদের আড্ডায় তা পড়ে শোনানো। তারপর সে নিয়ে আলোচনা। সে আনেক আগের কথা। কবিতার ঘোরের ভিতর তখন আমাদের ঘুম ভাঙত, আবার কবিতার চিন্তার মধ্যেই ঘুম আসতো। মনে হতো, প্রতিদিন অন্তত একটা হলেও কবিতা লিখবো। ভালো কবিতা। মাঝেমধ্যে এমনও হয়েছে একটাও ভালো কবিতা লিখতে পারছিনা। অথচ বন্ধুদের কেও কেও অসাধারণ সব লিখে যাচ্ছে। মনে মনে ঈর্ষা হোতো তখন। সেখান থেকে হতাশা। তারপর এমনকি রাগও হোতো। অনির্দেশ্য রাগ। কার উপর যে হোতো বুঝতে পারতাম না। একবার তো এমনই ঈর্ষা-হতাশা-রাগ নিয়ে ঘরে ফিরে আসি অনেক রাতে। অন্ধকার ঘরে কাপড় চোপড় খুলে সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে সিগারেট ধরাই। আর খোলা জানালা দিয়ে একবার তাকাই ব্যস্ত রাস্তার দিকে আর একবার আকাশে। অনেকক্ষণ এইভাবে কাটিয়ে একসময় নিস্তেজ হয়ে শুয়ে পড়ি। নিজের অদ্ভুত ওই আচরণে নিজেই অবাক হই পরে। না, কোনো কবিতা আসেনি মনে। আর আজ এতো বছর পর, জীবন ও জীবিকার ফাঁদে পিষ্ট হতে হতে এই আমি যখন দেখি সারাদিন সবজি ফেরি-করা লোকটাও দিন শেষে শিস দিতে দিতে বাড়ি ফেরে, তখন খুব ঈর্ষা হয়। সেই অনির্দেশ্য রাগ এসে ভর করে। তবে শামশের আনোয়ার তাঁর ঈর্ষা-কে কবিতায় এনেছেন আরও অকপট আরও আশ্চর্য নগ্ন ভাবে। আমরা দেখি যে, বন্ধুর বিষণ্ণ চোখকে তাঁর ঈর্ষা হয়। বন্ধুর, পবিত্র পাথরের মতো নরম বুক, যেখানে কেবল কবিতা আর কবিতা—তাকেও ঈর্ষা হয়। সবচে অদ্ভুত যে, আমার চেয়েও দুঃখিত মানুষের মতো রাস্তায় হেঁটে যেতে পারে সে, এ’জন্য তাকে ঈর্ষা হয়। শুধু তাই নয়—ঈর্ষায় ক্রোধ জন্মায়। আমার চেয়েও সন্ন্যাস নিয়ে বন্ধুর দুই চোখ দারুণ বিষণ্ণ হতে পারে। এই তার অপরাধ। এই আক্রোশে ছুরি হাতে বন্ধুর শিয়রে এসে দাঁড়িয়ে যাই আমি। ইচ্ছে হয় চোখ-শুদ্ধ গাঢ় লাল ছুরি তার বুকের ওপর বসিয়ে দিই।
তুই বিশ্বাস কর বিষ্ণু অন্য কোনো কারণে নয়
আমার মুঠোর ভিতর ঈর্ষার ছুরি
ছুরির ফলায় তোর দুই নক্ষত্র চোখ জ্বলে
ট্রাফিকের মতো দুই চোখ—
যেন এখনই শেষ ভূমিকম্প নামবে পৃথিবীর ওপর
রজনীগন্ধা হয়ে তোর দুই চোখ চিরকাল বিষণ্ণ
নিজের সমাধির পাশে
চোখ-শুদ্ধ গাঢ় লাল ছুরি তোর বুকের ওপর বসিয়ে দিই
অমন নরম বুক, কবিতার উইপোকায় খেয়ে গেছে
পবিত্র পাথরের মতো চুমু খাওয়া যায়
অন্য কোনো কারণে নয়—
নির্জন বৃষ্টির মধ্যে—তুই আমার চেয়েও দুঃখিত লোকের মতো
হেঁটে যেতে পারিস
কিংবা তোর দুই চোখ আমার দুই চোখের চেয়েও
অনেক বেশি সন্ন্যাসী
শুধু এই আক্রোশে হাতে ছুরি তোর ঘুমের পাশে এসে দাঁড়িয়েছি—
(ঈর্ষায় রচিত কবিতা)
হ্যাঁ, এইরকম ঈর্ষা আক্রোশেও পড়েছি আমরা জীবনে। সেই ইচ্ছার কথা সচেতন ভাবে এখন হয়তো মনে নেই আমাদের। আমরা মনে রাখতে চাইনি। কারণ, এই চাওয়াটা অবাঞ্ছিত। মনের অন্ধকার কুঠুরিতে পড়ে থাকা, সভ্যসমাজ দ্বারা অবদমিত সেই ইচ্ছা। যা আসলে ওই অন্ধকার ঘরেই ঘুরে ফেরে। বাইরের আলোয় আসে না কখনও। কিন্তু এই যে শামশের ভাই কী অবলীলায় তা তুলে আনলেন কবিতায়! আরেকটি কবিতা আছে “গোপন কার্তুজ।”
বড়দিনের ঠিক আগের সন্ধ্যায় সে তার লাল রিবন নাচিয়ে
বলেছিলো, ছোঁড়ো ঐ পিস্তল, বাবা দেখি আমি
সেদিন বিকেলেই অবশ্য শেরিফ তাকে মুক্তি দিলেন
হতভাগ্য পিতা জানতো না যে পিস্তলে একটিমাত্র কার্তুজই
লুকানো ছিলো।
শেরিফ বোঝেন নি, কিন্তু আজ থেকে দু-বছর আগে—
যেদিন কাফে দ্য মনিকোর একটি নির্জন কেবিনে
আমি তনিমা ঘোষালকে খুন করি, সেদিন আমার কাছেও
একটিমাত্র কার্তুজই ছিলো, খেলাচ্ছলে আমিও ঐ পিস্তল
ছুঁড়েছিলাম, এর ঠিক দু-মাস দশদিন পর অনুরাধা সেন
তার বালিগঞ্জের ফ্ল্যাটে আমাকে হত্যা করলো
অনুরাধার কোলের উপর আমার মাথা ছিলো
আমি ওর ছোট্ট ঝকঝকে সুন্দর পিস্তলখানা নিয়ে
অনেকক্ষণ খেলাও করেছিলাম, অনুরাধা জানতোনা পিস্তলে
একটিমাত্র কার্তুজই ছিলো
শেরিফ, সেই হতভাগ্য পিতা, অনুরাধা সেন, এমনকি
তনিমা ঘোষালও বোঝেন নি, কিন্তু আমি জানি
আমাদের ব্যক্তিগত পিস্তলের কোনো এক মারাত্মক খাঁজে
একটি মাত্র গোপন কার্তুজ লুকানো থাকে, খেলাচ্ছলে
আমরা পিস্তল ছুঁড়ি, ঐ কার্তুজ তখন আমাদের
অবদমিত ইচ্ছা নিয়ে খেলা করে।
(গোপন কার্তুজ)
প্রতিটি কবিতায়, কথা বা শব্দের আড়ালে কিছু সত্য লুকিয়ে রাখেন কবি। কবিতা পাঠ করতে করতে সেই সত্যকে আবিষ্কার করেন পাঠক। আর তাতেই কবিতাটি কবিতা হয়ে ওঠে পাঠকের কাছে। আনন্দ খুঁজে পান তিনি। খেলাচ্ছলে কিছু দুর্ঘটনার কথা বলা হচ্ছে কবিতায়। একইরকম ভাবে ঘটে যাওয়া কিছু খুন বা হত্যার বর্ণনা। শেরিফ, হতভাগ্য পিতা, অনুরাধা, কবি নিজে এবং তনিমা ঘোষাল। একে একে প্রত্যেকের ঘটনা ঘটে যায়। যেখানে পিস্তল আর তার কার্তুজ প্রতিটি ঘটনায় সাধারণ হয়ে প্রাধান ভূমিকা রাখে। তারপর শেষ স্তবকে আসে মোক্ষম দু’টি লাইন— যা কেউ বুঝতে পারে না সচরাচর— ‘আমাদের ব্যক্তিগত পিস্তলের কোনো এক মারাত্মক খাঁজে একটি মাত্র গোপন কার্তুজ লুকানো থাকে।’ আমাদের মনের গহিনে যে অন্ধকারের কথা বলছিলাম আগে, সেইখানে, কার্তুজ লুকানো থাকে, সেই কার্তুজ আমাদের কিছু-না-কিছু অবদমিত ইচ্ছে নিয়ে খেলা করে। খেলাচ্ছেলেই আমরা হয়তো এমন কোনো কথা বা কাজ করে ফেলি যা অন্যের মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কিংবা যাকে বলি সে মনে কষ্ট পায়। মৃত্যুর সমান সে’ কষ্ট। আর এভাবেই এই কবিতাটির সত্য এসে ধরা দেয় পাঠকের সামনে তার আশ্চর্য নিয়ে। এভাবেই এইসব অবাঞ্ছিত অঘটন প্রায়শই ঘটে যায় তাঁর কাবিতায়।
উদ্দীপিত বাস্তবতা
তিনি শামশের আনোয়ার। সমসময়ের সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, শঠতা, একাকীত্ব, স্বপ্নভঙ্গের ক্ষত থেকে উৎসারিত বেদনা, হতাশা, পরাজয়ের অবদমিত কষ্ট—এইসবই কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিল তাঁকে। নিজের ভিতর পুষে রাখছিলেন সব। মানতে পারছিলেন না। ভিতরে ভিতের প্রচণ্ডরকম এক ‘না’ কে ধীরে ধীরে বড় হতে দিচ্ছিলেন। আর এর জন্যই হয়তো তাঁর কিছু কবিতায় আমরা পড়তে পাই ক্ষোভ আর তীব্র রাগ। যা আমাদের দারুণভাবে স্পর্শ করে যায়। ভীষণ অবাক হই যখন—
আমার ইচ্ছে হয় কলমটাকে পেটের ভিতর বসিয়ে
দিই আমূল, বদ্ধ—যেখানে স্ত্রীলোকেরা ধারণ
করে ভ্রূণ কিংবা যে হৃদয়ের ভিতরে থাকে
স্বামীর প্রতি ভালোবাসা।
আমার ইচ্ছে হয় কলমের নিব ঠুকে বসিয়ে
দিই জিভের ওপর;
সংখ্যাহীন যা নাড়িয়ে নাড়িয়ে পৃথিবীর মানুষেরা কথা বলে
অথবা কপালের ভিতর ঢুকিয়ে বিদ্ধ করি মগজ—
যে চোখ দিয়ে মানুষ তাকায় ও বিচার করে
ইচ্ছে হয় সেই চোখের ভিতর মর্মান্তিক, ক্লিপ অবধি
ঢুকিয়ে দিই আমার কলম।
(মর্মান্তিক, ক্লিপ অবধি)
এবং দেখি যে কবিতাটি পাঠ করতে করতে এই ক্ষোভ আমার ভিতরেও সঞ্চালিত হচ্ছে। মনে হয় যেন—
মাঝে মাঝে আমার ঘরের সমস্ত কিছু হঠাৎ
কুকুরের মতো ডেকে ওঠে
আয়না, মার্বেলের হাতি, টেলিফোন সমস্ত কিছুই রাগে কুঁজো
হয়ে, চোখ পাকিয়ে ছুটে আসতে চায়—
ভৌ ভৌ শব্দে চিৎকার করে
এমনকি আঙুলের দশটি নখে আমি দশটি ছোট অথচ হিংস্র
কুকুর জেগে উঠতে দেখি, তারাও ক্রুদ্ধ হয়ে ডাকতে ডাকতে
আঙুল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে চায়
ওই সব কুকুরদের ডাকের ঝড়ে ধুলোয় ভর্তি হয়ে ওঠে
আমার ঘর, পর্দা ওড়ে—জানালা বন্ধ হয় এবং খুলে যায়
হুক লাগানো শিলিং-এ নিজেরই লেজ কামড়ে ধরার
জন্য পাগল, বিদ্যুৎস্পৃষ্ট ফ্যান ঘুরে চলে সমস্ত রাত…
(কুকুর, হতাশা এবং ক্রোধ)
হতাশা এবং ক্রোধের এও এক অভিনব চিন্তা। অদ্ভুত প্রকাশ। কবিতাটি পড়তে পড়তে সাধারণ ঘর আসবাবপত্র সব, এমনকি আমিও আমার কাছে আচমকা বদলে যাই। চোখের সামনের জগৎ ঘুরে যায় অন্য জগতে। খুলে যায় অন্য পৃথিবী। সারারাত ঘুম হয় না আমার। মাথার পেছন দিকে টান টান উত্তেজনা অনুভব করি। মাঝেমধ্যেই ড্রেসিং টেবিলের দিকে চোখ যায়, মাঝেমধ্যেই হাত উঁচু করে নখ দেখি। আমার ঘর আমার পর্দা ফ্যানের বাতাসে দোলে সারারাত। আমি চোখ বন্ধ করে ভিতরের কুকুরটাকে দেখতে চাই। কান খাঁড়া করে শুনতে চাই ওর চিৎকার। আর ওই চিৎকারে মিশে যেতে চেয়ে ধীরে ধীরে আমার মধ্যে এসে ধাক্কা খায় সেই অস্থিরতা। কবিতার ভিতর থেকে উঠে আসা ক্রোধ। সংক্রমিত হয়। তারপর ধাক্কা খেতেই থাকে রাত ভোর হওয়া পর্যন্ত। বিদ্যুৎস্পৃষ্ট ফ্যানের মতো ক্রোধাক্রান্ত হয়ে নিজেরই লেজ কামড়ে ধরতে চাই যেন। নিজের নখ যে নিজের কাছেই হঠাৎ অচেনা হয়ে উঠতে পারে এইভাবে, জানিনি আগে। এক আশ্চর্য উদ্দীপিত বাস্তবতা (augmented reality) খুলে যায় আমার সামনে। বুঝতে পারি এদ্দিন যে বাস্তবতার কথা ভাবছিলাম আমি, ভাবছিলাম যা কবিতায়ও হতে পারে,—এ’তো সে’ই। শামশের আনোয়ার যেটা করে রেখেছেন সেই কবে!
হ্যাঁ, উদ্দীপিত বাস্তবতার এই জগৎ এমনই এক জগৎ যার থেকে শামশের ভাই কখনও বেরুতে পারেন না। হয়তো এখানেই তাঁর কবিতার শক্তি, এখানেই নিহিত রয়েছে তাঁর জীবনকবিতার মূলসূত্র। এটাই তাঁর কবিতার আশ্চর্য।
—ঋতো আহমেদ; ৮ই আগস্ট, ২০২১
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই আগস্ট, ২০২১ রাত ১১:৩৭