ভূমিকার পাঠ
‘কবিতা—এটা লেখার জিনিস নয়।’ শুরুতেই থমকে যেতে হয় কথাটা পড়ে। অজান্তেই ভেতরে কৌতুহল জাগে— কী বলতে চাইছেন কবি। ‘তবে কি নিজে নিজে হয়ে ওঠে কবিতা? না, তাও নয়।’ তাহলে কী সেটা? কী সেই প্রক্রিয়া? আমাদের মনে ও মননে প্রতিফলিত হয় ভাবনার আলোকরশ্মি। মাথার ভেতর ঘুরপাক খেতে থাকে পুরোনো পাঠ ও শ্রুতি। মনে পড়ে ফ্রাঞ্জ রাইটকে একবার এক সাক্ষাৎকারে বলতে শুনেছিলাম কবিতার বিশেষ মুহূর্তের কথা, আচ্ছন্ন হওয়ার কথা। আধ্যাত্মিক ব্যাপারের মতো রহস্যময় আহ্বানের কথা বলছিলেন তিনি। চাইলেই সেই মুহূর্তকে ফিরিয়ে আনতে পারতেন না। ওটা ছিল তার নিয়ন্ত্রণের বাইরের। অপেক্ষায় থাকতেন কখন ফিরে আসবে সেই ঘোর— কবিতা লিখবেন। আর আমাদের মন্দাক্রান্তা সেন? তিনি তো ইথারেই খুঁজে পান তার কবিতার সব পংক্তি। পাঠের শুরুর সময় থেকেই তাই আমাদের মনের ভেতর যে ধারণা গড়ে উঠতে থাকে কবিতার সূচনা-মুহূর্তটি সম্পর্কে, তা এক ঐশ্বরিক অনুভবের ধারণা। আমরা ভাবতে থাকি কবিতাকে লেখা যায় না, এটা অবতীর্ণ হওয়ার বিষয়। এক ধরনের অলৌকিক স্পার্কের মাধ্যমে কাব্যিক আবেশের ভেতর ঢুকে যান কবি। তারপর জন্ম হয় কবিতার। কিন্তু কবিই আবার বলছেন, ‘..না, তাও নয়। ছড়িয়ে থাকা চারপাশকে, এই বিশ্বজগৎকে, দেখে দেখে দেখে যে চরম বিন্দুতে পৌঁছায় আমাদের চিন্তা, যে পার্শ্ববিন্দুগুলোতে, এবং দুঃসাধ্য চেষ্টায় সেই চরমকে অতিক্রম করতে গিয়ে— কখনো-বা আটকে গিয়ে— কাতরায়, কবিতা মানুষের সেই কাতরানি। সেই আবিষ্কার এবং অসহায়তা।’ তাহলে— এইখানে এসে পাল্টে গেল সব? নাকি আগের অসম্পূর্ণ ধারণাটি এবার আরও পরিণত হয়ে সম্পূর্ণতার দিকে এগিয়ে গেল?
দৈবাদিষ্টতা নিয়ে জানতে চাওয়ায় জোসেফ ব্রডস্কিকে একবার বলতে শোনা গেছে— ‘এটা নিয়ে উদ্বেগের কিছু নেই, কারণ সেটা হতেও পারে আবার নাও হতে পারে। ওগুলো আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে।..যদি কেউ বলেন, কবিরা আবিষ্ট কণ্ঠস্বর শুনতে পান, আমি বলবো তা বাজে কথা, যদি-না সেই আবেশের প্রকৃতিকে নির্দিষ্ট করা হয়। কিন্তু যদি আমরা আরও একটু ভালো করে লক্ষ্য করি, তাহলে বুঝতে পারবো এই আবিষ্ট কণ্ঠস্বর প্রকৃতপক্ষে ভাষারই কণ্ঠস্বর। আমি যতোটা বলছি তার চেয়ে অনেক বেশি জাগতিক এটা।’ ব্রডস্কির এই বক্তব্যের সাথে আমরা যখন মুখোমুখি সম্পর্কিত হই, আমাদের দৈবাদিষ্টতার ধারণার উপর সমাপতিত হয়ে ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে থাকে কাব্য-কৌশল কথাটি। অতি-জগৎ থেকে নেমে, ফিরে আসি পার্থিবতায়। তাকাই, ছড়িয়ে থাকা চারপাশে। বিশ্বজগৎকে দেখি আর দেখি। আর আমাদের চিন্তা এক-একটি স্তর অতিক্রম করে এগিয়ে যেতে থাকে কোথাও। হয়তো পৌঁছায় কোনো চরম বিন্দুতে। তারপর শুরু হয় নিজেকে অতিক্রম করার দুঃসাধ্য প্রয়াস। কাতরানি। অসহায়তা। আবিষ্কার। এবং কবিতা। আর—
মণীন্দ্র গুপ্ত মনে করতেন ‘কবিতা একটি জীবিত প্রক্রিয়ার ফল, এবং সে স্বয়ংও প্রচণ্ডভাবে জীবন্ত।..কবিতার বীজ প্রত্যক্ষ ও প্রাথমিক অবস্থায়, আমাদেরই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। কিন্তু পরমুহূর্তেই সে স্মৃতি— অভিজ্ঞতা বা অভিজ্ঞতাজাত স্মৃতি এবং কবিতা যেহেতু অভিজ্ঞতার সঙ্গে সংলগ্ন থেকে লেখা যায় না, অর্থাৎ লৌকিক অভিজ্ঞতা যতক্ষণ না দ্বিতীয় ভুবনের অলৌকিকতায় প্রবেশ করছে ততক্ষণ কবিতার জন্মচক্র সঠিকভাবে আরম্ভ হয় না।’
তাহলে এই যে চারপাশ, এই যে বিশ্বজগৎ, এই যে চরম বিন্দু আর পার্শ্ববিন্দুগুলোর কথা বলা হলো— সে তো আমাদেরই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। আর চরম বিন্দুকে অতিক্রম করার কাতরানি— অসহায়তা— আবিষ্কার— যেন ওই দ্বিতীয় ভুবনের অলৌকিকতায়ই প্রবেশ-প্রয়াস।— কবিতার জন্মচক্রের শুরু। এইভাবেই যেন ভূমিকার পাঠে জুড়ে যাচ্ছেন সকলে। ফ্রাঞ্জ রাইট, মন্দাক্রান্তা, ব্রডস্কি থেকে মণীন্দ্র গুপ্ত, একরাম আলি— সবাই। সমস্ত কবিতা— কবিতা-ভাবনা, পরস্পর ঠিক যেন সম্পর্কিত।
চিন্তা মূলত নিভৃতিসন্ধানী
..পিঁপড়েরা টেনে নেয়, পিঁপড়েরা খুঁটে খুঁটে খায় কালো তারার মগজ।— সে দেখেনি। কিন্তু, আমরা দেখতে চাই, আর খুঁজি, বলিশের গর্তে কালো মাথা, ধ্রুবতারা। আমাদের অন্তর্চোখ এইভাবেই নক্ষত্রলোকের দিকে তাকিয়ে শুরু করে আরও এক নিবিড় ভ্রমণ। তিরিশ বছর শেষ হয়ে এলে দু-ধারে নদীর জল যেমন ফেঁপেফুলে ওঠে— যত দিন যায়, নিভৃতি আমাদের ভেতর ভাবনায় জামের রঙের মতো গাঢ় হয়ে আসে। আমরা ঘুরে বেড়াই পাড়ার গলির পাকে পাকে। বিড়ি ধরাই।
১৯৮৩ থেকে আমাদের এই ভ্রমণ। নিভৃতিসন্ধানী চিন্তার ভ্রমণ।
একদিন, সেই ভ্রমণের পৃষ্ঠা ওল্টাতেই একজন গেরিলা অতর্কিতে এসে হাজির হন তার স্বপ্ন নিয়ে। আর সেই স্বপ্নের ভেতর ডুবে যেতে গিয়ে গেরিলা, মেয়ে, হত্যা, স্বপ্ন, প্রতিশোধ— এইসব মাথার ভেতর ঘুরপাক খেতে থাকে আমাদের। দেখতে পাই চারিদিকে অলিভ পাতার চকচকে হাসি। দেখি সবুজ জঙ্গলাকীর্ণ বিছানা। কিন্তু স্বপ্নের ভেতর ঘটনা বা দৃশ্যের পরম্পরা কি ঠিক থাকে মানুষের? কিংবা যৌক্তিকতা? আমাদের কারো কারো হয়তো গেরিলা বলতেই মনের পটে মূর্ত হয়ে ওঠে চে গুয়েভারার ছবি। অলিভের জঙ্গলে রাইফেল হাতে এগিয়ে যাচ্ছেন চে। তিনি কি কোনো মেয়েকে কখনো হত্যা করতে চেয়েছিলেন? যার ভাই তাঁর স্বপ্নে প্রতিশোধ নিতে আসে। হয়তো না।
এরকম কথাও দিয়েছিলাম, কিন্তু শুধু আমি জানি
ভোট কাকে যে দিয়েছি, আজ ভূত-হয়ে-যাওয়ার পরেও
মধ্যগ্রীষ্মরাতে সেই নেতা লোহিত নদীর জল সাঁতরে
এসেছে আমার ঘুমকিনারায়
(একজন গেরিলার কথা/অতিজীবিত)
লোহিত নদীর জল সাঁতরে এসেছে আমার ঘুমকিনারায়। ঘুমকিনারা কথাটা পড়তেই ঘুম কেমন নদী হয়ে গেল। ঘুম যেন এক অথৈ নদী। যার কিনার মানে তীরে সাঁতরে এসেছে সেই নেতা যাকে ভোট দেয়ার কথা। কিন্তু দিয়েছি কিনা সে কেবল আমরাই জানি। আবার লোহিত নদীর জল সাঁতরে মানে তো আমাদের অন্তর্গত রক্তের স্রোতের ভেতর দিয়ে এগিয়ে এসেও হতে পারে— । তাহলে, ভোট কাকে দিয়েছি যে, তা আজ অতীত হয়ে গেছে। কিন্তু তবু এই গ্রীষ্মের মধ্যরাতে ঘুমের ভেতর আমাদের রক্তস্রোত সাঁতরে এগিয়ে আসেন সেই নেতা। ‘যে-মেয়েটিকে আমি হত্যা করতে আজও চাইছি / তার স্তন, যোনি, লম্বা লম্বা হাত ও পায়ের / ডিজেল-চিৎকার থেকে উঠে এসে..’ আবারও একবার থমকে যাই আমরা এখানে ‘ডিজেল-চিৎকার’ কথাটায়। কে এই মেয়ে? সেই নেতার বোন? ‘ডিজেল-চিৎকার’-ই-বা কী? এবং কেন? আমাদের ঘুমের ভেতর, স্বপ্নে, সেই মৃত, ভূত-হয়ে-যাওয়া, অতীত ফিরে আসে আজ। আমাদের নেতা। আবারও আগামী ভোটের দিকে টেনে নিয়ে যাই তাকে। বলি, এই দিকে দরজা খোলার শব্দ। এইদিকে ভবিষ্যৎ।
গায়ে ‘সমগ্র বাংলাদেশ পাঁচ টন’ লিখে রাজপথ জুড়ে দানবের মতো ছুটে যাওয়া ট্রাকগুলোর কথা মনে করি। সেই ছোট বেলা থেকে দেখছি নিচের দিকে মাঝ বরাবর জ্বালানী ট্যাঙ্কে লিখা— ‘ডিজেল।’ তবে কি ডিজেল চালিত ইঞ্জিনের আওয়াজের সাথে তুলনা করা হলো? স্তন, যোনি, লম্বা লম্বা হাত ও পা— এগুলো তো সব জৈবিক, আর ডিজেল যান্ত্রিক। জৈব-যান্ত্রিকতার বেষ্টন থেকে উঠে এসে আগামীর দিকে যাত্রার কথা বলা হচ্ছে তবে?
আবার এওতো মনে হচ্ছে, গেরিলা মানে যোদ্ধা, মানে সমাজ ব্যবস্থার বৈপ্লবিক পরিবর্তন চাওয়া সক্রিয় শক্তি। তিনি জৈব-যন্ত্রিকতাকে হত্যা করতে চাইছেন। চাইছেন নতুন সমাজ নতুন ভবিষ্যৎ। আর সেদিকে টেনে নিয়ে এগিয়ে দিচ্ছেন জৈব-যন্ত্রিকতারই সহোদরকে। মানে সাধারণকে। কিন্তু কেন সে প্রতিশোধ নিতে আসবে স্বপ্নে? স্বপ্নে প্রতিশোধ নিতে আসা মানে তো এই পুরো ব্যাপারটায় আমাদের(গেরিলার) মনের ভেতর অপরাধবোধ রয়েছে কোনো। লুকিয়ে আছে বিরাট কোনো হিপোক্রেসি। কেননা ভোট যে কাকে দিয়েছি সে কেবল আমরাই জানি। আর তাঁকে সবুজ জঙ্গলাকীর্ণ বিছানার দিকে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বলি, ‘ব্যস্ত কী, এই সবে দুপুর হয়েছে’।
যে-মেয়েটিকে আমি হত্যা করতে চেয়েছিলাম
স্বপ্নে, তার ভাই আজ প্রতিশোধ নিতে ছুটে আসে
অলিভ পাতার হাসি চারিদিকে চকচক করে
আমি তাঁকে সবুজ জঙ্গলাকীর্ণ বিছানার দিকে
টেনে নিয়ে যেতে যেতে বলি,‘ব্যস্ত কী, এই সবে দুপুর হয়েছে’
এরকম কথাও দিয়েছিলাম, কিন্তু শুধু আমি জানি
ভোট কাকে যে দিয়েছি, আজ ভূত-হয়ে-যাওয়ার পরেও
মধ্যগ্রীষ্মরাতে সেই নেতা লোহিত নদীর জল সাঁতরে
এসেছে আমার ঘুমকিনারায়
যে-মেয়েটিকে আমি হত্যা করতে আজও চাইছি
তার স্তন,যোনি, লম্বা লম্বা হাত ও পায়ের
ডিজেল-চিৎকার থেকে উঠে এসে, আজ
তাঁকে, আমি পুনরায় আগামী ভোটের দিকে
টেনে নিয়ে যেতে যেতে বলি, ‘আসুন, আসুন
এই দিকে দরজা খোলার শব্দ, এই দিকে আসুন’
(একজন গেরিলার কথা/অতিজীবিত)
শেষ পর্যন্ত মনে হয় ঘৃণা, মিথ্যে স্বপ্ন, আশ্বাস, প্রতারণা, স্বপ্নভঙ্গ, প্রতিশোধ স্পৃহা, অপরাধবোধ আবার আশ্বাস, স্বপ্ন আর ঘৃণার গল্প এটা। অথবা নিভৃতে মনের আনাচে অন্য সময় অন্য কোনো পথেও হয়তো এগিয়ে যেতে পারি আমরা।
কবিতার সত্য
(কল্পনা, কল্পনার ভিতরে অভিজ্ঞতা এবং চিন্তার সারবত্তা।)
‘এই জ্ঞান কবিমনের অতলঘূর্ণি থেকে উৎসারিত হয়ে এই কক্ষের চেয়ে যদি অন্যতর সত্যের প্রকাশ ঘটাতে পারে, তাহলেই সেটা কবিতার সত্য। এবং কবির প্রাণপণ চেষ্টাও থাকে তেমনই। যদি তিনি সফল হন, তাহলে তাঁর কবিতায় যে-সত্য ব্যক্ত হয়, সেই সত্য পাঠকের মর্ম ছুঁতে পারে।’ কিন্তু—
কখনো সামনে আসে না
কক্ষনো না
তার সার্থকতা— আড়ালে থাকা
মূলত সে অদৃশ্য প্রাণী
যেমন, কোনো কিছু উড়ে গেলে
সেই উড়ে-যাওয়াটাই ঝড়ের আকার
যেমন, কবিতা
(খুনি/প্রলয়কথা)
শেষের এই কবিতা কথাটি একটি বিস্ময়ে এনে ধাক্কা দেয় আমাদের। খুনি এবং কবিতার স্বভাবের এমন মিল আমাদের কাছে অভূতপূর্ব। এই কবিতায় আমরা যে-সত্যকে অনুধাবন করতে পারি তা আমাদের মর্ম ছুঁয়ে যায়, কেননা ওইযে বলেছি, একটি বিস্ময় আমাদের মনে আলোড়ন তোলে। আমরা উপলব্ধি করতে পারি কবিতার সেই সত্যকে। আবার, কবিতায় পার্টিকুলারকে ইউনিভার্সাল করে তোলার কথাও জেনেছি। জেনেছি ‘সব বিষয়বস্তুই কাব্যিক এবং যাঁর দৃষ্টিতে এই কাব্যিকতা ধরা পড়ে, তিনিই কবি। এমন-কি চিন্তা করার নির্দিষ্ট পদ্ধতিও আছে, যে-পদ্ধতিতে ভাবলে কাব্যিকতা বেরিয়ে আসতে বাধ্য হয়। বিষয়বস্তুর মধ্যেই কাব্যিকতা লুকিয়ে থাকে..।’ কবি সেই পদ্ধতির ভেতর দিয়েই কবিতার সত্যকে আড়াল করে রাখেন কবিতারই ভেতর। আমরা একটু একটু করে পাঠে এগিয়ে যাই আর আবিষ্কার করি তাকে।
১৯১৭ সালে ভিক্টর শিলভস্কিও এইরকমই এক প্রক্রিয়ার কথা বলছিলেন আমাদের। যাকে বলা যায় defamiliarization অথবা আমরা বলতে পারি “making strange,” অর্থাৎ আমরা যা দেখতে পাই সামনে, আমাদের অভিজ্ঞতার সাধারণ সেই উপাদানগুলো অন্তর্চেতনায় গ্রহণ করে সেগুলোকে এমন কিছু সত্যের উপলব্ধিতে প্রকাশ করেন কবি যেন মনে হয় তা অভূতপূর্ব, মনে হয় এইভাবে আগে কখনো দেখিনি। কবিতায় এই সত্য, এই অভূতপূর্বকে প্রতিস্থাপন করার অনেকরকম পথ বা কৌশল রয়েছে কবির। সচেতনভাবে এবং অর্ধসচেতনভাবে এমনকি অসচেতনভাবেও অনেকেই এরকম কবিতা লিখেছেন। যেমন আমরা দেখেছি উইলিয়াম ব্লেইকের কবিতায়। তবে সচেতনভাবে অভূতপূর্ব-কে কবিতায় স্থাপন করতে হয়নি তাঁর। তিনি নিজেই ছিলেন অদ্ভূত। ২০০ বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরও তাঁর কবিতার অভূতপূর্বতা সমানভাবেই বিরাজমান। তাঁর দূরদর্শী এবং ভবিষ্যদ্বাণীমূলক কবিতাগুলোয় এখনও তিনি প্রায় দুর্ভেদ্য হয়ে উঠতে পারেন।
কবিতার সত্য, বা এই defamiliarization দু’রকমভাবে হতে পারে: ভিন্নভাবে দেখা আর ভিন্নভাবে বলা। তবে এই দু’য়ের চমৎকার সহাবস্থানও পাই আমরা এজরা পাউন্ডের কবিতায়, যা তাঁর কবিতাকে করে তুলেছে অভিনব। কবিতা পাঠের ভেতর দিয়ে কবি আমাদের নতুনভাবে দেখতে শেখান, নতুনভাবে ভাবতে শেখান। আর এর জন্য অবশ্য প্রত্যেক কবির থাকে নিজস্ব ভাষা, আপন শৈলী।
তোমার মৃত্যুর কথা আমার মৃত্যুকে
বার বার টপকে যায়— বার বার তুমি
বোঝাতে চাইছ, এই পথ
সংলগ্ন সমস্ত ভূমি একদিন ধ্বংস হয়ে যাবে
(তারপর…/বাণরাজপুর)
ধ্বংসোন্মুখ সৃষ্টিশীলতা
বাণরাজপুর কবিতাবইয়ের উৎসর্গপত্রের পরের পাতায় লেখা ছিল : ‘আবু হোরাইরা থেকে বর্ণিত আছে, রসুলুল্লাহ্ আলাইহে ওয়া সাল্লাম বলেছেন, কারও অভ্যন্তর পুঁজে পরিপূর্ণ হয়ে পচে যাক, তাও কবিতায় পরিপূর্ণ হওয়া অপেক্ষা উত্তম।’— বোখারী শরীফ, ষষ্ঠ খণ্ড, ২৩৫০’। এ প্রসঙ্গে আওয়াজ হচ্ছিল কিছু। আর আমাদের মনে পড়ছিল সৈয়দ ওয়ালী উল্লাহ্-র সেই সার্বজনীন উক্তি, ‘‘শস্যের চেয়ে টুপি বেশি, ধর্মের চেয়ে আগাছা বেশি।’’ হয়তো এ জন্যই কবি একরাম আলি তাঁর ফেসবুকের এক পোস্টে স্পষ্ট করতে চাইছিলেন বলে,—
‘কবিতা প্রকৃতপক্ষে এমনই, যা হৃদয় পুঁজে পরিপূর্ণ হওয়ার চেয়েও ভয়ঙ্কর। কবিতার যে সর্বগ্রাসী ধ্বংসোন্মুখতা আছে, অন্তত কবির জীবনে, হাঙরের ঢেউয়ে সাঁতার কাটার বিপজ্জনক সেই তরঙ্গকে আমি দেখতে চেয়েছিলাম। .. দুনিয়ার কোনো রাষ্ট্রই প্রকৃত কবি এবং তাঁর কবিতাকে স্বাগত জানাতে পারেনি। রাষ্ট্র কোনো ব্যক্তির সৃষ্টিকর্মকে সহ্য করতে পারে না যে!’
এইটুকু পড়তে পড়তে আমাদের মনে পড়তে পারে গত বছরের কাশ্মিরের সেই কণ্ঠস্বর কবি আমির আজিজের সেই কবিতা : ‘সাব ইয়াদ রাখহা যায়েগা।’ ভারত সরকার কি তাঁকে স্বাগত জানাতে পেরেছিল?
হ্যাঁ, ঠিক তাই। রাষ্ট্র কোনো ব্যক্তির সৃষ্টিকর্মকে সহ্য করতে পারে না। এই ৩/৪ বছর আগেও (২০১৭) ঢাকার রাজপথে, দেয়ালে দেয়ালে আগারগাঁও-মহাখালী লিংক রোডে, পুরোনো বিমানবন্দরের দেয়ালে এক সারিতে আঁকা হয়েছিল সুবোধের তিনটি গ্রাফিতি— লেখা ছিল, ‘সুবোধ তুই পালিয়ে যা, এখন সময় পক্ষে না,’ ‘সুবোধ তুই পালিয়ে যা, মানুষ ভালোবাসতে ভুলে গেছে,’ ‘সুবোধ তুই পালিয়ে যা, তোর ভাগ্যে কিছু নেই,’ কিংবা ‘সুবোধ তুই পালিয়ে যা, পাপবোধ নিশ্চিন্তে বাস করছে মানুষের মনে।’ আর এই প্রতিটি দেয়ালচিত্রে লোগো আকারে ব্যবহার করা হয়েছিল একটি শব্দ: ‘হবেকি’(HOBEKI?)। চমৎকার সৃষ্টিকর্ম। ‘সুবোধ’-এর এই দেয়ালচিত্র অনেক পথচলতি মানুষের আগ্রহের বিষয়ে পরিণত হয়েছিল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকেও ছড়িয়ে পড়েছিল এই চিত্রগুলো। সেখানে অনেকেই সুবোধ এবং এর আঁকিয়ে কিংবা আঁকিয়েদের পরিচয় জানতে কৌতূহলী হয়ে উঠেছিল। এই দেয়ালচিত্রের মাধ্যমে কী বার্তা দেওয়া হচ্ছে, তা জানতেও কৌতূহলী হয়ে উঠছিলেন তাঁরা। কেউ কেউ এই দেয়ালচিত্রগুলো দিয়ে অ্যালবাম সাজিয়েছেন। কেউ তাঁদের প্রোফাইল ছবি ও কাভার ছবি বানিয়েছেন এই গ্রাফিতি দিয়ে। এর কিছুদিন পর খবর বেরুলো, ‘সুবোধ’কে জেলে পাঠিয়ে নিশ্চিন্তে সরকার: টানা দশ মাস ধরে সরকারকে বিব্রত করে বার বার সংবাদ শিরোনামে এসেছিল অজ্ঞাত পরিচয় শিল্পীরা। ‘সুবোধ’ নামেই পরিচিত সেই শিল্পীদের তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। মহানগর ঢাকার দেওয়াল জুড়ে বিভিন্ন ইঙ্গিতপূর্ণ ছবি ও লেখা ‘সুবোধ তুই পালিয়ে যা’ সৃষ্টির পিছনে এরা জড়িত বলেই জানিয়েছে সরকার। ধৃতদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আনা হয়েছে। যদিও তিন শিল্পীর নাম প্রকাশ করা হয়নি।’ রটিয়ে দেয়া হলো, সুবোধ জঙ্গি, সন্ত্রাসী; এমনকি আন্ডারওয়ার্ল্ডের গডফাদারের থেকেও ভয়ঙ্কর। তার কারণ সে সরাসরি চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে রাষ্ট্রকে। রাষ্ট্রের চরম অপদার্থতাকে। সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে সরাসরি আঙ্গুল তুলে বলছে ‘সুবোধ তুই পালিয়ে যা, এখন সময় পক্ষে না’। গত দশ মাস ধরে সে রাষ্ট্রের ব্যর্থতাকে দেওয়াল চিত্রের মাধ্যমে খুব সহজভাবে বলে ফেলছে। এতেই প্রবল বিব্রত শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ সরকার। খাঁচায় বন্দি সূর্য নিয়ে উলঙ্গ বুকে পালানো ছোকরাটির জন্যে ঘুম উড়ছে গোটা দেশের।
কিংবা শুরুতে যে আমরা ব্রডস্কির কথা বলছিলাম। সেই নোবেল জয়ী কবিকেও তাঁর সময়ে তাঁর নিজ দেশে কবিতার জন্য নির্বাসনে যেতে হয়েছিল। বহু বছর অন্তরীন ছিলেন, নজরবন্দী ছিলেন। এক পর্যায়ে দেশ ছাড়তেও বাধ্য হন। অথচ কী আশ্চর্য যে, এখন সেই রাশিয়াতেই সর্বোচ্চ মর্যাদা দেওয়া হয় তাঁকে। হ্যাঁ, এই রকমই হয়। আবার উল্টোটাও দেখতে পেয়েছি আমরা এবার যুক্তরাষ্ট্রে। মানে শুরুটা কবিতা দিয়ে শুরু করলেন এবারের নব নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। তার অভিষেক অনুষ্ঠানে মাত্র বাইশ বছর বয়সী তরুণ কবি, ইয়ুথ পোয়েট লরিয়েট অ্যামান্ডা গোরম্যান আবৃত্তি করলেন তাঁর কবিতা ‘আমরা যে পাহাড় বেয়ে উঠি।’ আমরা আশা করবো কবিতার সাথে, সাহিত্যের সাথে, শিল্প-সৃষ্টির সাথে তার সরকারের তার রাষ্ট্রের এই ভাব বহুদূর পর্যন্ত স্হায়ী হবে।
—জানুয়ারি, ২০২১।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে জানুয়ারি, ২০২১ রাত ১০:১৫