লেখাঃ #রনক_হাসান_নূর
আমি তানিম বিয়ে করেছি দুবছর, খুব সুন্দর সাজানো একটা সংসার আমার ! আমি শিপে জব করি। নয় মাস আমাকে জাহাজে থাকতে হয়। আর তিন মাস বাড়িতে থাকি। আমি যখন বিয়ের করার জন্য দেশে আসি দুই মাস লেগেছিল মেয়ে দেখতে।
অনেক খোঁজার পর , সৃষ্টিকর্তা আমার সাথে যে মেয়েটার জোড়া মিলিয়ে রেখেছেন তাকে খুঁজে পাই। মেয়ে টাকে প্রথম দেখেই আমি খুব অবাক হয়েছিলাম ! ঠিক যেমন টা কল্পনা করতাম, তেমনি দেখতে মেয়ে টা। তার সব কিছুর মধ্যেই যেনো একটা মায়া আছে , আমি সে দিন সত্যি সেই মায়ায় আটকে গিয়ে ছিলাম !
পরিবার কে বলি মেয়ে আমার পছন্দ হয়েছে , কথাবার্তা সেরে নেন ।দেখতে এসেই মেয়েটাকে আংটি পরিয়ে আসি , তিন দিন পর সেই মায়াবতী কে আমার ঘরে নিয়ে এসেছি , ওহ আচ্ছা মায়াবতীর নাম টা বলা হয়নি ! মায়াবতীর নাম হচ্ছে মিহি, বিয়ের প্রথম বছর ই সৃষ্টি কর্তা আমাদের একটা কন্যা সন্তান দান করেন।
কিন্তু শিপে জব করায় আমি থাকতে পারিনি , বিয়ের এক মাস পরেই আমাকে চলে যেতে হয়। যে দিন বাসা থেকে শেষ বিদায় নিয়ে যাচ্ছিলাম। মিহি আমায় ঝাপটে ধরে চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল, আপনি যাবেন না গো... মিহির সেই কান্নার আওয়াজ আজো আমার কানে বেজে উঠে ! এতো শক্ত করে আমাকে জড়িয়ে ধরেছিল সেদিন মিহি! মনে হচ্ছিলো মেয়েটা আমার শরিরে মিশে আমার সাথে চলে যাবে, সে দিন আমিও খুব কেদেছিলাম। মিহি কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিলাম। খুব কষ্ট হয়েছিল মিহিকে ছাড়তে। মিহি কিছুতেই ছাড়ে না আমায়... যখনি একটু ছাড়তে চাই মিহি আমকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।
কপালে হাত দিয়ে চোখ মুছে বলি , এই তো একবছর পর চলে আসবো , দেখতে দেখতে দেখবা সময় কেটে যাবে। কোন কথায় মিহি কানে নেয়নি সেদিন। সে আমাকে যেতে দেবে না। প্রায় এক ঘন্টার মত মিহি আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিল । সেই দিন একটা সেকেন্ডের জন্য মেয়েটাকে আমার চোখের সামনে থেকে আলাদা করতে পারিনি , বাসা থেকে বের হওয়া , বাসে উঠা, প্রতিটি সেকেন্ড মিহি আমার অনুভবে ছিল। আমার বার বার মনে হচ্ছিল, মেয়েটা এই একটি মানুষের উপর ভরসা করে ,তার আপন মানুষ গুলোকে ছেড়ে আমার বাড়ীতে এসেছে ! সেই ভরসার হাতটা যখন হুট করে একা করে দূরে চলে যায় ! তখন কি করে বুঝাবে মনকে? কোন মেয়েই হয়তো পারে না , সেদিন মিহিও পারে নি ।
সৃষ্টি কর্তার কাছে চাইতে জানলে উনি কাউকেই ফিরিয়ে দেন না , আমাদেরকেও ফিরিয়ে দেননি। বিয়ের প্রথম রাতেই আমরা নামাজ পড়ে দুজন একটি মেয়ে সন্তান ছেয়েছিলাম। সৃষ্টিকর্তা আমাদের একটি মেয়ে সন্তান দিয়েছেন। খুব ভাল ভাবেই চলছিল আমাদের সংসার জীবন। আমার কর্ম জীবনের ব্যাস্ততা , মিহির সংসার এবং মেয়ে কে নিয়ে ব্যাস্ত থাকা। মনে হচ্ছে ভালোবাসার সুবাতাস পুরো ঘরটা দোল খাচ্ছে। সুখের হাওয়া একটু পর পর এসে গায়ে পরশ দিয়ে যাচ্ছে। খুব সুন্দর সাজানো একটা সংসার। প্রতিবছর তিন মাস পর পর দেশে আসি... মিহি এবং রুহি কে নিয়ে ঘুরাঘুরি... খুব সুন্দর করে নিজেদের স্বপ্ন গুলোকে দেয়ালে দেয়ালে সাজাই। ভালই যাচ্ছিলো আমাদের সুখের সংসার।
কাজের ফাঁকে একটু সময় পেলে ফেসবুকে আসি। নিউজ ফিড দেখি, মানুষের গল্প পড়ি ভালই লাগে, মাঝে মাঝে মিহির সাথে গল্প গুলো শেয়ার করি। প্রিয় গান টা শেয়ার করি। ইনবক্সে তেমন একটা যাওয়া হতো না। প্রয়োজন ছাড়া কারো সাথে চ্যাট করতাম না।
একদিন রাতে অপরিচিত একটা আই ডি থেকে মেসেজ আসে।
-কেমন আছো?
সিন করেছি কিন্তু রিপ্লাই দেইনি।
কয়েকদিন পর আবার একই মেসেজ
-কেমন আছো?
বললাম জি ভাল আলহামদুলিল্লাহ্ !
তার পর কয়েকদিন আর ফেসবুকে আসা হয়নি।
বেশ কয়েক দিন পর এসে দেখি রিপ্লাই দিয়েছে মেয়েটা
-সুখ ধরে গেছে তোমায়...
লিখা টা খুব পরিচিত মনে হচ্ছিলো সেদিন, তাই রিপ্লাই দিয়েছিলাম।
কে আপনি ? কি চাচ্ছেন ? পরিচয় বলুন, না হলে ব্লক দেবো।
পরের দিন রিপ্লাই আসে ,
-ব্লক তো দিয়েই রেখেছো সেই অনেক আগে ?
-ভার্চুয়াল ব্লক দিয়ে আর কি হবে ?
তখন আমি বুঝে গিয়েছি এটা ইরা। মুহুর্তের মধ্যে মন কেমন যেন হয়ে উঠলো । এক এক করে স্মৃতি ছেড়া পাতা গুলো চোখের সামনে ভাসতে লাগলো। আমি কোন রিপ্লাই না দিয়ে ফেসবুক থেকে লগ আউট হয়ে যাই। কিন্তু তবুও কেন জানি আজ ইরার কথা খুব মনে পড়ছে।
ইরার সাথে কাটানো প্রতিটি মুহুর্ত এক এক করে আমার চোখের সামনে ভাসছে... আর ভারী করে তুলছে আমার মন কে।
শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগলাম, এতো বছর পর ইরা কেন আমাকে নক করবে ? ইরা তো সুখে থাকার কথা।
আমার সাথে ব্রেক আপ হবার পর ইরার একটা ছেলের সাথে রিলেশানে যায়... তার সাথে বিয়ের কথাবার্তাও ঠিক। দুই জনের পরিবার থেকে সম্মতি আছে , এমনটাই তো বলেছিল ইরা !
তাহলে ইরা আমাকে মেসেজ দিচ্ছে কেন ? কি চাচ্ছে আমার কাছে... এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি টের পাইনি।
সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি মিহির অনেক গুলা মিসড কল।
খুব তাড়া হুড়ো করে মিহি কে কল দেই ।
তাড়া হুড়ো করতে গিয়ে উডিও কল দিয়ে ফেলেছি।
মিহি কল রিসিভ করেই;
কি ব্যপার আপনি তো অডিও কল দেন না কখনো !
সরি মিহি একটু তাড়া হুড়ো করতে গিয়ে ভুল করে দিয়ে ফেলেছি।
আচ্ছা কেটে আবার কল দিচ্ছি।
কেটে কল দিলাম। মা মেয়ে দুজন কে দেখছি, আমার মেয়েটার নাম রুহি, রুহি দেখতে একদম মিহির মত হয়েছে। রুহি একটি পর পর পাপা পাপা ডাকে আর মোবাইল টা ধরতে চায়। কি যে ভাল লাগে তখন ইচ্ছে করে ঝাপটে ধরে মেয়েটাকে বুকে নেই । কিন্তু পারি না।
যাক পরের দিন ফেসবুকে লগইন করি, ইরার মেসেজ !
-কি আমার কথায় খুব কষ্ট পেয়েছো ?
ইরা আজকে অনলাইনে আছে , সবুজ বাতিটা জ্বলছে।
উত্তর দিলাম
না কষ্ট পাওয়ার কি আছে !
-তাহলে মেসেজের রিপ্লাই দিচ্ছ না কেন ?
বললাম বাদ দাও এসব। কেমন আছো বলো ?
-এই তো ভালো!তুমি কেমন আছো।তোমার মেয়ে বউ কেমন আছে ?
আলহামদুলিল্লাহ্ ভাল ! তো তোমার সংসার কেমন চলছে ?
-যেমন চলার কথা ছিল
মানে কি বুঝলাম না!
-মানে কিছু না বাদ দাও তোমার কথা বলো। তোমার মেয়ের কি নাম।
কি নাম রাখার কথা ছিল... সেই নাম...
-আহাহা সত্যি ? আমার দেয়া নামটাই রেখেছো তুমি ? শুনে খুব ভাল লাগলো।
তোমার গল্প বলো তোমার হাজবেন্ড কি করে ?
-আমার কেউ নাই এখনো একাই আছি !
মানে কি তোমার নতুন রিলেশান ! বিয়ে কথাবার্তা সব ঠিক !
কি বলছো এসব ? হাহা তুমি মিথ্যে বলছো !
-হ্যাঁ আমি তো সব সময় মিথ্যে ই বলে এসেছি...
এভাবে প্রতিদিন ইরার সাথে একটু চ্যাট করতাম , কিন্তু মনের মধ্যে কেমন যেন একটা অপরাধ বোধ কাজ করতো। খুব ভাবনায় পড়ে যেতাম , ইরার সাথে এ ভাবে চ্যাট করা ঠিক হচ্ছে।
তার পর একদিন রাতে ইরা আমাকে মেসেজ দেয় ,
ইরা আমাকে প্রশ্ন করে
-তুমি কি আমাকে এখনো ভালবাসো?
আমি বলেছি ভালোবাসি কিনা জানি না তবে মিস করি মাঝে মধ্যে !
সেই দিন গল্প করতে করতে আমরা সেই আগের মত চ্যাট শুরু করি ।দুজন খুব আবেগ প্রবণ হয়ে যাই... কখন যে দুজন দুজন কে ভালবাসি বলে ফেলেছি, আমরা কেউ জানি না। মনে হচ্ছে দুজন কল্পনার ভেসে বেড়াচ্ছি, আমাদের সেই স্বপ্নের সাজানো ঘর বাড়ী আমরা আবার ফিরে পেয়েছি। এভাবে সকাল পর্যন্ত চ্যাট করতে কখন যে দুজন ঘুমিয়ে পড়েছি কেউ বুঝতে পারিনি।
সকালে ঘুম ভাঙ্গতেই দেখি মিহির অনেক গুলা মিসড কল । কল দিলাম মিহিকে। কিন্তু কথায় মনোযোগ আসছে না , বার বার ইরার সাথে রাতের সেই চ্যাট গুলা ভেসে আসছে। মিহি আমাকে জিগেয়স করছে ? কি হয়েছে আপনার ! আপনি কি কোন বিষয় নিয়ে খুব চিন্তিত ? মিহি কে, নাহ ঠিক আছে বলে ফোন রেখে দেই । সেই দিন টা খুব কষ্ট কেটেছে আমার। এক দিকে মিহি আমার মেয়ে আরেক দিকে ইরার ফিরে আসে। কি করবো কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। ইরার সাথে চ্যাট করতে আমার ভাল লাগে, সেই আগের মত অনুভূতি গুলো কাজ করে , কখন ইরা অনলাইনে আসবে সেই অপেক্ষায় একটু পর পর ফেসবুক চেক করতাম।
এভাবে ইরার সাথে প্রতিদিন চ্যাট হতো, কিন্তু ইরার সাথে শেষে যখন , মিহি কে কল দিতাম , নিজেকে খুব অপরাধি মনে হতো।আমি মিহি এবং আমার মেয়ে কে ঠকাচ্ছি । এই সব টেনশনে রাতে ঘুম আসতো না। মিহির সাথে মন খুলে কথা বলতে পারতাম না। খুব কষ্ট হতে থাকে মিহি এবং আমার মেয়ের জন্য। এই নিষ্পাপ দুটি মানুষ কে আমি ঠকাচ্ছি... এটা ভাবতেই মাথায় জট লেগে যেতো। খুব অপরাধ বোধ কাজ করে। আমি মনে মনে সিদ্ধান্ত নেই ইরাকে সব খুলে বলবো।
পরের দিন ইরা কে সব টেক্সট করি। সেদিন আর ইরা আমার মেসেজের রিপ্লাই দেয়নি। আমাকে ব্লক করে দেয়।
এখনো মাঝে মাঝে ইরা কেমন আছে জানতে ইচ্ছে করে। কিন্তু ইরার সাথে যোগাযোগ করার কোন পথ খুঁজে পাইনি।
ইরা সুখে থাকলে হয়তো এতো কষ্ট লাগতো না। কিন্তু ইরা সুখে নেই এটা ভাবতেই কেন জানি মাঝে মাঝে খুব কষ্ট হয়।
আসলে ভালোবাসার মানুষ গুলো, দূরে থাকলেও যদি ভাল থাকে, সুখে থাকে, মনের ভেতোর একটা ভাল লাগা কাজ করে। আর যখন শুনি ভাল নেই, তখন কেন জানি মন খারাপ হয়। কষ্ট হয় মানুষ টার জন্য। এবং মনে একটা প্রশ্ন থেকেই যায় !
মানুষ টা ভালো আছে তো?
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে জানুয়ারি, ২০১৯ রাত ৯:০৮