কামাল চোখে অন্ধকার দেখে। তবুও উঠে দাঁড়ায়। হাঁটতে হাঁটতে কালুর দোকানে যায়। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর আস্তে আস্তে বলে, কালু কাহা তিন দিনের হরতালে রিসকা নিয়া বাইর হইবার পাই নাই। ট্যাকা পয়সা হাতে এডাও নাই। যদি আমারে দুই সের চাইল করজা দেও তাইলে জানডা বাঁচে। হরতাল শেষ হইলেই তোমার পাওনা মিটাইয়া দিমু। সইত্য কইতাছি। তোমার দোহানে কোন দিন করজা নেয়নের জইন্যে আহি নাই। আজ ফিরায়ে দিও না। কামালের কথায় কালুর মন গলে না। সে শয়তানি হাসি দিয়ে বলে, হরতাল যে থামবো তার বালাই আছে। আজ বাকি দিলে কালও আইবি। তয় হরতাল থামলে ট্যাকা দিবি কিবায়? দিনের ট্যাকায় তো দিনই চলে না। আমার বাকির টাকা দিবি কিবায়। যা, বাহি দেয়ন যাইবো না। কামাল তাও মিনতির সুরে বলে, আজ দেও দেইহো তোমার ট্যাকা একবেলা না খাইয়া হইলেও দিয়ে দিমু। কালুর মন তবুও গলে না। সে বলে, যা এহন, এমন কতা কত জনেই তো কয়, বিপদ গেলেই মনে থাহে না। বাকি দেয়ন যাইবো না। তয়, তরে একটা ভাল কথা কইবার চাই। আইজকাল তো অনেহেই করে। তবে তুই যদি মুনে কিছু না করস। ঘরে অমন সুন্দরী বউ থাকতে চিন্তা কী? রাইত তো হইয়া আইল এখন গলির মাথায় দাঁড়ায় থাইকলেই তো তর বউয়ের ট্যাকার অভাব থাইকবো না। এইটুকু শোনার পরই কামালের ক্ষুধার্ত দেহে আগুন লেগে যায়। ক্ষুধা আর ক্রোধে কামালের শিরদাঁড়া দিয়ে হিম রক্ত বয়ে যায়। কামাল প্রতিবাদ করতে চায়। কিন্তু দেহে বল পায় না। ক্ষুধার নিষ্ঠুরতা এই পৃথিবীর চরম খেলা। এই খেলা খেলতেই যে বিধাতা বিরাট ভালবাসে। তার মহিমা দেখায়। তবুও কামাল বলে উঠে, দেহ কালু কাহা অমন কথা কইবা না ভালা হইবো না। কালু বলে উঠে, যা দোহানের সামনে থাইকা। পেটে ভাত নাই আবার দেমাক কত? কামাল আর প্রতিবাদ করতে পারে না। ক্ষুধা আর অপমান এই দুই-ই যে গরীবের জন্ম সূত্রে পাওয়া উত্তরাধিকার। সারাজীবন অপমান সহ্য করাই তাদের একমাত্র নিয়তি। এই নিয়তিকে মেনে নিয়েই কামাল ফিরে আসে তার বস্তির ঘরে। মৃদু স্বরে ডাকে বউকে। জোলেখা তবুও উত্তর দেয় না। ক্ষুধার্ত দেহের কাছে কামালের মৃদু সুরেলা ডাকও মনে হয় তীব্র চাবুকের আঘাত। তারপর কামাল জোলেখার পাশে বাসে, পিঠে হাত রাখে। আস্তে আস্তে বলে, কালুর দোহানে কর্জা চাইবার গেছিলাম, দিল না। আরও তোমারে নিয়া আউন বাউন কথা কইল। জোলেখা এবার তীব্র ঝাঁঝালো গলায় বলে উঠে, তোমারে না কইছি ঐ শয়তানের দোহানে কোন দিনও করজা চাবার যাবা না। গেছ ক্যা? গেছ ক্যা? কামাল তবু উত্তেজিত হয় না, জোলেখাকে খুব ক্ষীণ কন্ঠে বলে, তোমারে এডা কথা কইবার চাই। তয় তোমারে কইতে ডর ও শরম দুইডাই লাগতাছে। কিবাই যে কই তোমারে? জোলেখা চোখ ঘুরিয়ে তাকায় এবং মনে মনে বলে, খিদেয় জান যায় আবার এহন শখের কথা। কামার জোলেখার চোখের দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বলে, যদি কিছু মুনে না নেও তাইলে কই? ম্যালা মাইষেই এহন এমুন করে। পেটে ভাত না থাকলে আবার মান-সুম্মান কিয়ের? খিদেয় তো আর শরম-ভরম, মান-সুম্মান দেহে না। জোলেখা বলে উঠে, কি কইতে চাও কও? অত আউন-বাউন কইয়ো না। কামাল বলে, কই ছিলাম কী যদি তুমি এই রাইতের বেলায় ঐ গলির মাথায় গিয়ে দাড়ায়ে দুইডে এডা খদ্দের খোঁজ তাইলে অভাবডা থ্যাইকা বাচি। জোলেখার চোখ বিস্ফুরিত হয়ে উঠে, কামালের মুখের দিকে তাকাতে পারে না। দু’চোখে অশ্রু ভরে উঠে জোলেখার। কামাল যে এমন কথা বলতে পারে সে ভাবতেও পারে নি। তার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। জোলেখা কামালের দিকে তাকিয়ে বলে, তুমি আমার সোয়ামী! তুমি এমুন কতা আমারে কইতে পারলা! তোমার মুখে ছেপ দেওন দরকার। আমারে না ভালবাইসে বিয়া করছিলা? আজ তোমার এই রূপ! কামালের দু’চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে। জোলেখার কথাগুলো শোনার পর কামালের মরে যেতে ইচ্ছা করছে। তবু নিজেকে সংযত করে, জোলেখার হাত ধরে। জোলেখার চোখ পড়ে কামালের চোখে, জোলেখা কেঁদে উঠে শিশুর মতো। কামাল ধরা গলায় বলে উঠে, বউ আমারে শাস্তি দেও, যত পার শাস্তি দেও। খিদের জ্বালায় সব ভুইলা গেছি। ক্ষুধার তৃষ্ণার মাঝে ভালবাসার সম্ভ্রমটুকু বিলীনের সিদ্ধান্ত নেয় জোলেখা। ক্ষুধার কাছে জগতের সবই তুচ্ছ। ক্ষুধার কাছে এক ঈশ্বর ব্যতিত জিম্মি সবাই। জোলেখা আর কোন কথা বলে না। কামাল যে হাতটি ধরেছিল তা ছাড়িয়ে নেয়। ভাঙ্গা ট্রাঙ্ক থেকে বিয়ের লাল শাড়িটা বের করে। তারপর সেই কাপড় নিজের দেহে জড়িয়ে নেয়। কামাল জোলেখার হাত ধরে বলে উঠে, থাইক বউ, তোমারে দিয়ে এমুন কাম আমি করাইতে পারমু না। এর চাইতে না খাইয়ে মরণ ভালা। জোলেখা কোন কথা কয় না। নিজেকে মুক্ত করে বলে উঠে, যে শাড়ি পইড়া একদিন তোমার হইছিলাম সেই শাড়ি পইরাই আইজ অন্যের খাদ্য হয়নের লাইগা যাইতাছি। কামাল কেঁদে উঠে আর জোলেখা রাতের অভিসারের পথে ছুটে চলে খদ্দেরের খোঁজে।
কামালের মনে পড়ে অতীতের অনেক কথা। জোলেখা আর কামাল একই গার্মেন্টসে কাজ করত। তারা দুই জনেই জামালপুর জেলার মানুষ। তবে গ্রাম, থানা সবই আলাদা। তবু একই জেলার লোক বলেই তাদের পরিচয়। জোলেখরা বিপদের সাথীই ছিল একমাত্র কামাল। একদিন জোলেখা কামালকে বলল, কামাল ভাই আফনেরে এডা কবার চাই। কামাল বলে, কও? জোলেখা কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলে উঠে, ঐ সুপারফাইজার আমারে পঁচা প্রস্তাব দেয়। আফনে আমারে বাঁচান। কামাল কোন কিছুই বোঝে উঠতে পারে না। এখন তার কী করা কর্তব্য? কামাল বলে, তয় আমি কি করবার পারি? জোলেখা মাটির দিকে তাকিয়ে থেকে বলে, যদি সামুস দেন তয় কইতে পারি। কামাল বলে, কও? জোলেখা মৃদু কন্ঠে বলে উঠে, কামাল ভাই আমি আপনেরে ভালবাসি। যদি আপনে আমারে বিয়া করেন তাইলে আর কোন ঝামেলা থাকে না। কামাল মাসের পর মাস অপেক্ষা করেছে এই কথাটা শোনার জন্য। আজ জোলেখার মুখে সেই ভালবাসি কথাটি শোনার পর কামালের মনে এক বসন্ত সুবাস বয়ে যায়। ধরণি যেন হয়ে ওঠে নৃত্য রত। চারপাশ যেন নতুন আলোয় ঝলসিত। জোলেখা! জোলেখা! যাকে নিয়ে কত স্বপ্নের পিরামিড গড়িয়েছে এসে আজ উপযাজক হয়ে তার প্রেমপিয়াসী। কামাল সুযোগ হাত ছাড়া করতে চাই না। হাতে কিছু টাকাও আছে। তাই কামাল সাত-পাঁচ না ভেবেই বলে, আগামী শুক্রবার আমাদের বিয়ে হবে। জোলেখার কানে যেন শত শঙ্খের বাজনা বেঁজেছিল। শুভলগ্নের সেই সময়ের কথা মনে করেই জোলেখার মুখে হাসি ফুটে। বিয়ের পরও সুপার ফাইজার নানা ভাবে উত্ত্যক্ত করতো। জোলেখার কাছে একান্তভাবে সময় চাইতো। লোভনীয় প্রস্তাব দিত, যদি তাকে সময় দেয় তাহলে তাদের দু’জনের বেতন বাড়িয়ে দিবে। কামালকে জোলেখা এইসব কথা জানায়। কামাল রাগে ক্ষোভে আর জোলেখার নিরাপত্তার কথা ভেবে দুজনেই চাকরি ছেড়ে দেয়। কামাল রিক্সা চালানো শুরু করে।
জোলেখা খদ্দের পায়, খদ্দের পাওনা মিটায়, নিজের পাওনা টাকাও বুঝিয়ে নেয়। টাকা নিয়ে জোলেখা কালুর দোকানে যায়। চাউল চায় কালুর কাছে। কালু হেসে কয়, জোলেখা যে, চাউল চাস? কয় কেজি দিমু। জোলেখা বলে, এককেজি দেও। কয় টাকা কেজি? কালু এবার আরও উল্লসিত হয়ে বলে, আরে ট্যাকা লাগবো না। সাঁজবেলা কামাল আইছিল। তখন মাথা গরম আছিল। তাই করজা দেই নাই। এখন নিয়ে যায়। জোলেখা বলে, ট্যাকা আনছি। কালু বলে, ট্যাকা পাইলি কই? জোলেখা কথা বলে না। কালু এবার সয়তানি হাসি মুখে এনে বলে, বুঝছি, কইতে হইবো না। আমার বুদ্ধিই কামাল ধরছে। তর চালের দাম লাগব না যদি ফজরের আযানের সুময় তুই একবার আামার বাসায় আহস। জোলেখা কথার কোন প্রতিবাদ করে না। প্রতিবাদের ভাষা যে আজ তার বাঘবন্দি। এতদিন যে অহঙ্কার তার সম্পদ ছিল আজ তা কলঙ্ক। নির্ঝরে ভাঙ্গে তার বুকের পাঁজর। তারপরও বলে, চাইল দেও। কালু রান্নার জন্য যা প্রয়োজন চাল, ডাল, লবণ, ও ডিম সবই দেয়। কিন্তু টাকা নেয় না। জোলেখাকে আরেক বার পরখ করার জন্য বলে, আইবি তো? জোলেখা বিদ্রোহী মন মরে গেছে। ক্ষুধার কাছে সে আজ হার মেনেছে। হার মেনেছে জীবনের কাছে। জীবন ধারনই এখন তার একমাত্র ব্রত। আর যদি জোলেখা সম্মতি না দেয় তো কাল পাড়ার লোক সবাই জানবে। মান গেলেও তা ঢেকে রাখা ভাল। তাই জোলেখা মৌন সম্মতি জানায়। কালু বলে, আরও পঞ্চাশ ট্যাকা পাবি।
জোলেখা ঘরে ঢুকে বাতি জ্বালায়। কামালের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। কামালের মুখের দিকে তাকিয়েই জোলেখার বুক শুকিয়ে উঠে। কামালের মুখ সম্পূর্ণ নীল। তার দু’চোখে কোন ক্ষুধা নেই, সে আর কোন দিনও ক্ষুধার তাড়নায় জোলেখাকে বলবে না খদ্দেরের কাছে যেতে। চারপাশের অন্ধকারে নিমজ্জিত সমাজ ব্যবস্থা হতে বহু দূরে চলে গেছে জীবনের অভিমানে। যে জোলেখার নিরাপত্তার জন্য সে তাকে ঘরে এনেছিল সেই জোলেখাকেই নিজের ইচ্ছায় তুলে দিতে হয়েছে অন্যের হাতে। লজ্জা আর অভিমানে তাই বিষ পানে এনেছে জীবনের সমাপ্তি। জোলেখার নিরাপত্তার চিন্তা আজ আর তার নেই। মুক্ত সে মুক্ত। মুক্ত এই দেশ এই সমাজ ব্যবস্থা হতে। জোলেখার চারদিকে অসীম শূন্যতার মাঝেও কামালের দিকে তাকিয়ে আর স্থির থাকতে পারে না। সে চিৎকার করে বলে উঠে, এই দেশের দুই নেত্রী না মেয়ে মানুষ। তারা কী মেয়েদের উজ্জতের দাম বুঝে না? আইজ যদি হরতাল না থাকতো আমি বেশ্যা হইতাম না, আমি সোমায়ী হারাইতাম না। আমাকে খদ্দের খুঁজতে হইতো না। গরীবের প্রতি অন্যায় অবিচারের বিচার কে করবো? কালু যদি এমুন বুদ্ধি কামালরে না দিত তাইলে সেও আমারে খদ্দের খুঁজতে কইতো না। কালুর প্রতিই জেগে উঠে জোলেখার ক্ষোভ। জোলেখা কামালকে জড়িয়ে ধরে। তারপর বিড় বিড় বলে আমিও আইতাছি তোমার কাছে, আমার শেষ খদ্দের শেষ কইরা। জোলেখা কামালের লাশের উপর পড়ে কাঁদতে থাকে। ভোরের আকাশে ফরজের আযান ভেসে আসে।
জোলেখা তৈরি হয় তার জীবনের শেষ খদ্দের কালুর জন্য।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে নভেম্বর, ২০১৫ রাত ১০:০০