ছি রাজাকার! ধিক মুক্তিযোদ্ধা!!
সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল
আমার নানাকে নিয়ে আমি একটা লেখা লিখেছিলাম। সেই লেখাটি ফরিদ কবির ছেপেছিলেন ভোরের কাগজে ৩০ ডিসেম্বর ১৯৯৩-এ, পরে তা গ্রন্থিত হয়েছে মাওলা ব্রাদার্স কর্তৃক ১৯৯৪ প্রকাশিত 'স্বাধীনতা যুদ্ধের স্মৃতি' গ্রন্থে। আমার নানা মাওলানা ইউসুফ মিয়া শেরপুরে (বর্তমানে জেলা) শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন। আর তার কু'যোগ্য সাগরেদ ছিলেন জামায়াতের যুগ্ম সেক্রেটারি কুখ্যাত রাজাকার কামরুজ্জামান। তাদের কুকর্মের স্বাক্ষ্য এখনও মুছে যায়নি। কিন্তু তারা তাদের কুকর্ম মোছার নানা অপচেষ্টা করছে। তাই প্রতিবছর মার্চ আর ডিসেম্বর মাস এলেই শুরু হয় তাদের নিত্যনতুন মোনাফেকি কথাবার্তা, কর্মসূচি। সে জন্যই এবার তথাকথিত 'জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা পরিষদ' গঠন করে গত ২০ ডিসেম্বর 'পাঁচ মুক্তিযোদ্ধাকে সংবর্ধনা' দেয়ার নতুন প্রজেক্ট হাতে নিয়েছিল। যুদ্ধাপরাধী হিসেবে যখন তারা বিচারের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে, তখন 'দেশপ্রেমিক' সাজার কৌশল করছে। বলছে, 'যুদ্ধাপরাধীদের বিচার মানে ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র।' এটা তো আর নতুন কিছু নয়। ইতোপূর্বে জাতির জনক বঙ্গবনন্ধু শেখ মুজিবকে নিয়ে কটাক্ষ করেছে। বলেছে, '৭১-এ বাঙালি জাতিকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে মুজিব পাকিস্তানে বসে হালুয়া-রুটি খেয়েছে। তাদের আরও কিছু প্রলাপ নিম্নরূপ :
ক। '৭১-এ তারা ভুল করেনি। কারণ, যুদ্ধের সময় গণহত্যা, নারী নির্যাতন, লুণ্ঠন ও অগি্নসংযোগ জাতীয় অপরাধ জায়েজ এবং ওয়াজেব।
খ। ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যা আওয়ামী লীগেরই নীলনকশা।
গ। পাকিস্তান 'আল্লাহ ঘর'। তাই পাকিস্তান আর নিজামীর সমালোচনা করা মৃত্যুদ- অপরাধ।
ঘ। বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী শামসুর রাহমান, জাহানারা ইমাম, কবীর চৌধুরীরা ইসলামের দুশমন!
ঙ। গোলাম আজমের ভাষ্য '৭১-এর রাজাকার বাহিনী তৈরি না হলে পূর্ব পাকিস্তানের পাঁচ কোটি মানুষকেই প্রাণ দিতে হতো।
চ। প্রগতিশীলতার নামে যারা ইসলাম ও জামায়াতে ইসলামের বিরুদ্ধে বক্তৃতা ও বিবৃতি দেয়, তাদের জন্য 'বস্নাসফেমি আইন' প্রর্বতন প্রয়োজন ইত্যাদি ইত্যাদি।
'বিজয়ে দিবসে' তারা তাদের 'পরাজয় দিবস' মানতে রাজি নয়। আজ মনে পড়ছে- ইমদাদুল হক মিলনের 'রাজাকারতন্ত্র' এবং হুমায়ূন আজাদের 'পাকসার জমিন সাদবাদে'র কথা। কিভাবে সুপরিকল্পিতভাবে তাদের উত্থান-উত্তরণ ঘটেছে। স্বাধীনতাবিরোধী শাহ আজিজ প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন, আবদুর রহমান বিশ্বাস স্পিকার ও রাষ্ট্রপতি হয়েছেন, বিচারপতি নূরুল ইসলাম উপ-রাষ্ট্রপতি হয়েছেন, মওলানা মান্নান, মুজাহিদ, নিজামীরা মন্ত্রী হয়েছেন। জাতির জন্য চরম অপমানের বিষয়_ এদের গাড়িতে শহীদদের রক্তমাখা জাতীয় পতাকা শোভা পেয়েছে। সেই দুঃখ-গ্লানি-অপমান নিয়ে আবু হাসান শাহরিয়ার লিখেছেন কষ্টের কবিতা_ 'খুনিদের গাড়িতে উড়ে জাতীয় পতাকা!'
আমরা যারা সাধারণ, যৎসামান্য লেখালেখি করি, তারাও স্বাধীনতা বিরোধীদের সহযোগিতা করি না। অথচ প্রায় সব রাজনৈতিক দলই 'কমপ্রোমাইজ' করছে। বিএনপি, জাতীয় পার্টির কথা বাদই দিচ্ছি; আওয়ামী লীগও শান্তি কমিটির মওলানা নূরুল ইসলামকে ধর্ম-মন্ত্রী বানিয়েছে। সমঝোতায় এসেছে মওলানা মান্নানের ইনকিলাবের সঙ্গে। অথচ ঘনিষ্ট কবিবন্ধু আতাহার খান ওই দৈনিকটির সহযোগী সাপ্তাহিক 'পূর্ণিমা' দীর্ঘদিন নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন, কিন্তু আমরা কখনই রাজাকারদের রক্তাক্ত হাতে হাত মিলাইনি এবং তাদের পত্রপত্রিকাতেও লেখালেখি করিনি!
আমার মাকে ক্ষেপানোর জন্য মাঝে মধ্যে দুঃখ করে বলি: আমিও তো এক রাজাকারের নাতি, আমার জন্ম পাকিস্তান আমলে, বাল্যশিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে আমিও স্কুলে পাকিস্তানি জাতীয় সঙ্গীত গেয়েছি_ পাক সার জমিন সাদ বাদ/কিশোয়ারে হাসিন সাদ বাদ ...
দুঃখ হয়, তিন দশক পরেও তারা এই সঙ্গীতকে ভুলতে পারে না। 'আমার সোনার বাংলা' ... তাদের কাছে হিন্দু কবির লেখা গান। তাতে আছে_ 'তোমার কুলে ঠেকাই মাথা' ...। তাই জাতীয় সঙ্গীত পাল্টানোর জন্য তারা পাঁয়তারা করেছিল। জাতীয় সঙ্গীত পাল্টাতে না পারলেও ইতিহাস পাল্টানোর চেষ্টা করে। তাই স্বাধীনতার শত্রু 'মোমেন খান' এখন 'শহীদ মোমেন খান' হয়ে উঠছে। জাতির এই লজ্জা আমরা কী দিয়ে ঢাকব ?
হে পঞ্চপা-ব, বীর মুক্তিযোদ্ধা সেক্টর কমান্ডার মেজর (অব.) আবদুল জলিল, বীর প্রতীক আফাজ উদ্দিন, মেজর জেনারেল (অব.) শফি আহমেদ, উইয়ং কমান্ডার (অব.) হামিদুল্লাহ খান এবং কবি আল মাহমুদ, দেশ ও জাতি কি আপনাদের সম্মান দেয়নি? আপনারা কীভাবে সম্মতি দিলেন যে, স্বাধীনতা বিরোধী জামায়াত-রাজাকারদের কাছ থেকে আপনারা 'সংবর্ধনা' নেবেন? আপনারা একটি বারও ভাবলেন না_ এত কলঙ্কের তিলক! মেজর জলিলের পরিবারও কীভাবে রাজি হলেন, 'মরণোত্তর' সংবর্ধনার নামে কলঙ্কের তিলক নিতে? দেশের মানুষ আজ বিস্মিত!
এতদিন আমরা বলতাম; ছি রাজাকার! এখন কি বলতে হবে_ ছি মুক্তিযোদ্ধা !!
উল্লেখ্য, প্রথমে সংবর্ধনা অনুষ্ঠান স্থগিত করলেও পরে গত ২৭ ডিসেম্বর ২০০৯-এর কড়া নিরাপত্তার ভেতর সংবর্ধনা দেয়। এতে মরণোত্তর মেজর জলিলের পক্ষে কেউ যাননি। অনুষ্ঠানে কবি আল মাহমুদ ৫০ হাজার টাকা পেয়ে জামায়াতের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেছেন, 'এ সম্মাননা গ্রহণকে নিজের জন্য ন্যায়সঙ্গত ভাবছি। এ সংবর্ধনা ইতিহাসের জন্য অনির্বায।' সংবর্ধিত লে. ক. (অ.) আফাজ উদ্দিন বলেন, জামায়াত মুুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে কী না তা তার জানা নেই। তিনি আরও বলেন 'মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তো মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল। তাই বলে কি তাদের সঙ্গে আমরা সম্পর্ক নষ্ট করে ফেলব?' (উইং কমান্ডার হামিদুল্লাহ খানের নাম সংবর্ধনার তালিকায় থাকলেও শেষ পর্যন্ত তার নাম খুঁজে পাওয়া যায়নি)।
এদিকে সংসদের উপ-নেত্রী সাজেদা চৌধুরী বলেছেন, 'যারা জামায়াতের সংবর্ধনা নিয়েছে, তাদেরও বিচার করা হবে।' এই হচ্ছে তথাকথিত মুক্তিযোদ্ধা এবং মোনাফেক রাজাকারদের নাট্যচিত্র।
[লেখক: কানাডা প্রবাসী কবি ও গবেষক। টরন্টো থেকে প্রকাশিত অধুনালুপ্ত সাপ্তাহিক বাংলা রিপোর্টারের প্রধান সম্পাদক।]