বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের দুটো ঘটনার কথা সামু এর ব্লগারদের সাথে শেয়ার করলাম।
ছিনতাই
আপনারা অনেকে হয়তো প্রকৃত ছিনতাইকারীদের শিকার হয়েছেন। এসব ছিনতাই অধিকাংশক্ষেত্রে জন সমাগম যেখানে কম সেখানে হয়ে থাকে। কয়েক হাজার তরুন-যুবকের মাঝ থেকে ছিনতাই একটু দু:সাহসিকই বটে। এ ধরণের ছিনতাইয়ের শিকার বোধ করি কেউ হননি বা প্রত্যক্ষ করেননি। এরকমই একটা ছিনতাইয়ের ঘটনা আজ বলবো।
তখন আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। আমরা ছয় বন্ধু সকাল-দুপুর, রাত-মধ্যরাত, সারা রাত সব সময়ই এক সংগে থাকতাম বা থাকার চেষ্টা করতাম। আমাদের ছয়জনের সকলেই ক্যাম্পাসে বা হলে নেহাৎ ভদ্র ছেলে হিসেবেই পরিচিত ছিলাম এবং সকলেই মোটামুটি ভাল ছাত্র। ছয় জনের মধ্যে তিনজনতো মাস্টার্স এ ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়েছিল এবং একজন পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকও ছিলো। বন্ধুদের নাম ধরা যাক মইন, নিরু, জাহিদ,বাবুল, কচি আর আমি, এরমধ্যে প্রথম তিনজন ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট। ঘটনায় ফিরে আসি।
সেদিন ছিল ডাকসু আয়োজিত ক্রীড়া প্রতিযোগিতা। বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে বিভিন্ন খেলা চলছিল। আমরা ছিলাম দর্শকের ভুমিকায়। এক সময় শুরু হলো যেমন খুশি তেমন সাজো প্রতিযোগিতা। ভার্সিটির শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন সাজে মাঠ প্রদক্ষিণ করছিল, কেউ বা মূর্তি সেজে নির্দিষ্ট স্থানে মূর্তিমান দাঁড়িয়েছিল। কেউ পাগল, কেউ ভিখিরি, কেউ ফুলওয়ালী ইত্যাদি নানা সাজ। আমরা নেহায়েৎ ভদ্র হলেও সহপাঠী বা সমকক্ষদের সাথে দুষ্টুমির সুযোগ কখনো হাতছাড়া করেছি বলে মনে পড়ে না। তাই স্বভাবসুলভ কাজে মাঠে নেমে পড়লাম, মানে যেমন খুশি তেমন সাজোর প্রতিযোগীদের পেছনে লাগলাম। একজন ফুলওয়ালী ছিল তার কাছ থেকে ফুল কেনার ছল করে কিছুক্ষণ আলাপ করার সুযোগ নিলাম। এমন সময় জাহিদ -- আমাদের মধ্যে সেরা ছাত্র এবং সেরা দুষ্টু, আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলো ভিখিরির সাজে থাকা একটি মেয়ের দিকে। দেখলাম মেয়েটি মুখে কালি মেখে ময়লা কাপড় পরে থালা হাতে ভিক্ষে করছে। ইতোমধ্যে তার থালায় পরেছে দশ টাকা, পাঁচ টাকা ও এক টাকার কয়েকটি নোট এবং কিছু খুচরা পয়সা। দুস্টু জাহিদ প্রস্তাব দিলো ভিক্ষাসহ থালা ছিনতাই করতে হবে। আমার আবার জাহিদের সাথে ঘনিষ্টতা ছিল বেশি, সাথে সাথেই রাজি হয়ে গেলাম। পরিকল্পনাটা জাহিদের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠ যারা দেখেছেন তারা জানেন, মাঠের এক পাশে গ্যালারি, গ্যালারির দুটো অংশ, মাঝখানে মাঠে ঢোকার রাস্তা। পরিকল্পনা হলো, ভিখিরি সাজের মেয়েটা যখন গ্যালারির মাঝখানে অর্থাৎ মাঠে ঢোকার রাস্তায় আসবে তখনই অ্যাকশনে যেতে হবে, ছিনতাই করবো জাহিদ ও আমি, কেননা হান্ড্রেড মিটার স্প্রিন্টে আমাদের দুজনের জুড়ি নেই । আমরা দৌড়ে পালানোর পর অন্য চার জন কাভারেজ দেবে অর্থাৎ এমনভাবে দাঁড়িয়ে থাকবে যাতে কেউ সাথে সাথেই আমাদের পিছু নিতে না পারে, ত্রিশ থেকে চল্লিশ সেকেন্ড পর ওরা চার জনও ধর ধর বলে আমাদের পিছু নেবে। আমরা দুজন দৌড়ে গিয়ে সাইন্স এনেক্স বিল্ডিং ( মাঠের উল্টোদিকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে) অবস্থান নেবো, ওরা চারজন পরে সেখানে আসবে।
একদম হান্ড্রেড পারসেন্ট পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ হলো। মেয়েটা আমাদের পরিকল্পিত স্থানে আসার পর জাহিদ ও আমি তার দুপাশে অবস্থান নিয়ে আকস্মিকভাবে ভিক্ষার থালাটা কেড়ে নিয়েই ভো দৌড়, যা মেয়েটার ভাবনারও অতীত ছিল। দুজন এক দৌড়ে রাস্তা পার হয়ে আইন বিভাগের বারান্দায়। আর ওরা চার জন আমাদের পিছু পিছু সামাণ্য একটু দৌড়ে তারপর নির্বিঘ্নে হেটে হেটে আমাদের কাছে এলো। ছিনতাইয়ের টাকার হিসাব করা হলো, খুচরা পয়সাসহ সর্বমোট সাঁইত্রিশ টাকা পঁচাত্তর পয়সা। টাকা নিয়ে মেডিক্যাল কলেজের ক্যান্টিনে (এখন সম্ভবত সে ক্যান্টিনটা নেই) মোগলাই পরটা আর চা, বিল হলো চুয়াল্লিশ টাকা, বাকি টাকা কে দেবে ? সবাই পকেট উল্টালো টাকা নেই অগত্যা প্রধান ছিনতাইকারী আমার জরিমানা ছয় টাকা পঁচিশ পয়সা। সবার জ্ঞাতার্থে বলছি, সে সময় হলের ডাইনিং হলে প্রতি মিল ছিল দু টাকা।
আর এটা ছিনতাই ! ---- না আমরা একে খেলা হিসেবেই নিয়েছিলাম।
অ্যাডাম টিজিং
ঈভ টিজিং এর কথাতো হর হামেশা শোনা যায় এবার শুনুন অ্যাডাম টিজিং এর গল্প।
আমার মধ্যে সব সময়ই জনপ্রিয় হবার একটা বাসনা ছিল। শুধু জনপ্রিয় হওয়া শেষ কথা ছিল না, অনেকবার জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের পরীক্ষায়ও নেমেছিলাম, অর্থাৎ নির্বাচন করেছিলাম, জয়লাভ করেছি নব্বই ভাগ ক্ষেত্রে। সে সময় ছিল ডাকসু নির্বাচনের তোড়জোড়। নির্বাহী সদস্য পদে নির্বাচনে দাঁড়ালাম এবং অবশ্যই স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে। সুন্দর ও আকর্ষণীয় একটা প্রচারপত্র ছাপালাম (আমার অনিকেত নামটা সে প্রচারপত্রেই প্রথম আসে)। প্রচারপত্র এমনই আকর্ষণীয় ছিল যে, সে প্রচারপত্র অনেকে চেয়ে চেয়ে নিয়েছে। আমারতো কোন দল নেই অর্থ নেই। তাই প্রচারের কৌশল ছিল -- যখনই রাতে দেখি কোন ছাত্র সংগঠনের কর্মীরা দেয়ালে চিকা মারতে বের হচ্ছে আমিও তাদের সংগী হতাম এবং তাদের রঙ ব্রাশ ব্যবহার করে নিজের জন্য চিকা মারার কাজটা সেরে ফেলতাম। আর চিকা মারা শব্দটার ব্যুৎপত্তি সে সময়ই প্র্যাকটিকালি জানতে পারলাম। রাতের পাশের ড্রেন থেকে রাস্তায় অসংখ্য চিকা দৌড়াদৌড়ি করে, সে সময় ফুটবলের মতো কষে লাথি দিয়ে চিকা মেরে ফেলার মজাই আলাদা। কিন্তু রোকেয়া কিংবা সামসুন্নাহার হলে তো রাতে চিকা মারা যায় না। একদিন দিনের বেলা একটি ছাত্র সংগঠনের চিকা মারা পার্টির একজনের সাথে গেলাম রোকেয়া হলে, আমার উদ্দেশ্য নিজের প্রচারটা নিশ্চিত করা। আমার সাথে বন্ধু মইন ও নিরু ছিল। রোকেয়া হলের গেট দিয়ে ঢুকে সোজা গেলে যে ভবনটা সে ভবনের দেয়ালে মই লাগিয়ে ছাত্র সংগঠন কর্মীটি দেয়ালের উপরের অংশে লেখার কাজ করছে, তার সাথে রঙের টিন হাতে নিরু, আর আমি মইয়ের মাঝামাঝি জায়গায় দাঁড়িয়ে, মইন নিচে। মেয়েদের হল -- কেউ ভবনে ঢুকছে কেউ বের হচ্ছে, কেউ মাঠে বসে আড্ডা দিচ্ছে,কেউ বারান্দায় কাপড় মেলছে। ভালই লাগছিল এসব দৃশ্য দেখতে। হঠাৎ করে অনুভব করলাম আমার পিঠে ঢিল মতো কিছু একটার আঘাত। পেছনে তাকালাম কাউকেই দেখলাম না। একটু পর আর একটা ঢিল এসে মাথায় লাগলো। নিরুর দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম। সে তিন তলার দিকে দেখালো একটা মেয়ে রেলিংয়ের উপর বসে বড়ই খাচ্ছে আর বিচিগুলো ছুড়ে মারছে আমার দিকে। কোন রকমে মান ইজ্জত নিয়ে চিকা মারা শেষ করে বের হবার জন্য হলের গেটের দিকে যাচ্ছি। তখন দেখি আরেক যমদূত নারী! জিনস পেন্ট কালো টি শার্ট পরে একটা টেবিলের উপর পায়ের উপর পা তুলে বসে পা নাচিয়ে মহা দুষ্টুমি চোখে আমাদের দেখছে। এই সেই পলি হাবিব (সে সে সময়ের রোকেয়া হলের ভিপির ক্যাডার বলে পরিচিত) যাকে ইতিপূর্বে ক্যাম্পাসে হালকা ধরণের টিজ করার চেস্টা করেছে আমার বন্ধু নিরু। এবার পলির পালা। আমরা তার সামনে দিয়ে অতিক্রম করতেই সে টেবিল থেকে লাফ দিয়ে নেমে বাংলা সিনেমার ভিলেনের মতো আমাদের পা থেকে মাথা পর্যন্ত নিরীক্ষণ করে বললো ’’ আপনারা কি রোকেয়া হলেই থাকেন নাকি? ” আমি তার দিকে না তাকিয়ে ’জী থাকি’ বলেই দ্রুত হাটা, এক নি:শ্বাসে টিএসসির সামনে এসে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম যেন।
আর আমার নির্বাচনের খবর হলো--- একশত ভাগ রাজনীতি সচেতন মানুষদের মাঝে স্বতন্ত্র প্রার্থীর জয়লাভ কঠিনস্য কঠিন।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই অক্টোবর, ২০০৯ রাত ১২:৫৭