মাঝে মাঝেই বিভিন্ন সংস্থা দেশী-বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের র্যাং কিং প্রকাশ করে থাকে। ব্যক্তিগতভাবে এমন কোন খবর আমার নজরে এলে বেশ সাগ্রহে তা পড়ে থাকি। রুদ্ধশ্বাসে ‘ঢাবি’র নাম খুঁজে ব্যর্থ হয়ে নিদেনপক্ষে বাংলাদেশের অন্য যেকোন বিশ্ববিদ্যালয়ের খোঁজ চালাই। বলাই বাহুল্য, এখানেই অবস্থা তথৈবচ। মনের গহীন থেকে পাজর ভাঙ্গা দীর্ঘ্শ্বাস বের হয়ে আসে। হায়রে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড!
বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক র্যাং কিং এর জন্য যে সকল মানদন্ড থাকে, যেমনঃ উন্নততর গবেষণা, এর আকার, আয়তন, শিক্ষক সংখ্যা ও তাদের যোগ্যতা, মোট শিক্ষার্থী সংখ্যা, সুযোগ সুবিধা, বাজেট, আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে এর অবদান, শিক্ষা শেষে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ছাত্র ছাত্রীদের অবদান, ইত্যাদি ইত্যাদি। অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা নাইবা বলি। কিন্তু ঢাবি’সহ বেশ কিছু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে উল্লেখিত বেশীরভাগ মানদন্ডই বিদ্যমান। তবু কেন আমরা কখনই র্যাং কিংয়ে সামনের কাতারে থাকতে পারি না? এর হেতু কি, আর সমাধানই বা কি? চলুন আজ সবাই মিলে এর সত্যিকার কারণ অনুসন্ধানে কিছু সময় ব্যয় করি।
শিক্ষাই একটি জাতির মেরুদন্ড। একটি সুখি, সমৃদ্ধশালী ও উন্নত জাতি গঠনে শিক্ষাই মূল চালিকাশক্তি। শিক্ষা ছাড়া কোন জাতি বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারেনি। শিক্ষায় যে জাতি যত অগ্রগামী, সে জাতিই বিশ্বে শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী। তবে শুধু গড়পড়তা একটা শিক্ষা ব্যবস্থা থাকলেই হবে না। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার কাঠামোটা এমন শক্তিশালী ভিতের উপর থাকতে হবে যেন সত্যি তা মেরুদন্ডরুপে বিবেচিত হতে পারে। আমাদের দেশের সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থায় কি এমন শক্তিশালী কাঠামো বিদ্যমান? এককথায় এর উত্তর ‘না’। তাহলে এটা কি মেরুদন্ড হবার যোগ্য? এর উত্তরও ‘না’। যাইহোক, আমরা সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থায় না গিয়ে শুধুমাত্র উচ্চশিক্ষায় আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখার চেস্টা করব।
উচ্চশিক্ষার জন্য আমাদের দেশে বিভিন্ন ধরণের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে, যথা সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়, বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ইঞ্জিনিয়ারিং এবং প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়। ইউজিসি’র তথ্যমতে, উচ্চ শিক্ষায় বর্তমানে ত্রিশ লাখ ছাত্রছাত্রী অধ্যয়ন করছে। এটা বাংলাদেশের জন্য বড় অর্জন। এখন প্রশ্ন হলো, আমরা কি উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার প্রকৃত মান বজায় রাখতে পারছি। বোধহয় না। কেন পারছি না? এর কারণ কি?
মোটা দাগে বলতে গেলে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে মূলত দুটি কাজ হয়। একটি শ্রেণিকক্ষে পাঠদান ও অন্যটি গবেষণা করা। বাকীসব গৌণ। আর এই কাজে নিয়োজিত থাকেন সম্মানিত শিক্ষকমন্ডলী। ধরে নিলাম প্রথমটি মানে শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের কাজটি আমাদের সম্মানিত শিক্ষকমন্ডলী যতটা সম্ভব করার চেস্টা করে যাচ্ছেন। কিন্তু দ্বিতীয়টির বেলায় মানে, গবেষণার কি অবস্থা? দ্বিধাহীনচিত্তেই বলা যায় যে, বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তুলনায় আমরা গবেষণায় যোজন যোজন পিছিয়ে আছি। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্যই হচ্ছে নতুন নতুন জ্ঞান সৃষ্টি, জ্ঞান ধারণ এবং জ্ঞান বিতরণ করা। আর গবেষণা ছাড়া নতুন জ্ঞান সৃষ্টি সম্ভব নয়। তাই উচ্চশিক্ষায় গবেষণার গুরুত্ব অপরিসীম। তবে গবেষণার কাজ যে একেবারেই হয় না-তা না। কিন্তু এটি প্রয়োজনের তুলনায় নেহায়েত কম। আর ঠিক এখানেই র্যাং কিংয়ে পিছিয়ে পড়ার আসল কারণ নিহিত আছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর যে র্যাং কিং করা হয়ে থাকে তা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত গবেষণাপত্রের মানের ও সংখ্যার ওপর নির্ভর করেই। আমাদের দেশে গবেষণা খুব কম পরিমাণে হয়। এর পেছনে কিছু যৌক্তিক কারণও বিদ্যমান। যেমন, গবেষণা বাবদ খুব অল্প পরিমানে অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়। আন্তর্জাতিক মানের বিশ্ববিদ্যালয় তৈরির প্রধান শর্ত হচ্ছে, উচ্চমানের গবেষণার অবকাঠামো তৈরি। বাংলাদেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় এই ইনডেক্সে অনেক পিছিয়ে। ওয়ার্ল্ড ইনডেক্স তো দুরের কথা এশিয়ার সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো তালিকার মধ্যেও বাংলাদেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয় স্থান করে নিতে পারেনি। এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দোষ একার নয়।
গবেষণা খাতে বাজেটে আশানুরূপ বরাদ্দ থাকে না। খুবই হতাশ হতে হয় যখন দেখা যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেটে বরাদ্দকৃত ৪২৫ কোটি ৫০ লক্ষ টাকার মধ্যে গবেষণা খাতে বরাদ্দ মাত্র ৪ কোটি ৫০ লক্ষ টাকা (মোট বাজেটের ১ দশমিক ০৬ শতাংশ!), যেখানে ঘানা এবং কেনিয়ার মত দেশে তা ৩১ শতাংশ।
এর জন্য কি শুধু বিশ্ববিদ্যালয়কে দায়ী করব? আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের দায় থাকলেও এর জন্য বেশি দায়ী করব সরকারকে। জাতীয় বাজেটে শিক্ষায় বিশেষ করে উচ্চশিক্ষা খাতে বরাদ্দের চিত্র খুবই হতাশাজনক। জাতীয় বাজেটে যেখানে শিক্ষাখাতে মোট বাজেটের ২০ শতাংশ বরাদ্দ করা দরকার সেখানে বরাদ্দ আছে মাত্র ১০.৭ শতাংশ। সরকার কি কখনও ভেবে দেখেছে কেন আমাদের কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বের শীর্ষ ৫০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে নেই? গবেষণাই যেখানে নেই সেখানে ঢাবি এশিয়ারও ১০০ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যেও টিকবে না সেটাই স্বাভাবিক।
স্বাধীনতার পর থেকে যতবার বাজেট পাস করা হয়েছে প্রায় প্রতিবারই শিক্ষাখাতে বরাদ্দের হার এমনই। আগামী দিনেও এটা আচমকা বহুগুণ বেড়ে যাবার আশা ক্ষীণ। তাহলে কি আমাদের দেশীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চিরদিন একেবারে পেছনের কাতারেই থেকে যাবে? এর থেকে পরিত্রাণের কি কোন উপায় নেই? একটা উপায় অবশ্যই আছে। সত্যি বলতে কি, শুধুমাত্র এই কথাটি বলার জন্যই এত কথা বলে যাচ্ছি।
আমাদের দেশের সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট বরাদ্দের হার প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। আর বেসরকারী বিশ্ববুদ্যালয়কে ত পুরোটাই ছাত্রদের টিউশন ফি’র উপর ডিপেন্ড করতে হয়। তাদের নিজস্ব আয় বলতে গেলে নেই-ই। বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্টদের টিউশন ফি’ নামমাত্র। তবু একটা সুন্দর পথ খোলা আছে গবেষণার জন্য ফাণ্ড তৈরী করার। আর সেটা হলো, অ্যালামনাই বা প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রী। যারা যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন তারা এগিয়ে এলেই সমস্যার সমাধান হতে পারে।
বিভিন্ন সুত্রমতে জানা যায় যে, বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গবেষণা তহবিলে অর্থ যোগানের লক্ষ্যে অ্যালামনাইদের কাছে উন্মুক্ত আবেদন করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যালামনাই বেশ আগ্রহ সহকারে সাধ্যমত বিশ্ববিদ্যালয় ফান্ডে অর্থ দিয়ে সহযোগিতা করে থাকেন। তারা পারলে আমরা কেন পারব না?
ধরা যাক, প্রাচ্যের অক্সফোর্ডখ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা। এখানে থেকে বহু প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীগণ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে অবদান রেখে যাচ্ছেন। অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন কেউ কেউ। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে গেলেই কি তাদের দায়িত্ব শেষ? যে বিশ্ববদ্যালয় তাকে তৈরী করল তার প্রতি কি তাদের কোনই দায়িত্ব নেই? মোটেও তা নয়। বরং যেই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে আপনি আজ সমাজের একটা বিশেষ স্থান অধিকার করে আছেন, সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নের জন্য আপনি/আমি সামান্য কিছু অবদান রাখতেই পারি। এটা আমাদের কর্তব্য। একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থীরাই পারে এ দেশকে, বিশ্ববিদ্যালয়ের চেহারাকে আমূল পরিবর্তন করে দিতে।
খুবই আশাপ্রদ খবর হলো, অতি সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হয়ে গেল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের ‘হিরণ্ময় অ্যালামনাই মেলবন্ধন-২০১৬। এখানে এর সভাপতির বক্তব্যে রকিবউদ্দীন আহমেদ বলেন, শতবর্ষ পূর্তির আগে ১০০ কোটি টাকা সংগ্রহ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তহবিল গঠনে ইউনিভার্সিটি অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন সহযোগিতা করবে। বড়ই আনন্দের খবর এটি। যাত্রা শুরু হয়েছে বলতে হবে। এটাকেই বৃহত্তর পরিসরে নিয়ে যাওয়া যেতে পারে। কিভাবে? চলুন দেখি।
আমার প্রস্তাবঃ
আমরা প্রত্যেকেই স্ব স্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য সামান্য কিছু অবদান রাখতে পারলে নিজেদের সৌভাগ্যবানই মনে করব। এই ব্যাপারে আমার সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব নিম্নরুপঃ (একজন প্রাক্তন ছাত্র হিসেবে আমি উদাহরণস্বরুপ ঢাবির নাম ব্যবহার করছি)।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন প্রথিতযশা ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে “Dhaka University Central Alumni Association (DUCAA)” গঠন করা হোক। এর সভাপতি ও পরিচালনা পর্ষদের অন্যান্য সদস্যপদ আলোচনার মাধ্যমে ঠিক করা হবে। স্ব স্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল প্রাক্তন ছাত্রছাত্রী নির্দিষ্ট ফি’র পরিশোধ করে এর ‘সাধারণ সদস্য’ পদ গ্রহণ করবেন। উল্লেখ্য, আজীবনের জন্য মাসিক ভিত্তিতে সবাইকে উক্ত ফি দিয়ে যেতে হবে। ধরে নিলাম, মাসিক ফি’র হার ১০ (দশ) টাকা মাত্র। এটা কমবেশী হতে পারে। তবে এর পরিমাণ খুব বেশী হওয়া উচিত হবে না। কেউ ব্যক্তিগতভাবে বেশী দিতে চাইলে দিতে পারবেন। তবে ন্যুনতম ফি অবশ্যই ফিক্সড থাকতে হবে।
বছরের একটা নির্দিষ্ট সময়ে গবেষণা তহবিলে অর্থ যোগানের লক্ষ্যে অ্যালামনাইদের কাছে উন্মুক্ত আবেদন করা হবে। এর জন্য একটা নির্দিষ্ট ব্যাংক একাউন্ট থাকবে যেখানে সবাই টাকা জমা দিবে। আমার বিশ্বাস কমপক্ষে ৬০-৭০ শতাংশ ছাত্রছাত্রী সাগ্রহে এতে শরিক হবেন।
এখন নেক্সট পদক্ষেপ হলো, টাকা খরচ হবে কিভাবে? খুব সহজ। একটা সাব-কমিটি করা যেতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষকগণ নিয়মমাফিক তাদের গবেষণার বিষয়বস্তু একটার একটা ‘প্রপোজাল’ এই সাব-কমিটিতে জমা দিবেন। কমিটির সদস্যগণ এটি যাচাই-বাছাই করে উপযুক্ত মনে হলে প্রয়োজনীয় অর্থবরাদ্দ দিবেন। অর্থবরাদ্দপ্রাপ্ত শিক্ষকগণকে অবশ্যই সময়ে সময়ে গবেষণার হালনাগাদ তথ্য সাব-কমিটিকে অবহিত করতে হবে। এভাবেই এগিয়ে যাবে গবেষণা কর্মসূচী।
মোটা দাগে এই হলো আমার প্রস্তাবনা। আরও যে সকল খুটিনাটি ব্যাপার থাকবে তা সমাধা করতে খুব একটা বেগ পেতে হবে না।
এই ব্যাপারে আপনাদের সুনির্দিষ্ট কোন বক্তব্য থাকলে আমাদের জানান।
সবাইকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।
রেফারেন্সঃ
১. Click This Link
২. Click This Link
৩. Click This Link
৪. Click This Link