
এমন সময় আবার রিনরিনে কন্ঠটা শোনা গেল, ‘বানান ঠিক করতে বললাম না!’
আমিতো হতভম্ব হয়ে গেলাম, তারমানে সত্যি আমি কারো কথা শুনছি! সারা গা কেমন যেন কেঁপে উঠল। ঘরে কি আসলেই কোন ভূত এসেছে?
‘কথা কানে যায় না? আমার নাম ংঙ্যুণ্রী? এটা কোন নাম হল? লেখ, গায়ত্রী।‘
আমি ধাক্কামতন খেলাম। জিজ্ঞেস করলাম, ‘ভূতের নাম গায়ত্রী?’
মনে হল দাঁত খিঁচাল ভূতটা, ‘কেন, আমার নাম গায়ত্রী হলে তোমার অসুবিধা আছে? হুমায়ূন আহমেদের বই পড়ে তোমাদের মাথা গেছে। উনি ভূতেদের নাম দিচ্ছেন হ্রিহ্রিলা, ভোভোয়া। ছি ছি…না জেনে আমাদের এভাবে অপমান করার অর্থ কী?’
‘তু-তু-তুমি হুমায়ুন আহমদের বই পড়?’ তোতলাতে তোতলাতে জিজ্ঞাসা করলাম। এবং আবিষ্কার করলাম, হঠাৎ করে ভয়টা কমে গেছে। যে ভূতের নাম গায়ত্রী হয় এবং যে হুমায়ূন আহমদের বই পড়তে পারে, সে নিশ্চয়ই খারাপ হতে পারেনা! শাকচুন্নি সম্বন্ধে অনেক ধারণাই আমাদের ভুল দেখা যায়।
‘আগে পড়তাম, এখন আর ভাল লাগেনা,’ গায়ত্রীর কন্ঠ একটু খুশি খুশি শোনা গেল। তাকে ভুল করে তুমি বলে ডেকে ফেলেছি, সেজন্যেই নাকি! যাই হোক, কিছু যখন বলেনি, তুমি করেই বলা যাক! গায়ত্রী বলল, ‘কয়েকদিন আগে ভূত নিয়ে হুমায়ূন সাহেবের একটা লেখা পড়লাম, “সালাউদ্দিনের মহাবিপদ”। উনি যা ইচ্ছে তাই লিখেছেন। ভূত নাকি ব্যাটারী খায়…কী আশ্চর্য! এতো কিছু থাকতে আমরা ব্যাটারী খাবো কেন? অ্যামোনিয়াম ক্লোরাইড কি খাওয়ার জিনিস?’
খুবই সত্য কথা। কিন্তু এতো দেখি শিক্ষিত শাকচুন্নি, অ্যামোনিয়াম ক্লোরাইড পর্যন্ত চেনে! রয়েসয়ে কথা বলতে হবে দেখা যায়। বললাম, ‘তাহলে তোমরা খাও কি?’
‘আমাদের সাথে গাছেদের অনেক মিল আছে। পার্থক্য হচ্ছে আমরা নাইট্রোজেন খাই, তারা কার্বন ডাইঅক্সাইড। এজন্যেই আমাদের শরীর অনেক শীতল থাকে। আমাদের ব্যাপারে এই একটা ধারণাই তোমাদের সত্যি, আমাদের শরীর অনেক ঠাণ্ডা। মাঝে মাঝে তোমাদের কাতুকুতু দিই, তোমরা বল, কি ঠাণ্ডা বাতাস!,' হিহি করে হাসল গায়ত্রী, 'আর আমাদের বেশি কিছু ত্যাগ করতে হয়না, প্রয়োজনীয় পরিমাণ নাইট্রোজেন গ্রহণ করে বাকিটা বের করে দেই!’
আমি মুগ্ধ হলাম। কি সুন্দর ব্যবস্থা! বাথরুমের ঝামেলাটা পর্যন্ত নেই!
ল্যাপটপে ংঙ্যুণ্রী নামটা শুদ্ধ করে গায়ত্রী করতে করতে বললাম, ‘তা গায়ত্রী, আমার কী-বোর্ডের বাটনের এই অবস্থা নিশ্চয়ই তুমি করেছ?’
খিলখিল করে হেসে উঠল গায়ত্রী। আমি আবারও মুগ্ধ হয়ে সে হাসি শুনলাম। সে বলল, ‘অবশ্যই আমি করেছি। এতো ভুলে ভরা লেখা লিখলে হবে কিভাবে? তুমি রীতিমতো আমার জীবন নিয়েই লিখেছ, কিন্তু আমার এ কি বর্ণনা দিয়েছ! আমার চুল থেকে পঁচা শ্যাওলার গন্ধ বের হয়? আমার দাঁত মাদ্রাজি মুলার মতো? আমার স্কিন সিরিশ কাগজের মতো?,’ শাকচুন্নি মনে হচ্ছে রেগে গেল, ‘তুমি…তুমি জানো আমি স্কিনের জন্যে কতো কষ্ট করি?’
আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘তোমার সাথে জীবনকাহিনী মিলে গিয়েছে নাকি? আমিতো ভেবেছি আমার গল্পের নায়িকাও শাকচুন্নি দেখেই তুমি গায়ত্রী নাম রাখতে বলছ। তারমানে তুমিও ংঙ্যুণ্রীর মতো সুন্দরী?’
‘আর বোলোনা,’ বিষণ্ণ শোনাল গায়ত্রীর কন্ঠ, ‘এই জীবন আর ভাল লাগেনা। ফাজিল ছোকরাদের জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে গেছি! গত একমাসেই বিয়ের প্রস্তাব এসেছে সাতটা। কিন্তু কাউকেই আমার পছন্দ হয়না। সবাই শুধু আমার রূপটাই দেখে, কেউ আমার ভেতরটা দেখে না। গত সপ্তাহে এক ছেলে দেখতে এল, আমার সম্বন্ধে কিছুই জিজ্ঞেস করল না। শুধু বলে তোমার দাঁতটা দেখি, চুলটা দেখি,’ গলা ধরে এল গায়ত্রীর, 'এমনভাবে আমার দিকে তাকায় যেন আমাকে গিলে খাবে!'
‘আহাহা,’ বললাম, ‘দুঃখ কোরোনা গায়ত্রী। কেউ না কেউ অবশ্যই একদিন তোমাকে বুঝবে।‘
উজ্জ্বল শোনাল গায়ত্রীর কন্ঠ, ‘হ্যাঁ, একজন বুঝেছে তো বটেই!’
‘এইতো বললাম না, কেউ না কেউ অবশ্যই তোমাকে বুঝবে! তা কে সেই সৌভাগ্যবান ভূত? নাম কি?’
‘সেতো ভূত না,’ কেমন আদুরে কন্ঠে বলল গায়ত্রী, ‘সে হচ্ছে জ্বলজ্যান্ত মানুষ! আমার সামনেই বসে আছে!’
‘তো-তো-তোমার সামনে! মা-মা-মানে আ-আ-আমি???’
‘হ্যাঁ। তুমি ছাড়া আর কে? ইস, কি সুন্দর করে আমাকে নিয়ে লিখেছ! তুমি ছাড়া আমাকে আর কে এভাবে বুঝবে, বল?’
এই সেরেছে! আমি দাঁতে দাঁত চেপে চেষ্টা করতে থাকলাম অজ্ঞান না হওয়ার। অনেক কষ্ট করে বেশ ফ্রেঞ্চকাটটা বাগিয়ে এনেছি, গায়ত্রীর চড় খেয়ে সেটার শেপ চেঞ্জ করার কোন মানে হয়না।
আমি কোনমতে বললাম, ‘কি-কিন্তু আমি, মানে আমার কি ক-করার আছে? আ-আমি কি করতে পারি তোমার জন্যে?’
‘আশ্চর্য! তুমি আমাকে বিয়ে করবে!’
নাহ, মনে হচ্ছে পারা গেল না! অজ্ঞান হয়ে যাবোই! আর গায়ত্রী যেরকম ভূত, মনে হচ্ছে ঘাড় মটকাতে মোটেই দ্বিধা করবে না। তাও ভাল...অবশ্য শ্যাওলার গন্ধওয়ালা কোন শাকচুন্নি সাথে সংসার করার চেয়ে কবরের নিচে শুয়ে থাকা ঢের আরামের!
হাঁটুর কাঁপাকাঁপি শুরু হয়ে গেল আমার। শ্রাবণীর মুখটা মনে পড়ল। হায়…ওকে কি আর এ জীবনে বিয়ে করা হবেনা! আমার দূর সম্পর্কের আত্মীয় হলে কি হবে, পাঁচ বছরের প্রেম আমাদের। একমাস আগে বাগদান হয়ে গেছে। আচ্ছা, মারা যাবার আগে কি ওকে একটা ফোনও দিতে পারব না?’
‘তুমি ভয় পেও না সোনা,’ মিষ্টি করে হাসল মনে হল গায়ত্রী, ‘আমার চুলে শ্যাওলার গন্ধও নেই, রঙও আলকাতরার মতো না। আমাদের সবকিছুতেই টক টক গন্ধ। আর আমাদের তো দেখা যায়না, তবে সংসারের প্রয়োজনে একটা রূপ ধারণ করতে হবেই। আমিতো এতোক্ষণ হাওয়া হয়ে তোমার সাথে কথা বলছিলাম। চোখ বন্ধ কর, এবার আমি আসল রূপে তোমার সামনে হাজির হব!’
‘ওহ মাই গড!’ বিড়বিড় করে চোখ বন্ধ করলাম। আচ্ছা, আর যদি না খুলি গায়ত্রী কি খুব রাগ করবে?
‘চোখ খোল।'
কি আশ্চর্য, এরই মধ্যে হয়ে গেল? আমি একটা ঢোক গিলে ভয়ে ভয়ে চোখ খুললাম।
একি! এতো মানুষই! এরকম হলেতো বিয়েও করে ফেলা যায়, মন্দ হয়না! সুন্দর মুখ, এমনকি একটা চেনা আদলও আছে! সুন্দর চুল, সুন্দর চোখ, আর…আর…
‘তো-তো-তোমার হা-হা-হাত…,’ দাঁতকপাটি সামলানোর আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগলাম।
‘ওহ! তুমি এটাই জানোনা! তোমাদের সাথে আমাদের মূল পার্থক্য হচ্ছে আমাদের হাত আর পায়ের গোড়ালি থাকে পেছন দিকে। মানে তোমরা হাঁটো সামনের দিকে, আর আমরা পেছন দিকে…’
আমার গায়ত্রীর পায়ের দিকে চোখ গেল। নূপূর পরা পা, কিন্তু…কিন্তু…গোড়ালি সামনের দিকে…পায়ের পাতা পেছন দিকে…
নিজের দাঁতকপাটির শব্দে নিজেরই কানে তালা লেগে যাচ্ছে। মূর্ছা যাওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে শুনতে পেলাম, ‘হ্যাপি বার্থডে ভাইয়া!!’
*
ল্যাপটপের বাটন উঠানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছি, কিছুতেই উঠছেনা, মেজাজ খিঁচড়ে আছে। এমনসময় রুনা ঘরে ঢুকল, ‘ভাইয়া…’
‘আরে রাখ তোর ভাইয়া! খুব তো চাপতে চাপতে বাটন ডাবিয়ে ফেলেছিস, এখন উঠাবো কিভাবে?’ চেঁচিয়ে বললাম।
হিহি করে হাসতে লাগল রুনা, আমার গা জ্বলে গেল। বললাম, ‘আমি কিছু ঠিকভাবে লিখতে পারছিনা, আর হাসতে হাসতে জান শেষ তোদের! জয়া, বিণু, নদীও হয়েছে যেমন! ভূতের ভয় দেখাবি ভাল কথা, আমার কী-বোর্ডটা নষ্ট করার কি দরকার ছিল?’
‘আস্তে, আস্তে,’ বলতে বলতে যে ঘরে ঢুকল, তাকে দেখে তড়াক করে বিছানা থেকে লাফ দিয়ে নামলাম।
‘তুমি!’
‘চিৎকার করছ কেন! আমিও কি ভূতের ভয় দেখিয়েছি নাকি?’ শ্রাবণী বলল।
‘কিন্তু তুমি এখানে কি করছ! আমার খালার বাড়ি এটা…’
‘তোমাদের গ্রামের বাড়িতে আমার আসা নিষেধ? তোমার মিমি খালা আমার চাচি, দূর সম্পর্কের চাচি, ভুলে গেছ?'
থতমত খেলাম। বললাম, ‘না না, তা না…কিন্তু…’
‘কিসের কিন্তু! এই ধরো,’ কাঁধের ঝোলানো ব্যাগটা নিচে নামালো শ্রাবণী, ‘তোমার নতুন ল্যাপটপ!’
‘নতুন ল্যাপটপ মানে!’ চোখ কপালে তুলে জিজ্ঞেস করলাম।
‘নতুন ল্যাপটপ মানে নতুন ল্যাপটপ,’ বিরক্ত হয়ে বলল শ্রাবণী, ‘দশ বছর আগের এটা দিয়ে আর কতোদিন চালাবে? এই বার্থডে তে তাই আমরা সবাই টাকা দিয়ে তোমার জন্যে নতুন ল্যাপটপ কিনে এনেছি! ব্যাচেলর হিসেবে এটাই মনে কর তোমার শেষ বার্থডে গিফট!'
বাইরে থেকে দেখে বুঝলাম, যে সে ল্যাপটপ তো না, আমার আজীবনের স্বপ্ন ঝাঁ চকচকে একটা ম্যাকবুক!! আমি আনন্দে বিকট এক চিৎকারে দিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরতে যাচ্ছিলাম, ঠিক সেই সময় ইলেকট্রিক শক খেয়ে যেন পিছিয়ে এলাম। হায় খোদা...একি দেখছি আমি! ঠকঠক যে শব্দটা হচ্ছে, সেটা কি আমার হাঁটু বাড়ি খাবার শব্দ?
শ্রাবণী, রুনা সবার পায়ের গোড়ালি সামনের দিকে… আর কিরকম অদ্ভুত গোদা গোদা বেঢপ পা...
গোঁ গোঁ করে করতে করতে অজ্ঞান হওয়ার আগে দিয়ে আবারও রুনার কন্ঠ শুনলাম, ‘আরে আপু! তুমি জুতোটা এখনো বদলাওনি! আরে আরে...আমিওতো বদলাইনি!'
'রুনা, তাড়াতড়ি এক জগ পানি নিয়ে এসো!,' দৌড়ে আমার কাছে চলে এল শ্রাবণী, 'ও আবার অজ্ঞান হয়ে গেছে!'
রুনার যাওয়ার শব্দ শুনতেই চোখে মেলে শ্রাবণীর মুখটা আমার উপর ঝুঁকে থাকতে দেখলাম। ও কিছু বোঝার আগেই টপাটপ ওর মুখে কয়েকটা চুমু খেয়ে বললাম, 'থ্যাঙ্কস সো মাচ, শ্রাবণী! রুনা ঘর থেকে না গেলে কিভাবে এই কাজটা করতাম বল তো! এতোবড় আমি প্রেজেন্ট তুমি আমাকে দিয়েছ, আমি যদি এতোটুকুও না দিই...' বলে চোখ টিপলাম, 'সামলাতে পারলাম না!'
'যাও!,' চোখমুখ লাল করে বলল শ্রাবণী, 'এরই জন্যে অজ্ঞান! যদি কেউ দেখে ফেলত...'
কিন্তু আমি কিছু বলার আগেই দরজার কাছ থেকে রুনা, বিণুর চিৎকার শোনা গেল, 'দেখে ফেলেছি! দেখে ফেলেছি!' নদী আরও এক ডিগ্রী উপরে, 'চল চল, খালুর কাছে চল! বিয়ের দিন আরও দু সপ্তাহ আগাতে হবে...এরা অতদিন অপেক্ষা করতে পারবেনা!'
হতভম্ব হয়ে আমি শ্রাবণীর দিকে তাকালাম। আচ্ছা...শ্রাবণী কি আমার চেয়ে বেশি লাল হয়ে গিয়েছে??
***
একি! এবার ভূতের গল্প লিখতে গিয়ে রোমাণ্টিক গল্প হয়ে গেল দেখি! যথারীতি ব্যর্থ চেষ্টা...নাহ, আর চেষ্টাই করা যাবে না!!


[এই লেখাটা ব্লগিং-এর শুরুতে একবার দিয়েছিলাম, এখন পুরনো পোস্ট ঘাঁটতে গিয়ে দেখি পুরোটাই উধাও!! হতে পারি আমি অতি সাধারণ ব্লগার, কিন্তু কষ্টের লেখা এরকম কথাবার্তা ছাড়া উধাও হয়ে গেলে যথেষ্টই কষ্ট লাগে


সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে নভেম্বর, ২০১১ বিকাল ৫:২১