পূর্বের পর্বের জন্যে এখানে ক্লিক করুন।
বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি সাথে নিয়ে আবারও বিলেত গেলেন দ্বারকানাথ। জ্যেষ্ঠ পুত্রের ব্যবহারে তাঁর অন্তরের রক্তক্ষরণ কোনমতেই থামছিল না।
এতোদিনে দিনে তিনি একটা সত্য বুঝতে পেরেছেন।তাঁকে সবাই ভয় করে বা শ্রদ্ধা করে,কিন্তু কেউ ভালোবাসেনা।এ সত্য বোঝার পর তাঁর সকল উৎসাহ-উদ্দীপনা যেন এক নিমেষে উধাও হয়ে গিয়েছে।তাঁর সারাজীবনের উপার্জিত এই সম্পত্তি যদি কেউ রক্ষণই না করে,তবে এই আয়ের সার্থকতা কি?তাই দ্বারকানাথ মনস্থির করলেন,অনেক হয়েছে।এবার তিনি দুহাতে ব্যয় করবেন।
বিলেত যাওয়ার সময় তিনি প্রভূত সম্পত্তি সাথে করে নিয়ে গেলেন।এছাড়া দেবেন্দ্রকে নির্দেশ দিয়ে গেলেন,যেন তাঁকে প্রতিমাসে এক লক্ষ টাকা করে পাঠানো হয়।তৎকালীন এক লক্ষ টাকা দিয়ে পাঁচ হাজার ভরি স্বর্ণ ক্রয় করা যেত।
কনিষ্ঠ পুত্র নগেন্দ্রনাথ,ভাগনে নবীনচন্দ্র ও কয়েকজন আত্মীয়-স্বজন এবং কর্মচারী নিয়ে শুভ দিন দেখে বিলেত পাড়ি দিলেন দেবেন্দ্রনাথ।লণ্ডোনে নেমেই তিনি বিরাট এক বাড়ি ভাড়া নিয়ে বসবাস করতে লাগলেন।অতি দ্রুত আবারও অভিজাত ইংরেজ মহলে তিনি জনপ্রিয় হয়ে গেলেন।সরকারী মহলও এ দিলখোলা মানুষটিকে নিজেদের করে নিল।দ্বারকানাথ এখানেই থাকবেন শুনে তাঁরা বেশ উৎফুল্ল হলেন।বলা বাহুল্য,এর আগে কোন ভারতীয় স্থায়ীভাবে বিলেতে অবস্থান করেননি।দ্বারকানাথই প্রথম।
রাণীর বাসভবনে প্রায়ই তাঁর ডাক পড়ে।উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মকর্তারা তাঁর বাড়িতে ভোজন করেন।এছাড়া তিনি দেশ থেকে নিজ খরচে দু জন ছাত্রকে ইংল্যাণ্ড নিয়ে এসে তাদের মেডিকেল কলেজে ভর্তি করিয়ে দিলেন।ইংলিশ সংস্কৃতি,আচার-ব্যবহার ইত্ত্যাদি তিনি নিজ জীবনে আষ্টেপৃষ্ঠে গ্রহণ করলেন।ব্রিটিশ পার্লামেণ্টের অধিবেশন দেখে তাঁর মাথায় নতুন একটা চিন্তা এল।তিনি ভাবলেন,ভারতবর্ষের একজন প্রতিনিধিও তো এ পার্লামেণ্টে উপস্থিত থেকে নিজেদের সুবিধা-অসুবিধার কথা সরাসরি মহারাণীকে জানাতে পারে!আর এক্ষেত্রে তাঁর নিজের চেয়ে যোগ্য প্রার্থী আর কে আছে!
মহারাণীর কাছে কথাটা তুললে মহারাণী অস্বস্তিতে পড়লেন।এই বিশিষ্ট মানুষটির মনে আঘাত্ লাগে সেরকম কিছু তিনি করতে পারবেন না,আবার এমন কোন ব্যাপারে সরাসরি মত দেয়াও মানায় না।একজন হিন্দুকে যে এরকম খৃষ্টানদের সরকারী অধিবেশনে মানায় না,তিনি তা একথা-ওকথায় দ্বারকানাথকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন।
দ্বারকানাথ বোকা নন।তিনি মনে মনে বেশ বিরক্ত করলেন।খৃষ্ট ধর্ম সম্বন্ধে তাঁর অতি উচ্চ ধারণা থাকলেও এ ঘটনার কারণে তা কিছুটা নেমে গেল।হাওয়া বদলের জন্যে তিনি কিছুদিন ফ্রান্স থেকে কাটিয়ে আসলেন।সম্রাট লুই ফিলিপস ও তাঁর অন্দরমহলের রমণীদের সাথেও তাঁর আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে উঠল।ফরাসী দেশে এক বিরাট অট্টালিকা ভাড়া করে তিনি এক সন্ধ্যায় নৈশভোজের আয়োজন করেছিলেন।প্রায় সকল সম্ভ্রান্ত ফরাসী পরিবার থেকেই কাউকে না কাউকে তিনি দাওয়াত করেছিলেন।সকলকে অনুরোধ করেছিলেন নিজ নিজ স্ত্রী বা প্রেয়সীকে নিয়ে আসতে। ভারতীয় ভদ্রলোকের আহবানে প্রায় সকলেই সাড়া দিল।সব আমন্ত্রিত অতিথিদের তিনি একটি করে বহুমূল্য কারুকার্যখচিত,নকশাদার শাল উপহার দিলেন।এরুপ অন্দুত সুন্দর শীত নিবারনের পোশাক ফরাসীরা আগে কখনো দেখেনি,তারা যারপরনাই মুগ্ধ হল।সেদিন পাঁচশতের বেশি শাল এভাবে বিলি করলেন দ্বারকানাথ।সেসবের মোট মূল্য
কম করে হলেও পাঁচ লক্ষাধিক টাকা।
এদিকে কলকাতায় তখন তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র দেবেন্দ্রনাথ অন্য কাণ্ড ঘটিয়ে চলেছেন।পিতা থাকা অবস্থাতেই তিনি বিষয়কর্মের প্রতি একটুও মনযোগী ছিলেন না,পিতা বিদেশ গমনের পর তিনি ব্যবসাপাতি,জমিদারি সবকিছু থেকেই নিজেকে গুটিয়ে আনলেন।ধর্ম সাধনাই তাঁর একমাত্র সুখ,তাঁর জীবনের একমাত্র লক্ষ্য।রাজা রামমোহন রায়ের ব্রাহ্মধর্মকে তিনি পুনর্জীবন দান করেছেন।রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশ,যিনি রামমোহন রায়ের সরাসরি শিষ্য,একাই কোনমতে এতোদিন ব্রাহ্মধর্ম টিকিয়ে রেখেছিলেন।এই বৃদ্ধ তাঁর সমস্ত জীবনই পরম ব্রহ্মের প্রতি উৎসর্গ করেছেন।প্রায় শুন্য উপাসনালয়,লোকের টিটকিরি সহ্য করে একমাত্র পুরোহিত হিসেবে উপাসনা পরিচালনা করেছেন।এই বিদ্যাবাগীশের সাহচর্যেই দেবেন্দ্র সফলভাবে ব্রাহ্মধর্মকে জীবন দান করলেন।বিভিন্ন গ্রাম-গঞ্জেও উপাসনা হতে লাগল।খৃষ্ট ধর্মকে তিনি সহ্য করতে পারতেন না।পাদ্রীরা বিভিন্ন সাধারণ মানুষদের বুঝিয়ে শুনিয়ে খৃষ্ট ধর্ম গ্রহণ করাতো,ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের দেশীয় শিক্ষা বাদ দিয়ে ইংরেজি শিক্ষা দিত,যীশুর শিক্ষা দিত।বেদান্ত নিয়ে গালাগালি করতো,হিন্দুশাস্ত্রের নিন্দা করতো।এসব দেখলেই দেবেন্দ্র তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠতেন।
তিনি হিন্দুদের দ্বারে দ্বারে ঘুরে ব্রাহ্মধর্মের মাহাত্ম্য প্রচার করতে লাগলেন,খৃষ্টধর্ম কিভাবে এই দেশকে ধ্বংস করে ফেলছে তা বোঝাতে লাগলেন।হিন্দু ধর্মকে সংস্কার করে ব্রাহ্মধর্ম তৈরী করা হয়েছে,এখানে গোঁড়ামি ব্যতীত কোন হিন্দুয়ানি বাদ দেয়া হয়নি।অন্যান্য ধর্মের ভাল ভাল কথাগুলো ব্রাহ্মগ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।তাই এ ধর্ম অন্য যে কোনো ধর্মের চেয়ে শ্রেয়,এই ছিল তাঁর সবচেয়ে বড় যুক্তি।এই যুক্তিতে অনেকেই আকৃষ্ট হলেন।ব্রাহ্মধর্মকে সমর্থন না করলেও দেশীয় ছেলেমেয়েদের ইংরেজ সংস্কৃতির প্রতি ঝুঁকে যাওয়া অনেকের চোখে পড়ল।দেবেন্দ্রের আপ্রাণ চেষ্টায় ও জনগণের প্রচেষ্টায় শেষ পর্যন্ত শিমুলিয়ায় একটি হিন্দু হিতার্থী বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হল।সেখানে মূলত নিরাকার ঈশ্বরের আরাধনাই ছাত্রদের শেখানো হত,তবে সনাতন ধর্ম কঠোরভাবে অনুশীলকারী ছাত্রদেরও নিরুৎসাহিত করা হতো না।
কিন্তু দেবেন্দ্রকে বেশিরভাগ সম্ভ্রান্ত হিন্দুই ভাল চোখে দেখেলেন না।সনাতন ধর্মকে তিনি আঘাত করার চেষ্টায় মেতেছেন বলে তাদের মনে হতে লাগল।রক্ষণশীল হিন্দু সমাজের শিরোমণি রাধাকান্ত দেব ব্রাহ্মসমাজের বিরুদ্ধে একটি হিন্দু ধর্মসভা প্রতিষ্ঠিত করলেন।যদিও তা ব্রাহ্মধর্মের
বিকাশে তেমন কোন প্রভাব ফেলতে পারল না।
এসব নিয়ে বেশ কিছু বছর মত্ত থাকলেন দেবেন্দ্র।অগাধ টাকাপয়সা খরচ করলেন,পিতাকেও টাকা পাঠালেন,পরিশ্রম করলেন।সকল শ্রমই দিলেন তাঁর ব্রাহ্মসমাজের জন্যে।তাঁদের ব্যবসার কোন উল্লেখযোগ্য উন্নতিই তিনি করতে পারেননি।
এই সময় তাঁর দীর্ঘদিনের সাথী বিশিষ্ট পণ্ডিত বাবু অক্ষয়কুমার দত্তের পরামর্শে পরিশ্রান্ত দেবেন্দ্রনাথ প্রকাণ্ড এক বজরা ভাড়া করে পত্নী সারদাদেবী ও তিন পুত্র দ্বিজেন্দ্র,সত্যেন্দ্র ও হেমেন্দ্রকে নিয়ে ভ্রমণে বের হলেন।
অতি চমৎকার দিন কাটতে লাগল দেবেন্দ্রনাথের।নদীর ফুরফুরে হাওয়ায় তাঁর দেহ-মন প্রফুল্ল হয়ে উঠল।দৈনন্দিন ঝামেলা থেকে দূরে থেকে স্ত্রী-পুত্র-বন্ধুদের সাথে খোশগল্পে মেতে উঠলেন।এরই সাথে তাঁর মানসিকতায় কিঞ্চিৎ পরিবর্তন দেখা দিল।তাঁর মনে হতে লাগল,যতোই ছুটোছুটি মানুষ করুক না কেন,মোক্ষলাভের আশায় যতোই ঈশ্বরের উপাসনা করুক না কেন,ঈশ্বর সৃষ্ট এই অপরুপ প্রকৃতি খুব কাছে থেকে না দেখলে কখনোই চূড়ান্ত মুক্তি লাভ করা যায়না।ছোট্ট একটা গণ্ডীর মধ্যে জীবনকে বেঁধে রাখাকে জীবন বলে না;তাঁর চোখে তারা জীবন্মৃত। ঈশ্বরের সৃষ্টি দর্শনের মধ্যে উপাসনার চূড়ান্ত রূপ খুঁজে পেলেন দেবেন্দ্র।তিনি ঠিক করলেন,ফিরে গিয়েই উপাসনালয়ে তাঁর এ নব আবিষ্কারের কথা ঘোষণা করবেন।
কিন্তু মানুষ ভাবে এক,হয় আরেক। নবদ্বীপ ও পাটুলি ছেড়ে বজরা যখন তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছিল,তখনি হঠাৎ সমস্ত আকাশ কালো হয়ে এল।মেঘের আঁধারে পাশের লোককেও দেখা যায়না,এমন অবস্থা।বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দে কান পাতা দায়।ভয়াবহ সে ঝড়ে দেবেন্দ্রনাথের বজরা বাদামের খোলসের মতো উথাল-পাথাল করতে লাগল।স্ত্রী-পুত্রদের জড়িয়ে ধরে একমনে ঈশ্বরকে ডাকতে লাগলেন তিনি।
শেষে বহু কষ্টে নদীপাড়ের এক ছোট গ্রামে বজরা ভেড়াল মাঝিরা।ঈশ্বরের কৃপায়ই কিনা কে জানে,ভ্রমণ দলটির কেউই গুরুতর আহত হল না।
তবে দেবেন্দ্রর নাক ফেটে গিয়েছে,সেখান থেকে রক্ত পড়ছে।স্ত্রী সারদাদেবী যত্ন করে তাঁর নাকে গজ বেঁধে দিচ্ছেন,এমন সময় ছোট এক পানসী নিয়ে ছুটতে ছুটতে হাজির হল দু জন লোক।এই প্রবল ঝড়ের মধ্যেও তারা দেবেন্দ্রকে খুঁজে বের করেছে।তবে কাজটা যে খুব সহজে পারেনি,তা তাদের চেহারা দেখেই অনুমান করা যায়।
সন্ধ্যা হয়ে এসেছে,চারিদিক বেশ অন্ধকার।এরই মধ্যে একবার বিদ্যুৎ চমকাল।দ্রুত ছোট চিঠিটা পড়ে ফেললেন দেবেন্দ্র।তিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন,সেখান থেকে ঝট করে বসে পড়লেন।তাঁর দু চোখ স্ফীত,মুখ থরথর করে কাঁপছে।ছুটে এলেন অক্ষয়কুমার।দ্রুত দেবেন্দ্রর হাত থেকে চিঠিটা নিলেন।আরেকবার বিদ্যুৎ চমকাতেই সেটা পড়লেন,”শ্রীযুক্ত বাবু মহাশয় প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর চারদিন আগে রাত্রি ৩ ঘটিকায় পরলোকগমন করেছেন…।“
বাবু অক্ষয়কুমার দত্ত বেশ শক্ত ধাতের মানুষ।এ খবরটা পড়ে তিনিও দেবেন্দ্রর পাশে বসে পড়লেন,তবে শোকে বিহবল হয়ে নয়।তাঁর মনে পড়েছে,গত মাসে একটা হিস্যা পাঠানো হয়েছিল ঠাকুর কোম্পানীতে,যে দ্বারকানাথ ঠাকুর এক কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন,ছয় মাসের মধ্যে সেই টাকা শোধ করতে অক্ষম হলে আইনের আশ্রয় নাওয়া হবে।মনে মনে প্রমাদ গুনলেন অক্ষয়কুমার।ঠাকুরদের কোষাগারে এখন সবমিলিয়ে ত্রিশ লক্ষের বেশি টাকা নেই।
নাকের রক্তও ঠিকভাবে মোছা হল না দেবেন্দ্রনাথের,তিনি ঝড়-জঞ্ঝা তুচ্ছ করে কলকাতার দিকে ছুটলেন।
(আগামী পর্বে সমাপ্ত)
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে মে, ২০১১ রাত ৯:০৫