দেবতা বলতেই আপনার চোখে হয়ত ফুটে উঠেছে বিশাল ক্ষমতাধর এক মহান চরিত্র। তবে আমি দেবতা বলতে কেবলই একটি কাল্পনিক চরিত্র বুঝে থাকি, যার কোনো শক্তি নেই, যে অপদার্থ এবং অকর্ম। দেবতাদের যে শক্তিগুলো আছে বলে মনে করা হয়, তার কোনটাই তাদের থাকে না। দেবতাদের থেকে থাকে কিছু অন্ধ অনুসারী। দেবতার ব্যাপারে মন্তব্য করা নিষেধ। দেবতা সম্পর্কে যৌক্তিক আলোচনা সব সময়ই প্রাণঘাতী। দেবতার যে কীর্তির কথাগুলো বলা হয় সেগুলো সত্য অথবা মিথ্যা যাই হোক না কেন সে কেবল বেঁচে থাকে তার ভক্তদের শ্রদ্ধায় এবং মনে। যা কেবলই হাস্যকর।
হুমায়ূন আহমেদকে তাই বাঙলা সাহিত্যের দেবতা বলা যেতেই পারে। তিনি অমর হয়ে উঠেছেন রবীন্দ্রনাথের মত। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ যেভাবে বেঁচে আছেন তার বইয়ের পাতায় আর গানের সুরে; যেমনটি প্রতিটি কবি-লেখক-গীতিকারের থাকার কথা সেভাবে; কিন্তু কতটুকু বেঁচে আছেন হুমায়ূন আহমেদ? হুমায়ূন আহমেদ বইয়ের চেয়ে বেশি বেঁচে আছেন মেলায়, এবং হলুদ পাঞ্জাবী পরা কিছু উদভ্রান্ত যুবকের মাঝে। একজন কবি বা লেখকের এভাবে বেঁচে থাকার মধ্যে সার্থকতা কোথায়? একজন লেখক যদি তার লেখা দিয়ে দুই-একটি কুসংস্কার চিরতরে দূর করতে না পারলেন, যদি তার লেখা থেকে নতুন চিন্তা বেরিয়ে না এসে বারবার একই পঁচা-গলা কাহিনী বেরিয়ে আসে তাহলে তার লেখার সার্থকতা কী? লেখক হিশেবে তার জীবনের সার্থকতা কী?
হুমায়ূন আহমেদের সফলতা বলতে - তিনি কিছু ছেলেমেয়ের মাথায় খোদাই করতে পেরেছেন হলুদ পাঞ্জাবি পরে খালি পায়ে রাত-বিরাতে হেঁটে বেড়ালেই মহাপুরুষ হওয়া যায়। তিনি তার গল্পে বারবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছেন হঠাৎ কিছু ফুলের গন্ধ, যা হ্যালুসিনেশন। তার লেখা পড়ে এখন আমার মনে হয় আমি স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির তৃতীয় হওয়া ছেলেটির লেখা প্রশ্নের উত্তর পড়ছি। সে চাইলে অনেক কিছুই লিখতে পারত, সে অনেক কিছুই জানে। কিন্তু পরিক্ষার খাতায় সে একই কথা বারংবার লিখে এক পৃষ্ঠার উত্তর রাবারের মত টেনে তিন পৃষ্ঠা করেছে। উদাহরণ দেয়া যাক - যেখানে লেখা যেত ''পাখিটি আলতাফের ভালো লাগল''। উনি লিখতেন, 'পাখি মানেই সুন্দর। কবুতর শান্তির প্রতীক। কিন্তু আলতাফের পাখি ভালো লাগে না। তার মনে হয় পাখি মাত্রই তেলাপোকাকে ম্যাগনেফাইন করে দেখা হচ্ছে। তবে, আজ পাখি দেখে তার মনে হলো পাখি আসলেই সুন্দর। কৈ মাছের মত সুন্দর।'' তার এই রাবার টানার খেলা তিনি তার প্রতিটি লেখাতেই খেলেছেন। (অন্তত আমি যে কয়টি পড়েছি)
তবে আমার পক্ষে কখনোই সেই হুমায়ূন আহমেদকে অস্বীকার করা সম্ভব নয়, যে 'নন্দিত নরকে' লিখছে। যে লিখেছি '১৯৭১' এর মত উপন্যাস, 'জলিল সাহেবের পিটিশন'' এর মত ছোট গল্প। আমি মনে করি তিনি এমন গল্প-উপন্যাস চাইলেই আরও লিখতে পারতেন, কিন্তু কেবল মাত্র একটি নির্দিষ্ঠ পাঠক শ্রেণিকে ধরে রাখার লক্ষ্যেই (হয়তো) তিনি আর এমন লেখা লেখেননি। আপনি দেখুন, আশেপাশের ১২-১৭ বয়সীদের, এদের বেশিরভাগই 'আই হেঁট পলিটস্ক' নামের রাজনৈতিক দলের সদস্য!! এরা মুক্তিযুদ্ধ, নতুন চিন্তা চায় না। এদের প্রয়োজন ছিল লঘু কিছু লেখার, যেখানে মনোযোগ দিয়ে না পড়লেও খুব ভালভাবেই বুঝে নেয়া যায় এরপর কী ঘটবে। হুমায়ূন আহমেদ পড়ার সময়, মাঝের দুই একটা পৃষ্ঠা বাদ দিয়ে পড়ে দেখুন, আপনার গল্প বুঝতে সমস্যা হবে না।
অথচ, হুমায়ূন আহমেদ চাইলেই তাদের মনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিকাশ ঘটাতে পারতেন, যেমনটি করেছেন জাফর ইকবাল। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রতি চার বছরেও হয়তো একটা লেখা চাইলেই লিখতে পারতেন বাঙ্গালা সাহিত্যের এই মহান দেবতা।
২.
''তোমার প্রিয় লেখক কে?'' আমি যখনই এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছি আমাকে বলা হয়েছে। ''উনি ত একজন বিতর্কিত লেখক।'' স্বাভাবিক ভাবে একজন লেখকের বিতর্কিতই হওয়া কথা। লেখক যদি বিতর্কিত না হন তাহলে কি সেই বোবা লোকটি বিতর্কিত হবে যে সারা জীবনে একটি কথাও মুখ ফুটতে বলতে পারেন নি? যেই লেখক কখনো বিতর্কিত হন না, সে ভণ্ড। একজন মানুষের সকল বক্তব্য এবং দর্শন কখনোই সমাজের প্রতিটি মানুষের ভালো লাগবে, এমন চিন্তা করা মূর্খতা।
কিন্তু হুমায়ূন ভক্তরা তাকে একজন লেখকের থেকে দেবতাই বেশি মনে করেন। তারা মনে করেন, তার অপন্যাসকেও স্বাদরে গ্রহণ করতে হবে আমাদের, যেভাবে কথিত ঐশ্বরিক শাস্ত্রগুলোতে দেবতাদের বিভিন্ন কুরূচিকর পরিচয় থাকা সত্ত্বেও তাদেরই পূজা করা হয়।
লেখকদের মধ্যে সম্ভবত হুমায়ূন আহমেদই সম্ভবত সব থেকে অভাগা। তিনি লেখক হতে চাইলেও, তার ভক্তরাই তাকে পাথরের মূর্তি বানিয়েছে।
৩.
আমার কতটুকু যোগ্যতা আছে হুমায়ূন আহমেদের মত একজন দেবতার সমালোচনা করার বা তার সাহিত্যগুণ নিয়ে আলোচনা করার?
আমি মনে করি আমার যদি সেই যোগ্যতা না থেকে থাকে তাহলে, আমাদের কারই যোগ্যতা নেই তামিম ডাক মারলে তার সমালোচনা করার। কিন্তু, সেদিন মাত্র ক্রিকেট বুঝতে শেখা আট বছরের বাচ্চাও তামিমের সমালোচনা করবে যদি সে দেড়শ বল খেলে দশ রান করে আউট হয়।
কিংবা, একই যুক্তিতে বলা যায়, '৭১-এ যেহেতু আমাদের জন্ম হয়নি, রাজাকারেরা যেহেতু আমাদের থেকে বয়সে অনেক বড় তাই তাদের অসম্মান না করে সম্মান দেখানোই কর্তব্য। এবং তারা রাজাকার হইলেও যুদ্ধে ত অংশ নিয়েছিল, আমাদের ত তখন জন্মি হয়নি।
৪.
খোদ হুমায়ূন আহমেদ ভক্তরাও যে বিষয়ে নিয়ে দ্বিধাতে ভোগে তা হলো তার দ্বিতীয় বিয়ে। অথচ, আমাদের উচিৎ হবে ব্যক্তি হুমায়ূন আহমেদ নয় বরং লেখক হুমায়ূন আহমেদ নিয়ে আলোচনা করা।
৫.
হুমায়ূন আহমেদের ভক্তদের বলছি, যৌক্তিক সমালোচনা গ্রহণ করতে শিখুন। ''সমালোচনা মানেই অসম্মান'' এটা যে গ্রন্থে পড়ছেন তা ছিঁড়ে-পুড়িয়ে কোমডে ফ্ল্যাশ করে দিন। শাদাকে শাদা আর কালোকে কালো বলতে বয়স-অভিজ্ঞতা-প্রতিভা নিষ্প্রয়োজন, বরং চোখ খোলা থাকাই যথেষ্ট।
দেবতা অপেক্ষা মানুষ উত্তম।
-----
১৪ নভেম্বর, ২০১৪
দুপুর ১২টা ৯
ফাহিম শিহাব রেওয়াজ