যাপিত জীবনের পথ পরিক্রমায় নানাবিধ সমস্যায় আক্রান্ত হইয়া বহুবার বহু বিদগ্ধজনের শরণাপন্ন হইতে হইয়াছে। কখনও তাহাদের দ্বারস্থ হইয়াছি, কখনও তাহারা উপযাচক হইয়া তাহাদের মহান সেবার হাত বাড়াইয়া দিয়াছেন। আজিকে এইরুপ দুই বিদগ্ধ হেকিমের কথা বলিব, চিকিৎসা শাস্ত্রে যাহাদের অগাধ পাণ্ডিত্য ও দখল আমাকে যাহার পর নাই বিস্মিত করিয়াছে।
হেকিম নং – ১
এই ভদ্রলোকের সহিত আমার বহু পূর্বেই পরিচয় হইয়াছিলো। বিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয়ে একত্র পাঠ গ্রহণ করিলেও শতাধিক শিক্ষার্থীর ভীড়ে তাহার এই মহৎ গুণের পরিচয় আমার নিকট অজ্ঞাত। তাহারপর যেই মহেন্দ্রক্ষণে রাজধানীবাসী হইবার অভিলাষ পোষণ করিলাম তদ্যপি হইতে সম্পর্কে তিনি হইলেন আমার সহকক্ষনিবাসী। এইবার তাহার অব্যর্থ হেকিমি/কবিরাজি/ধন্বন্তরি/ আয়ুর্বেদ বিদ্যার পরিচয় দেইঃ
একদা খানকয়েক কার্য্যালয়ে দৌড়ঝাঁপ দিয়া কর্ম সম্পাদন করতঃ গৃহে প্রত্যাবর্তণ করিতে করিতে ঘড়ির কাটা পাঁচের ঘরকেও অতিক্রম করিতে উদ্যত হইল। ক্ষুধার আধিক্যে চক্ষুদ্বয়ে অন্ধকার ঘনাইয়া আসিতেছে। অগ্র-পশ্চাৎ বিবেচনা না করিয়াই খাদ্যগ্রহণ করিলাম, ফলাফল অবশ্যম্ভাবী; প্রচণ্ডমাত্রায় উদরের পীড়ায় আক্রান্ত হইলাম। যন্ত্রণায় আমার গড়াগড়ি দিইবার দশা। অম্ল-শূলের বেদনায় যাহা হইয়া থাকে। লক্ষ্মণ সকল দেখিয়া শুনিয়া হেকিম সাহেব বিজ্ঞের মত মাথা নাড়াইয়া কহিলেন “দোস্ত, তুই সেভেন আপ খা, ঠিক হয়ে যাবে”। ভাবিলাম কী জানি উহার হয়তো ইহাতেই আরোগ্য হয়, আর গায়ে মাখিলাম না।
ইহারপর একদা সান্ধ্যকালীন ভ্রমণ সমাপ্ত করিবার পথে এক রেস্তোরাঁয় বিস্তর তেলে-ভাজা দেখিয়া আমার রসনা বিদ্রোহ করিয়া বসিলো। আমিও তাহাতে সম্মতি জ্ঞাপন করিয়া বিস্তর পরিমাণে উদরস্মাৎ করিলাম। গৃহে প্রত্যাবর্তণ করিতে বিলম্ব হইতে পারে, কিন্তু জ্বালা পোড়া আরম্ভ হইতে বিলম্ব হইল না। আমি অত্যধিক পরিমাণে পানি পান করিতে করিতে ঘর বাহির করিতে ছিলাম। লক্ষ্মণ সকল দেখিয়া শুনিয়া হেকিম সাহেব চশমার কাঁচ মুছিতে মুছিতে বললেন “দোস্ত, তুই সেভেন আপ খা, ঠিক হয়ে যাবে”। আমার তখন ছাড়িয়া দে মা কাঁদিয়া বাঁচি অবস্থা, তাই উহার কথায় কর্ণপাত করিলাম না।
তাহার সর্বোৎকৃষ্ট হেকিমি পরিচয় যেইদিন পাইয়াছিলাম তাহা আজও আমার মানসপটে উজ্জ্বল হইয়া রহিয়াছে। ভবিষ্যতেও থাকিবে বহুকাল, এইকথা হলফ করিয়া বলিতে পারি। জন্ম হইতে অদ্যাবধি এতোটা কাতর কখনই হই নাই। খাদ্যে বিষক্রিয়ায় নির্গমণ প্রচণ্ডমাত্রায় এবং আশঙ্কাজনকরুপে বৃদ্ধি পাইয়াছিল। শরীর ভয়ানক মাত্রায় দূর্বল। গৃহে ফুটাইয়া রাখা পানির উপরও আস্থা হারাইয়া ফেলিয়াছিলাম। সেই যাত্রায় একনাগাড়ে বেশ কয়েকদিন ক্রয়কৃত বোতলজাত পানি ভিন্ন অন্যকোন পানি পান করিতাম না। এমত ভয়াবহ অবস্থায় বিজ্ঞ হেকিম সাহেব তাহার প্রতিবেশীসুলভ দায়িত্ব ও কর্তব্য একখানা জ্ঞানী বিদগ্ধ আপ্ত বাক্য উচ্চারণের মাধ্যমেই সম্পন্ন করিয়াছিলেন। প্রিয় পাঠক আপনি অভ্রান্ত অনুমান করিয়াছেন। তাহার সেই মহৎ বাক্যখানা ছিলো “দোস্ত, তুই সেভেন আপ খা, ঠিক হয়ে যাবে”। সেইক্ষণে হস্তে একখানা সেভেন আপের বোতল থাকিলে কি করিতাম জানি না!! তবে ঐ মুহূর্তে তাহার নাম ঠিক করিলাম হেকিম সেভেনাপ খাঁ।
চিকিৎসক নং- ২
এইক্ষণে যাহার কথা বলিব বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে তিনি ছিলেন আমার একমাত্র ধূমপায়ী সহকক্ষনিবাসী। আমার যন্ত্রণায় ও আচরণে অতিষ্ঠ বেচারাকে সর্বদাই কক্ষের বাহিরে যাইয়া ধূমপান করিতে হইতো। বেচারা বিরক্ত হইয়া মাত্র একমাস পরেই আরেক কক্ষে চলিয়া যান। এক বৎসরকাল পরে পুরো গৃহই ত্যাগ করেন। তদুপরি যোগাযোগ বিদ্যমান ছিলো এবং এখনও তাহা বিদ্যমান রহিয়াছে বৈকি!! তাহার এক বিচিত্র অভ্যাসের কথা না বলিয়া থাকিতে পারিতেছি না। তাহার স্কন্ধের থলেতে সর্বদাই এক বোতল ডেক্সপোটেন মজুদ থাকিত। (যাহারা ইহার সাথে পরিচিত নন তাহাদের উদ্দেশ্যে বলিতেছি, ইহা একটি সর্দি-কাশি নিবারণের তরল ঔষধ, যাহা অতিরিক্ত সেবনে মৃদু ঝিমুনি ভাব হইতে পারে বলিয়া মোড়কের গায়ে সতর্কতা হিসেবে ভারী যানবাহন ও যন্ত্রপাতি পরিচালনা হইতে বিরত থাকিবার কথা মুদ্রিত রহিয়াছে।) ভুলেও যদি আমরা কেহ উহার সামনে খুক করিয়া কাশিয়া ফেলিতাম তো আমাদের ধরিয়া এক চামচ ডেক্সপো (পুরো নাম ডেক্সপোটেন হইলেও আদর করিয়া তিনি ইহাকে ডেক্সপো ডাকিতেন) সেবন করাইয়া দিতেন। কেহ হয়তো বলিলো মাথা মৃদু ঝিম ঝিম করিতেছে............ তাহার আর নিস্তার নাই। এইরুপে সর্দি, কাশি, হাঁচি, মাথাব্যথা, মাথাধরা, গা ম্যাজ ম্যাজ, হালকা জ্বর হইতে শুরু করিয়া এমন কি পেটব্যাথায়ও এই একই ঔষধ ব্যপক উৎসাহ উদ্দীপনার সহিত সেবন করাইয়াছেন বলিয়া জানা যায়। একবার কোন এক পরীক্ষার আগে তাহার সম্মুখে আমি বিরক্তি প্রকাশ করিয়া বলিয়াছিলাম “ধুর!! পড়ায় মনই বসাতে পারছিনা”। খেসারত এবং মনযোগ বৃদ্ধির টনিক হিসাবে আমাকেও একচামচ ডেক্সপো সেবন করিতে হইয়াছিলো। আর যদি কোন অভাগা ভুলে বলিয়া ফেলিলো রাত্রে উহার ঘুম হয় নাই, তাহা হইলে তো একাদশে বৃহঃস্পতি। তাহার জন্য দাওয়াই বৃদ্ধি পাইয়া দুই চামচ হইতো। তাই ভুলের বশবর্তী হইয়াও কখনোই আমরা উহার সামনে কোন প্রকার অভাব অভিযোগ সমস্যার কথা বলিতাম না। এবং সর্বদা এই ভয় করিতাম যে কবে তিনি বলিয়া বসেন “তোদের কোন সমস্যা নাই কেন?? একচামচ ডেক্সপো খা”
প্রিয় পাঠক, শেষক্তজনের নামকরণের গুরুভার আপনাদিগের বিজ্ঞ হস্তেই অর্পণ করিলাম।
********************
একটা সময় সাধু ভাষায় লিখতে খুব তৃপ্তি পেতাম। মন ভালো হয়ে যেতো। সামুতে আমার প্রথম পোস্টটি (অনুরোধে ঢেঁকি গেলা) ছিলো সাধু ভাষায়। আজ বাংলাদেশের সাথে আইসিসি যে আচরণ করল, তাতে খুব মন ক্ষুণ্ণ হয়েছিলাম। তাই ভাবলাম মনটা একটু হালকা করি।