somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃ মহাপূর্ণিমা

২১ শে জানুয়ারি, ২০১৫ বিকাল ৩:৩৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

শুরু.
গোত্রপ্রধান হিসেবে একটা কান না থাকা আসলে বেশ বিব্রতকর ব্যাপার, উপরন্তু তা যদি হয় লার্মাসের মত সুঠামদেহীর। এটা নিয়ে আফসোসের শেষ নেই তার, কিন্তু গোত্রপতি হবার জন্য বাম কানটা বিসর্জন দিতে হল তাকে। যদিও এই আক্ষেপ টা কখনো কারো সামনে প্রকাশ করে না লার্মাস। নিষ্ঠুর পৃথিবী একটা বিষয় খুব ভালো করে শিখিয়েছে তাকে, বেঁচে থাকতে হলে কখনও নিজের দূর্বলতা বা কষ্টের জায়গা অন্য কারো সামনে প্রকাশ করা যাবে না, তা সে যত আপনই হোক। সূর্য্য হেলে পড়েছে, শীঘ্রই ডুবে যাবে। কিছুক্ষনের মধ্যে নিমকের চলে আসার কথা। নিমক, লার্মাসের সবচেয়ে বিশ্বস্ত আর পুরো গোত্রের মধ্যে সবচেয়ে সাহসী আর ক্ষিপ্র অনুসারী। এত বিশ্বস্ত হলেও শান্তি নেই লার্মাসের। নিমককে সব সময় চোখে চোখে রাখতে হয়। আপাতত গোত্রে তার বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়ানোর মত শক্তি আর সাহস এক নিমকই রাখে। আচ্ছা বিহক কি তাকে একই চোখে দেখত ?? গোত্রের আগের নেতার কথা মনে করে মুচকি হাসে লার্মাস। যে যত যা বলুক নেতা হবার সব গুন থাকলেও দূরদর্শীতা তার ছিল না, নইলে লার্মাসের উত্থান এবং তার পতন কোনভাবে এক ছকে ফেলা যায় না। নিমকের উপর এতটা বিশ্বাস করা তার উচিৎ হচ্ছে না। কিন্তু গোত্রে তেমন যোগ্য আর কেউ নেই। তাই নিমকের নিরাপত্তার অজুহাতে সব সময় একাধিক চোখ রাখতে হয়। নিমকের আসার শব্দে চিন্তার সুতাগুলো ছিঁড়ে গেলো। নিমক সামনে দাড়িয়ে গোত্রের নিয়ম অনুযায়ী মাথা নুইয়ে অভিবাদন জানিয়ে একপাশে বসে পড়ল। তার সাথে আগামীরাতের অভিযানের খুঁটিনাটি নিয়ে আলোচনা করছে লার্মাস। মনে মনে দারুণ প্রসন্ন সে নিমকের উপর। সে অনেকটা তাঁর মতই হয়ে উঠছে। যে ছকে পরিকল্পনা করেছে নিমক, লার্মাস হলে ঠিক একই রকম পরিকল্পনাই করতো কারন এটাই সবচেয়ে নিখুঁত। তবে দুটো ব্যাপার কখনই বুঝতে দেয়া চলবে না নিমককে,
এক. লার্মাসও ফেউ লাগিয়ে অভিযানের সব তথ্য যোগাড় করেছে আর
দুই. লার্মাস আসলে নিমকের উপর অনেকটাই সন্তুষ্ট।

বেশ খানিকক্ষণ শলা পরামর্শের পর দু'জন দু'দিকে চলে গেলো। লার্মাস গেলো সোজাসুজি, তার সামনে সার দিয়ে দাড়িয়ে আছে আজকের অভিযানের জন্য নির্বাচিত গোত্রসন্তানরা। প্রত্যেকের সামনে দিয়ে দৃপ্ত পায়ে হেঁটে যাচ্ছিল সে আর স্বভাবসুলভ নিয়মে সবাই তাদের মাথা নুইয়ে অভিবাদন জানাচ্ছে। এই সময় তাদের মনে কি খেলা করে তা খুব ভালো করে জানে লার্মাস, একই পথ পাড়ি দিয়ে সেও তো এসেছে এতোটা। এদের মাঝে কারো কারো আজক প্রথম অভিযান আবার কেউ অভিজ্ঞতায় অনেক প্রাচীন কিন্তু দলপতির নজর কাড়তে পারেনি। এভাবে হাঁটতে হাঁটতে দলের একদম শেষ মাথায় দাঁড়ানো গোত্রসন্তানের মাথায় আলতো করে একটা আঘাত করলো লার্মাস। স্পর্শ পেয়ে মাথা আরো নুইয়ে গেলো ফিখফের, আজকের অভিযানের নেতৃত্ব তার হাতে। এই স্পর্শটা কতটা সাহস বাড়িয়ে দেয় সেই অভিজ্ঞতাও লার্মাসের আছে। সে ভালো করে জানে এই অভিযান সফল করতে চূড়ান্ত রকমের ঝুকি নিতে প্রস্তুত এখন ফিখফ। মারা যাবার আগে একমূহুর্তের জন্যেও নিজের জীবন বাঁচাবার কথা মনে আসবেনা তার। একে একে সবাই তার সামনে দিয়ে চলে গেলো অভিযানে, আর লার্মাস ফিরে আসলো তার ডেরায়।

শুরুর পর.
নিমক গিয়েছিলো লার্মাসের ডেরার বামে যেখানে গোত্রের বাকি সবাই অলস সময় কাটাচ্ছে। সেখান থেকে বেছে বেছে কয়েকজন বলিষ্ঠ গোত্রসন্তানকে ডেকে এককোণে আলাদা করে তাদের আগামী রাত্রের অভিযানের বিস্তারিত বিবরণ দিতে লাগল শান্ত, ধীর কিন্তু কর্তৃত্বপূর্ণ কণ্ঠে। পুরো ব্যাপারটা তাদের বুঝিয়ে দিয়ে দলনেতা হিসেবে ডিফচকে নির্বাচিত করলো নিমক। ব্যাপারটাতে বোধহয় একসময়ের দলনেতা অভিজ্ঞ দিনজের একটু আপত্তি ছিল কিন্তু নিমকের সামনে মাথা তুলে কিছু বলার সাহস হল না তার। ডিফচের নেতৃত্বে দলটি বেড়িয়ে গেল আগে থেকে জায়গাটা দেখে সব কিছু নির্ধারণ করতে। আর নিমক ফিরে চলল লার্মাসের ডেরায়।

নিমককে আসতে দেখে উঠে দাঁড়ালো লার্মাস, তারপর দুজন মিলে পুরো গোত্র টহলে বের হল। যে ই সামনে পড়ছিল উঠে দাড়িয়ে মাথা নুইয়ে সম্মান জানাচ্ছিল লার্মাসকে, কোথাও হয়তো দাঁড়িয়ে কারো কারো খোঁজখবরও নিতে হচ্ছিল তাকে। এভাবে পুরো গোত্র টহল দেয়া হয়ে গেলে আবার নিজের ডেরায় ফিরে আসল লার্মাস। এসে দেখে তার জন্য অপেক্ষা করে আছে কিটল, পুরো গোত্রের নিরাপত্তার ভার যার উপর ন্যস্ত। নিয়ম মাফিক বর্ণনা করে গেল সার্বিক পরিস্থিতি। আপাতত এই এলাকাটা পুরো গোত্রের জন্য নিরাপদ, তবে কতক্ষন থাকবে বলা যায় না। যে কোন মুহুর্তে অনুপ্রবেশ ঘটতে পারে যে কারো। তাই সবসময় সতর্ক থাকতে হয় গোত্রের সবাইকে।



শেষের আগে.
মহাপূর্ণিমা আসন্ন, গোত্রের রেওয়াজ অনুযায়ী প্রতিবারের মত এবারও একটা মহোৎসবের আয়োজন করতে হবে। সেটা নিয়ে জোর গুঞ্জন চলছে গোত্রের সবার মাঝে। কিন্তু ঠিক কি হবে আঁচ করে উঠতে পারছে না কেউ! আবার বিষয়টা নিয়ে যে দলপতির সাথে কথা বলবে সেই সাহসও হয়ে উঠছেনা কারও, কে না জানে গত পূর্ণিমায় লার্মাস তার প্রেয়সী য়াতাকে হারিয়েছে। কী তীব্র ভালোবাসা ছিলো তাদের দুজনের মাঝে! সেই ছোট বেলা থেকে একসাথে বেড়ে ওঠা। এত সহজে কি ভোলা যায়?? না ভোলে নি লার্মাস। তার বুকে জ্বল জ্বল করে আছে আছে বিচ্ছেদের ক্ষত। কিন্তু অন্যান্য আর দশটা শহীদ গোত্রসন্তানের মত স্বাভাবিকতা দেখিয়েছে য়াতার মৃত্যুতে। পরদিন থেকে যথারীতি তার নিত্যনৈমেত্তিক কাজ চালিয়ে গেছে স্বাভাবিক নিয়মে। তাতেই আরও ভয় বেড়েছে সবার। লার্মাসের এই স্বাভাবিক থাকাটাই যেন অস্বাভাবিকতার লক্ষ্মণ। এমনটা না থেকে কিই বা করতে পারতো লার্মাস?? য়াতার মৃত্যুর খবর যখন আসে ততক্ষণে আর কিছু বাকি ছিলো না তার। পরদিন এক ফাঁকে শুধু দেখেছিলো দানোরা য়াতাকে মেরেই ক্ষান্ত হয়নি বরং ঝুলিয়ে দিয়েছে তার লাশ। কেবল তার পরের অভিযানগুলোতে সিরফকে আর কখনো নেতৃত্ব দিতে দেখা যায় নি। সিরফ প্রায় গোত্রসন্তানদের কাছে বলে বেড়ায় য়াতার মৃত্যুতে তার কোন হাত ছিলো না, এমন কি কিছু করারও ছিলো না। কিন্তু আজ পর্যন্ত তার সাহস হয়নি লার্মাসের সামনে দাঁড়িয়ে একটি কথা বলার।



শেষ.
মেজাজটা খুব খিচড়ে আছে বজলু মিয়ার। মনে মনে নিজের মন্দভাগ্যকে গালি দিতে দিতে ভ্যানের প্যাডেল মেরে বাড়ি ফিরছে সে প্রতিদিনকার মত। ভ্যান ভর্তি মুরগীর খাঁচা। আজ একটু বেশি দেরী হয়ে গেলো, কিন্তু কি করবে এতক্ষণ অপেক্ষা করলো সারাদিনে একটা মুরগীও বিক্রি হলো না। দুই টিলার মাঝখান দিয়ে রাস্তা, টিলা দুইটি অনেক টা তোরণের মত হয়ে আছে, উপরন্তু কিছু গাছপালার জন্য জায়গাটা জমাট অন্ধকার। এটা পেরুলেই হঠাৎ করেই রাস্তার দুদিকে খোলামাঠ, ভোজবাজির মত টিলাগুলো সরে যায় দূরে আর তার গায়ে কার্পেটের মত বিছানো চা বাগান, খুব সুন্দর করে ছেঁটে রাখা। এই জায়গাটা পার হবার সময় প্রতিবারই মন ভালো হয়ে যায় বজলু মিয়ার আর জ্যোৎস্নারাত হলে তো এর চেহারাই পালটে যায়, মনেই হয় না এটা এই পৃথিবীর কোন অংশ। কিন্তু আজ কেন যেন এখানে এসে গা ছমছম করে উঠল তার। মনের মাঝে কুডাক ডাকা শুরু করল। দূরে চা বাগানের গায়ের ছায়াগুলো আজ অনেক গাঢ় মনে হচ্ছে। বেশখানিকটা উপরে উঠে গেছে চাঁদ, তার আলোয় ক্রমশ ঘন হয়ে উঠছে চারপাশের ছায়াগুলো, মাঝে মাঝে নড়ছেও যেন। আপনাআপনি কমে আসে ভ্যানের গতি। আশেপাশে তাকিয়ে রাস্তার দিকে চোখ ফেরাতেই জমে কাঠ হয়ে যেতে চায় বজলু মিয়ার শরীর। শিউরে ওঠে। ঠিক রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে আছে দুটো বড়সড় বনবিড়াল, এর মাঝে সামনের জনের একটা কান নেই...................






*********************************************

উৎসর্গঃ প্রতি ছুটিতে বাসায় গিয়ে যখন ভাইয়ার ল্যাপ্টপ নিয়ে ব্লগে ঘোরাঘুরি করতাম, ভাইয়া আপুর পিচ্চিগুলো এসে বলত কি করো?? ব্লগে কি থাকে?? আর কি থাকে?? সব কি বড়দের গল্প?? তুমি আমাদের জন্য একটা গল্প লেখো!! তাদের কথা রাখতে গিয়েই এই গল্প। গল্পটা তাদেরই উৎসর্গ করলাম, সাথে ব্লগ সম্পর্কিত আগত/অনাগত আমার সকল ভাগ্নে, ভাগ্নি, ভাইপো ভাইঝিকে।

কৃতজ্ঞতাঃ আমার সহব্লগারগণ যারা ক্রমাগত ঠেলা ধাক্কা দিয়ে আমাকে পোস্ট দিতে বাধ্য করেন, এবং আমার ব্লগিং জীবন দীর্ঘায়িত করেন।

বিশেষ কৃতজ্ঞতাঃ
মাহমুদ ০০৭ ভাইকে। আমি গল্পটা পোস্ট করা নিয়ে দ্বিধায় ছিলাম। ভাই সাহস দিলেন, সাহায্যও করলেন।

প্রেক্ষাপটঃ একদিন বাংলানিউজ২৪ডট কমে একটা সংবাদ পড়লাম, নেত্রকোণায় একদল লোক একটা গন্ধগোকূলকে মেরে ঝুলিয়ে দিয়েছে। ঐদিন সন্ধ্যায় চাঁদের আলোয় সিলেটের তারাপুর চা বাগান হয়ে আলীবাহার টি স্টেটের পথে যাচ্ছিলাম “শেষ” অংশটুকু সেই রাস্তাকে মাথায় রেখে লেখা।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা মে, ২০১৬ সকাল ১১:৪৪
৫৩টি মন্তব্য ৫৫টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মত প্রকাশ মানে সহমত।

লিখেছেন অনুপম বলছি, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১:২৭

আওয়ামী লীগ আমলে সমাজের একটা অংশের অভিযোগ ছিলো, তাদের নাকি মত প্রকাশের স্বাধীনতা নাই। যদিও, এই কথাটাও তারা প্রকাশ্যে বলতে পারতেন, লিখে অথবা টকশো তে।

এখন রা জা কারের আমলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আত্নমর্যাদা!

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ২:৪৩

রেহমান সোবহান একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। তার বাড়ি থেকে বিদ্যালয়ের দূরত্ব প্রায় ৬ কিলোমিটার। রেহমান সাহেব এমন একটি বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন যা খুব নির্জন এলাকায় অবস্থিত এবং সেখানে যাওয়ার... ...বাকিটুকু পড়ুন

কাঁঠালের আমসত্ত্ব

লিখেছেন বিষাদ সময়, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৭

কাঁঠালের কি আমসত্ত্ব হয় ? হয় ভাই এ দেশে সবই হয়। কুটিল বুদ্ধি , বাগ্মিতা আর কিছু জারি জুরি জানলে আপনি সহজেই কাঁঠালের আমসত্ত্ব বানাতে পারবেন।
কাঁঠালের আমসত্ত্ব বানানের জন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। অ্যাকসিডেন্ট আরও বাড়বে

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৫৯



এরকম সুন্দরী বালিকাকে ট্র্যাফিক দায়িত্বে দিলে চালকদের মাথা ঘুরে আরেক গাড়ির সাথে লাগিয়ে দিয়ে পুরো রাস্তাই বন্দ হয়ে যাবে ।
...বাকিটুকু পড়ুন

কেমন হবে জাতীয় পার্টির মহাসমাবেশ ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৫৬


জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বিক্ষুব্দ ছাত্র জনতা আগুন দিয়েছে তাতে বুড়ো গরু গুলোর মন খারাপ।বুড়ো গরু হচ্ছে তারা যারা এখনো গণমাধ্যমে ইনিয়ে বিনিয়ে স্বৈরাচারের পক্ষে কথা বলে ,ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়াতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×