পাঠশালায় দিনকাল মজায় কেটে যাচ্ছিল। রেজাল্টও ভালো করছিলাম। নিয়মিত মেধাতালিকায় স্থান পেতাম ইত্যাদি ইত্যাদি। গোল বাঁধল যখন জিলা স্কুলে ভর্তি হলাম। এত বড় স্কুল, এত ছাত্র আর এত বড় মাঠ দেখে আমার ভিমরী খাবার দশা। সাহস করে চলতে লাগলাম, দিনগুলোও কেটে যাচ্ছিল। ভালোভাবেই যাচ্ছিল। সমস্যা হলো অন্য জায়গায়, পড়াশোনার ব্যপারে আমার আগ্রহ বাড়লেও লেখার ব্যপারে আমাকে মনে হয় ভূতে পেয়ে বসল। আমি হাজার বার পড়তে রাজি আছি কিন্তু একবার লিখতে রাজি না!! এর প্রভাব পড়ল ধীরে ধীরে। আমার হাতের লেখার গতি কমে যেতে লাগল। পরীক্ষার হলে কখনই সবগুলো উত্তর লিখে দিয়ে আসতে পারতাম না সময়ের অভাবে। কোন জানা প্রশ্নের উত্তর পরীক্ষার খাতায় লিখতে না পারার কষ্ট ভূক্তভোগী মাত্রই জানেন। এর ছাপ রেজাল্টেও পড়া শুরু করল। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের মত সম্মানজনক ফলাফল নিয়ে আমাকে চলতে হচ্ছিল, মেধাতালিকায় স্থান পাওয়া তো দূরের কথা। এই অবস্থায় বাসায় মুখ দেখানো দায় !! তখন থেকেই শুরু করলাম স্কুল ব্যাগ লুকিয়ে রাখা, সবসময় না শুধু যে সময় রেজাল্ট দিতো সেই সময়টা। লুকোনোর জন্য চমৎকার একটা জায়গাও খুঁজে বের করেছিলাম। টেলিভিশনের টেবিলের নীচে একটা বড় ট্রাভেল ব্যাগ থাকত কাপড়ের কভার দিয়ে ঢাকা, আমি সেই কভারের নীচে স্কুল ব্যাগটা রেখে দিতাম। ন’মাসে ছ’মাসে সেই ট্রাভেল ব্যাগটা খোলা হত, তাই আমার স্কুল ব্যাগ থাকত সবার চোখের সামনে আবার সবার চোখের আড়ালে। আর লুকিয়ে রাখার পর চলত বিভীষিকা!! চোরের মন পুলিশ পুলিশ হলে যা হয় আর কি!! সর্বদা তটস্থ হয়ে থাকতাম!! এই বুঝি বাসার সবাই আমার ব্যাগ খুঁজতে শুরু করল বা আমার ব্যাগ লুকোনোর ব্যপারটা মনে হয় ধরা পড়ে গেলো। বাসায় কেউ যদি জিজ্ঞেস করতো রেজাল্টের কথা, তো সাত সতেরো কিছু একটা বলে রাখতাম। অন্য সবসময় সত্য কথা বলতাম তাই আমার এই ব্যপারটা নিয়ে কারো মনে সন্দেহ আসতো না তেমন। কিন্তু লুকিয়ে আর কতদিন?? ঐদিকে ক্লাস টিচার ঝামেলা করতো অভিভাবকের স্বাক্ষর সমেত রেজাল্ট কার্ড জমা দেবার জন্য!! মাঝে মাঝে পিটুনিও দিতো!! শেষ মেশ পিটুনি খেয়ে বিরস বদনে আরো একদফা মিথ্যা বলে বাসায় রেজাল্ট দেখাতেই হতো। বকুনি, গাল মন্দ খেয়ে বাবার স্বাক্ষর নিয়ে রেজাল্ট কার্ড আবার জমা দিতাম। এভাবেই কয়েক বছর চলল!! একসময় হঠাৎ মনে হলো, ধুর! এভাবে আর না!! রেজাল্ট তো সেই বাসায় দেখাতেই হচ্ছে, গাল মন্দও খেতে হচ্ছে, বাবাকে দিয়ে স্বাক্ষরও করিয়ে নিতে হচ্ছে!! তাহলে শুধু শুধু এত লুকোচুরি কেন?? এর চেয়ে যা হয় একবারেই বলে দেব। এই লুকোচুরি আর মিথ্যার প্রতি ঘেন্না ধরে গেছে। সত্যই সুন্দর!!
এই ব্যাগ লুকোনোর দিনগুলো থেকে আমি খুব চমৎকার দুটো ব্যপার শিখেছিলাম যেটা আমার পরবর্তী জীবনে এমনকি এখন পর্যন্ত কাজে দিচ্ছে।
এক. কোন সমস্যা/ঝামেলা থেকে রেহাই/মুক্তি পাবার উপায় হচ্ছে সেটার মুখোমুখি হওয়া।
দুই. সত্য আসলে সবসময়ই সবচেয়ে সহজ, সবচেয়ে সুন্দর, শ্রেয় এবং কাঙ্ক্ষিত।
***************************************
২০১২ সালের পর আর টিউশনি করাইনি। টিনেজারদের সাথে আমার যোগাযোগও কমে গেছে। কিন্তু ইদানিং কালে তাদের কিছু কীর্তিকলাপ কানে আসছে যা শুনে আমি একটু হতাশ। তাই আমার জীবন থেকে পাওয়া কিছু শিক্ষা শেয়ার করলাম। যদি কারো বোধোদয় হতে একটু সাহায্য করে.........
অস্বীকার করি না মিথ্যার মাঝে কিছু সৃজনশীল ব্যপার আছে। মাঝে মাঝে মিথ্যা বলতে একটা হুলুস্থুল রকমের মজা পাই। গত বছর থিসিস জমা দিয়ে যখন মাস্টার্সের টেস্টিমনিয়াল তুলছিলাম তখন আমাদের দীর্ঘ দিনের ক্লাস মনিটর আমাকে হঠাৎ জিজ্ঞেস করে বসলো, “..............., এখন কি করবি ??” আমার উত্তরঃ “রেজাল্ট হলে সার্টিফিকেট আর ট্রান্সক্রিপ্ট তুলে, সব কিছু নিয়ে বাড়িতে চলে যাব। তারপর হাজার কয়েক টাকা নিয়ে বরিশাল, সুন্দরবন আর বান্দরবানের রুমা, বগা লেক আর তাজিওডং ঘুরতে যাব। এই জায়গাগুলো দেখা হয়নি”। শুনে বেচারার চেহারা হয়েছিলো দেখার মত
আমি কি আসলেই মিথ্যে বলেছিলাম তাকে?? আমি তো আমার স্বপ্নের কথা বলেছিলাম। আজ যদি রূঢ় বাস্তবতা আমায় তাড়া না করত তবে সত্যিই চলে যেতাম..................