কমল দা’র সেলুনে চুল কাটাতে যাই তা প্রায় ছয় বছর হয়ে এলো। উনার সাথে সম্পর্কটা এতোই ভালো হয়ে গেছে যে উনি আমাকে দেখলে পরিস্কার বলে দিতে পারেন রুটিন মাফিক এলাম না দেরী করে ফেলেছি, আর সাথে টং এর চা তো আছেই। আমিও উনার সেলুনে যেয়ে দাঁত বের করে একটা হাসি দিয়ে থাই গ্লাসের দরজা ঠেলে সাউন্ডপ্রুফ করবার একটা চেষ্টা করে বলি “আল্লাহর দুনিয়ায় এতো জায়গা থাকতে, আপনে কোন দূঃখে যে এই ওয়ার্কশপের পাশে পজিশন নিলেন। সারাদিন ঘড়র ঘড়র শব্দ আর দুম দাম হাতুড়ির আওয়াজ!!”
কিন্তু সেবার সেলুনে যেয়ে অনেকক্ষণ পরেও কোন শব্দ না পেয়ে আমি কৌতুহলী হয়ে দাদাকে ওয়ার্কশপের দিকে ইঙ্গিত করে জিজ্ঞাসা করলাম, “দাদা ঘটনা কি ?? আইজ কোন আওয়াজ নাই”!! “এক্কেরে পুইড়া কয়লা হইয়া গেছে বুজছেন বাইসাব, চেহারা দেইখখা আর চেনা যায় না, মানুষ পোড়া কি গোন্ধ!! পোলাডা বড়ই শান্তশিষ্ট আছিলো, কয়েক মাস হয় নতুন বিয়া করছে। ঘরে বুইড়া মাও আছে। ভগবানই জানে তাগো কেমনে চলব”?? মূল ঘটনা হলো গতকাল ঐ ওয়ার্কশপের জাহাঙ্গীর নামের এক ওয়েল্ডিং মিস্ত্রী নবনির্মিত এক বহুতল ভবনে কাজ করতে গিয়ে, তার পাশের ইলেক্ট্রিক তারে পুড়ে সাথে সাথেই মারা গেছেন। ওহ!! কি বীভৎস একটা সংবাদ! দোকানের মালিক আর বিল্ডিঙের মালিক মিলে জাহাঙ্গীরের নতুন বউ আর মাকে হাজার বিশেক টাকা ক্ষতিপূরণ দিয়েছে। ব্যাপারটা মিটমাট হয়ে গেছে। বাহ! কি চমৎকার করে বলে গেলাম পুরো ব্যাপারটা মিটমাট হয়ে গেছে!! একটা মানুষের জীবনের মূল্য বিশ হাজার টাকা?? আর ব্যাংকের ভাষায় লিখতে গেলে সাথে মাত্র কথাটাও লিখতে হবে। আর না লিখেই বা কি করব? দুইদিন পর আপনি, আমি আমরা সবাই এই ঘটনা বেমালুম ভুলে যাব। ভুলে যেতে হবে!! নইলে সামনে এগুবো কি করে?? আমিও যাপিত জীবনের নিয়মে ঘটনাটা ভুলে গিয়েছিলাম। দিন কেটে যাচ্ছিল, যেমন যায় আর কি!!
তারপর সেদিন হঠাৎ এক বন্ধু ফোন করে বলল, তাদের বাসায় আমাদের পুরো সার্কেলের দাওয়াত। দুষ্টলোকেরা বলে আমি নাকি আবার দাওয়াতের কথা শুনলে একটু বেশিই উত্তেজিত হয়ে যাই!! এসব আপনাদের বিশ্বাস করতে হবে না। আর দুষ্টলোকের কথা নিজ দায়িত্বে বিশ্বাস করবেন, এর কোন দায়-দায়িত্ব আমি নেব না। তো যথারীতি আমরা সবান্ধবে হাজির হলাম। এটা সেটা দিয়ে একেবারে হাজার পদের খাবার। সেগুলোর সদ্ব্যবহার করতে কোন কসুর করছিলাম না। হাসি গল্প গানে সময় কেটে যাচ্ছিল। সব শেষে পুরো বাসাটা ঘুরে দেখলাম। বেশ বড়। ভাড়া শুনলাম আট হাজার টাকা। এত বড় বাসা তুলনায় ভাড়াটা বেশ কম। তারপর যেটা জানা গেলো সেটা হলো, এই বাসার পাশ দিয়ে ইলেক্ট্রিসিটির খুব মোটা মোটা তার গিয়েছে। ভবন তৈরীর সময় ঠিক এই ফ্ল্যাটের কোণায় জানালার পাশে এক মিস্ত্রী নাকি খুব বাজেভাবে পুড়ে গেছে। তারপর বাসা তৈরী শেষ হলেও তাতে ভাড়া হচ্ছিল না। সবাই খুব ভয় পাচ্ছিলো এই বাসায় উঠতে, বলা তো যায় না অপঘাতে মৃত্যু!! তখন মালিক বাধ্য হয়ে বাসা ভাড়া বেশ কমিয়ে দিলেন, আর তাতেই টপাটপ ভাড়া হয়ে গেলো ফ্ল্যাটগুলো। গরজ যে বড় বালাই !!
বেচারা জাহাঙ্গীর!! কোথায় কীভাবে আছে কে জানে?? তবে আর যাই হোক তার স্টোরিটার একটা মাল্টি ডাইমেনশনাল অ্যাপ্রোচ আছে। কত জন তার জন্য সস্তায় বাসা ভাড়া পাচ্ছে!! কেউ তার কথা বলে ব্লগে লাইক কমেন্ট কামাচ্ছে!! আর কেউ হয়ত ভুত এফ এমে তার কথা বলে নিজেকে বানিয়ে দেবে সেলিব্রেটি। জাহাঙ্গীরের নতুন বউ আর মায়ের কপালে দু’বেলা দু’মুঠো ভাত জোটে কি না তার খবর কে রাখে ??