কোথা চেঙ্গিস, গজনী-মামুদ, কোথায় কালাপাহাড় ;
ভেঙ্গে ফেল ঐ ভজনালয়ের যত তালা-দেওয়া-দ্বার !
[মানুষ – কাজী নজরুল ইসলাম]।
“সবাই বলে, ঊর্মির স্বভাব ওর ভাইয়েরই মত প্রাণ পরিপূর্ণ। ঊর্মি জানে, ওর ভাই ওর মনকে মুক্তি দিয়েছে। হেমন্ত ওকে উপদেশ দিয়ে বলতো, আমাদের ঘরগুলো এক একটা ছাঁচ, মাটির মানুষ গড়বার জন্যই। তাই তো এতকাল ধরে বিদেশী বাজিকর এত সহজে তেত্রিশ কোটি পুতুলকে নাচিয়ে বেড়িয়েছে। সে বলত, ‘আমার যখন সময় আসবে তখন এই সামাজিক পৌত্তলিকতা ভাঙবার জন্য কালাপাহাড়ি করতে বেরোব’।”
[দুই বোন (উপন্যাস) - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর]
তড়িৎ বাবু কিছু বলার আগেই গুরুগম্ভীর গলায় প্রশ্ন শোনা গেলো- “তোমরা রাজুকে দেখেছো? রাজু”। দেবতোষবাবু আমাদেরই উদ্দেশ্যে প্রশ্নটা করেছেন। ভদ্রলোক এরই মধ্যে পুব থেকে উত্তরের বারান্দায় চলে এসেছেন। তার লক্ষ্য আমাদেরই দিকে। তড়িৎ বাবু আমাদের হয়ে জবাব দিলেন “না, এঁরা দেখেননি”। .............. রাজু হল কালাপাহাড়ের আরেক নাম।
[রয়েল বেঙ্গল রহস্য (ফেলুদা) - সত্যজিৎ রায়]
“তারুণ্য দেখিয়াছি আরবের বেদুইনদের মাঝে, তারুণ্য দেখিয়াছি মহাসমরে সৈনিকের মুখে, কালাপাহাড়ের অসিতে, কামাল-করিম-মুসোলিনি-সানইয়াৎ লেনিনের শক্তিতে।”
[যৌবনের গান– কাজী নজরুল ইসলাম]
“আপনি একটু শুনুন মিস্টার সোম। আমি জানি প্রস্তাবটা খুবই হাস্যকর শোনাবে, কিন্তু উপায় নেই। সাধারণ ডিটেকটিভ এজেন্সির পক্ষে কাজটা করা সম্ভব নয়। প্রফেসর বনবিহারী আমাকে বললেন আপনি ঠিক মানুষ। আমি যাঁর গতিবিধি জানতে চাই তিনি এখনকার মানুষ নন। তিনি ১৫৮০ খ্রিস্টাব্দে মারা যান।”
“অদ্ভুত। ইন্টারেস্টিং।” অমল সোম বসে পড়লেন আবার, “এতদিন জীবিত মানুষ নিয়ে কাজ করেছি। মৃত মানুষ, তাও আবার চারশ দশ বছর আগে মৃত মানুষের কেস নিয়ে কেউ আসবেন ভাবতে পারিনি। মানুষটির নাম কি আমরা জানি?”
“জানা স্বাভাবিক। অন্তত ইতিহাসের বইয়ে দু-চার লাইন প্রত্যেকেই একসময় পড়েছি। ওঁর নাম যাই হোক, ইতিহাস ওকে কালাপাহাড় নামে কুখ্যাত করেছে।
[কালাপাহাড় (অর্জুন) - সমরেশ মজুমদার]
কৈশোরে এভাবেই বারবার চোখে পড়তে লাগলো কালাপাহাড়ের নাম। শুরু করেছিলাম খোঁড়াখুঁড়ি। যা বেড়িয়েছিলো আজ তুলে দিচ্ছি আপনাদের হাতেঃ
বাংলার ইতিহাস ও সাহিত্যে প্রলয়-ধবংসের মূর্ত প্রতীক হিসেবে যিনি আপন মহিমায় বিরাজমান তিনি কালাপাহাড়। ধরে নেয়া হয় ১৫৩০ সালের কাছাকাছি কোন এক সময়ে উত্তর বাংলার এক বাঙ্গালি ব্রাহ্মণ পরিবারে তার জন্ম হয়। তখন তার নাম ছিল রাজীব লোচন রায় ওরফে রাজু। দিল্লীর মসনদে তখন মুঘল সম্রাট নাসির উদ্দীন মুহাম্মদ হুমায়ূন আর বাংলায় চলছে হুসেন শাহী বংশের স্বাধীন সুলতানি আমল। এরপর তার শৈশব কৈশোর নিয়ে তেমন কিছু জানা যায় না। এটুকু জানা যায় তিনি কোনভাবে সুলায়মান খান কররানির সেনাদলে যুক্ত হয়েছিলেন। ব্রাহ্মণসন্তান বিদ্যা অর্জন বাদ দিয়ে কেন সৈন্যদলে যোগ দিলেন, তা আজো রহস্যাবৃত। অবশ্য কেউ কেউ দাবি করেন তিনি ছিলেন কলিঙ্গ-উৎকল সাম্রাজ্যের শেষ সম্রাট গজপতি মুকুন্দ দেব এর সেনাপতি। এ বিষয়ে অবশ্য জোরালো প্রমাণের অভাব রয়েছে।
এরমাঝে বদলে যায় অনেক কিছু, ১৫৪০ সালে মুঘল সম্রাট হুমায়ূন পরাজিত হয়ে দিল্লী হারান আফগান শাসক শের শাহ এর কাছে। তার আগেই কয়েকবারের প্রচেস্টায় বাংলা ও বিহার জয় করে নিয়েছিলেন শের শাহ, যা কিছুদিন আগেই মুঘল সাম্রাজ্যভূক্ত হয়েছিল। পরে ১৫৫৬ সালে পানি পথের দ্বিতীয় যুদ্ধে আদিল শাহের সেনাপতি হিমুকে পরাজিত করে আকবর মুঘল সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধার করলেও বাংলা থেকে যায় আফগানদের হাতেই। যা হোক, দক্ষিণ বিহারের জায়গীর লাভ করেছিলেন শের শাহের দুই সেনাপতি তাজ খান কররানি ও তার ভাই সুলায়মান খান কররানি। ক্রমে তারা পুরো বিহার ও বাংলা তাদের শাসনাধীন করেন (১৫৬৪ সাল)। এমনই কোন এক সময়ে সাধারণ সৈনিক থেকে ধাপে ধাপে উন্নতি করা বিচক্ষণ ও বুদ্ধিমান সমরবিদ রাজীব লোচন রায়ের উপর সুনজর পড়ে বাংলার সুলতান সুলায়মান খান কররানির। তিনি রাজীব লোচন রায়কে ধর্মান্তরিত হবার শর্তে তার কন্যার সাথে বিবাহ দিয়ে সেনাপতি পদে অধিষ্টিত করার প্রতিশ্রুতি দেন। মতান্তরে রাজীব লোচন রায় শাহজাদীর প্রেমে পড়লে উক্ত প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। লোভে পড়ে অথবা চক্রান্তে, রাজীব রায় রাজী হলে হিন্দু সমাজ তাকে একঘরে করে ফেলে। তার কাছে খাদ্যদ্রব্য বিক্রয় করতে অস্বীকৃতি জানায় এমনকি তার সন্তানের পানের জন্য দুধ বিক্রয় পর্যন্ত বন্ধ করে দেয়। ক্ষোভে, দূঃখে বা অনুশোচনায় তিনি পুনরায় হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করতে চান। কিন্তু তৎকালীন কট্টর বাঙ্গালি হিন্দু সমাজ তাকে গ্রহন করতে অস্বীকৃতি জানায়। বাধ্য হয়ে তিনি উড়িষ্যার পুরীতে অবস্থিত জগন্নাথের মন্দিরে যান শুদ্ধ হতে। কিন্তু এখানেও তাকে হতাশ হতে হয়। যবন (মুসলমান) হওয়ায় তাকে মন্দিরে ঢুকতে দেয়া হয়নি। একরকম অপমানিত হয়ে ক্ষোভে ফেটে পড়েন তিনি। ব্যর্থ মনোরথে ফিরে আসেন রাজধানীতে, যা গৌড় থেকে তান্ডায় স্থানান্তর করা হয়।
মোটামুটি ধারণা করা হয় বৃত্তাঙ্কিত স্থলভাগে বিচরণ ছিল কালাপাহাড়ের।
কথা রেখেছিলেন সুলায়মান কররানি, তিনি ধর্মান্তরিত রাজুকে সেনাপতি করেছিলেন যার ফলে রাজুর হাতে আসে প্রচুর ক্ষমতা। কররানি শাসকদের মধ্যে খুব বিচক্ষণ আর দূরদর্শী ছিলেন সুলায়মান কররানি। তিনি তার রাজত্ব বিস্তৃত করেন আসাম থেকে উড়িষ্যা পর্যন্ত, এবং এই অভিযানগুলোতে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন রাজু যিনি ততদিনে “কালাপাহাড়” নামে পরিচিত হয়ে উঠেছেন। হিন্দুসমাজ এবং মন্দির থেকে প্রত্যাখ্যাত হবার অপমান তখন পুড়িয়ে মারছে তাকে। তাই এই সব অভিযানে যত মন্দির তার সামনে পড়েছে তার খুব কমই রেহাই পেয়েছে তার ধবংসের হাত থেকে। একই সাথে বিনষ্ট হয়েছে ইতিহাস, ঐতিহ্য, কৃষ্টি আর শিল্পকলা। তার ক্রোধের রোষে পতিত বিখ্যাত মন্দিরগুলোর মধ্যে আছে পুরীর জগন্নাথ মন্দির, গৌহাটির কামাখ্যা মন্দির, কোণার্কের সূর্য মন্দির, বালাসোরের গোপিনাথ মন্দির, ময়ুরভঞ্জ, মেদিনীপুর সহ আরো বেশকিছু মন্দির । কথিত আছে যে, তার ধবংসলীলার জন্য আসামে তাকে কালোকুঠার বা পোড়াকুঠার নামেও সম্বোধন করা হত। জানা যায় তিনি কিছু কিছু ক্ষেত্রে মন্দিরের ভেতর বিশাল আকৃতির ঢোল ও ঘন্টা বাজিয়ে অনুরনন তৈরী করে মন্দিরের ক্ষতি সাধন করতেন । ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৫৬৮ সালে উড়িষ্যায় পরিচালিত অভিযানে তিনি সবচেয়ে বেশি ক্ষতি সাধন করেন পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে এবং এই অভিযানে প্রচুর পরিমাণ সম্পদ তার হস্তগত হয়।
পুরীর জগন্নাথ মন্দির।
সুলায়মান খান কররানি উড়িষ্যা জয়ের সংকল্পে তাঁর পুত্র বায়াজিদ ও দুর্ধর্ষ সেনাপতি কালাপাহাড়ের অধীনে অভিযান প্রেরণ করেন। কূটসামার নিকট যুদ্ধে উড়িষ্যার রাজা হরিচন্দন মুকুন্দরাম ও তার সৈন্যাধক্ষ রামচন্দ্র ভানজা (ধৃত ও নিহত) পরাজিত ও নিহত হন। (১৫৬৮ খ্রিস্টাব্দ)
একই সময় কুচবিহারের রাজা বিশ্ব সিংহ তাঁর পুত্র ও খ্যাতনাম সেনাপতি শুক্লধ্বজের (চিলা রায় নামে সুপরিচিত) অধীনে একদল সৈন্য কররানি রাজ্য আক্রমণ করতে পাঠান। সুলায়মান কররানি শুক্লধ্বজকে পরাজিত ও বন্দী করে কালাপাহাড়কে কুচবিহার জয়ের জন্য প্রেরণ করেন। কালাপাহাড় কুচবিহারের কামাখ্যা ও হাজু পর্যন্ত অধিকার করেন। এই সময় উড়িষ্যায় এক বিদ্রোহ দেখা দিলে সুলায়মান কররানি কালাপাহাড়কে ডেকে পাঠান এবং দখল করা জায়গাগুলো ফিরিয়ে দিয়ে ও শুক্লধ্বজকে মুক্তি দিয়ে বিশ্ব সিংহের সাথে মিত্রতা স্থাপন করেন।
কোণার্কের সূর্য রথের মন্দির। ছবি স্বত্বঃ জুন আপু
একদিকে রাজ্য বিস্তার করলেও কূটনৈতিক দূরদৃষ্টি সম্পন্ন সুলায়মান কররানি মুঘল সম্রাট আকবরের আনুগত্য মেনে নিয়ে তার সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখেই চলছিলেন উত্তর প্রদেশের মুঘল শাসক মুনিম খাঁ’র মাধ্যমে। কিন্তু ১৫৭২ সালে এই শাসকের (সুলায়মান কররানি) মৃত্যু হলে হুমকির মুখে পড়ে বাংলায় আফগান শাসন। তার পুত্র দাউদ খান কররানি বাংলার সিংহাসনে বসলে বিরোধ বাধে মুঘল সাম্রাজ্যের সাথে। কারন দাউদ কররানি বাংলার বিশাল ঐশ্বর্য দেখে নিজেকে বাদশাহ বলে ঘোষণা করেন। ফলশ্রুতিতে মুঘল সম্রাট আকবরের নির্দেশে মুনিম খান আক্রমন করেন দাউদ খানকে এবং তার রাজধানী তান্ডা দখল করে নেন, বিতাড়িত দাউদ খান উড়িষ্যায় আশ্রয় গ্রহণ করেন। এদিকে তান্ডায় প্লেগের সংক্রমন হলে মুনিম খান এবং তার প্রচুর সৈন্য মারা যায়, এই সুযোগে দাউদ খান আবার তান্ডা পুনরুদ্ধার করেন। অপরদিকে বারভূইয়ার ঈশা খাঁ পুর্ব বাংলা থেকে মুঘল সৈন্যদের তাড়িয়ে দেয়। সকল যুদ্ধে অত্যন্ত বীরত্বের সাথে দাউদ খানের পাশে ছিলেন কালাপাহাড়।
মুনিম খাঁ’র মৃত্যু সংবাদ দিল্লীতে পৌছালে অভিযানের দায়িত্ব নিয়ে খানজাহান হুসেন কুলি খান এবং তার সহকারী হিসেবে আসেন রাজা টোডরমল (নবরত্নের অন্যতম)। উভয় পক্ষের মাঝে চূড়ান্ত যুদ্ধ হয় রাজমহলে। ১২ জুলাই ১৫৭৬, রাজমহলের যুদ্ধের শুরুতে কালাপাহাড়ের তীব্র আক্রমণে মুঘল সৈন্যরা পিছু হঠতে বাধ্য হয়। বিহারের শাসনকর্তা মুজাফফর খান তুরবাতি এই যুদ্ধে মুঘলদের সহযোগিতা করেন। প্রচন্ড এই যুদ্ধে দাউদ খান পরাজিত হন এবং পরে তার মৃত্যুদন্ড দেয়া হয় এবং কথিত আছে যে, এই একই যুদ্ধে মুঘল কামানের গোলার আঘাতে কালাপাহাড় নিহত হন কালীগঙ্গা নদীর তীরে।
মতান্তরে মুঘলদের গুলির আঘাতে কালাপাহাড় আহত হন এবং যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সরে পড়েন।
শেষে আরও কিছু বলতে চেয়েছিলাম কিন্তু মনে হল মোহিতলাল মজুমদারের লেখা কবিতাটি আপনাদের সাথে শেয়ার করলে সবচেয়ে ভালো হয়।
কালাপাহাড় (মোহিতলাল মজুমদার)
শুনিছ না---ওই দিকে দিকে কাঁদে রক্ত পিশাচ প্রেতের দল!
শবভুক্ যত নিশাচর করে জগৎ জুড়িয়া কী কোলাহল !
দূর-মশালের তপ্ত-নিশাসে ঘামিয়া উঠিছে গগন-শিলা !
ধরণীর বুক থরথরি কাঁপে --- একি তাণ্ডব নৃত্য লীলা !
এতদিন পরে উদিল কি আজ সুরাসুর জয়ী যুগাবতার ?
মানুষের পাপ করিতে মোচন, দেবতারে হানি' ভীম প্রহার,
---কালাপাহাড় ! ...
কতকাল পরে আজ নরদেহে শোনিতে ধ্বনিছে আগুন গান !
এতদিন শুধু লাল হ'ল বেদী --- আজ তার শিখা ধূমায়মান !
আদি হ'তে যত বেদনা জমেছে --- বঞ্চনাহত ব্যর্থশ্বাস---
ওই ওঠে তারি প্রলয়-ঝটিকা, ঘোর গর্জন মহোচ্ছাস !
ভয় পায় ভয় ! ভগবান ভাগে ! ---প্রেতপুরী বুঝি হয় সাবাড় !
ওই আসে---তার বাজে দুন্দুভি, তামার দামামা, কাড়া-নাকাড় !
---কালাপাহাড় !
কোটি-আঁখি-ঝরা অশ্রু-নিঝর ঝরিল চরণ-পাষাণ-মূলে,
ক্ষয় হ'ল শুধু শিলা-চত্তর --- অন্ধের আঁখি গেল না খুলে !
জীবের চেতনা জড়ে বিলাইয়া আঁধারিল কত শুক্ল নিশা !
রক্ত-লোলুপ লোল-রসনায় দানিল নিজেরি অমৃত-তৃষা !
আজ তারি শেষ ! মোহ অবসান ! ---দেবতা-দমন যুগাবতার !
আসে ওই ! তার বাজে দুন্দুভি---বাজায় দামামা, কাড়া-নাকাড় !
---কালাপাহাড় !
বাজে দুন্দুভি, তামার দামামা---বাজে কী ভীষণ কাড়া নাকাড় !
অগ্নি-পতাকা উড়িছে ঈশানে, দুলিছে তাহাতে উল্কা-হার !
অসির ফলকে অশনি ঝলকে---গলে যায় যত ত্রিশূল চুড়া !
ভৈরব রবে মুর্ছিত ধরা, আকাশের ছাদ হয় বা গুঁড়া !
পূজারী অথির, দেবতা বধির---ঘন্টার রোলে জাগে না আর !
অরাতির দাপে আরতি ফুরায়---নাম শুনে হয় বুক অসাড় !
---কালাপাহাড় !
নিজ হাতে পরি' শিকলি দু'পায় দুর্বল করে যাহারে নতি,
হাত জোড় করি' যাচনা যাহারে, আজ হের তার কি দুর্গতি !
কোথায় পিনাক ? ---ডমরু কোথায় ? কোথায় চক্র সুদর্শন ?
মানুষের কাছে বরাভয় মাগে মন্দির-বাসী অমরগণ !
ছাড়ি' লোকালয় দেবতা পলায় সাত-সাগরের সীমানা-পার !
ভয়ংকরের ভুল ভেঙে যায় ! বাজায় দামামা, কাড়া-নাকাড়,
---কালাপাহাড় !
কল্প-কালের কল্পনা যত, শিশু-মানবের নরক-ভয়---
নিবারণ করি' উদিল আজিকে দৈত্য-দানব-পুরঞ্জয় !
দেহের দেউলে দেবতা নিবসে---তার অপমান দুর্বিষহ !
অন্তরে হ'ল বাহিরের দাস মানুষের পিতা প্রপিতামহ !
স্তম্ভিত হৃৎপিণ্ডের 'পরে তুলেছে অচল পাষাণ-ভার---
সহিবে কি সেই নিদারুণ গ্লানি মানবসিংহ যুগাবতার
---কালাপাহাড় ?
ভেঙে ফেল' মঠ মন্দির-চূড়া, দারু-শিলা কর নিমজ্জন !
বলি-উপচার ধূপদীপারতি রসাতলে দাও বিসর্জ্জন !
নাই বাহ্মণ, ম্লেচ্ছ-যবন, নাই ভগবান---ভক্ত নাই,
যুগে যুগে শুধু মানুষ আছে রে ! মানুষের বুকে রক্ত চাই !
ছাড়ি' লোকালয় দেবতা পলায় সাত-সাগরের সীমানা-পার !
ভয়ংকরের ভয় ভেঙে যায়, ---বাজায় দামামা, কাড়া-নাকাড়,
---কালাপাহাড় !
ব্রাহ্মণ যুবা যবনে মিলেছে, পবন মিলেছে বহ্নি সাথে !
এ কোন্ বিধাতা বজ্র ধরেছে নবসৃষ্টির প্রলয়-রাতে !
মরুর মর্ম বিদারি' বহিছে সুধার উত্স পিপাসাহরা !
কল্লোলে তার বন্যার রোল ! ---কূল ভেঙে বুঝি ভাসায় ধরা !
ওরে ভয় নাই ! ---মুকুটে তাহার নবারুণ-ছটা, ময়ূখ হার |
কাল নিশীথিনী লুকায় বসনে !---সবে দিল তাই নাম তাহার
কালাপাহাড় !
শুনিছ না ওই--- দিকে দিকে কাঁদে রক্তজপিশাচ প্রেতের পাল !
দূর-মশালের তপ্ত-নিশাসে ঘামিয়া উঠিছে গগন-ভাল !
কার পথে-পথে গিরি নুয়ে যায় ! কটাক্ষে রবি অস্তমান !
খড়্গ কাহার থির-বিদ্যুৎ ! ধূলি-ধ্বজা কার মেঘ-সমান !
ভয় পায় ভয় ! ভগবান ভাগে ! প্রেতপুরী বুঝি হয় সাবাড় !
ওই আসে ! ওই বাজে দুন্দুভি---বাজায় দামামা, কাড়া-নাকাড়
---কালাপাহাড় !
তথ্যসূত্রঃ
১. মোহিতলাল মজুমদার
২. A story of ambivalent modernization in Bangladesh and West Bengal; the rise and fall of Bengali elitism in South Asia
৩. Karrani dynasty and end of independent Bengal Karrani dynasty and end of independent Bengal
৪. Sulaiman Karrani
৫. হিন্দু কালাপাহাড় - ধর্ম যখন ব্যাকফায়ার করে
৬. কোর্ণাকের সূর্য মন্দির
৭. Asiatick Researches, Or, Transactions of the Society Instituted in Bengal
৮. ইতিহাস পুনর্পাঠ
৯. ম্যাপ
১০. ছবিঃ আন্তর্জাল (কোণার্কের সূর্যরথের মন্দির ব্যতীত)
১১. বাংলাদেশের ইতিহাস- ডঃ মুহাম্মদ আব্দুর রহিম, ডঃ আবদুল মমিন, ডঃ এ বি এম মাহমুদ, ডঃ সিরাজুল ইসলাম. নওরোজ কিতাবিস্তান, ঢাকা। আগস্ট ২০০৫.
*********************************
কৃতজ্ঞতাঃ কোণার্কের সূর্যরথের মন্দিরের ছবির জন্য জুন আপুর কাছে অসংখ্য কৃতজ্ঞতা।
উৎসর্গঃ সেই সব কিশোরদের; বই পড়ে যাদের জানার ক্ষুধা কখনোই কমেনি বরং বেড়েছে।