somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

যারা আমায় বাঁচতে শেখায় – ৩

১৯ শে মার্চ, ২০১৩ ভোর ৪:০৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মেসের বুয়া আল্টিমেটাম দিয়ে দিয়েছে, “মামা, বটি ধার কইরা আনুইন যে, নাইলে আর কাম করতাম নায়!!” এসব ক্ষেত্রে আমি যা করি এবারো তাই করলাম। সুন্দর করে খালাকে বললাম “খালা আপনার বাসার বটি যেমনে ধার করেন এটাও নিয়ে সেইভাবে ধার করে আনেন, টাকা যা লাগে আমি দিয়ে দেবো।” পরেরদিন খালা বেজার মুখে যা বর্ণনা করলেন তা হলো বটির মুখ নাকি পইড়া গেছে,(আমি অবশ্য বুঝলাম না বটির মুখ পরে ক্যামনে) বালি দিয়ে ধার দেয়া যাচ্ছে না। অগত্যা বটি কাগজে মুড়ে ব্যাগে ভরে কামারশালার সন্ধানে বের হলাম। Real Steel এর যুগে কামারশালা খুঁজে বের করা যে কী পরিমাণ দূরহ ব্যাপার সেটা ঐদিন বুঝেছিলাম। যত দূরহই হোক আমিও হাল ছাড়ার পাত্র নই, উপরন্তু ক্লাস এইটে Blacksmith এর উপর পড়া বিদ্যাগুলো পেটের মধ্যে একের পর এক পাক খেয়ে উঠছিল। অবশেষে খোঁজ পেলাম এক কামারের। কিন্তু কামারশালায় ঢুকে চরমভাবে আশাহত হলাম। কোথায় পড়েছিলাম ব্লাকস্মিথের খুব ভালো মাসল হয়!! এখানে এক অশীতিপর বৃদ্ধকে বসে থাকতে দেখলাম। কাছে যেয়ে গলা তুলে জিজ্ঞাসা করলাম, কাকা কাজ কি আপনিই করেন?? আমার মনে হচ্ছিল অন্য কেউ বোধহয় কামার, তিনি হয়তো কোন কাজে বসে আছেন। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে উনি উপরে নিচে মাথা ঝাঁকালেন। কি আর করা, আমি তাঁর হাতে বটিটা তুলে দিয়ে বললাম এটা ধার করতে হবে। তারপর শুরু হল ম্যাজিক!! বিশ্বাস করুন পুরো ম্যাজিক!! জীবনে চলতে গিয়ে মাঝে মাঝেই খুব অবাক হয়ে নিজেকে খুব অদ্ভুত কিছু জায়গায় আবিষ্কার করি। শুধু মনে হয় এরকম একটা জায়গায় আমি কোন টাইম মেশিনে চড়ে আসলাম ?? যেমনটা এখন হচ্ছে। চোখের সামনে একটা মানুষকে যন্ত্র হয়ে যেতে দেখলাম। বটিটা রেখেই তিনি হাত বাড়িয়ে দিলেন বেড়ায় গুঁজে রাখা ফতুয়ার দিকে, তার পকেট থেকে আলতো হাতে বের করে আনলেন একটা ডান্টাভাঙ্গা চশমা। তারপর সুতোর লুপগুলো (যেহেতু ডান্টাভাঙ্গা) কানে পরে নিবিষ্ট মনে বটিটা দেখলেন কিছুক্ষণ। তারপর বললেন চল্লিশ টাকা লাগবে। আমি রাজী হলে, এবার তিনি হাত বাড়িয়ে দিলেন ফতুয়ার আরেক পকেটে। সেখান থেকে ম্যাচ বের করতে করতে বললেন, আরেকটু আগে আসলে ভালো করতেন,আমি একটু আগে আগুন নিভাইলাম। তারপর কাগজে আগুন ধরিয়ে তার আশেপাশে কয়লা দিয়ে শুরু করলেন হাপর টানা। সাবলীলভাবে কাজ করে যাচ্ছিলেন তিনি, মনেই হচ্ছিল না তার বয়স এত। আগুনে কয়লাগুলো ভালো করে জ্বলে গেলে বটিটা ঠেলে দিলেন সেই অগ্নিকুণ্ডে তারপর আবার হাপর টানা। একসময় পুরো বটি লাল হয়ে গেলে প্ল্যায়ার্সের মত একটা যন্ত্র দিয়ে ওটা ধরে আরেক হাতে রেলের প্লেটের উপর পেটানো শুরু করলেন। দুই হাত ব্যস্ত, তাতে কী?? অবলীলায় বাম পায়ের বুড়ো আঙ্গুল হাপরের আংটায় আঁটকিয়ে সমানে হাপর টেনে গেলেন। তারপর আরেকদফা বটি আগুনে দিয়ে যা করলেন আমি পুরো মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গেলাম, ঠোঁটে একটা সিগারেট গুঁজে প্ল্যায়ার্সের মতো লম্বা হাতাওয়ালা যন্ত্রটা দিয়ে দিব্যি মুখের কাছে নিয়ে আসলেন গনগনে কয়লা। তারপর মনের সুখে ধোঁয়া ওড়াতে লাগলেন। মনে হচ্ছিল ওয়েস্টার্ন ম্যুভি দেখছি। হলিউডের কোন অ্যাকশন স্টারও বোধহয় এত চমৎকার করে, করে দেখাতে পারবে না।
বটি পিটানো হয়ে গেলে ডুবিয়ে দিলেন পানিতে, তারপর সুন্দর করে মুছে র্যাঁগদা দিয়ে ঘষে ধার দিলেন বটি। আমি তাকে টাকা দিয়ে ফিরে এলাম আর শিখলাম বার্ধক্যের সংজ্ঞা।
“বার্ধক্য তাহাই—যাহা পুরাতনকে, মিথ্যাকে, মৃত্যুকে আঁকড়িয়া পড়িয়া থাকে; বৃদ্ধ তাহারাই—যাহারা মায়াচ্ছন্ন নব মানবের অভিনব জয় যাত্রার শুধু বোঝা নয়, বিঘ্ন; শতাব্দীর নব যাত্রীর চলার ছন্দে ছন্দ মিলাইয়া যাহারা কুচকাওয়াজ করিতে জানে না, পারে না; যাহারা জীব হইয়াও জড়; যাহারা অটল সংস্কারের পাষাণস্তূপ আঁকড়িয়া পড়িয়া আছে। বৃদ্ধ তাহারাই-যাহারা নব অরুণোদয় দেখিয়া নিদ্রাভঙ্গের ভয়ে দ্বার রুদ্ধ করিয়া পড়িয়া থাকে। আলোক-পিয়াসী প্রাণ চঞ্চল শিশুদের কল কোলাহলে যাহারা বিরক্ত হইয়া অভিসম্পাত করিতে থাকে, জীর্ণ পুঁথি চাপা পড়িয়া যাহাদের নাভিশ্বাস বহিতেছে, অতি জ্ঞানের অগ্নিমান্দ্যে যাহারা আজ কঙ্কালসার—বৃদ্ধ তাহারাই। ইহাদের ধর্মই বার্ধক্য। বার্ধক্যকে সব সময় বয়সের ফ্রেমে বাঁধা যায় না। বহু যুবককে দেখিয়াছি যাহাদের যৌবনের উর্দির নিচে বার্ধক্যের কঙ্কাল মূর্তি। আবার বহু বৃদ্ধকে দেখিয়াছি যাঁহাদের বার্ধক্যের জীর্ণাবরণের তলে মেঘলুপ্ত সূর্যের মতো প্রদীপ্ত যৌবন। তরুণ নামের জয়-মুকুট শুধু তাহারই যাহার শক্তি অপরিমাণ, গতিবেগ ঝঞ্ঝার ন্যায়, তেজ নির্মেঘ আষাঢ় মধ্যাহ্নের মার্তণ্ডপ্রায়, বিপুল যাহার আশা, ক্লান্তিহীন যাহার উৎসাহ, বিরাট যাহার ঔদার্য, অফুরন্ত যাহার প্রাণ, অটল যাহার সাধনা, মৃত্যু যাহার মুঠিতলে।” (যৌবনের গান- কাজী নজরুল ইসলাম)


(সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরনঃ ধুমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।)

********************************************
আমার আগের দুই পোস্টে জীবন সংগ্রামে অপরাজেয় দুই যোদ্ধার কথা বলেছিলাম। আর আজকের পোস্টে এক তরুণের কথা বলতে চেয়েছি, বয়স যাকে বেঁধে রাখতে পারেনি। তার কাজের বর্ণনা হয়তো একটু বেশি হয়ে গেছে !! কিন্তু কি করব?? আমি যে ছোটবেলা থেকেই খুব মুগ্ধতা নিয়ে এসব দেখতাম। ছোটবেলায় আমার জীবনের লক্ষ্য ছিল কাঠমিস্ত্রী হওয়া। সেই গল্প না হয় আরেক দিন বলব।

আপাতত কৃতজ্ঞতা স্বীকার করি ব্লগার উৎকৃষ্টতম বন্ধু র কাছে। যার আন্তরিক অনুরোধে আমার মত অলস ব্যক্তি এত তাড়াতাড়ি পোস্ট দিল।


যারা আমায় বাঁচতে শেখায়

যারা আমায় বাঁচতে শেখায় – ২

সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই নভেম্বর, ২০১৩ দুপুর ১:২১
৪৮টি মন্তব্য ৪৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মত প্রকাশ মানে সহমত।

লিখেছেন অনুপম বলছি, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১:২৭

আওয়ামী লীগ আমলে সমাজের একটা অংশের অভিযোগ ছিলো, তাদের নাকি মত প্রকাশের স্বাধীনতা নাই। যদিও, এই কথাটাও তারা প্রকাশ্যে বলতে পারতেন, লিখে অথবা টকশো তে।

এখন রা জা কারের আমলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আত্নমর্যাদা!

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ২:৪৩

রেহমান সোবহান একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। তার বাড়ি থেকে বিদ্যালয়ের দূরত্ব প্রায় ৬ কিলোমিটার। রেহমান সাহেব এমন একটি বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন যা খুব নির্জন এলাকায় অবস্থিত এবং সেখানে যাওয়ার... ...বাকিটুকু পড়ুন

কাঁঠালের আমসত্ত্ব

লিখেছেন বিষাদ সময়, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৭

কাঁঠালের কি আমসত্ত্ব হয় ? হয় ভাই এ দেশে সবই হয়। কুটিল বুদ্ধি , বাগ্মিতা আর কিছু জারি জুরি জানলে আপনি সহজেই কাঁঠালের আমসত্ত্ব বানাতে পারবেন।
কাঁঠালের আমসত্ত্ব বানানের জন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। অ্যাকসিডেন্ট আরও বাড়বে

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৫৯



এরকম সুন্দরী বালিকাকে ট্র্যাফিক দায়িত্বে দিলে চালকদের মাথা ঘুরে আরেক গাড়ির সাথে লাগিয়ে দিয়ে পুরো রাস্তাই বন্দ হয়ে যাবে ।
...বাকিটুকু পড়ুন

কেমন হবে জাতীয় পার্টির মহাসমাবেশ ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৫৬


জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বিক্ষুব্দ ছাত্র জনতা আগুন দিয়েছে তাতে বুড়ো গরু গুলোর মন খারাপ।বুড়ো গরু হচ্ছে তারা যারা এখনো গণমাধ্যমে ইনিয়ে বিনিয়ে স্বৈরাচারের পক্ষে কথা বলে ,ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়াতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×