তখন আমার কতই বা বয়স উনিশ কিম্বা বিশ, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সেমিস্টার চলছে। বাবাকে হারিয়েছি মাসখানেক হল। ক্যাম্পাসে ফিরে এসেছি, কিন্তু কোন কিছুই ঠিক গুছিয়ে শুরু করতে পারছি না। একদিকে বাবাকে হারানোর কষ্ট, অন্যদিকে নতুন জায়গায় নিজেকে খাপ খাওয়াতে না পারা, সব মিলিয়ে দূর্বিষহ সময় কাটাচ্ছিলাম সিলেটে। ক্লাস শুরু করেছি বেশিদিন হয়নি তাই খুব ভাল বন্ধুত্ব হয়ে ওঠে নি কারো সাথে। খুব বিশ্রী আর অস্থির একটা সময় যাচ্ছিল আমার। এর মাঝে একদিন বিকেলে কি যেন কাজ শেষে শহর থেকে ফিরছিলাম। যে রাস্তা এখন চোখের পলকে শেষ হয়ে যায়, সেই রাস্তাও তখন মনে হচ্ছিল কোনদিন শেষ হবে না। রিকশায় বসে থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে আমি কথা শুরু করলাম রিকশাচালকের সাথে। নামটা কি বলেছিলেন আজ আর মনে নেই, শুধু মনে আছে তার বাড়ি হল বনলতা সেনের দেশে। বয়স আমার আশেপাশেই হবে। টুকটাক কথাবার্তায় জানতে পারলাম, তারও বাবা মারা গিয়েছেন কিছুদিন হল। বাড়িতে উপার্জনক্ষম আর কেউ নেই, উপরন্তু বিবাহযোগ্য দুটি বোন আছে। বেচারা নাটোরে থাকতে বেকারী শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন কিন্তু সেই কাজে আয় কম আর কাজেরও নিশ্চয়তা নেই। তাই বাধ্য হয়েই সিলেটে এসেছেন বেশি উপার্জনের আশায়। রাস্তার সাথে সাথে আমাদের গল্পও চলতে থাকে। কথায় কথায় জানতে পারলাম ক্লাস এইট পর্যন্ত লেখাপড়া করে অভাবের সংসারে বাবাকে সাহায্য করতেই হয়েছিলেন বেকারী শ্রমিক, আর আজ-পুরো সংসারের বোঝা তার ঘাড়ে। আমাকে খুব আফসোস করেই বলেছিলেন, “জানেন ভাইজান রিকশা আমি দ্যাশেই চালাইতে পারতাম, মা-বোইন নিয়া চাইরজন চলতে কতই আর লাগে?? কিন্তুক দ্যাশে যদি মাইনষে দেখত আমি রিকশা চালাই তাইলে আমার বাপের সুনাম নষ্ট হইত, বোইনগো বিয়ার সময় নানান কথা হইত, রিকশাওয়ালার বোইন দেইখা ভাল বিয়া আইতো না। এইহানেও সব সময় ভয়ে ভয়ে থাকি কহন কেউ দেইখা ফালায়, আইজকাল নাটোর আর সিলেট তো বেশি দূরের না”।
কি বিচিত্র সমাজ ব্যবস্থা আমাদের ?? কেউ এক বেলা না খেয়ে থাকলে সমাজ সেটা দেখতে আসে না। কিন্তু ভাই রিকশা চালালে তার বোনের নাম সমাজে হয়ে যায় রিকশাওয়ালার বোন। তাদের ভালো বিয়ে হতে মানা। খানিকপর আবার নিজে থেকেই বলতে শুরু করলেন “আমার কাছে কাজের কোন ছোট বড় নাই ভাইজান। আল্লায় শরিল দিছে, সেইটা খাটাই কাজকাম করি। কাউরে ধরি না, মারি না, কারোটা চুরিও করি না। পান, বিড়ি সিগারেটের নেশাও নাই ভাইজান। আমার কাছে কাজের কোন ছোট বড় নাই ভাইজান। খালি চিন্তা বোইন দুইটার বিয়া নিয়া, আপনেগো দোয়ায় যদি ভাল বিয়া দিবার পারি তাইলেই শান্তি। আল্লায় সামর্থ্য দেয় নাই তাই বোইন গুলার লেখাপড়া হইলো না, আল্লায় চাইলে তারা বি.এ. এম.এ. পাশ দিত, চাকরি করত। কিন্তুক আল্লায় আমারে যেটুক তৌফিক দিছে সেইটুক দিয়া আমি তাদের ভাল বিয়া দিমু। আপনে দোয়া কইরেন ভাইজান ”। প্রশ্ন করলাম বাড়ি যেতে ইচ্ছে করে না? বাড়ি যান না কেন? “মন আবার চায় না ?? ভাইজান, আমার শরিল খালি এইখানে রইছে, মন তো রইছে দ্যাশে-আমার বাড়িত। সাড়ে ছয় হাজার টেকা জমছে আরও কিছু জমলে বাড়িত যামু, দিন দশেক থাইকা আসমু।”
এরপর আরো অনেক কথা হয়েছিল আমাদের। হঠাৎ করেই পৃথিবীটা খুব স্নিগ্ধ হয়ে উঠল আমার কাছে। খুব করে বাঁচতে ইচ্ছে হল, মানুষকে ভালোবাসতে ইচ্ছে করল। তার সাথে কথা বলে একটা পরিষ্কার, স্বচ্ছ আর শিক্ষিত মনের দেখা পেয়েছিলাম আমি। আজ স্বীকার করতে লজ্জা নেই আমার চারপাশের অনেক ভদ্রলোকের মাঝেও আমি এত পরিচ্ছন্ন ও শিক্ষিত মানসিকতার দেখা পাই না। আমাকে যে ব্যাপারটা সবচেয়ে বেশি অভিভূত করেছিল সেটা ছিল তার শেখার আগ্রহ। তার শেখার আগ্রহ ছিল প্রচণ্ড। আমি সিলেটে কেন? আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে কি কি যোগ্যতা লাগে? আমার বিভাগ থেকে পাশ করে আমি কোন কোন কাজ করতে পারব? এখানে আর কি কি বিভাগ আছে? সেগুলোর কোনটার কাজ কি? ইত্যাদি ইত্যাদি অনেক গুলো প্রশ্নের উত্তর আমাকে দিতে হয়েছিল। পরিষ্কার বুঝতে পারছিলাম সে যথেষ্ট মেধাবী একজন মানুষ। ভাড়া মিটিয়ে যখন ফিরে আসছিলাম তখন তার জন্য কিছু করতে খুব ইচ্ছে করছিল। কিন্তু আমি কিছুই করতে পারিনি। আমার অক্ষমতাকে ঢাকতে চিৎকার করে কাঁদতে চাইলাম, আমার চোখ বেয়ে এক ফোঁটা পানিও বের হল না। শুধু মনে পড়ল অঞ্জনের গানের একটা লাইন-
“তখন তো বুঝিনি বড় হওয়া বড়ই শক্ত
বয়সের সাথে সাথে কমে যায় চোখের জল”
তারপর আর কখনো তার সাথে আমার কথা হয়নি, দেখা হয় নি, সত্যি কথা বলতে কি তার চেহারাও আমার মনে নেই। শুধু মনে আছে মানুষটাকে, মনে আছে আমার অক্ষমতাকে। আমি জানি না তিনি সাড়ে ছয় হাজার টাকার সাথে আরো কিছু জমিয়ে বাড়িতে যেতে পেরছিলেন কিনা ? জানি না তার বোনদের ভালো বিয়ে হয়েছিল কিনা? যৌতুকের জন্য তার বোনদের উপর অত্যাচার হয় কি না? এ প্রশ্নের উত্তরও আমার কাছে নেই। পৃথিবীতে সবচেয়ে সহজ উত্তর “জানি না”।
যারা আমায় বাঁচতে শেখায় – ২
যারা আমায় বাঁচতে শেখায় – ৩