গতরাতে খুব যে দেরি করে ঘুমিয়েছি তা নয়। আর যত রাতেই ঘুমাই না কেন সকালের একটা নির্দিষ্ট সময় পর আমি আর ঘুমাতে পারি না, ঘুম ভেঙ্গে যায়। কিন্তু আজ সব নিয়মের ব্যতিক্রম করে আমি ঘুমিয়েছি, অনেক বেলা পর্যন্ত ঘুমিয়েছি। তারপর হঠাৎ করেই ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। ভেঙ্গে গেল একটা গন্ধ পেয়ে। গায়ের গন্ধ, শরীরের গন্ধ। আমার খুব চেনা একটা গন্ধ। খুব ভালো করে জানি আমি গন্ধের উৎসকে, খুব ভালো করে জানতাম। তারপর থেকে নাকে আর কোন গন্ধ কাজ করছে না। শুধু একটা গন্ধই পাচ্ছি। মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে, দেয়ালে দেয়ালে আছড়ে পড়ছে। ঘোরলাগা মানুষের মত মশারি তুলে ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম দরজার দিকে, অন্য সব সময়ের মতই সেটা ভেতর থেকে বন্ধ। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি পাশের এক চিলতে খোলা জায়গায় হুল্লোড় করছে অগোপন্ড শিশুর দল। ওদের জন্য আমার মায়া হয়। আচ্ছা আমার জন্য কারো মায়া হয় না? তার মায়া হয় না?
কিছুতেই মুক্তি পাচ্ছি না সেই গন্ধ থেকে। এটা দেখি আমাকে পাগল বানিয়ে ছাড়বে। নাক চেপে ধরে বসে আছি গন্ধ থেকে মুক্তি পাবার আশায়। সাইনাসে আক্রান্ত মানুষের জন্য এটা যে কী ভীষণ কষ্টের! কেউ কি বুঝবে সেই কষ্ট ? আপুর ছোট্ট ছেলেটার কথা খুব মনে পড়ছে। গেলবার আমার নাকে বই দিয়ে বাড়ি মেরেছিল আর আমার বিরতিহীন হাঁচি। সেটা দেখে তার কি নির্মল আনন্দ। আচ্ছা আমার এই কষ্ট দেখেও কি সে নির্মল আনন্দ পায়? এতগুলো বছরের জমে থাকা কষ্ট, সেটা যদি কারো বিনোদনের খোরাক হয় খারাপ কি?
মুখ দিয়ে শ্বাস নিতে নিতে গলা শুকিয়ে গেছে। পানি খেতে খুব ইচ্ছে করছে, কিন্তু আমি একচুলও নড়ব না। যদি, যদি গন্ধটা হারিয়ে যায়, যদি আর কক্ষনো ফিরে না পাই। মনে হচ্ছে এখন আমি বায়োস্কোপ দেখছি। পুরনো স্মৃতিগুলো সব একে একে ভেসে আসছে। এতগুলো সময় একসাথে কাটিয়েছি একদিনও মুখ ফুটে মনের কথা বলি নি। পাছে যদি হারিয়ে ফেলি।
ওহ !! কী দূঃসহ !! গন্ধের সাথে এখন একটা গান ও মাথায় ঘুরছে....
ওহে হারাই হারাই সদা হয় ভয়, হারাইয়া ফেলি চকিতে।
আশ না মিটিতে হারাইয়া–
পলক না পড়িতে হারাইয়া–
হৃদয় না জুড়াতে হারাইয়া ফেলি চকিতে।
মাঝে মাঝে তব দেখা পাই, চিরদিন কেন পাই না......
পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছি অর্ণবের কণ্ঠ। আমি কী পাগল হয়ে গেলাম! আমার কী ঘোর লেগে গেল! আমি আর সহ্য করতে পারছি না। মাথার শিরা গুলো দপদপ করছে। মনে হচ্ছে মাথা ফেটে চৌচির হয়ে যাবে। চুলগুলো ধরে সমানে টানছি পাগলের মত দিকব্দিক জ্ঞান শূন্য হয়ে। দুই হাত জুড়ে অনেক গুলো ছেড়া চুল। মা দেখলে ভীষণ বকা দিতেন, সবসময় ব্যাকব্রাশ করতে নিষেধ করতেন চুল গুলো পড়ে যাবে বলে। মা তুমি কী জান, সামান্য চুল নয় তোমার ছেলের পুরো জীবনটাই অপচয় হতে চলেছে?
আচ্ছা উচ্চতার সাথে কি ঘ্রাণ শক্তির কোন তারতম্য হয়? এই যে আমি চেয়ারের উপর উঠে দাঁড়ালাম, এখন হাতে থাকা পাটের দড়িটার গন্ধ পাচ্ছি। তাহলে কি সেই গন্ধটাও আমাকে ছেড়ে চলে যাবে? যে ভাবে গন্ধের মালিক চলে গিয়েছিল। নাহ! আর দেরী করা উচিৎ হবে না, গন্ধটা থাকতে থাকতেই। ফ্যানটা ভীষণ নোংরা হয়ে আছে, পরিষ্কার করা হয় নি। এজন্যই বোধহয় ইদানিং বাতাস কম লাগত। প্লাস্টিকের চেয়ার কতক্ষণ যে আমার ভার বইতে পারবে? আচ্ছা গন্ধ যে যাই যাই করছে কিন্তু গানটা যে রয়েই গেলো..........
কী করিলে বলো পাইব তোমারে, রাখিব আঁখিতে আঁখিতে–
ওহে এত প্রেম আমি কোথা পাব, নাথ, তোমারে হৃদয়ে রাখিতে।
আমার সাধ্য কিবা তোমারে–
দয়া না করিলে কে পারে–
তুমি আপনি না এলে কে পারে হৃদয়ে রাখিতে।
মাঝে মাঝে তব দেখা পাই, চিরদিন কেন পাই না।
গন্ধটা আবার পাচ্ছি, পুরো দমে পাচ্ছি। গন্ধটা হচ্ছে অনেকটা....। থাক, এটা কাউকে বলবো না। এটা একান্তই আমার ব্যক্তিগত সম্পদ। এটা আমার সাথে থাকুক।
আর-কারো পানে চাহিব না আর, করিব হে আমি প্রাণপণ–
ওহে তুমি যদি বলো এখনি করিব বিষয় -বাসনা বিসর্জন।
দিব শ্রীচরণে বিষয়– দিব অকাতরে বিষয়–
দিব তোমার লাগি বিষয় -বাসনা বিসর্জন...
বিষয় বাসনা বিসর্জন দিয়ে কি হবে ? তার চেয়ে ঢের দামী কিছু আমার কাছে আছে।
************************************************************
লিরিক- রবীন্দ্র রচনাবলী- পূজা ও প্রার্থনা (৬৮)।
শিরোনামের জন্য ব্লগার শিশেন সাগরের কাছে কৃতজ্ঞ রইলাম।