বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিভাষা পরিস্থিতি
ডক্টর এ.বি.এম. রেজাউল করিম ফকির (মাসুদ)
অধ্যাপক, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
বিদেশী ভাষা মানে ভিন্দেশী ভাষা। প্রয়াত ভাষাতত্ত্ববিদ ড. হুমায়ূন আজাদ একে বিভাষা নামে অভিহিত করেছেন। তবে বিভাষা অভিধাটিতে অনেকের আপত্তি রয়েছে। †কননা বিভাষা †কবল বিদেশী ভাষার সংক্ষেপিত রূপ নয়, এটি বিজাতীয় ভাষা ও বিশিষ্ট ভাষা ইত্যাদি ধারণার সংক্ষেপিত রূপ হিসেবেও বিবেচিত হতে পারে।
বিদেশী ভাষা বিদেশের মানুষের কথিত ও লিখিত ভাষা হলেও বর্তমান বিশ্বায়নের †প্রক্ষাপটে এই বিভাষাই আমাদের †দশে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উ?েছে। †যহেতু বাংলাদেশের †প্রক্ষাপটে বিদেশী ভাষা এই প্রবন্ধের আলোচ্য বিষয়, কাজেই বাংলা ছাড়া অন্যান্য সব ভাষাই আপাতভাবে বিদেশী বলে মনে করা হবে। কিন্তু একটু অন্যভাবে চিন্তা করলে †দখা যাবে ব্যাপারটি এত সরল নয়। †কননা বাংলা ছাড়াও এদেশে আরও ৪০টির মতো ভাষা প্রচলিত রয়েছে। এগুলো এদেশের মানুষের †দশীয় ভাষা হলেও জাতীয় ভাষা নয়, উপজাতীয় ভাষা। আবার এর মধ্যে কয়েকটি ভাষা এদেশে উপজাতীয় ভাষা হলেও ভিন্ †দশে †সগুলো জাতীয় ভাষা। †যমন মনিপুরী ভারতের এবং বর্মী বার্মার জাতীয় ভাষা হলেও এগুলো এদেশে উপজাতীয় ভাষা হিসেবে অভিহিত। কিন্তু মনিপুরী ও বর্মী বিদেশে জাতীয় ভাষা হওয়ায় এগুলো আমাদের এ†দশে বিদেশী ভাষা হিসেবে স্বীকৃত হওয়া উচিৎ। কোন ভাষা কী †কান নির্দিষ্ট †দশে উপজাতীয় ভাষা না-কি বিদেশী ভাষা, এ নিয়ে বিতর্ক সব †দশেই রয়েছে। কিন্তু জাপানী অথবা †সায়াহেলী ভাষা †য বিদেশী ভাষা Ñ এ বিষয়ে †কান বিতর্ক †নই।
উপজাতীয় ভাষাসমূহের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি বা মর্যাদা না থাকলেও, এগুলোর †কান †কানটি আমাদের জাতীয় ভাষা বাংলা-এর গ?নকে সক্রিয়ভাবে প্রভাবিত করেছে। মুন্ডা, সাঁওতাল ও †কাল ইত্যাদি অষ্ট্রিক ভাষাগুলো হলো এরূপ ভাষা, যার কা?ামোতে বাংলা ভাষার সংগ?ন শুরু হয়; যদিও বাংলা বর্তমানে সংস্কৃত ও পালি ভাষাজাত ভাষা হিসাবে স্বীকৃত লাভ করেছে।
দেশীয় ভাষা নিয়ে উপরোক্ত বিতর্ক থাকলেও, পৃথিবীর বিভিন্ন †দশের প্রধান রাষ্ট্রীয় ভাষা †য বিদেশী ভাষা এ নিয়ে †কান বিতর্ক নেই। †সঅর্থে বিশ্বের রাষ্ট্র সংখ্যার সাথে তুলনায় বিদেশী ভাষার সংখ্যা হবে প্রায় দু’শটি। কিত্তু এদেশে বিদেশী ভাষা হিসেবে প?ন-পা?ন হয়ে থাকে তার কিছু সংখ্যক ভাষা। এগু†লা হল আরবী, ফার্সী, উর্দু, ইংরেজী, চীনা, জাপানী, †কারীয়, মালয়, থাই, তুর্কী, রুশ, †স্পনীয়, ফরাসী, জার্মান, ইতালীয়, সুইডিশ ইত্যাদি। বাংলাদেশের †প্রক্ষাপটে উপরোল্লেখিত বিদেশী ভাষাসমূহের মর্যাদা এক ও অভিন্ন নয়। এগুলোর প্রতি আমাদের অভিজ্ঞতা, আবেগ ও মমত্ববোধও সমান নয়। †কননা এগুলোর প্রত্যেকটির সাথে সংশ্লিষ্ট আছে ভিন্ন ভিন্ন ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক ও †ভŠগলিক †প্রক্ষাপট। আরবী, ফার্সী ও উর্দু এদেশে রাজনৈতিক কারনে ঐতিহাসিক †প্রক্ষাপটে প্রবর্তিত হয়ে এদেশের শিক্ষা-সংস্কৃতিকে যুগ যুগ ধরে প্রভাবিত করেছে। এখনও †স প্রভাব চলছে নানাভাবে।
মুসলিম দিগ¦ীজয়†দর হাত ধরে ১৩শ শতকে এদেশে প্রথম আরবী ও ফার্সী প্রচলিত হয়। আরবী শুরু †থকেই ধর্মীয় ভাষা হিসেবে প্রচলিত হয়। আর ফার্সী ১৪শ শতকে রাজভাষা হিসেবে প্রবর্তিত হয় এবং ১৮শ শতক পর্যন্ত এটি †দশের একমাত্র সরকারী ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। †মাঘল শাসকদের পৃষ্?পোষকতায় ১৬শ শতাব্দীতে ফার্সী ও উত্তর ভারতের স্থানীয় ভাষার সংমিশ্রণে সৃষ্টি হয় উর্দু ভাষা। মুসলিম শাসকদের পরিকল্পনায় স্থাপিত শিক্ষা প্রতিষ্?ান “মাদ্রাসা” সমূহে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে আরবী, ফার্সী ও উর্দু ভাষা প্রবর্তিত হয়। ফলশ্রুতিতে বর্তমানে †দশের মাদ্রাসাসমূহে এখনও এসমস্ত ভাষা শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে প্রচলিত রয়েছে। কাজেই আরবী, ফার্সী ও উর্দু ¬Ñএ তিনটি ভাষা বিদেশী ভাষা হলেও এগুলোর প্রতি এদেশের অধিকাংশ মানুষের রয়েছে মাতৃভাষার মত মমত্ববোধ।
১৭শ শতকে প্রথমে ইংরেজ বণিক ও পরে ইংরেজ শাসকদের হাত ধরে এদেশে ইংরেজী প্রচলিত হতে থাকে। ১৯শ শতকে পুরোপুরিভাবে এদেশে শিক্ষা প্রতিষ্?ানসমূহে ইংরেজী ভাষা প্রবর্তিত হয়। ইতোমধ্যে ইংরেজী ভাষা আন্তর্জাতিক ভাষার মর্যাদা লাভ করেছে, এটি এদেশের অন্যতম ব্যবহারিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। বিশ্বের তাবৎ জ্ঞানের বই-পুস্তক এ ভাষায় রচিত হওয়ায় এ ভাষার প্রতি শিক্ষিত জনগোষ্?ী সবচেয়ে †বশি আকৃষ্ট হচ্ছে। ফলে বিদেশী ভাষা হয়েও ইংরেজী আমাদের প্রণের ভাষা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আরবী, ফার্সী, উর্দু ও ইংরেজী বাদ দিলে বাকী †যসব বিদেশী ভাষা রয়েছে †যমন চীনা, জাপানী, †কারীয়, মালয়, থাই, তুর্কী, রুশ, †স্পনীয়, ফরাসী, জার্মান, ইতালীয় ও সুইডিশ ইত্যাদি বিদেশী ভাষাগুলোরও আধুনিক যুগে প?ন-পা?ন শুরু হয়েছে, তবে এক ভিন্ন †প্রক্ষাপটে। এ †প্রক্ষাপট সৃষ্টি হয়েছে বিশ্বায়নের ফলে। বিশ্বায়ন এই বিদেশী ভাষাগুলোর প?ন-পা?নের চাহিদা সৃষ্টি করেছে এবং ইদানীংকালে এই বিশ্বায়ন আরও নতুন নতুন বিদেশী ভাষা প?ন-পা?নের চাহিদা সৃষ্টি করে চলেছে।
বিশ্বায়নের ফলে এ †দশের সাথে বিভিন্ন †দশের সম্পর্ক বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ সম্পর্ক ব্যক্তি পর্যায়ে †যমন বৃদ্ধি পাচ্ছে, †তমনি রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও বৃদ্ধি পাচ্ছে। অর্থনৈতিক, বানিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক বিনিময়ের জন্য রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে †যমন বিদেশী ভাষার গুরুত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে, †তমনি ব্যক্তি পর্যায়েও বিদেশী ভাষার গুরুত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ †দশের মানুষ কাজ ও শিক্ষার সন্ধানে উন্নত বিশ্বে যাচ্ছে। আবার †কউ †কউ এদেশের মায়া ত্যাগ করে উন্নত জীবনের সন্ধানে অভিবাসী হচ্ছে। †য, †য উদ্দেশ্যেই বিদেশে গমন করুক না †কন, তার †স †দশের ভাষা জানা প্রয়োজন। ভাষাগত প্রতিবন্ধকতা থাকলে †কান †দশেই আশানুরূপ লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হয় না। †স জন্য এদেশে বিভাষা শিক্ষার উন্নয়ন এখন যুগের চাহিদা।
কিন্তু বিভাষা শিক্ষার উন্নত অবকা?ামো আমাদের †দশে †নই। এমনকি আমাদের †কান বিভাষা নীতিও †নই। অথচ বিদেশের সাথে অর্থনৈতিক, বানিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক বিনিময় বৃদ্ধির জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন একটি সুষ্?ু বিভাষা নীতির। যুগপযোগী বিভাষা নীতির আলোকে বিভাষা শিক্ষা অবকা?ামো তৈরী করা সম্ভব হলে এদেশের মানুষ প্রয়োজন অনুসারে বিভাষা শিক্ষার সুযোগ পাবে। ফলশ্র“তিতে এদেশের একজন নাগরিক †যমন বহির্বিশ্বে ভাষাগত প্রতিবন্ধকতা এড়িয়ে নিজের লক্ষ্য অর্জনে সফলকাম হবে, †তমনি বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিও উজ্জ্বল করতে পারবে। তবে বিভাষা শিক্ষার পরিস্থিতির এই ইতিবাচক পরিবর্তন আসতে হবে জাতীয় শিক্ষা নীতির আলোকে।