আমার পাশে বসে একজন খুব মনযোগ দিয়ে নাক খুঁটছে। মনে হচ্ছে সে খুবই আরাম পাচ্ছে। প্রতিবার নাক থেকে আঙুল বের করে আগ্রহের সহিত দেখছে নাক থেকে কি বের হল। আমার ধারনা কিছুক্ষনের মধ্যে নাক দিয়ে সোনা রূপা বের হয়ে আসবে। নইলে এমন যত্ন করে নাক খোঁটার দরকার তো দেখি না। আমি খুব আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছি সোনা রূপা বের হয়ে আসা দেখার জন্য।
সিটিবাস খুব আজব এক বস্তু। শহরের যত কিসিমের মানুষ আছে সব এক সাথে বয়ে নিয়ে যায়। চোর, স্টুডেন্ট, ডাকাত, ছা পোষা কেরাণি, ভাড়াটে খুনি, ভাড়াটে মেয়ে মানুষ কিংবা আমার মত মানুষ।
আমার পাশের সারিতে দুইজন প্রেমিক যুগল বসে আছে। মেয়েটা ছেলেটার কাঁধে মাথা দিয়ে বসে আছে। জানালা থেকে বাতাস ঢুকে মেয়েটার চুল হালকা এলমেলো করে দিচ্ছে। দেখতে খুব ভাল লাগছে। মেয়েটা টিপ পরে নি। তার উচিত ছিল টিপ পরা। টিপ পরলে যে তাকে খুব সুন্দর লাগবে এ কথা কি সে জানে? হয়তো জানে না। জানলে টিপ পরতো। মেয়েরা সব সময় চায় তাকে খুব সুন্দর দেখাক,তার দিকে পুরুষরা মুগ্ধ চোখে চেয়ে থাক। শুধু এক পুরুষ তার পাশে থাক আর বাকিরা দূর থেকে দেখুক। দীর্ঘশ্বাসে আশেপাশের আকাশ বাতাস ভারী হোক।
দীর্ঘশ্বাস বলতে মনে পড়লো আমার ও একটা পরিচিত দীর্ঘশ্বাস ছিল। সব চেয়ে ভাল মনে পরে সেই দীর্ঘশ্বাস যখন আমি শেষবার শুনছিলাম।
- তো আমি চলে যাচ্ছি।
- কোথায় যাচ্ছ?
- তোমার থেকে দূরে।
- স্বর্গপূর?
- হয়তো।
- নরকপুর হলে কে বাঁচাবে?
- বাঁচতে হবে কেন? মরেই না হয় যাব। কার কি এসে যায়?
- কারো কিছু এসে গেলে কি তবে যাবে না?
- জানি না শুভ্র।
- তবে আর জানার চেষ্টা করিও না। পিছনে ফিরে তাকিও না। পিছনে অনেক কষ্ট।বিদায়।
- একা ফেলে যাচ্ছি অভিশাপ দিবে না?
- অবশ্যই দিব। তুমি সারাজিবন ভাল থেকো। এটাই তোমার জন্য অভিশাপ।
তিশা আমার অভিশাপ শুনে সেদিন দীর্ঘশ্বাস দিয়েছিল। শেষবারের মত। হয়তো এই ভেবে দীর্ঘশ্বাস দিয়েছিল যে আমি ঠিক ভাবে অভিশাপটুকু ও দিতে শিখলাম না। কিন্তু যাকে ভালবেসেছি তাকে এর চেয়ে বড় অভিশাপ আমি আর কী দিতে পারি?
আমার সিটিবাস থেমে গেছে। আমি আমার পোর্টফলিও ব্যাগ আর বাজারের ব্যাগ হাতে নিয়ে নেমে গেলাম। বাস আর যাবে না। বাস এখানেই থেমে থাকবে। কিন্তু জীবন তো থেমে থাকে না। জীবন চলতে থাকে। আমার অনেক কিছু করা বাকি। বাসায় ঢুকতেই যে মেয়েটা হাসি দিয়ে আমার হাতের ব্যাগ নিবে,ফ্যান ছেড়ে দিবে। আমি ঠিক মত বাড়ী ফিরেছি দেখে তার চোখ যে ভাবে চকচক করবে আমাকে সব কিছু মুগ্ধভাবে দেখতে হবে। আবার এই মুগ্ধতা যত্ন করে লুকিয়ে রাখতে হবে। কারন আমি চাই না আমার জন্য প্রতিটা দিন অপেক্ষা করে থাকা এই মেয়েটা আর কারো মত দূরে চলে যাক। আমি চাই সে থাকুক। ঘুমানোর সময় আমার পাশে থাকুক। বাসা ফিরতে দেরী হলে সে উদ্বিগ্ন হোক। অবশেষে ফিরে এলে জড়িয়ে ধরুক। আমার শুধু একটাই ভয়। যখন সে জড়িয়ে ধরবে তখন কেঁদে ফেলবো না তো? এমন করে তো কেউ আমাকে কখনো জড়িয়ে ধরে নি।