somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গরিবের ডাক্তার জাফরুল্লাহ্ সময়ের চেয়ে অগ্রবর্তী মানুষ ছিলেন। শ্রদ্ধাঞ্জলি।

০৫ ই জানুয়ারি, ২০২৫ রাত ২:১০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



“যুগে যুগে জড় জীব সবে পড়ে রবে নিবিড় অবেলায়
ধুলি ধূসর পদচিহ্ন আঁকা মরুর বালুকায়
”- নিজ জয়গায় গেয়ে গেছেন ডা জাফরুল্লাহ স্যার। অবিভক্ত বাংলার ভাসানী থেকে ডা জাফরুল্লাহ, এমন কিছু মানুষ মুষ্টিবদ্ধ লড়ে গেছেন আমরণ। সেই সব মহামানবদের একজন ডা জাফরুল্লাহ । ২৭ ডিসেম্বর লড়াকু মানুষ জন্মে ছিলেন ।তৈলবাজি বুদ্ধিজীবীদের মত জীবন ধারণ করেন নি । public intellectual নোয়াম চমস্কি থেকে ইউনূস , এসবের মাঝেও ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা,চিকিৎসক,গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা জাফরুল্লাহ চৌধুরি। জীবনের বাকে বাকে ঘটে যাওয়া ঘটনা প্রবাহ নিয়েই আজকের আয়োজন।

'দেশের সাধারণ মানুষ কিডনি ট্রান্সপ্লান্টের সুযোগ পাবে না, আর আমি আমেরিকা থেকে করে আসব বা দেশে মিথ্যা কথা বলে করতে হবে, তা হয় না। আমি ট্রান্সপ্লান্ট করব না। ডায়ালাইসিস করব, যে সেবা গরিব মানুষকেও দিতে পারব।'

কভিডের থাবার দেশ প্রায় অচল। তখনও বীরদর্পে
দাপিয়ে বেরিয়েছেন শহরে অলি থেকে গলিতে। যেখানেই যে ডাক দিয়েছিলেন,সেখানেই উপস্থিতির জানান দিয়েছেন,চেয়েছিলেন স্বৈরাচার(হাসিনার) পতন।গণতন্ত্র আজ কবরে, মাটি দেয়ার অপেক্ষায়, ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরী স্বৈরাচার এরশাদ ঘনিষ্ঠও ছিলেন তিনি। কেন,কিভাবে সে আলোচনা একটু পরে করছি।

একদিন একজন প্রশ্ন করেছিলেন ‘স্যার আপনার শরীরের যে অবস্থা আপনি যেতে পারবেন? তিনি অবলীলায় বলেছিলেন-তোমরা যদি দুই আমাকে ধরে উঠাতে পারো ,আর হুইল চেয়ার যেতে পারে,তাহলে আমি অবশ্যই যাব। আলোচিত মহিউদ্দিন রনি যখন রেল সংস্কার নিয়ে মাঠে উত্তাপ ছড়াচ্ছিলেন তখন তেমন কেউ পাশে না পেলেও পাশে পেয়ে ছিলেন ডা। জাফরুল্লাহ্ স্যারকে। কোটা বিরোধী আন্দোলনেও ছিলেন বড় সমর্থক। নিরাপথ সড়ক আন্দোলনেরও সমর্থন জানিয়ে ছিলেন।সরাসরি কোনো রাজনৈতিক দলে যুক্ত না হলেও আজীবন বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় সক্রিয় ছিলেন ডা. জাফরুল্লাহ। গণমুখী বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে তিনি সংহতি-সমর্থন দিয়ে গেছেন। জাতীয় জীবনে অবদান রাখার জন্য ১৯৭৭ সালেই স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন তিনি।

ডায়ালাইসিস মিস করেও তিনি বিভিন্ন সভা,সেমিনার করতেন। কারণ একটাই গণতান্ত্রিক পরিবর্তন চাইতেন। না তাকে রাজনৈতিক মাঠ কাঠিতে মাপলে আপনি ভুল করবেন। তবে উনার চাওয়া,চেষ্টা নিয়ে কোন খাদ পাবেন না । সাপ্তাহে ২ বার ডায়ালাইসিস করেও তিনি কভিট সংকট নিয়ে কাজ করেছিলেন। এমন কি করোনা ভাইরাস শনাক্তের কিট উৎপাদন শুরু করিয়েছিলেন তিনি। কভিট সংক্রমণ হয়েও তিনি মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসছিলেন আমাদের মাঝে। তবে তিনি থেমে যান, তবে মৃত্যুর থাবা এড়ানোর সাধ্য কি কারও আছে? তাই ১১ এপ্রিল চলে গেলেন আমাদের ছেড়ে।
মৃত্যুর আগে বলেছিলেন -
আমাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিবে না , গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রেই আমার চিকিৎসা করাবে।

যুক্তি হিসাবে দেখিয়েছিলেন, এই মাটির সন্তান আমি ,এখানেই আমার চিকিৎসা হবে।আমার প্রতিষ্ঠিত হাসপাতালে আমি চিকিৎসা না নিলে ,গরিব মানুষ কিভাবে চিকিৎসায় বিশ্বাস রাখবে?

কিডনি প্রতিস্থাপন নিয়ে বিদেশ বহু সংস্থা প্রস্তাব করেছিলেন, তিনি রাজি তো হননি,বরং রাগ করেছিলেন। বলেছিলেন-
'দেশের সাধারণ মানুষ কিডনি ট্রান্সপ্লান্টের সুযোগ পাবে না, আর আমি আমেরিকা থেকে করে আসব বা দেশে মিথ্যা কথা বলে করতে হবে, তা হয় না। আমি ট্রান্সপ্লান্ট করব না। ডায়ালাইসিস করব, যে সেবা গরিব মানুষকেও দিতে পারব।'


তিনি চেয়েছিলেন দেশের স্বাস্থ্য সেবা জাতীয়করণ করতে,গরিব-মেহনতি মানুষের কাছে রাষ্ট্রীয় সেবা পৌঁছে দিতে। সে কি আর সম্ভব রাজনীতি না করলে। তবে করেছেন সাধ্য মত, যার সুফল আজও এই দেশের মানুষ পাচ্ছে। বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতির তথ্য অনুযায়ী, দেশীয় চাহিদার ৯৮ শতাংশ মেটানোর পর ইউরোপীয় ইউনিয়ন, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকাসহ অন্তত ১৫১টি দেশে ওষুধ রপ্তানি করে বাংলাদেশ।

সময়কাল স্বাধীনতা পরিবর্তী সময়ে জিয়াউর রহমানের কাছে গেলেন ‘জাতীয় ওষুধ নীতি’ প্রণয়নের জন্য। জিয়ার প্রস্তাব স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ে যোগ দিন,সব নিজের মত করে নিয়েন। অনেকটা রাজিও হয়েছিলেন। পরে স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ে যুদ্ধাপরাধী থাকার কারণে তিনি নীতির সাথে আপোষ না করে ,জিয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখান করেন। আসলো এরশাদ। এরশাদ বিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে। তিনি তখন এরশাদ ঘনিষ্ঠ। স্বার্থের কারণে , হ্যাঁ সেই স্বার্থ দেশের স্বার্থ, জনস্বার্থ। তিনি চাচ্ছিলেন এরশাদ কে দিয়ে জাতীয় ওষুধ নীতিটা করিয়ে নিতে। দেশীয় ব্যবসায়ী সমাজ,তেলবাজ বুদ্ধিজীবী ,আর্ন্তজাতিক কোম্পানীর প্রতিনিধি,এরশাদ এবং জাফরুল্লাহ্ স্যার অল্প কয়েকজনকে নিয়ে বৈঠকে বসলেন। কোনভাবেই বোঝাতে পারছিলেন না এরশাদকে। চুর্তুমুখী বির্তক চলমান। তখন বললেন আপনি যে ,আপনার চোখের কারণে যে ওষুধ খান তা ক্ষতিকর,ব্যয়বহুল , ব্যাগ থেকে বই বের করে দেখালেন। বইটি ছিলো বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার। বইটি তিনি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার লাইব্রেরিতে এক বসাতে পড়ে ছিলেন।বই আনার অনুমতি ছিলো না । এমন কি মূল্যাবান বইটি বিশ্বাবাজারেও অঘোষিত নিষিদ্ধ ছিলো। কেননা বইটিতে উন্নয়নশীল দেশের জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধের নাম লিপিবদ্ধ ছিলো। যা মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানি গুলোর ব্যবসায়ীক স্বার্থ পরিপন্থি । তাই বইটি আলোর মুখ দেখেনি। এই বই থেকে জাতীয় ওষুধ নীতি প্রণয়ন হয়। যা হোক--ব্যাখাসহ,রেফারেন্স পেয়ে এরশাদ রাজি হয়। গৃহীত হয় প্রস্তাব। এখন বাংলাদেশ শতাধিক দেশে ওষুধ রপ্তানিও করে।তিনি ছিলেন বর্তমান সময়ের চেয়েও অগ্রসর একজন মানুষ। বাংলাদেশ সময়ের চেয়ে অগ্রসর মানুষ খুব একটা পাইনি।

এছাড়াও নানান লড়াকু লড়াইয়ে ভরপুর এই কার্তীমানের জীবন। লন্ডন থাকাকালীন পরিক্ষা না দিয়ে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠন করেন,প্রতিবাদ স্বরুপ নিজ পাসপোর্ট প্রকাশ্যে (জনসভায়) ছিঁয়ে ফেলে পাকিস্থানি নাগরিকত্ব বর্জন করেন। ছাত্র জীবনে নিজ কলেজের দুর্নীতির জন্য সংবাদ সম্মালেন করে আলোচিত হন। লন্ডন থেকে কলকাতায় বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। এটিই বাংলাদেশের প্রথম হাসপাতাল। পরে এই নামে হাসপাতাল করার চেষ্টা করলে,বাংলাদেশ নাম থাকায় শেখ মুজিব আপত্তি জানাই । তারপর দুইজন মিলে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র নাম ঠিক করেন। বলে রাখা ভালো- শেখ মুজিব ও জাফরুল্লাহ্ স্যারের মাঝে তুই তুকারি সম্পর্ক। বন্ধুর মতো। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর সর্বাধিনায়ক কর্নেল আতাউল গণি উসমানি বহনকারী বিমানের সহযাত্রী ছিলেন। উল্লেখ্য উক্ত বিমানটি হামলার শিকার হয়েছিলো।

ডা. জাফরুল্লাহর জীবনের একটি ঘটনা নিয়েই বিখ্যাত পরিচালক আলমগীর কবির নির্মাণ করেছিলেন ‘মোহনা’। ১৯৮২ সালে মুক্তি পাওয়া ছবিটিতে অভিনয় করেছেন বুলবুল আহমেদ, জয়শ্রী, অঞ্জনা সুলতানা, ইলিয়াস কাঞ্চন, সাইফুদ্দিন, প্রবীর মিত্র, আহমেদ শরীফ প্রমুখ।এভাবে কিছু মহান নিজ জীবন কে মহিয়ান করে যান। সেই সব মানুষদের মাঝে জাফরুল্লাহ্ স্যার অমলিন থাকুক আমাদের মাঝে । জাফরুল্লাহ চৌধুরী’র প্রতি রইলো শ্রদ্ধাঞ্জলি। উনার আত্মার মাগফেরাত কামনা করি । এমন মানুষদের অবশ্যই আমরা স্বরণ করবো । তারাই জাতীয় বুদ্ধিজীবীদের একজন।

'মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন'। লেখার পরও যারা মন্তব্য করে ভালোবাসা দেখিয়েছেন। তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। অনেক বেশি ভালো থাকুন।

সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জানুয়ারি, ২০২৫ সকাল ১০:৩৭
১০টি মন্তব্য ৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হাসনাতের বয়ানে সেনাবাহিনীর প্রস্তাব নিয়ে উত্তপ্ত রাজনীতি, সেনা সদরের অস্বীকার

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৪ শে মার্চ, ২০২৫ দুপুর ১:০১

হাসনাতের বয়ানে সেনাবাহিনীর প্রস্তাব নিয়ে উত্তপ্ত রাজনীতি, সেনা সদরের অস্বীকার

ছবি: অন্তর্জাল থেকে সংগৃহিত।

জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহ সম্প্রতি দাবি করেছেন যে, সেনাবাহিনী আওয়ামী লীগের একটি 'সংশোধিত' অংশকে রাজনৈতিকভাবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

তবু তো ফাল্গুন রাতে এ গানের বেদনাতে আঁখি তব ছলছলো....আমার দুঃখভোলা গানগুলিরে ......

লিখেছেন ইন্দ্রনীলা, ২৪ শে মার্চ, ২০২৫ বিকাল ৩:০৫



মাঝে মাঝে আমার বুকের গহীনে এক ব্যথার নদী উথলে ওঠে। উথাল পাথাল ঢেউগুলো পাড়ে এসে আছড়ে পড়ে। উত্তাল বেগে ধেয়ে এসে ভেঙ্গে খান খান হয়ে পড়ে বুকের মাঝে... ...বাকিটুকু পড়ুন

"বিস্মৃতি"

লিখেছেন দি এমপেরর, ২৪ শে মার্চ, ২০২৫ বিকাল ৪:৫৫


সে যে আজ কোথা হারিয়ে গিয়েছে, আঁধার ছেয়েছে ঘনঘোর কালো;
চাঁদ নেই তারকারাজিও উধাও, নেই জ্বলে কোথা টিমটিমে আলো!
সে যে জানে শত হৃদয়ের কথা, মায়াজালে ঘেরা হাজার স্মৃতি!
কত... ...বাকিটুকু পড়ুন

মাথা হালকা পোষ্ট!

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৪ শে মার্চ, ২০২৫ রাত ৮:০৭

অবিশ্বাস্য হলেও লেকটির অবস্থান খোদ ঢাকায়; কেউ কি এর লোকেশন বলতে পারেন?



কাটা তরমুজের ছবিটা দেবার বিশেষ মাজেজা আছে;
উটিউবে একজন কামেল বুজুর্গান পাকা সূমিষ্ট তরমুজ কেনার... ...বাকিটুকু পড়ুন

এলার্ট : শেখ হাসিনা আজ রাতে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে যাচ্ছেন !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ২৪ শে মার্চ, ২০২৫ রাত ৮:৪৭


বাংলাদেশের মানুষ কল্পনা করতে খুব ভালোবাসে। গুজব ও অপতথ্য শেয়ারে বাংলাদেশের মানুষ প্রথমদিকে থাকবে বলে অনেকের বিশ্বাস । দেশের মানুষের পাঠ্যবই ছাড়া অন্য কোনো বইয়ের প্রতি আগ্রহ নেই। আত্নউন্নয়ন মূলক... ...বাকিটুকু পড়ুন

×