ফলাফল ঘোষণার পর দেখা গেল আমি মোট ৫ বিষয়ে লেটার পেয়ে এসএসসি পাশ করেছি। তার মধ্যে আবার অংকে ৯৫! ‘এইটা কীভাবে সম্ভব?’ - শুধু এই ক্ষোভে আমার বেশ ক’জন ছোটবেলার বন্ধু আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিলো। কী যে অপরাধবোধ লাগছিলো নিজের কাছে? পাঁচ বিষয়ে লেটারের দরকারটা কী ছিলো? তার চেয়ে বন্ধুইতো ভাল!
তারপর এইচএসসি’তে ফলাফলের পতন হলো। প্রথম বিভাগে পাশ করলেও যেহেতু মাত্র দুইটাতে লেটার পেলাম, অতএব এবার পরিবারের সবাই বিরাট মন খারাপ করলো। সবাই এই সিদ্ধান্তে উপণীত হল যে, ‘আমি শেষ’! তারপর ‘পয়েন্ট শূণ্য তিনে’র ব্যবধানে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কমার্স ফ্যাকাল্টিতে চান্স পেলামনা, ততক্ষণে আমি বুঝলাম যে, আমার পায়ের নিচের সব মাটি মোটামুটি নাড়াচাড়া করতেছে, এবং আমি অবশ্যই শেষ….!
এই খারাপ রেজাল্টটা অব্যাহত রাখলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম সেমেস্টারে দুই বিষয়ে ‘এফ গ্রেড’ পেয়ে দ্বিতীয় সেমেস্টারে ওঠলাম। তবে শেষমেষ এই রেজাল্টের প্রভূত উন্নতি হয়েছে এবং অনার্সের শেষে দেখা গেল সিজিপিএ ৩ এর বেশ ওপরে। মাস্টার্সে আরো ভালো রেজাল্ট! কেমনে কী হলো, সেই প্রসঙ্গে না যাই! ভেবে দেখলাম, বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি যে কাজটা কদাচিৎ করেছি সেটা হলো ‘পড়ালেখা’!
কর্মজীবনে এসে দেখলাম, পড়ালেখাটা আরেকটু করলে খারাপ হতোনা! তবে না করেও যে খুব খারাপ করেছি তাও ঠিকনা। এই যেমন অনেক অনেক জায়গায় আমি অনেক ‘প্রথম হওয়াদের’ থেকে সুনির্দিষ্ট পয়েন্টে এগিয়ে আছি। এরা বোঝে কম, শুধু পেঁচায় আর অবশ্যই মাথা মোটা! (সবাই না) এবং এই সিদ্ধান্তে উপণীত হতে খুব বেশি সময় লাগলোনা যে, প্রথম/দ্বিতীয় হওয়াই জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত নয়, এর মধ্যে জীবনের একমাত্র সফলতাও লুকিয়ে নেই; বরং সামাজিকীকরণ (তখন ফেসবুক ছিলনা), সংগঠনের সাথে যুক্ত হওয়া, ডিবেট, রাজনীতি, ‘আউট বই’ পড়া, পত্রিকার প্রথম লাইন থেকে শেষ লাইন খুটিয়ে খুটিয়ে শেষ করা, দুনিয়ার সব ম্যাগাজিনের খবরাখবর, লিটল ম্যাগ করা, আঁকাআঁকি, আড্ডাবাজিও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়! আর কোন একটা কাজকে প্রচন্ড ভালবাসলে সফলতা অবধারিত।
আজ খানিক বাদে এসএসসি’র রেজাল্ট বেরুবে। আমি দিব্যমনে পিঠের ওপরে পড়া কিল-ঘুষির আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি। ‘মা মা আমি জিপিএ ‘ফাইভ’ পাইছি’ - কেন বলতে পারলোনা, এই হল কিল-ঘুষির মূল কারণ! ওরা কী করবে? প্রশ্ন আউট না হলে পরীক্ষা যে ভাল হয়না! তাদের জন্য আমার শুভকামনা। আমি তাদেরকে নিশ্চিত করতে চাই যে, ওরা যারা জিপিএ ফাইভ পাবেনা অথবা ব্যাকবেঞ্চার, জীবনের বিরাট সফলতা ওদের জন্য অপেক্ষা করছে।
তাদের অনুপ্রেরণার জন্য সারা পৃথিবীজুড়ে নানা জ্ঞানীগুনী আর সফলরা তো অপেক্ষা করেই আছে! রবীন্দ্রনাথের কীর্তি আমাদের জানা, নজরুলের কথা বলে মন খারাপ করে দিতে চাইনা। স্টিভ জবস বলে গেছেন, ‘আাজই যদি তোমার জীবনের শেষ দিন হয়, তাহলে তোমার জীবনে যা যা করার কথা ছিল, তা কী এই একদিনের মধ্যে শেষ করতে পারবে’?? কেমনে সম্ভব? তো? অযথা সময় নষ্ট করার কোন দরকার নাই। বরং মন যা চায় তাই করা উত্তম!
যারা প্রথম হয়, তাদের জীবনের লক্ষ্য স্থির হয়ে যায়। এরা প্রায় সকলে শিক্ষক হতে চায়। এক ব্যাচ থেকে শিক্ষকতো একজন হতে পারবে? কখনো কখনো তাও নয়! তো উপায়? অতএব নিজেদের মধ্যে কাদা ছোড়াছুড়ি। আর যারা পেছনের সারির, এদের জন্য সারা পুথিবীর অবারিত দুয়ার খোলা!
তো ব্যাকবেঞ্চারের দল? ওয়েলকাম ওন বোর্ড!!! জ্ঞানের অবারিত সমুদ্রে তোমাদেরকে স্বাগতম!