জসিম বিয়ে করেছে পাঁচ বছর গত হয়েছে। তার স্ত্রীর নাম রাবেয়া। তাদের দাম্পত্য জীবন সুখেই যাচ্ছে। শুধু একটি বড় অসুখ প্রতিনিয়ত তাদের ঠুকরে ঠুকরে খাচ্ছে। সেটা হলো, অনেক চেষ্টার পরও তারা একটি সন্তানের মুখ দেখতে পারলো না। ডাক্তার কবিরাজ কম দেখাননি কিছুতে কিছুই হলো না। এক পর্যায়ে তারা আশা ছেড়ে দিলো। জসিমের মা-বাবা বিয়ের আগেই গত হয়েছে তাই সংসারে খোটা দেয়ার কেউ নাই রাবেয়ার। কিন্তু পড়শিরা তাকে আড়ালে আড়ালে বন্ধ্যা বলে। সেটা সে জানে। জেনে আর কি করবে? ঝগড়া করে কয়জনের মুখ বন্ধ করা যাবে। তাই নিরবে সে সবকিছু সহ্য করে নেয়। জসিম রাবেয়াকে অনেক ভালোবাসে আর তার মনের ব্যাথাটাও বুঝে তাই কোন সময় কিছুই বলে না। নিজের কষ্টটাও রাবেয়াকে বুঝতে দেয় না। কিন্তু রাবেয়া খুব ভালো করেই বোঝে জসিমের কি কষ্ট।
জসিমের অনেক ধানি জমি আছে। সে বাড়িতেই থাকে আর কৃষি কাজ করে। অনেক ইচ্ছা ছিল লেখাপড়া করবে কিন্তু তা আর হয়নি। একদিন দুপুরবেলা জসিম ক্ষেত থেকে বাড়ি আসলে রাবেয়া হাসতে হাসতে জসিমের কাছে গিয়ে বলল,
-একটা সু-খবর আছে।
জসিমের বুকটা মোচর দিয়ে উঠলো। কারণ, শেষ কবে সুখবরের কথা জসিম শুনেছে সেটা তার মনে নেই। খুব আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞাস করলো,
-কি সুখবর? দেরি কইরো না জলদি কও দেরি সয় না।
কাপড়ের আচলটা হাতে নিয়ে মোচড়াতে মোচড়াতে মাথা নিচু করে হাসি মুখে রাবেয়া বলল,
-তুমি বাবা হতে চলেছ!
কথাটি শুনে মাত্রাতিরিক্ত আনন্দে জসিম অজ্ঞান হয়ে গেল। জসিমকে ধরে রাবেয়া খাটে শুইয়ে দিলো। দৌড়ে গিয়ে পানি নিয়ে আসলো। তারপর পানি ছিটিয়ে দিল মুখে। ক্ষানিক সময় পর জসিমের জ্ঞান ফিরলো। সেদিন দশ কেজি মিষ্টি কিনে জসিম সবাইকে খাইয়েছিল।
নয়মাস পর তার ঘরে আল্লাহ আকাশের চাঁদ এনে দিলো। জসিমের ছেলে সন্তান হলো। ছেলের নাম জসিম নিজেই রাখল। ছেলের নাম রাখল "মানিক"। নামের মানে হলো, এই ছলে তার কাছে সাত রাজার ধন মানিক।
ছেলে হওয়ার পর জসিম অনেক বড় অনুষ্ঠান করলো। গরু জবাই করে গ্রামের সকল মানুষকে খাইয়েছিল।
দিন আর দিন মানিক বড় হতে থাকলো। দেখতে অনেক সুন্দর হয়েছে মানিক। আর তাই বাবা-মায়ের আদরের সাথে সাথে পড়শিরাও তাকে খুব ভালোবাসে আদর করে।
এস এস সি ও এইচ এস সি পরিক্ষায় জিপিএ ৫ পেয়ে সে উর্ত্তীণ হয়। খুব আশা নিয়ে ঢাকা ভার্সিটিতে পরিক্ষা দেয় ভর্তি হওয়ার জন্য। কিন্তু ঢাকা ভার্সিটিতে তার পড়ার সুযোগ হয়না। এক বছর গ্যাপ দিয়ে ভর্তি হয় জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। আইন বিভাগে পড়া শুরু করে মানিক৷ অনেক বড় স্বপ্ন তার।অনেক বড় হবে একদিন। বাবা মায়ের মনের সমস্ত দুঃখ মুছে দিয়ে এনে দিবে শান্তির পৃথিবী।
এরই ফাঁকে একটি মেয়েকে ভালোবেসে ফেলেছে মানিক। মেয়েটিও তাকে খুব ভালোবাসে।
আজহার আলীর এক ছেলে আর এক মেয়ে নিয়ে সুখের সংসার। মেয়েটির নাম মুনিয়া আর ছেলেটির নাম মুহিত। মুনিয়া ৭ম শ্রেণির ছাত্রী আর মুহিত ৩য় শ্রেণীতে পড়ে। আজহার আলীর স্ত্রীর নাম শর্মিলা। দুজন দুজনকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিল। শর্মিলা দেখতে খুব সুন্দরী। টানা টানা তার চোখ দুটো বড়ই মায়াবী। ঠোঁটের বাম পাশে গালে একটি তিল আছে তার। তিলটি তার সৌন্দর্য আরো দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। হাসলে গালে টোল পরে শর্মিলার। বাবা মায়ের খুব আদরের মেয়ে শর্মিলা।
বাবা মায়ের বড় ছেলে আজহার আলী। তার এক ছোট বোন আছে। বিয়ে হয়ে গেছে। বউ ছেলে মেয়ে নিয়ে ঢাকার মিরপুরে থাকে আজহার। নিজের সংসার ও বাবা মায়ের সব দ্বায়িত্ব তার উপর। তার দিন খুব ভালোই কাটছিল। সে গাড়ি চালকের কাজ করে। লোকাল বাসের ড্রাইভার। প্রতিদিন খুব সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে আজহার। অফিস ডিউটির ট্রিপ ধরে সে। এই সময় বাড়তি ইনকাম একটু বেশি হয়। তবে গাড়ী চালাতে হয় প্রতিযোগিতায়। লাইনের অন্য বাসগুলোকে পিছনে ফেললে লোক বেশি পাওয়া যায়।
আজও খুব সকাল সকাল উঠছে সে। শর্মিলাকে শুধু বলে গেছে উঠে দরজা লাগিয়ে দেয়ার জন্য। আজহার প্রতিদিন সকালের নাশতা ও দুপুরের খাবার বাহিরেই করে। শুধু রাতে বাসায় খাওয়া দাওয়া করে। গত রাতে খাওয়ার সময় মুহিত তার বাবার কাছে একটি সাইকেলের আবদার করেছিল। সেটা সে আজ বাসায় ফেরার সময় কিনে নিবে বলে মুহিতিকে কথা দিয়েছে।
রাস্তাঘাটে স্টুডেন্টদের জন্য তার খুব খারাপ লাগে। বেশি স্টুডেন্ট উঠলেই ইনকাম কিছু কম হয়। কারণ, তারা হাফ ভাড়া দেয়। আজহার গাড়ি চাল্লাচ্ছে। হেলপার গেইটে দাঁড়িয়ে তাকে সহযোগিতা করছে। লোক উঠা নামানো করছে।
-ওস্তাদ সামনে স্টুডেন্ট গারী জোরে চালান। ওস্তাদ বায়ে লন সামনেরটারে পিছে ফালান।
এই কথা বলতে বলতে হেলপার হাত দিয়ে গাড়ীতে শব্দ করে জোরে চালানোর সংকেত দিয়ে যাচ্ছে। আজহার গাড়ীটি বামে নিয়ে সামনের গাড়ীটিকে ওভারটেক করতে গেল ঠিক এই সময় সে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে চাপা দিল এক ছাত্রকে। সাথে সাথে রক্তে লাল হয়ে গেল রাস্তা এবং তাৎক্ষণিক আজহার আর তার হেলপার গাড়ি রেখে পালিয়ে গেল।
যে ছেলেটি এক্সিডেন্ট হলো সে আর কেউ নয় সে ছেলেটি তার বাবা মায়ের সাত রাজার ধন মানিক। সাথে সাথে তার সহপাঠীরা রাস্তা অবোরোধ করলো। শুরু হলো আন্দোলন। মিডিয়াগুলো নিমিষেই সারা দেশে খবর পৌছে দিলো। মানিকের মা বাবার জানতে দেরি হলো না এই সর্বনাশা খবরটি। খবর শুনেই মানিকের মা অজ্ঞান হয়ে গেল। মানিকের বাবা পাগলের মত আবোলতাবোল বলে যাচ্ছে, "না না আমি বিশ্বাস করিনা। এটা ভুল বলতেছে। মানিক মানিক বাবা তুই বাড়ি চলে আয়। ও মানিক মানিক কই বাবা তুই। আমি তোকে ডাকতেছি। তোর মা ঘুমিয়ে গেছে বাবা তারাতাড়ি চলে আয়। তোর মায়ের ঘুম ভাঙাতে হবে।" মোবাইল কানের কাছে ধরে এভাবে বলে যাচ্ছে। পাশের স্বজনেরা নিরবে কেঁদে যাচ্ছে তাদের প্রলাপ দেখে। সাথে সাথে তাদের নিয়ে ঢাকা চলে আসলো মানিকের মামা।
মানিকের মা কিছুতেই বিশ্বাস করছে না তার ছেলের এক্সিডেন্টের কথা। মানিকের মায়ের দুঃখের প্রলাপ, "আমার বাবা কই? মানিক বাবা আমি ডাকতেছি তোরে। বাবা আমার বুকে আয় বাবা। আমার সাত রাজার ধন কই বাবা তুই। ও মানিক মানিক বাবা আমার ও বাবা। আমার বাবারে আমার ধারে আইন্না দাও। ও মানিকের বাপ পোলারে কওনা কেন তোর মায়ে ডাকতাছে। ওই তো মানিক, ও মানিক বাবা কই যাও তুই।" পাগলের মত প্রলাপ করতেছে মানিকের মা আর ক্ষণে ক্ষণে অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে। তাকে হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।
মানিকের ভালোবাসার মেয়েটি একটি ভাঙা বুক নিয়ে শুধুই নিরবে অশ্রু বিসর্জন দিয়ে যাচ্ছে। মুখ খুলে কাউকেই বলতে পারছে না। নিরবে বেশিক্ষণ কাঁদতে পারলোনা মেয়েটি। বুকের ব্যাথাটা একটু হালকা করতে জোরে জোরে কান্না করা শুরু করে দিলো নিজের রুমটি আটকিয়ে।
এদিকে আজহারকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। তার নামে মামলা হয়েছে৷ তাকে রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। আদালত তাকে ১২ বছরের সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত করেছে। শর্মিলা ছেলে মেয়ে দুটি নিয়ে অসহায় হয়ে গেল। কাজের সন্ধানে ঘুরেছে বহু দ্বারে। কাজের পরিবর্তে পেয়েছে মানুষের লোভী আচরণ। মুনিয়ার আর লেখাপড়া হলোনা। সে মানুষের বাসায় কাজ করে এখন।মুহিতের নতুন সাইকেল চালানো আর হলোনা সে এখন পায়ে হেটে হেটে রাস্তায় কাগজ টোকায়। শর্মিলা অভাবের কাছে হারিয়েছে তার সর্বস্ব। সেও মানুষের বাসায় কাজ করে সাথে সাথে কিছু খারাপ পুরুষের সাথে তার গড়ে উঠেছে অনৈতিক সম্পর্ক। আর আজহারের মা বাবা ভিক্ষা করে সংসার চালাচ্ছে এখন।
এভাবেই এক একটি দূর্ঘটনা হাজারো পরিবাবের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ বয়ে আনে। আমরা সবাই একটু সচেতন হলেই পারি এ ধরনের দূর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা পেতে। নিয়ম মেনে গাড়ি চালানো উচিৎ প্রতিটি চালককে। আমরা পথচারীরা একটু সতর্ক হয়ে পথ চলি! ফিটনেস বিহীন গাড়ির পারমিট দেয়া থেকে বিরত থাকা উচিৎ কর্তৃপক্ষকে। বিআরটি-এর উচিৎ সঠিক পথ অবলম্বন করে লাইসেন্স প্রদান করা।