-হ্যালো।
-শুভ সকাল। কেমন আছ?
-আমি ভালো আছি। কিন্তু আপনি যার কথা জানতে চাচ্ছেন সে ভালো নাই।
-কে আপনি? আর কিনক কোথায়? কেন কিনক ভালো নাই?
-আমি ওসি কামরুজ্জামান।
-কিনক কোথায়?
-ও আমাদের হেফাজতে আছে। কিন্তু আপনি কে?
-আমি জ্যোতি। কিনকের ফ্রেন্ড। কিনক কি করেছে? ওকে থানায় কেন নিয়েছেন?
-সেলোয়ার কামিজ চুরি করেছে।
-কি আবোলতাবোল বলছেন?
-আবোলতাবোল বলছি না। সত্যি বলছি। সে সেলোয়ার কামিজ চুরি করেছে। এই সেলোয়ার কামিজের ভিতর ছিল আস্ত একটা মেয়ে। যার নাম সনি।
-আপনারা মিথ্যা বলছেন। ও এ কাজ করতে পারে না। প্লিজ ওকে ছেড়ে দিন।
-আপনার থেকে শুনতে হবে না ওকে কি করবো। সময়ই বলে দেবে ওকে কি করবো।
এই কথা বলে ওসি ফোন রেখে দিল।
জ্যোতি চিন্তায় অস্থির হয়ে গেল। জ্যোতি ভালো করেই জানে এ কাজ কিনক কিছুতেই করতে পারে না। তার উপর মিথ্যা অপবাদ দেয়া হচ্ছে। সনি নামের মেয়েটির সাথে কিনকের ভালোবাসার সম্পর্ক ছিল। সবই জানে জ্যোতি। সনি মেয়েটি আরো তিন জনের সাথে একই সাথে ভালোবাসার সম্পর্ক চালিয়ে যাচ্ছিল। কিনক জানতে পারায় সনি নিজ থেকেই চলে যায় কিনককে ছেড়ে। তা প্রায় আট মাস পার হয়ে গেল। আর এখন কিনক সনিকে কেন কিডন্যাপ করবে? এটা হতে পারে না। কাল রাতেও কিনকের সাথে ফোনে কথা হয়েছে জ্যোতির। কিন্তু সেরকম কোন আভাস পায়নি জ্যোতি।
জ্যোতি কিনককে অনেক ভালোবাসে। তার অতীত বর্তমান জেনেই জ্যোতি সম্পর্কে জড়িয়েছে কিনকের সাথে। বেচার কিনক জন্মের আগেই বাবাকে হারিয়েছে কার এক্সিডেন্টে। জন্মের পর হারালো মাকে। কথাগুলো ভাবতেই জ্যোতির দু-নয়নের বারান্দা থেকে কয়েক ফোঁটা জল বেরিয়ে পরলো। চোখের জল মুছতে মুছতে বিছানা থেকে উঠলো জ্যোতি। বাবার কাছে ব্যাপারটি বলতে হবে। বাবা চাইলেই কিনককে ছাড়িয়ে আনতে পারবে।
জ্যোতির বাবা গাজীপুর জেলার ডিসি। অনেক ক্ষমতা তার। ধানমন্ডি নিজের বাড়ি আছে তার। বাড়ির নাম "সুখের নিবাস"। দুই তলা বিশিষ্ট ভবন। নিচে কার পার্কিংয়ের ব্যবস্থা আর দুই তলায় তারা থাকে। বাড়ির সামনে খানিক যায়গা আছে। সেখানে ফুলের বাগান। ফুল জ্যোতির খুব পছন্দ আর তাই মেয়ের কথা ভেবে সামনের যায়গাটুতে বিভিন্ন ফুলের গাছ লাগিয়েছেন রাসেদ সাহেব। জ্যোতির একটি ছোট ভাই আছে তার নাম আলিফ। দুটি ছেলে মেয়ের মাঝেই রাসেদ খানের জীবনটা অর্ধেক অর্ধেক ভাগ করা।
জ্যোতির বাবা ড্রইং রুমে বসে চা খাচ্ছিলেন আর সকালের নিউজ দেখছিলেন। জ্যোতি তার বাবার কাছে গিয়ে বসলো। মুখটা খুব ভার করে রাখলো। কি বলবে আর কিভাবে বলবে ভাবছে। বাবা কি মনে করবে? কিন্তু মেয়ের চেহারা দেখেই রাসেদ খান বুঝে ফেললেন কোন গরমিল আছে৷ মেয়ের মন খারাপ। কিছু একটা বলতে চায়। রাসেদ খান তার মেয়েকে বললেন,
-মাগো, তুমি যা বলতে চাও নির্ভয়ে বলো।
রাসেদ খান তার মেয়েকে সব সময় মা বলে ডাকে আর ছেলেকে ডাকে বাবা বলে। ছেলে মেয়ের মন খারাপ তিনি সহ্য করতে পারেন না। চোখের জল দেখলে তো পাগল হয়ে যান তিনি। বাবার এমন কথা শুনে জ্যোতি মনে সাহস পেলো।
-বাবা।
-বলো যা বলতে চাও।
-আমার একজন বন্ধুকে পুলিশ ধরে নিয়েছে।
-এ জন্য এতো মন খারাপ করার কি আছে? তো তুমি কি জানো কি জন্য ধরে নিয়েছে?
-ওরা বলছে একটি মেয়েকে নাকি কিডন্যাপ করেছে। কিন্তু আমার সেটা বিশ্বাস হয় না।
-কোন থানায় আছে?
-আমাদের এই ধানমন্ডি থানায় আছে।
-নাম কি?
-কিনক। সুফিয়ান ইসলাম কিনক।
-যাও ফ্রেশ হয়ে নাশতা করো। চিন্তা করো না আমি দেখতেছি।
গুটি গুটি পায়ে জ্যোতি নিজের রুমে চলে গেল।
হাতে একটি ডিম নিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কিনককে দেখিয়ে ওসি সাহেব জিজ্ঞাস করলেন,
-এটা কি জানো?
-এটা তো সাধারণ মানুষের ভাষায় ডিম। কিন্তু আইনের ভাষায় এটাকে কি বলে তা জানি না।
একটি বদ্ধ রুমে রিমান্ডে নেয়া হয়েছে কিনককে। তাদের মাথার উপর একটি ঝুলন্ত একটি বাতি জ্বলছে। রুমের ঠিক মাঝখানটায় একটি কাঠের টেবিল আর দুই পাশে কাঠের দুটি কেদারা। একটিতে ওসি সাহেব অন্যটিতে কিনক বসে আছে। ওসি সাহেবের পাশে একজন কনেস্টেবল আছে।
-আইনের ভাষায় এটাকে কি বলে বলব তোমাকে?
-বলুন।
-আইনের ভাষায় এটাকে বলে হট থেরাপি।
-বুঝলেন স্যার, শিক্ষার শেষ নাই। থানায় এসে নতুন নতুন অনেক কিছুই শিখতেছি।
-চিন্তা করোনা আরো অনেক কিছুই শিখবে। এখন বলো এটার ব্যবহার।
-এটা তো ব্যবহার করতে শুনিনি কখনও। এটা সিদ্ধ করে খায়, মামলেট করে খায়, রান্না করে খায়, ভর্তা করেও খায় কেউ কেউ।
-এটার ব্যবহারও আছে। এটাকে গরম করে পায়ুপথে ব্যবহার করা হয়।
-কি বলেন স্যার? থানায় কি খাওয়া দাওয়া পায়ুপথ দিয়ে করে?
-হুম, তবে সবাই না। অপরাধীরা।
-স্যার, তাহলে হাগু দেয় কোন পথ দিয়ে?
-যা যা জিজ্ঞাস করবো তার ঠিক ঠিক উত্তর না দিলে তোমাকে পায়ুপথ দিয়েই খাওয়াবো আবার পায়ুপথ দিয়েই হাগু দেয়াবো।
-বলুন কি জানতে চান?
-সনিকে কোথায় রেখছ?
-কোন সনি?
-যাকে কিডন্যাপ করেছ।
কিনক এবার জানতে পারলো তাকে কি কারণে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সনির সাথে তার তো অনেক আগেই রিলেশন ব্রেকাপ হয়েছে। কি জন্য সে সনিকে কিডন্যাপ করবে? কে জানে কার সাথে পালিয়েছে মেয়েটা। ওসি সাহেব কিনককে ধমক দিয়ে বললেন,
-কথা বলছ না কেন? বল সনিকে কোথায় লুকিয়ে রেখছ?
-স্যার আপনাদের সন্দেহের লিস্টে আরো কত জনের নাম আছে জানতে পারি?
-উল্টা প্রশ্ন করছ?
পাশের কনেস্টেবলকে উদ্দেশ্য করে ওসি সাহেব বললেন, 'ফোরকান, ডিমটি গরম করার ব্যবস্থা করো। বুঝছি সোজা আঙ্গুলে ঘি উঠবে না।' ফোরকান ইয়েস স্যার বলে ডিম নিয়ে চলে গেল। কিনক ওসি সাহেবকে বলল,
-স্যার পাত্রে যদি ঘি না থাকে তাহলে আঙ্গুল বাঁকা করেও কোন লাভ হবে না।
-কি বলতে চাস তুই?
-খুবই সোজা। আমি সনির ব্যপারে কিছুই জানিনা। ওর সাথে আমার ব্রেকাপ হয়েছে অনেক দিন আগে। আমাদের মনের মিল ছিল না বলে আমরা দুজন দু প্রান্তে চলে গেছি নিজেদের ইচ্ছায়। তারপরে ওর সাথে আমার আর কোন যোগাযোগ হয়নি।
-তাহলে সনি চিরকুটে তোর নাম কেন লিখে গেল?
-চিরকুটে আমার নাম লিখে গেছে?
-হুম, তোর নাম লিখে গেছে।
-এটার ব্যপারে আমি কিছু বলতে পারবো না।
-বলতে যে তোকে হবেই বাছাধন। ডিম গরম করে নিয়ে আসলেই বলবি।
-স্যার আমার মনে হচ্ছে সনি আমাকে ফাঁসাতে চাচ্ছে।
-কেন তোকে ফাঁসাবে? কোন ক্ষতি করেছিস ওর?
-না কোন ক্ষতি করিনি।
ফোরকান ডিম নিয়ে আসতে আসতে আসতে একজন ক্ষমতাবান লোক ফোন করলো ওসি সাহেবকে।
-হ্যালো স্যার।
-কিনক নামে কোন ছেলেকে গ্রেপ্তার করেছ?
-জ্বি স্যার।
-ছেলেটি নির্দোষ। তাকে ছেড়ে দাও।
-স্যার যে মেয়েটি কিডন্যাপ হয়েছে সে একটি চিরকুটে লিখে গেছে যে কিনক তাকে কিডন্যাপ করেছে।
-যদি মেয়েটি চিরকুট লিখে যায় তাহলে তো তাকে কিডন্যাপ করা হয়নি সে নিজ ইচ্ছাই ঘর ছেড়েছে। এই সহজ জিনিসটা কেন বুঝনা?
-সরি স্যার। এক্ষুনি ছেড়ে দিচ্ছি।
ফোনটি রেখে দিয়ে ওসি সাহেব একটি নিঃশ্বাস ছাড়লেন করলেন আর বললেন, "এই বড় স্যারদের জন্য অপরাধীদের ঠিক মত সায়েস্তা করা গেলনা।"
কিনক ওসি সাহেবকে বলল,
-স্যার, হট থেরাপি দিবেন না?
-দিব। তবে আবার যখন আনবো তখন।
ইতিমধ্যেই ফোরকান ডিম সিদ্ধ করে নিয়ে এসেছে। কিনক আবার বলল, স্যার ডিমটা আমি খেয়ে ফেলি। সকাল থেকে কিছুই খেতে দেননি। পেটে খুব খিদে। তাছাড়া শীত শীত লাগছে। গরম ডিম খেলে শরীরটা একটু গরম হবে।
ওসি সাহেব ডিমটি কিনককে দিয়ে দিলেন। আর মুখখানা গোমরা করে নিজের যায়গায় বসে রইলেন। কিনক ডিম খেতে খেতে থানা থেকে বের হয়ে হাটা শুরু করলো টিএসসি মোরের দিকে। বাহিরে হাল্কা বাতাস ছিল। কিনক শার্টের দুটি বুতাম খুলে দিল সাথে সাথে হৃদয়ের জানালাটাও। থানায় আটকা থেকে হৃদয়টা বায়ুশূন্য হয়ে গেছে। কিনকে ফোনে একটা কল আসলো। মোবাইল বের করে দেখলো মেস ম্যানেজার ইলিয়াস ভাই।
-ভাই বলুন?
-কোথায় আছেন?
-রাস্তায়। কিছুক্ষণ আগে থানায় ছিলাম। আর এখন রাস্তায়।
-আপনার রুমে কে যেন আছে। ভিতর থেকে দরজা লক করা।
-আমার রুমে কে আসলো আবার?
-ভাই আমি দরজা নক করেছি কিন্তু কোন সারা দেয় না। আর তাই আপনাকে কল করলাম।
-দরজায় আর নক করার দরকার নাই। আমি আসতেছি।
-আচ্ছা ঠিক আছে। ভাই রাখছি এখন।
-ঠিক আছে।
হাটতে হাটতে টিএসসির মোরে চলে আসলো। মরুভূমির সাথে দেখা হয়ে গেল। মরুভূমির চোখে একটি চশমা লক্ষ করলো। চশমাটা নিয়ে নিজের চোখে পরলো কিনক। তারপর মরুভূমিকে বলল,
-দেখতো মরুভূমি কেমন লাগে?
-খুব ভালো লাগছে ভাই। অপনাকে অনেক মানিয়েছে গ্লাসটায়।
-ধন্যবাদ। এটা আমি নিয়ে নিলাম। এখন তুই আমাকে একটি সিগারেট খাইয়ে মনের পেরেশানি দূর কর। রাত চারটা থেকে থানায় ছিলাম। মাত্র বেড় হয়ে সোজা চলে আসলাম এখানে।
-ভাই আপনি এক মিনিট দাঁড়ান আমি পাঁচ মিনিটে সিগারেট লইয়া আইতেছি।
-দাঁড়াইতে পারবো না। ভিতরে গিয়া বসি তুই বিড়ি নিয়া আস। যা।
-ঠিক আছে।
মরুভূমির আসল নাম আকাশ। কিনক তাকে মরুভূমি বলে ডাকে তাতে আকাশের কোন দুঃখ নাই। শত প্রিয় মানুষের মধ্যে কিনক আকাশের শ্রেষ্ঠ প্রিয় মানুষ। সানগ্লাসটা কিনককে দিবে বলেই কিনেছিল। কিন্তু কোন গিফট কিনক গ্রহন করতে চায়না। তাই চোখে পড়ে কিনকের সাথে দেখা করলো মরুভূমি।
মরুভূমির সাথে আড্ডা দিয়ে বাসার দিকে হাটা শুরু করলো। কিনকের বাসা নিউমার্কেট। একটি সস্তা মেসে একটি রুম নিয়ে থাকে সে। ঘুমহীন রাত এবং থানায় থাকায় কিনকের খুব ক্লান্তি লাগছে। তাই একটি রিক্সা নিল বাসায় যাওয়ার জন্য। রিক্সায় উঠে বসতে বসতে জ্যোতি ফোন করল,
-হ্যালো, বলো।
-কোথায়?
-বাসায় যাচ্ছি।
-আলহামদুলিল্লাহ। খুব খুশি হয়েছি ওরা তোমাকে ছেড়ে দিয়েছে বলে।
-তুমি কিভাবে জানলে ওরা আমাকে গ্রেপ্তার করেছে?
-আমি খুব সকালে তোমাকে ফোন করেছিলাম। ওসি সাহেবের সাথে কথা হয়েছে। আর তখনই ব্যপারটি বাবাকে জানাই।
-তোমার বাবা কি বলল?
-বলেছে, চিন্তা করো না ছেড়ে দিবে।
-এতক্ষণে বুঝলাম আমাকে ছাড়ানোর জন্য কার ফোন ছিল।
-ঠিক আছে। এখন বাসায় গিয়ে বিশ্রাম নাও। বিকালে দেখা করবো। অনেক দিন তোমাকে দেখি না। মনটা ভিষণ কান্না করে তোমার জন্য।
-ঠিক আছে বিকালে লেকে চলে এসো।
-ঠিক আছে রাখছি এখন।
-আচ্ছা।
রিক্সা থেকে নেমে রিক্সা চালককে বলল,
-মামা ভাড়াটা বাকি রাখেন। এখন টাকা নাই। পরে দিব।
-মামা সমস্যা নাই। আপ্নে টেহা দিলেই আমি নিতাম না। একদিন আপনে আমারে একটা উপকার করছেন। আপনের মনে না থাকলেও আমার মনে আছে।
-যাক তাহলে ভালোই হলো। ঠিক আছে মামা যাও তাহলে।
কিনক দরজার সামনে গিয়ে দেখল দরজা ভিতর থেকে লক করা। কিনক দরজায় নক করলো এবং বলল,
-ভিতরে কে আছেন? দরজা খুলুন।
কিনকের কথার আওয়াজ পেয়ে দরজা খুলে দিল মেয়েটি। মেয়েটিকে দেখে কিনক হাই ভোল্টেজ এক শক খেলো। মেয়েটি আর কেউ নয়, মেয়েটি হলো সনি। কিনক কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। বাক শূন্য হয়ে তাকিয়ে রইলো এক দৃষ্টিতে সনির দিকে। আর সনি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মুচকি মুচকি হাসছে কিনকের দিকে তাকিয়ে।