প্রথম পর্ব
সেই এক চিল চিৎকারে সাত সকালে কান ঝালাপালা হয়ে গেল !!
-ওঠো, ওঠো।কখন সকাল হয়েছে এখনো হেঁদিয়ে মড়ার মত পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছো।এত ঘুমালে সংসার ঠেলবে কে? আমি একা আর কত দিক সামলাবো?
ডিসেম্বর মাস ঠান্ডাটা বেশ জাঁকিয়ে পড়েছে। মনে হচ্ছে লেপটা আমায় নতুন বউয়ের মত জড়িয়ে ধরছে বারবার।এমতাবস্থায় বেরসিক বউটা সাত সকালে কোথেকে এসে শ্যাওড়া গাছের পেত্নীর মত ঘ্যানঘ্যান করে ডেকে চলেছে।উত্তর না করলে তিষ্ঠানো দায় হয়ে যাবে।একটু আহ্লাদী গলায় বললাম।
-উঠছি তো!
আবারও আরেক ঝাটকা!
-উঠছি তো বললে হবে না।একদম ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা করবে না।ছুটির দিনের নাম করে লেপ কম্বল দখল নিয়ে আরাম খাওয়া। একদম চলবে না।
কোথাও কোন শান্তি নেই। সকাল সকাল বড্ড অভিমান হলো। মনে হলো,আমার সব থেকেও কিছু নেই। আমি নিঃস্ব,রিক্ত,দুস্থ,অসহায়।মানুষ হিসাবে আমার কোন স্বাধীনতা নেই। এ মারছে টান তো ও ধরছে কান।কখনও হেঁচকা কখনও হালকা।যার যেমন খুশি।
আমার চারপাশটুকু অসীম শূন্যতায় ঘেরা
এমতাবস্থায় আমার মন বলল," নে চল অনেক হয়েছে। এবার বেড়িয়ে পড়।"
জানালা দিয়ে স্ফটিক স্বচ্ছ আকাশের দিকে তাকাতে সে বলল, "আয় বুকে আয়"
রোদ আকুল হয়ে আমায় টানলো,ভ্রু নাচিয়ে বলল,"বড্ড বোকা তুই "
দুর দিগন্তের সবুজ বনানী হাতছানি দিল,বলল
"এসো এসো আমার বুকে এসো।অনেক হয়েছে এই বেলা প্রাণটা জুড়িয়ে নাও দিকিনি "
ওদিকে ফুলের সুবাস আমায় মাতাল করে তুলল।
আমার মন আপ্লুত হলো। অমন মায়াময় হাতছানি আমার মনকে বোঝালো এখনই তোমার বেড়িয়ে পড়া উচিত।এই তো সুযোগ। এমন সুযোগ বারবার আসবে না।
হ্যাঁ-আমি শূন্যে ভাসতে চাই।
আমি ভার মুক্ত হতে চাই।
আমি দ্বায়িত্বহীন জীবন চাই।
আমি প্রকৃতির মাঝে ডুব দিয়ে স্থির নিশ্চল ক্লেদ মুক্ত জীবন চাই।আমার সুখ শান্তি ফেরত চাই।
যে জীবনে কোন তাড়া নেই। যে জীবনে তথাকথিত সফলতার মাপকাঠি নেই। যে জীবনে কেউ চোখরাঙানির কেউ নেই। না বস, না বউ।এমন একটা জীবন চাই।
যেই ভাবা সেই কাজ,সংসারের সব বাধা ছিন্ন করে
সুতো কাটা ঘুড়ির মত এই ভেসে চললুম!
আহ শান্তি! পূর্ণ স্বাধীনতা!
প্রদীপের মত আগলে চলা জীবন থেকে মুক্তি সংসারের মোহমায়া, ঝুট ঝামেলা, বাজার করা
বাচ্চাদের স্কুলে পৌঁছানো,ন'টা - পাঁচটা অফিস করা,টার্গেট ফিল-আপ করা,এটা নেই,ওটা নেই
ঘ্যানঘ্যান খ্যানখ্যান,বাচ্চাদের আবদার, গিন্নির মুখ ঝামটা,চিল চিৎকার।সব দায় থেকে মুক্তি।
সুখ বলতে তো ওই অতটুকু পায়রার ডিমের মত!
রাত দুপুরে খাপখোলা ভালোবাসার চর্চা,যোষিৎ সংসর্গ টুকুই।সেও থোড় বড়ি খাড়া খাড়া বড়ি থোড়।কোথাও কোন বৈচিত্র্য নেই।
এবার তবে মুক্তি!অনেকটা পথ হেঁটে - বসেছিলুম রোদ পিঠ করে।হাঁটাহাঁটির ফলে পেটে টান ধরেছে। কেমন যেন খামচা খামচি চলছে উদর গহ্বরে।আমার এই এক দোষ বেশিক্ষণ অভুক্ত থাকতে পারি না।অভিমান টান এক নিমেষেই কোথায় যেন হাওয়া হয়ে গেল। বড্ড গাল ফুলেছিল সেসব বেলুনের মত ফেটে গেল নিমেষেই । নাহ ফিরতে হবে।
যাবো কি যাবো না দ্বিধা এলো একটু নাহ মনটা সত্যি সত্যি খচখচ করে উঠলো, তাইতো গিন্নির পায়ের ব্যাথাটা বেড়েছে বলেছিল। আজ ডাক্তারের কাছে যাবার কথা,সিরিয়াল লেখাতে হবে।শীত পড়ে গেছে ছোট্ট মেয়েটার সোয়েটার কিনতে হবে।বছর শেষ এই বেলা ছেলেদের স্কুল ড্রেসের অর্ডার কনফার্ম না করলে হবে না।বন্ধের দিন সাপ্তাহিক বাজারটা আমিই করি। গিন্নি বাজারে গেলে আমারই খবর আছে। হাতখরচার টাকায় টান পড়বে।দায়িত্ব! দায়িত্ব!! দায়িত্ব!!! কোন মুক্তি নেই।
নাহ ফিরতে হবে দেখছি কোন উপায় নেই। নাহলে সব ল্যাটা ফ্যাটা পেকে যাবে। এ মাকড়সার জালে যে জড়িয়েছে তার মুক্ত হবার উপায় নেই।
বাড়ি ফিরলুম ভয়ে ভয়ে । গিন্নিকে না বলে বেরিয়েছি যে! দরজার মুখে গিন্নিও আমায় দেখে হাতে যেন চাঁদ পেলো গদগদ হয়ে বলল
- কোথায় ছিলে বল তো! খুঁজছি তোমাকে। ওদিকে নাস্তা ঠান্ডা হতে চলল যে। মর্নিং ওয়াকে গিয়েছিলে বুঝি?
আমি দাঁত কেলিয়ে মাথা ঝাঁকালাম।
- তা বেশ। তাড়াতাড়ি খেয়ে দেয়ে বাজারে ছোট দিকিনি ওদিকে তোমার বড় সমুন্দি তার বউ ছেলে মেয়ে নিয়ে আসছে। বাচ্চাদের বার্ষিক পরীক্ষার পর বন্ধের ছুটিটা এখানেই কাটাবে বলেছি। কি বলো ঠিক করি নি?
আমি মাথাটা একবার ওপর নিচ করতে করতে গোগ্রাসে গিলতে লাগলাম।
© রফিকুল ইসলাম ইসিয়াক।