হেলাল হাফিজ
(জন্মঃ ৭ অক্টোবর, ১৯৪৮) বাংলাদেশের একজন আধুনিক কবি যিনি স্বল্পপ্রজ হলেও বিংশ শতাব্দীর শেষাংশে বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। তার কবিতা সংকলন যে জলে আগুন জ্বলে ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত হওয়ার পর অসংখ্য সংস্করণ হয়েছে। ২৬ বছর পর ২০১২ সালে আসে তার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ কবিতা একাত্তর। তার অন্যতম জনপ্রিয় কবিতা ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’;- এ কবিতার দুটি পংক্তি ‘‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়, এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’’ বাংলাদেশের কবিতামোদী ও সাধারণ পাঠকের মুখে মুখে উচ্চারিত হয়ে থাকে। তিনি সাংবাদিক ও সাহিত্য সম্পাদক হিসাবে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় কাজ করেছেন। ২০১৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কারে ভূষিত হন।
যৌবনে হেলাল হাফিজ, ১৯৭৩। ছবি: শামসুল আলম আলমাজী
জন্ম ও শিক্ষাজীবন
১৯৪৮ সালের ৭ অক্টোবর নেত্রকোনায় জন্মগ্রহণ করেন । তার পিতার নাম খোরশেদ আলী তালুকদার । আর মাতার নাম কোকিলা বেগম। ১৯৬৫ সালে নেত্রকোনা দত্ত হাইস্কুল থেকে এসএসসি এবং ১৯৬৭ সালে নেত্রকোনা কলেজ থেকে তিনি এইচএসসি পাস করেন। ওই বছরই কবি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায় ১৯৭২ সালে তিনি তৎকালীন জাতীয় সংবাদপত্র দৈনিক পূর্বদেশে সাংবাদিকতায় যোগদান করেন। ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন দৈনিক পূর্বদেশের সাহিত্য সম্পাদক। ১৯৭৬ সালের শেষ দিকে তিনি দৈনিক দেশ পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক পদে যোগদান করেন । সর্বশেষ তিনি দৈনিক যুগান্তরে কর্মরত ছিলেন।
ঢাকা লিট ফেস্ট ২০১৭’তে কবিতা পড়ছেন হেলাল হাফিজ
মুক্তিযুদ্ধের সময়
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের ক্র্যাকডাউনের রাতে অলৌকিকভাবে বেঁচে যান হেলাল হাফিজ। সে রাতে ফজলুল হক হলে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় পড়ে সেখানেই থেকে যান। রাতে নিজের হল ইকবাল হলে (বর্তমানে জহুরুল হক) থাকার কথা ছিল। সেখানে থাকলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নৃশংস হত্যাযজ্ঞের শিকার হতেন। ২৭ মার্চ কারফিউ তুলে নেওয়ার পর ইকবাল হলে গিয়ে দেখেন চারদিকে ধ্বংসস্তূপ, লাশ আর লাশ। হলের গেট দিয়ে বেরুতেই কবি নির্মলেন্দু গুণের সঙ্গে দেখা। তাকে জীবিত দেখে উচ্ছ্বসিত আবেগে বুকে জড়িয়ে অঝোরে কাঁদতে থাকলেন নির্মলেন্দু গুণ। ক্র্যাকডাউনে হেলাল হাফিজের কী পরিণতি ঘটেছে তা জানবার জন্য সে দিন আজিমপুর থেকে ছুটে এসেছিলেন কবি গুণ। পরে নদীর ওপারে কেরানীগঞ্জের দিকে আশ্রয়ের জন্য দুজনে বুড়িগঙ্গা পাড়ি দেন
হেলাল হাফিজ। ছবি: জিয়া ইসলাম
সাহিত্য কর্ম ও পুরস্কার
১৯৮৬ সালে প্রকাশিত তার কবিতার বই ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ প্রকাশিত হয়। কবিতার জন্য পেয়েছেন নারায়ণগঞ্জ বৈশাখী মেলা উদযাপন কমিটির কবি সংবর্ধনা (১৯৮৫), যশোহর সাহিত্য পরিষদ পুরস্কার (১৯৮৬), আবুল মনসুর আহমদ সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৭), নেত্রকোনা সাহিত্য পরিষদের কবি খালেদদাদ চৌধুরী পুরস্কার ও সম্মাননা প্রভৃতি।কবিতায় তিনি ২০১৩ সালের বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন।
কাব্যগ্রন্থ
যে জলে আগুন জ্বলে (১৯৮৬)
কবিতা ৭১ (বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষায়, একুশে বইমেলা ২০১২)
উল্লেখযোগ্য পুরস্কার
আবুল মনসুর আহমদ সাহিত্য পুরস্কার, বাংলা একাডেমি পুরষ্কার (২০১৩)
প্রথম আলোয় প্রকাশিত কবি হেলাল হাফিজের সাক্ষাৎকার
০৪ অক্টোবর ২০১৯
‘আমার সবচেয়ে বেশি প্রিয় আলস্য, নারীর চেয়েও প্রিয়’
‘আমার সবচেয়ে বেশি প্রিয় আলস্য, নারীর চেয়েও প্রিয়’
যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’—এই অমর পঙ্ক্তিই বিখ্যাত করেছে কবি হেলাল হাফিজকে, পাল্টে দিয়েছে তাঁর জীবনধারাও। ৭ অক্টোবর বাংলাদেশের জনপ্রিয় এই কবির ৭২তম জন্মদিন। জন্মদিনের ক্ষণে প্রথম আলোর মুখোমুখি হয়ে প্রথমবারের মতো তিনি উন্মোচন করলেন তাঁর লেখালেখি, প্রেম, বিরহসহ জীবনের নানা অজানা অধ্যায়।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন হাসান হাফিজ।
হাসান হাফিজ: ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ নামে একটি কবিতা লিখে যৌবনেই বিখ্যাত হয়ে যান আপনি, সেই কবিতায় তখন লিখেছিলেন ‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়/ এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।’ বর্তমানে জীবনসায়াহ্নে এসে বার্ধক্যে উপনীত হয়ে ওই ধরনের পঙ্ক্তি কি আর লিখতে ইচ্ছা করে? কী মনে হয় এখন এই কবিতার দিকে তাকিয়ে?
হেলাল হাফিজ: ‘এখন যৌবন যার...’, এই দ্যুতিময় পঙ্ক্তির যিনি স্রষ্টা, তিনি তো চিরনবীন। বাস্তবে তার বয়স যতই হোক না কেন। এটা ঠিক, শরীর একটা বড় ফ্যাক্টর। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, সমাজে যত দিন অন্যায় উৎপীড়ন অনিয়ম অনাচার থাকবে, এই পঙ্ক্তিমালাকে আশ্রয় করে প্রতিবাদী কিছু মানুষ ঘুরে দাঁড়াতে চাইবে। রুখে দাঁড়াবে অন্যায় ও বৈষম্য। এই কবিতাপঙ্ক্তি তাদের প্রাণিত করবে। এমনটা হতেই পারে যে বেশির ভাগ মানুষ ক্ষমতার বলয়ের মধ্যে থাকতে চাইবে। কলাটা-মুলোটার জন্য। কিন্তু কিছু মানুষ তো ব্যতিক্রমী থাকবেই। তারা রুখে দাঁড়াবে। অন্যায়-অবিচারের অবসান চাইবে।
হাসান: এই কবিতা লেখার প্রেক্ষাপট সম্পর্কে জানতে চাই।
হেলাল: কবিতাটা লেখা হয়েছিল ১৯৬৯ সালের গণ-আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে। তখন জাতি ছিল স্বাধীনতা-উন্মুখ, দেশ ছিল টালমাটাল। ওই সময়ে দেশ যে কেমন অগ্নিগর্ভ ছিল, এখনকার ছেলেমেয়েরা তা চিন্তাও করতে পারবে না। আজকাল মিছিল-মিটিং হয় টাকার বিনিময়ে। সে সময়ে এ রকমটা হতো না। সবই হতো স্বতঃস্ফূর্তভাবে। আদর্শের একটা ব্যাপার ছিল। আমি কোনো রাজনৈতিক বা ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম না; না ছাত্রজীবনে, না কর্মজীবনে। কোনো মিছিলে আমি কখনো যাইনি। তবে ভেতরে-ভেতরে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের স্বপ্ন-প্রত্যাশা, আশা-আকাঙ্ক্ষার ব্যাপারটি বুকে ধারণ করতাম ঠিকই। ‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’—ওই কবিতাটা সময়ই আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছে।
হাসান: সময় তো আপনাকে দিয়ে ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ লিখিয়ে নিল, কিন্তু এ কবিতার কথা মানুষ জানল কীভাবে?
হেলাল: ছফা ভাই (আহমদ ছফা) ও কবি হুমায়ুন কবির সদ্য লেখা সেই কবিতাসহ আমাকে নিয়ে গেলেন দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকা অফিসে, স্বনামধন্য কবি আহসান হাবীবের কাছে। হাবীব ভাই তখন দৈনিক পাকিস্তান-এর সাহিত্য পাতা সম্পাদনা করেন। তিনি কবিতাটি পড়লেন। তারপর মিষ্টি করে একটু হাসলেন। পড়া শেষে বললেন, শোনো তোমরা, এই কবিতা ছাপা যাবে না। ছাপলে আমার চাকরিটা চলে যাবে। পত্রিকা বন্ধও হয়ে যেতে পারে। তবে একটা কথা বলি, হেলালের আর কোনো কবিতা না লিখলেও চলবে। অমরত্ব ওর করায়ত্ত হয়ে গেছে।
ওই একটা কবিতা আমার জীবনকে পাল্টে দিয়েছে। কর্মজীবনের যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা, মানুষজনের আদর-আপ্যায়ন যা পেয়েছি জীবনে, তার পেছনে এই কবিতার বড় অবদান রয়েছে। আমি যখন ছাত্র, তখনই আমার চাকরি হয়ে যায় দৈনিক পূর্বদেশ-এ। সেটা সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে। সম্পাদক এহতেশাম হায়দার চৌধুরী দ্বিধান্বিত ছিলেন, ছাত্রকে কেমন করে চাকরি দেবেন। তখন অবজারভার হাউসের বড় কর্তা কবি আবদুল গনি হাজারী হায়দার ভাইকে বলেন, যে ছেলে এমন কবিতা লিখতে পারে, তার ব্যাপারে অন্য কোনো কিছু বিবেচনার দরকার নেই। তুমি বাপু, এখনি নিয়োগপত্র দিয়ে দাও ওকে। ব্যস, চাকরি হয়ে গেল আমার।
হাসান: আপনার জীবন নিয়েও রয়েছে নানা কিংবদন্তি। আজীবন হোটেলে হোটেলে কাটালেন। প্রেসক্লাবে আড্ডা দিয়ে জীবন পার করলেন। জীবনটাকে এমনভাবে বইতে দিলেন কেন?
হেলাল: ওই যে বললাম, ওই একটি কবিতা আমার জীবনধারা পাল্টে দিয়েছিল, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এসে ওই কবিতা আমাকে রীতিমতো স্টার বানিয়ে দেয়। এখন কী মনে হয় জানো, তা-ই বোধ হয় কাল হয়েছে। উত্তাল উনসত্তরের অগ্নিঝরা সময়ে ওই কবিতা লেখার পর অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটতে থাকল আমার জীবনে। মাত্র দুই রাতে গোটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের দেয়ালে দেয়ালে স্লোগান হিসেবে এই পঙ্ক্তি লেখা হলো। চিকা মারা যাকে বলে। এখনকার প্রজন্ম অবশ্য চিকা মারা কী, সেটার মর্ম বুঝতে পারবে না। গভীর রাতে, ভীতিকর পরিবেশে দেয়াললিখনরত তরুণদের জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, কী করছ? উত্তরে ওরা বলেছিল, চিকা (ছুঁচো) মারছি। সেই থেকে দেয়াললিখনের কাজকে বলা হতো চিকা মারা।
সেই সময় এমন হতো, হল থেকে ক্লাসে যাচ্ছি, টিএসসিতে যাচ্ছি, মেয়েরা বলাবলি করত, ওই যে কবি যায়। আমার নাম বলত না, ওই কবিতার কথা বলত। স্বাধীনতার পরও চার-পাঁচ বছর আমি সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে (সাবেক ইকবাল হল) ছিলাম। তখন নিয়ম ছিল, পরীক্ষা হয়ে গেলে হলের সিট ছেড়ে দিতে হতো। প্রভোস্টকে বলায় তিনি বললেন, ‘আচ্ছা, তুমি থাকতে পারবে। তবে বাবা, একটু আড়ালে-আবডালে থাকবে।’ ১৯৭৫ সালের আগস্ট ট্র্যাজেডির পর হল ছেড়ে দিই আমি। টিএসসিতে কখনো আমাকে নিজের পয়সায় খেতে হয়নি ওই কবিতার কারণেই।
আমি একটু দুষ্টুও ছিলাম সে সময়। আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের এক ক্লাস ওপরে পড়তেন। তখন তাঁকে দেখলেই দুষ্টুমি করে বলতাম, ওই যে অড্রে হেপবার্ন যায়। বঙ্গবন্ধুর বুকে মাথা রেখেছে তাঁর আদুরে জ্যেষ্ঠা কন্যা—এ রকম একটা ছবি আছে। ওই ছবি দেখলে আমার এই নামকরণের সারবত্তাটা তুমি বুঝতে পারবে। শেখ হাসিনাকে যে অড্রে হেপবার্ন বলতাম, তিনি সেটা বেশ উপভোগ করতেন বলে মনে হয়। সেই সময়ে সোফিয়া লরেন, অড্রে হেপবার্ন, সুচিত্রা সেন—এঁরা ছিলেন বিখ্যাত নায়িকা।
হাসান: ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ নিয়ে আর কোনো স্মরণীয় স্মৃতির কথা মনে পড়ে?
হেলাল: বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের বিভাগ ছাড়িয়ে আমার কবিখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল চারদিকে। তত দিনে আরও কয়েকটি মিষ্টি প্রেমের কবিতা লিখেছি। সেসব যে খুব শিল্পগুণসম্পন্ন, তা নয়। তখনকার সমাজ তুলনামূলকভাবে সুস্থির ছিল। কোমলতা ছিল মানুষের মনে। যেমন, এতকাল পরও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাকে মনে রেখেছেন। আগেই বলেছি, আমার জীবন মূলত জাতীয় প্রেসক্লাবকেন্দ্রিক। শেখ হাসিনা প্রায় প্রতিবছরই প্রেসক্লাবে আসেন—কখনো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে, কখনোবা বিরোধী দলের নেত্রী হিসেবেও। আমি কখনোই তাঁর ধারেকাছে যাই না। ২০১৪ সালে যখন আমি তাঁর হাত থেকে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার গ্রহণ করি, তখন ধরা পড়তেই হলো। একাডেমি মঞ্চে পুরস্কার নিচ্ছি। তাঁর নিরাপত্তাকর্মীরা আমাদের আগেভাগেই বলে দিয়েছেন কোনো কথাবার্তা নয়। কিন্তু শেখ হাসিনা প্রটোকল ভেঙে আমার সঙ্গে কয়েক মিনিট কথা বললেন। সে এক বিড়ম্বনাময় পরিস্থিতি। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমাদের টুনটুনি কেমন আছে রে, ওর কোনো খবর জানিস? দুষ্টু মেয়ে টুনটুনি স্বাধীনতা-পূর্বকালে ছাত্রলীগ করত। প্রধানমন্ত্রী জিজ্ঞেস করলেন হাসির কথা। হাসি তৎকালীন ছাত্রলীগের চার খলিফার একজন প্রয়াত আবদুল কুদ্দুস মাখনের স্ত্রী। অনির্ধারিত কথায় কথায় এইভাবে চার-পাঁচ মিনিট সময় কেটে গেল। নিরাপত্তাকর্মীরা ভীষণ উসখুস করছিলেন।
শেখ হাসিনার সঙ্গে পরে আবার দেখা হয় গণভবনে। আমার চোখের চিকিৎসার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছিল তাঁর ব্যক্তিগত সহকারী প্রয়াত কবি মাহবুবুল হক শাকিল। প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ওকে অফিসে নয়, গণভবনে আসতে বলো। তাই গেলাম। প্রচুর খাবারের ব্যবস্থা ছিল। মুঠোফোন, কাঁধে ঝোলা সঙ্গে নিয়েই আমি গণভবনে ঢুকেছি। অথচ এগুলো নিয়ে ঢোকা যায় না। কঠিন নিষেধাজ্ঞা আছে। প্রধানমন্ত্রী আগে থেকেই বলে রেখেছিলেন বলে কোনো অসুবিধা হয়নি। শেখ হাসিনা আমার ঝোলা হাতড়ে দেখলেন। বললেন, কী আছে এর ভেতরে? চোখের চিকিৎসার ব্যাপারে তিনি বললেন, যত যা লাগে, আমি দেব।
হাসান: সেই সময়—মানে আপনার যৌবনের কথা কি আরেকটু বিশদভাবে বলবেন?
হেলাল: বরাবরই আমি অব্যবস্থিতচিত্ত মানুষ। বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ নেই। চলাফেরা, খাওয়াদাওয়া অনিশ্চিত। একধরনের বোহিমিয়ান জীবন যাপন করি। খাবারদাবারের কষ্ট অবশ্য হয়নি। অগ্রজ কবি শামসুর রাহমান ও হাসান হাফিজুর রহমানের কাছে ধরনা দিয়ে আমি আর আবুল হাসান খাবারের জন্য টাকাপয়সা নিতাম। হাসান ভাই পাঁচ টাকার বেশি দিতেন না। ইচ্ছা করেই। তিনি বলতেন, তাহলে এরা উল্টা-পাল্টা খরচ করবে। তখন পাঁচ টাকা কিন্তু অনেক। এই টাকাপয়সার ফেরে পড়ে সে সময় এক-আধটু অনৈতিক কাজও যে করিনি, তা নয়। কবি মোহাম্মদ মাহ্ফুজউল্লাহ্র একটা প্রবন্ধ ছিল ‘পূর্ব পাকিস্তানের কবিতায় প্রকৃতি’। বাংলা একাডেমির পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। সেটা একটু অদলবদল করে নতুন একটা প্রবন্ধ দাঁড় করিয়ে ফেললাম। সেটা ছাপা হলো পাকিস্তানী খবর-এ। সুশোভন আনোয়ার আলী ছাপলেন। তিনি আমাকে স্নেহ করতেন। তো, ওই অদলবদল মানে চুরি করে লেখা প্রবন্ধের জন্য সম্মানী কত পেলাম, জানো? ৭৫ টাকা। সে এক বিশাল অঙ্ক। যেদিন এত্তগুলো টাকা বিল পেলাম, কীভাবে তা খরচ করব, ঠিকঠাক ঠাহর করে উঠতে পারছিলাম না। সে সময় আমার মধ্যে যে উচ্ছৃঙ্খলতা এসেছিল, তা-ও কিন্তু কবিতার জন্যই।
হাসান: বিয়ে করলেন না কেন?
হেলাল: আমি বিয়ে করিনি, এটা ঠিক। তবে এটাও তো ঠিক হতে পারে যে কোনো মেয়েও আমাকে বিয়ে করেনি বা করতে চায়নি।
হাসান: আপনার কবিখ্যাতি যেমন প্রবল, তেমনি নারীভাগ্যও তো বেশ ভালো। এই ব্যাপারটা কি একটু খোলাসা করে বলা যাবে?
হেলাল: স্কুলজীবন থেকেই আমাকে দেখে আকৃষ্ট হতো মেয়েরা। সুশ্রী ছিলাম। খেলাধুলা প্রিয় ছিল। পাশাপাশি সাংস্কৃতিক বিভিন্ন ক্ষেত্রেও সফল ছিলাম। বাংলা ও ইংরেজি কবিতার আবৃত্তি, গল্পবলা, উপস্থিত বক্তৃতায় পুরস্কার পেতাম। ফার্স্ট-সেকেন্ড হয়েছি প্রায়ই। সুন্দর হাতের লেখার জন্যও পুরস্কৃত হয়েছি বহুবার। আমার পুরস্কারের সব বই নেত্রকোনা পাবলিক লাইব্রেরিতে উপহার হিসেবে দিয়ে দিই। এর বিনিময়ে আমার আব্বাকে পাবলিক লাইব্রেরির আজীবন সদস্য পদ দেওয়া হয়েছিল।
তো বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার পর অসংখ্য বান্ধবী হলো আমার। কোনো অভাব ছিল না। আবার স্বাধীনতার পর যখন পূর্বদেশ-এর মতো কাগজের সাহিত্য সম্পাদক হলাম, সেটাও একটা বাড়তি সুযোগ তৈরি করে দিল।
হাসান: নারীদের কাছ থেকে কী ধরনের উপহার বেশি পেয়ে থাকেন আপনি?
হেলাল: সেই সময়ে সবচেয়ে বেশি উপহার পেতাম চুমু, ফুল, কলম। নানান নামের সুগন্ধি, মধ্যাহ্নভোজের টাকা, শার্ট ও প্যান্টের পিস (সত্তরের দশকে, রেডিমেড প্যান্ট তেমন একটা পাওয়া যেত না)। গত পাঁচ-সাত বছরে সবচেয়ে বেশি উপহার যা পাচ্ছি, তা হলো গলার মালা। হাতের ব্রেসলেট। আমার কিছু মেয়ে ভক্ত আমাকে এগুলো পরতে বাধ্য করছে। এসব তারা জোগান দিয়েও চলেছে।
হাসান: আপনার জীবনে তো অজস্র প্রেম এসেছে। প্রেমের কথা বলুন...
হেলাল: কৈশোরে হেলেন নামের এক তরুণীর সঙ্গে প্রেম হয়েছিল। আমার চেয়ে বয়সে একটু ছোট ছিল। কবিতায় তার কথা লিখেছি। ওর সঙ্গে প্রথমে বন্ধুত্ব, ভালো লাগা, পরে হলো প্রেম। সেটা ঘটেছিল নেত্রকোনায়। ওই প্রণয় পরিণতি পায়নি। ওকে খুব পছন্দ করতাম। সে-ও ভালোবাসত আমাকে। ইন্টারমিডিয়েট পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলো সে।
১৯৭৩ সালে যখন আমার অনার্স পরীক্ষা সামনে, তখন বড় দুটি মর্মান্তিক ঘটনা জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয় আমার। আমার আব্বা—যিনি আমার মা-ও ছিলেন—হঠাৎই মারা যান। এর এক-দেড় মাস পর হেলেনের সঙ্গে আকস্মিক ব্রেকআপ হয়ে গেল আমার। হেলেনের কথা সবিস্তারে এই প্রথম বলছি। তো এখন যেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরি, সেটা আগে ছিল পাবলিক লাইব্রেরি। ওই চত্বরে বিখ্যাত ভাস্কর নভেরা আহমেদের বেশ কিছু ভাস্কর্য ছিল। একটি ভাস্কর্যের পাশে আমরা দুজন বসলাম একদিন। হেলেন আমাকে চমকে দিয়ে বলল, আমি তো অন্য একজনকে বিয়ে করতে যাচ্ছি।
হাসান: এটা শুনে কী প্রতিক্রিয়া হলো আপনার?
হেলাল: আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। বজ্রাহত। চোখে পানি এসে গেল। হায়! এত গভীর ভালোবাসার এই পরিণতি! এত বড় আঘাত! সামাল দেওয়া অত্যন্ত শক্ত কাজ। একেবারেই ভেঙে পড়লাম। অসম্ভব অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়লাম। সেই বিষণ্নতা কাটিয়ে উঠতে বেশ কয়েকটি বছর লেগে গেল।
হাসান: সে সময় কি আত্মহত্যার কথা ভেবেছিলেন?
হেলাল: হ্যাঁ। ভেবেছিলাম। একাধিকবার আমি আত্মহত্যার চেষ্টা করেছি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সফল হতে পারিনি। তবে এই প্রবণতা একসময় প্রায় গ্রাস করে ফেলেছিল আমাকে।
হাসান: এই যে কয়েকবার আত্মহত্যার ব্যর্থ চেষ্টার কথা বললেন, তার সবই কি নারীর কারণে?
হেলাল: তা বলতে পারো। অলমোস্ট সে কারণেই। আত্মহত্যা যে করতে পারলাম না, তার পেছনেও বড় দুটি কারণ রয়েছে। প্রথমত, সবিতা মিসট্রেসের অবদান। তিনি বিদুষী স্কুলশিক্ষিকা, নেত্রকোনায় আমার শিক্ষক ছিলেন। তাঁর সঙ্গে আমার মা-ছেলের মতো সম্পর্ক ছিল প্রথমটায়, পরে সেটা বন্ধুত্বের সম্পর্কে রূপান্তরিত হয়। তাঁর দীক্ষা ও রুচিতে আমার মানস গঠিত হয়েছিল। সেটা একটা শক্তি। আর দ্বিতীয় কারণটি হলো, কবিতার জন্য মানুষের যে ভালোবাসা-আদর আমি পেয়েছি, তার ইতিবাচক প্রভাব। এই দুই কারণ না থাকলে আমি মরেই যেতাম; অথবা অথর্ব, সাদামাটা জীবন যাপন করতাম।
হাসান: আর কোনো প্রেম? আর কোনো গোপন বেদনার কাহিনি?
হেলাল: হ্যাঁ। আরও আছে। নেত্রকোনায় আমি যখন ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র, তখন শঙ্করী বলে অসামান্য সুন্দরী এক মেয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হৃদ্যতা গড়ে উঠেছিল আমার। সে ছিল আমার সহপাঠী। পরস্পরকে আমাদের ভীষণ ভালো লাগত। ওর সঙ্গে সবচেয়ে বেশি কাছাকাছি হতে পারতাম প্র্যাকটিক্যাল বা ব্যবহারিক ক্লাসের সময়। বায়োলজি ক্লাসের জুয়োলজি ও বোটানির প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস যখন হতো, শিক্ষকেরা বিশেষ থাকতেন না। এ সময় মেলামেশার সুযোগ হতো বেশ। অসম্ভব সুন্দরী তরুণী শঙ্করীর প্রেমে হাবুডুবু খেত কলেজের অনেকেই।
সন্ধ্যায় প্রতিদিন আমরা প্রচলিত পথে না গিয়ে রেললাইন ধরে পাশাপাশি হাঁটতাম। সে এক আশ্চর্য রোমান্টিক সময় গেছে আমাদের। একদিনের কথা বলি। বোটানির প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস চলছে। রক্তজবা ফুল ডিসেকশনের জন্য দেওয়া হয়েছে। জবা ফুলের দুটি কেশর থাকে। একটি পুং কেশর, অন্যটি স্ত্রী কেশর। আমার পাশের টেবিলেই ছিল শঙ্করী। আমি ওকে বললাম, শঙ্করী, পুং কেশর কোনটা, দেখিয়ে দাও তো একটু। শঙ্করী একটু মুচকি হেসে বেশ দৃঢ়তার সঙ্গে ব্যক্তিত্ব নিয়ে আমাকে বলল, তোমার মতো ভীরুকে পুং কেশর চিনিয়ে দিয়ে আমার কী লাভ?
সেই শঙ্করী পরে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে পড়েছে। ডাক্তার হয়েছে। আমিও ডাক্তারি পড়তে চেয়েছিলাম। হয়নি। শঙ্করীকে পাওয়া হলো না আর। আমি চলে এসেছি কবিতার পথে। ওই যে হেমন্তের একটা গান আছে না, ‘আজ দুজনার দুটি পথ ও গো দুটি দিকে গেছে বেঁকে...।’
হাসান: কবিতা ও নারী—কে বেশি রহস্যময়ী?
হেলাল: দুটোই খুব রহস্যময়ী। একজনের প্রাণ আছে। কবিতা যদি শিল্পগুণসমৃদ্ধ হয়, তাহলে সেটারও প্রাণ থাকে। নারীকে আমি শুধু নারী হিসেবেই দেখতে চাই না, তাকে দেখতে চাই মানুষ হিসেবে। আবার এ কথাও তো সত্য যে নারীরও পুরুষকে দরকার। নারীরও তো আকাঙ্ক্ষা-স্বপ্ন আছে পুরুষকে নিয়ে। তারও গভীর, তীব্র আকাঙ্ক্ষা আছে স্পর্শ করার, ঘ্রাণ নেওয়ার। দুই তরফেই এক রকম চাহিদা।
আমার কবিতাপুঞ্জে এত যে আকুতি, এত প্রেম তার সিংহভাগ কিন্তু বিচ্ছেদ-বিরহকেন্দ্রিক। এই বিষয়টা শুধু আমার কবিতায়ই মিলবে না, আমার যাপিত জীবনেও একই ধরনের চিত্র তুমি পাবে। তিন বছর বয়সে যখন মাকে চিরতরে হারালাম, সেটার আফটার অ্যাফেক্ট বুঝতে বুঝতে অনেকটাই সময় লেগে গেল আমার। দুঃখ-বিরহ-বিষাদ কিন্তু নিছক কান্নাকাটির বিষয় নয়, এটা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করারও বিষয়। প্রকৃত শিল্পী ও কবি তিনিই, যিনি এই কষ্ট-দুঃখ-বিরহ-বিচ্ছেদকে মহৎ শিল্পে রূপান্তরিত করতে পারেন। শিল্পের জন্য বিরহ কিন্তু খুবই জরুরি।
হাসান: আপনার প্রিয় জিনিসগুলো সম্পর্কে জানতে চাই—প্রিয় পোশাক, রং, খাবার, ফুল, মাছ ইত্যাদি।
হেলাল: আমার প্রিয় পোশাক প্যান্ট-শার্ট। পাঞ্জাবি প্রায় পরিই না, মাঝেমধ্যে পরা হয়। আমি ভাটি অঞ্চলের মানুষ, নেত্রকোনায় জন্ম ও বেড়ে ওঠা। প্রিয় খাদ্য হলো ভাত-মাছ, শুঁটকি। ফলের মধ্যে কলা আমার বেশ প্রিয়। প্রতিদিনই খাওয়া হয়। এই ফল সারা বছর পাওয়া যায়। আম-কাঁঠালও বেশ প্রিয় আমার।
কলা খাওয়ার একটা সুবিধা আছে। সেটা কী, জানো, হাত ময়লা হয় না। হাত ধুতেও হয় না। ফলের মৌসুমে সুহৃদ-অনুরাগীরা আমার জন্য কাঁঠাল নিয়ে আসেন। ঢাকার বাইরে থেকেও আনেন কেউ কেউ। সুহৃদ, সহকর্মী বন্ধুরা, বউমায়েরা প্রায়ই তাঁদের বাড়িতে রান্না করা আনাজ-তরকারি আমার জন্য নিয়ে আসেন। ও হো, বেগুনভর্তা আমার বড্ড পছন্দের। আর মাছের কথা বলছ? সব মাছই ভালো লাগে। মাগুর মাছের কথা বলি। বেশ প্রিয়। ইলিশও পছন্দের। দেশি কই মাছ খেতে ভালো লাগে। কাঁঠালের বিচি দিয়ে শুঁটকিভর্তা পছন্দ করি ভীষণ। মাষকলাইয়ের ডালও বেশ ভালো লাগে।
আমার প্রিয় রং হলো নীল। বেদনার রং তো। জীবনের আনন্দ ও বেদনার আবেগের সবকিছুই খুঁজে পাই নীলের মধ্যে। লাল রংও ভীষণ ভালো লাগে। এটা দ্রোহের রং, বিপ্লবেরও।
প্রিয় ফুল হচ্ছে কচুরিপানার ফুল। এটা কেন প্রিয়, তারও একটা মজার ইতিহাস আছে। আগেই বলেছি, আমার প্রিয় মানুষ ছিলেন সবিতা মিস্ট্রেস। আমার মতো মাতৃহীন এক বালককে তিনি মাতৃস্নেহ দিয়েছেন। তাঁর প্রেমিক ছিলেন হক ভাই। নেত্রকোনা শহরে মগরা নদীর ওপারে থাকতেন সেই হক ভাই। গোপনে ওঁরা দেখাসাক্ষাৎ করতেন। হক ভাই তাঁর প্রেমিকার জন্য প্রতিদিন একটা করে কচুরিপানার ফুল নিয়ে আসতেন। একদিন সবিতা মিস্ট্রেস বললেন, ‘এখন থেকে দুটো করে ফুল আনবে। একটা আমার জন্য, আরেকটা হেলালের জন্য।’ হক ভাই তা-ই করতে থাকলেন। কচুরিপানার ফুলের প্রতি সেই প্রিয়তা আমার আজও রয়ে গেছে।
হাসান: কবি হওয়ার জন্য, ভালো কবিতা লেখার জন্য কী কী গুণাবলি থাকা আবশ্যক বলে আপনি মনে করেন? একটি কবিতা কীভাবে মানুষকে নাড়া দেয়?
হেলাল: কবিতা জন্মগতভাবে পাওয়া বিশেষ একটা বিষয়। কেউ কেউ এটা নিয়েই জন্মায়। অগ্রজ বা নিকটাত্মীয় কেউ লেখক বা শিল্পী থাকলে প্রতিভা বিকাশের ক্ষেত্রে তা সহায়ক হয়। প্রতিভার পরিশীলন, লালন, বিকাশের জন্য পড়াশোনার বিকল্প নেই। কবিতা অত্যন্ত স্পর্শকাতর একটি মাধ্যম। কোন কবিতা কাকে কখন নাড়া দেবে, সাড়াজাগানিয়া হবে, তা আঁচ করা মুশকিল। এটা খুবই ট্রিকি একটা ব্যাপার।
হাসান: প্রধানত তরুণ-তরুণীরাই আপনার কবিতার পাঠক ও অনুরাগী। ডিজিটাল প্রযুক্তির প্রসারের বর্তমান সময়ে হালফিল তরুণদের মধ্যে কবিতার প্রতি টান বা প্রীতি কি হ্রাসমান, এ ব্যাপারে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?
হেলাল: এখন তো কম্পিউটার, অন্তর্জাল ও ফেসবুকের যুগ। হ্যাঁ, বই পড়া কমেছে আগের তুলনায়। ধরো, ফেসবুকে আমি একটি কবিতা পোস্ট করলাম। মুহূর্তের মধ্যে গোটা বিশ্বে তা ছড়িয়ে পড়ছে। আবার ফেসবুকের দুর্বলতাও আছে। বড় দুর্বলতা হলো, দ্বিতীয় বা তৃতীয় কেউ সম্পাদনা করার নেই। নান্দনিকতার একটা ঘাটতি থেকেই যাচ্ছে সে কারণে। কোনো ব্যক্তি যদি নিজের সুরুচির দ্বারা শাসিত না হন, তবে সেটা কুৎসিত আকার ধারণ করে।
এ-ও সত্য, কম্পিউটার, ফেসবুক পুরো দুনিয়াকে আমাদের হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে। বড়ই বিস্ময়কর অগ্রগতি। ধরো, নিউইয়র্কের সবচেয়ে বড় লাইব্রেরিতে তুমি জানতে চাইলে অমুক বইয়ের অমুক পৃষ্ঠাটা আমি দেখতে চাই। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই সেটা পেয়ে যেতে পারো তুমি। এই যে চমৎকার সুবিধা, এটা এনে দিয়েছে ফেসবুক বা অন্তর্জাল। এই অন্তর্জাল যেমন ওপরে ওঠার সিঁড়ি, তেমনি নিচে নামারও সিঁড়ি। কথা হলো, কে কীভাবে ব্যবহার করছে, তার ওপর সবকিছু নির্ভর করে।
এখানে আতঙ্কের কথাও রয়েছে। একেবারে বয়ঃসন্ধিকালের ছেলে বা মেয়ে, তাদের জন্য এই সুযোগ মারাত্মক তো বটেই। এসব ডিভাইস তাদের হাতে নিশ্চিন্তে তুলে দেওয়া যেমন খানিকটা বিপজ্জনক, তেমনি ওদের একেবারে বঞ্চিত করে রাখাটাও বোকামি। অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল সেট যদি না দাও, তাহলে ওরা পিছিয়ে পড়বে। অনেকে তো মোবাইলে পড়াশোনাও করে থাকে আজকাল। একটা ছেলে বা মেয়ে যখন বাড়ির আলাদা রুমে থাকে, তার সুবিধা-অসুবিধা দুটোই রয়েছে।
হাসান: এই সংকট মোকাবিলার উপায়টা কী তাহলে?
হেলাল: উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েদের মারধর করা যাবে না। তাদের বুঝিয়ে বলতে হবে। ওদের প্রযুক্তি থেকে বঞ্চিত করা মানে হলো অন্ধকারের দিকে ঠেলে দেওয়া। দেখো, মুঠোফোন দারুণ উপকারীও। বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের খোঁজখবরও তরুণ-তরুণীরা এর মাধ্যমে নিতে পারছে। আবার এই মোবাইল দিয়ে সাবালক মানুষও আজেবাজে কাজ করছে। তাদের সংখ্যাই হয়তো বেশি। তারপরও এ বিষয়ে শেষ কথা হলো, হালফিল দুনিয়ায় আইটি আমাদের এক ধাক্কায় চার-পাঁচ শ বছর এগিয়ে নিয়ে গেছে। ফলে সহজ, সুন্দর ও সৎভাবে আইটি ব্যবহার করতে পারলে সেটা দেশের জন্য সেটি মঙ্গলজনক হবে বলেই আমি মনে করি।
হাসান: সম্প্রতি দুই দফা হাসপাতাল থেকে ফিরলেন। বেশ ধকল গেছে। এখন মৃত্যুচিন্তা কি আসে আপনার মধ্যে?
হেলাল: এ বছরের মে মাসে ল্যাবএইড হাসপাতালে যখন প্রথম দফায় গেলাম, এ রকম একটা ধারণা হয়েছিল যে আর বোধ হয় ফিরতে পারব না। খুব স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েছিলাম। হাসপাতালের বেডে শুয়ে শুয়ে মনে পড়েছিল আমার শৈশব, কৈশোর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের কথা, দীর্ঘ ৫০ বছর ধরে জাতীয় প্রেসক্লাবকেন্দ্রিক যে জীবন আমি যাপন করে আসছি, সবকিছু মনে পড়ছিল। প্রেসক্লাবে তিন বেলা আমি আহার করি। জীবনের খুব লম্বা একটা সময় এখানে কাটালাম।
তবে এখন মনে হয়, বিদায়ের সময় তো একপ্রকার হয়েই গেছে। দেশের মানুষের গড় আয়ু এখন ৭১-৭২ বছর। সেটা তো আমার হয়েই গেছে। যদি বিদায় নিতেই হয়, বিধাতা, প্রকৃতি কাউকে দোষারোপ করার কিছু নেই। মৃত্যু নিয়ে আমার বিশেষ কোনো ভয় নেই। তবে কথা হলো, কে অত সহজে যেতে চায়? একরকম অতৃপ্তি থাকেই। মনে হয়, জীবন যদি আরেকটু দীর্ঘায়িত হয়, বেশ হয় তাহলে। আরও একটুখানি সময় যদি থেকে যাওয়া যায়, মন্দ হয় না। তবে হ্যাঁ, আমার কোনো অতৃপ্তি-অনুতাপ নেই। সত্য বটে, সময়ের অপচয় করেছি। সেটা না হলে হয়তো আরও ভালো হতো। যা গেছে, গেছেই। গন ফর এভার।
এখন যে কদিন পরমায়ু আছে, মোটামুটি সুস্থ থাকতে পারলেই ভালো—এটাই সামান্য চাওয়া। শরীর অনেকটাই ঠিক নেই। শরীরের অনেক অর্গান তার স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে। চোখ নিয়ে গুরুতর সমস্যা রয়েছে। ভালো লেখার জন্য অনেক পড়াশোনা করতে হয়। চোখের কারণে সেটা পারি না। আরও একটা উপলব্ধি হয়েছে আমার, ৫০-৫৫ বছর পর্যন্ত একার জীবন, ইটস অলরাইট। তারপর সঙ্গী লাগে। এই যে প্রয়োজনের কথা বলছি, সেটা শুধু শরীরের চাহিদার কারণেই নয়। একজন বিশ্বস্ত, নির্ভরযোগ্য বন্ধু সব সময় পাশে থাকা খুবই প্রয়োজন। সেই অভাবটা অনুভব করি। আর আমি যেহেতু হোটেলে বসবাস করি, সুতরাং আমার অসুবিধাটা একটু বেশি। জীবনের পড়ন্ত বেলায় একজন বন্ধুর পাশে থাকাটা জরুরি। বাট, ইটস টু লেট! এখন অবশ্য কিছুই আর করার নেই।
হাসান: ধরুন, আপনাকে বাংলাদেশের সর্বময়, একক, নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব দেওয়া হলো, কোন কাজটাকে অগ্রাধিকার দেবেন তখন?
হেলাল: হা হা হা, এমন ক্ষমতা আমি নেবই না। আমার সবচেয়ে বেশি প্রিয় আলস্য, নারীর চেয়েও প্রিয়। ক্ষমতা যদি নিইও, রাষ্ট্রের বারোটা বাজবে। একই সঙ্গে আমারও। এটা আসলে আমার কাজই নয়। দেখলে না, সারা জীবনে একটা বই লিখেই কাটিয়ে দিলাম।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন হাসান হাফিজ।
কবি হেলাল হাফিজের কবিতা সমূহের নাম
নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়
নিরাশ্রয় পাঁচটি আঙুল
দুঃসময়ে আমার যৌবন
অস্ত্র সমর্পণ
অগ্নুৎসব
বেদনা বোনের মতো
ইচ্ছে ছিলো
প্রতিমা
অন্যরকম সংসার
নিখুঁত স্ট্রাটেজি
আমার সকল আয়োজন
হিরণবালা
দুঃখের আরেক নাম
প্রত্যাবর্তন
তীর্থ
অনির্ণীত নারী
অশ্লীল সভ্যতা
কবিতার কসম খেলাম
পরানের পাখি
বাম হাত তোমাকে দিলাম
উপসংহার
শামুক
আমার কী এসে যাবে
ইদানীং জীবন যাপন
পৃথক পাহাড়
অহংকার
কোমল কংক্রিট
নাম ভূমিকায়
সম্প্রদান
একটি পতাকা পেলে
মানবানল
যার যেখানে জায়গা
কবি ও কবিতা
ফেরিঅলা
উৎসর্গ
যেভাবে সে এলো
রাডার
যাতায়াত
যুগল জীবনী
লাবণ্যের লতা
তোমাকেই চাই
ভূমিহীন কৃষকের গান
কবুতর
নেত্রকোনা
তুমি ডাক দিলে
হিজলতলীর সুখ
রাখাল
ব্যবধান
কে
অমীমাংসিত
সন্ধি
ক্যাকটাস
তৃষ্ণা
হৃদয়ের ঋণ
প্রস্থান
ঘরোয়া
রাজনীতি
ডাকাত
তথ্য সূত্রঃ
https://bn.wikipedia.org/wiki/
প্রথম আলো ও অন্যান্য
ধন্যবাদ
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই অক্টোবর, ২০১৯ রাত ১০:১৯