পর-"ক্রিয়া"
===========
আড়াল থেকে একনজর দেখলাম,তাও ট্যারা চোখে। মেয়েটাকে আমার মোটেও ভালো লাগেনি।ভালো লাগার কথাও নয়,প্রিয়ন্তির ছাপের ছিটেফোটা থাকলেও মনকে বোঝাতে পারতাম আমি।কিন্তু,ও প্রিয়ন্তির সম্পূর্ণ বিপরীত।প্রিয়ন্তীর চোখ টানা টানা ছিলো এ মেয়েটার চোখে রাজ্যের সরলতা!যেন ভাজা মাছটাও উল্টে খেতে জানেনা সে।এমন মেয়ে নিয়ে সংসার করবো,এটা ভেবেই আমার রাগ হচ্ছিলো।
কিংবা,আমার মনে হয়তোবা অন্য কোন মেয়ের জন্য জায়গা হবেও না।প্রথম মনটা দিয়েছিলাম প্রিয়ন্তিকে।অন্যরকম একটা মেয়ে ছিলো সে।হয়তো,আমার চোখে অন্যরকম।
যেই মেয়েটাকে আমি আমার সামনে দেখছি ওর নামটাও বেখাপ্পা রকমের। নিদ্রি।মেয়ে হতে হবে চঞ্চল কিন্তু এই মেয়ে এর নামের মতোই।সারাদিন মনে হয় ঝিমুচ্ছে।আমার বিরক্তিটা বেড়ে গেছে ততক্ষণে।খটখট করে উঠে তাদের বাড়ির বাইরে চলে গেলাম।চুলোয় যাক ভদ্রতা আমার।ওদের জামাই আমি হবোনা,ব্যাস।
ঘর লাগোয়া একটা সিড়ি আছে নিদ্রিদের।সেখানে বসলাম।দক্ষিণমুখী।মন-মেজাজ ভালো করতে পারছি না কিছুতেই।এ মুহুর্তে আমার মন একজনই ভালো করতে পারে।প্রিয়ন্তি্।তার কন্ঠস্বর।ভাবনার অন্তরায় আমি প্রিয়ন্তিরর ফোনে তাকে পাবার চেষ্টা করি। অপেক্ষারত ফোনটা আমাকে বেশীক্ষণ অপেক্ষা করায়নি।প্রিয়ন্তির কন্ঠ আমি শুনতে পাই।
-তুমি কেন ফোন করেছো?
-আমি তোমাকে ছাড়া পারছিনা।
-দুঃখিত,আমি বিবাহিতা।
ফোনটা কেটে গেলো।আমার মন ঠিক ভালো না খারাপ হলো বুঝলাম না।আমি জানি,প্রিয়ন্তির বিয়ে হয়ে গেছে।তাও আমি ওকে ফোন করেছি।নিজেকে বোকা বোকা লাগছে আবার খুব বড় প্রেমিক মনে হচ্ছে।আবার মনে হচ্ছে প্রেম ভালোবাসা সবই ভুয়া।বিয়ে আসল সমাধান।এক ঝাটকে উঠে গেলাম বসা থেকে।নিদ্রিকে বিয়ে করেই ফেলবো। পুরোটাই প্রিয়ন্তির উপর ক্ষোভে করা আমি জানি।কিন্তু,আমিও তো মানুষ।এভাবে একা থাকলে আমি দিন দিন পাগল হয়ে যাবো।
"আমি রাজী"-দুই পরিবারের কথাবার্তার মাঝে মনে হয় বৃদ্ধাঙ্গুল ঢুকালাম আমি। সবাই হা করে তাকিয়ে আছে বৈকি অস্ফুটে হেসে দিলো। উনাদের উত্তরের অপেক্ষা না করে আমি আবারো বললাম,'তবে আমার একটা শর্ত আছে'
নিদ্রির বাবা আঁতকে উঠলেন।কেমন যেন অসহায় ভঙ্গিমায় বললেন,'বাবা,একটা ফ্ল্যাটের বেশী দেয়ার সামর্থ্য নেই আমার'। আমি লজ্জা পেলাম।আবার বিরক্তও হলাম।একটু বেশী বুঝে।হেসে বললাম,'আমার শর্ত এসব কিছু না,বিয়েটা আজই করবো'।
এতক্ষণে আমি নিদ্রির কন্ঠ শুনতে পেলাম।মিনমিন করে বলে,'আমার কাল পরীক্ষা'।ওর বাবা ওকে ধমকে দেয়।কণ্যা দায়গ্রস্থ পিতাদের অভ্যাস আর কি।এদিকে আমিও বিপদে।আজ বিয়ে না করলে কাল যে আমার মানসিক অবস্থা পরিবর্তিত হবেনা তার কোন নিরাপত্তা দেয়া যাচ্ছেনা।প্রিয়ন্তি যাবার পর থেকে এ অবস্থা আমার।
অবলা নারী ইচ্ছের বিরুদ্ধেই হয়তোবা সমর্পিত হলো আমার কাছে।আজ আমার বিয়ে নাকি সেটাই বোঝা যাচ্ছেনা।টিভি চ্যানেলের খবর ছাড়া বাড়িতে কোন কিছু শোনা যাচ্ছেনা।দরজার আড়ালে কয়েকবার গলায় হুশফাশ করে রূমে ঢুকে পড়লাম আমি। নিদ্রির হাতে তখন বই।আমার মেজাজ আর ভালো থাকলো না। পা দিয়ে ধাক্কা দিয়ে দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়ি আমি। কয়েকবার নিদ্রি ডেকেছিলো আমাকে।ইচ্ছে করেই উত্তর দিইনি।
হুট করে রাতে আবার আমার প্রিয়ন্তির কথা মনে পড়লো।ওর কথা মনে পড়লেই বুকের ভেতর কেমন কেমন করে।চিনচিন ব্যাথা করে উঠে।আমি তখন নিদ্রির দিকে একবার তাকাই।ওর ভেতর প্রিয়ন্তিকে খোজার চেষ্টা করি।কিন্তু হচ্ছেনা,মিলছে না।নিদ্রির হাত বাশের কঞ্চির মতো চিকন আর প্রিয়ন্তির ছিলো গোল।নিদ্রির গাল লম্বা ,ঠোট পাতলা ।প্রিয়ন্তির গাল গোল ছিলো তবে চুল অনেক বড় ছিলো।
কয়েকদিন চলে যায়।নিদ্রির সাথে ঠিক মানিয়ে উঠতে পারছিনা।কিন্তু এখন নিদ্রি আমার খবর রাখে।বাঙালী বউরা পতিভক্ত হয় খুব।নিদ্রিও তেমনটাই।নিদ্রি আমার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলে,হুট করে হাসি আসলে মুখ চেপে ধরে,দুই ঠোট একসাথ করে মুচকি হাসে। এই প্রথম নিদ্রিকে আমার ভালো লাগে।মুচকি হাসলে মেয়েটাকে অন্যরকম লাগে।আমি মুগ্ধতায় তাকিয়ে আছি। নিদ্রি গলা উচিয়ে জিগেস করে,'ওভাবে তাকিয়ে আছো কেন?' আমি উত্তর দিইনা।
আচমকা পাশের ফোনটা বেজে উঠায় থতমত খেয়ে যাই আমি।প্রিয়ন্তির নাম্বারটা তখনো ফোন থেকে মুছে যায়নি।আমি নিদ্রির দিকে একবার তাকাই।মেয়েটা চতুর,ফোনের পর্দায় প্রিয়ন্তির ছবি ভেসে উঠা দেখেও না দেখার ভান করে আছে।ফোনটা বেজে যাচ্ছে। আমি ধরছিনা দেখে নিদ্রি আমার সামনে থেকে চলে গেলো। রূম লাগোয়া বারান্দায় যাই। প্রিয়ন্তির ফোনটা ধরা মাত্রই ওপাশে আর্তনাদ।আমার নাম ধরে ডাকল। আমি বেশ উটকন্ঠা নিয়ে বললাম,'কি হয়েছে?'প্রিয়ন্তি কেদে উঠে।
'সুমন মরে গেছে'-প্রিয়ন্তির কন্ঠে অস্থিরতা।আমিও চমকে উঠলাম।'কিভাবে?'-গতানুগতিক প্রশ্ন করি প্রিয়ন্তিকে।প্রিয়ন্তির কন্ঠে এবার দ্রৃঢ়তা আসে।গাম্ভীর্য নিয়ে বলে,'আমি মেরেছি'।খবরটা শুনে দু পা পিছিয়ে গেলাম।'মানে কি?নিজের স্বামীকে নিজেই খুন?'-প্রিয়ন্তিকে বেশ উৎসাহ নিয়ে জিগেস করি আমি।'আমি ফোনে এত কিছু বলতে পারবোনা,তুমি প্লিজ আসো'-প্রিয়ন্তির কান্না বেড়ে যায়।
আমার খানিকটা সন্দেহ হচ্ছে।মেয়েটা ইচ্ছে করে মারেনি তো?তবুও গেলাম।ভেতরে ভয় কাজ করছিলো খুব।
নিদ্রি সামনে এসে বলে,'কি হয়েছে?কার বিপদ?' আমি নিদ্রির কথায় উত্তর দিই না।ওকে এড়িয়ে বাসা থেকে বেরুলাম।প্রিয়ন্তির বাসা আমি চিনিনা।ও একবার কুরিয়ার করেছিলো তখন ঠিকানা যা দেয়া ছিলো সেই ঠিকানা মোতাবেক আমি প্রিয়ন্তির বাসায় যাই। সুমনের নিথর দেহ পড়ে আছে।দরজা খুলতেই প্রিয়ন্তির লাল চোখ উপেক্ষা করে আমার চোখ গেলো সুমনের মৃতদেহের দিকে। চিত হয়ে শুয়ে আছে লোকটা।
প্রিয়ন্তির দিকে অবাক দৃষ্টি নিয়ে তাকাই।মেয়েটাকে ফোনে যেমনটা অশান্ত লাগছিলো বাস্তবে তার বিপরীত।স্বামী মরার জন্য কাদেনি সে।সে কেঁদেছিল নিজের সমূহ বিপদের আশংকায়। 'আমার কিছু হবেনা তো?'-আমার দিকে কাতুর চোখে তাকায় প্রিয়ন্তি।
আমি অট্টহাসি দিই।'খুন করেছো আবার বলো কিছু হবেনা?'-পাগল নাকি?
'প্লিজ তুমি আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাও,প্লিজ'-প্রিয়ন্তি এবার কেদে দেয়।
'আশ্চর্য!আমি কোথায় নিবো তোমাকে?আমার ঘরে বউ আছে'-প্রিয়ন্তি চেচিয়ে বলি।প্রিয়ন্তি নিচুপ হয়ে যায়।মেয়েটা চুপ হয়ে গেলে ওকে খুব মায়া লাগে।ভার্সিটিতে প্রথম যেদিক ওকে দেখি সেদিনও এমন চুপ ছিলো ও। চুপচাপ একটা টেবিলের কোনে বসে ছিলো।সেদিনের সেই তাকানোই আমার মন খেয়েছে।আমি প্রিয়ন্তির প্রেম পড়েছি,প্রিয়ন্তিকে ভালোবেসেছি আর একটা সময় প্রিয়ন্তি আমাকে ভুল বুঝে পরিবারের মতাদর্শ মেনে সুমন কে বিয়ে করে আর আমার জীবন শেষ করে।
অথচ,এই মেয়েটাকে আমার এখনো ভালো লাগছে।মনে হচ্ছে আরেকবার তার প্রেমে পড়ি।আমি প্রিয়ন্তির দিকে তাকিয়ে আছি পলকহীন দৃষ্টিতে।প্রিয়ন্তি রেগে উঠে।চেচিয়ে বলে,'কি হলো?' আমি চোখ সরাই।মিনমিন করে বলে,'তুমি খুব মায়াবী'।প্রিয়ন্তির রাগটা আরো বেড়ে যায়।'আমার ভুল হয়েছে তোমাকে এখানে ডাকা,আমি ভুলে গেছিলাম,তুমি অকর্মা'-আঙুল উচিয়ে বলে সে।
'ওকে খুন করেছিলে কেন?'-গম্ভীর গলায় বলি আমি।প্রিয়ন্তি এবার আমার দিকে তাকায় একরাশ আকুলতা নিয়ে।'ওর ভেতর তোমাকে খুজে পেতাম,যা অসহ্য লাগতো আমার।আর কতটা অসহ্য লাগলে আমি খুন করি,বোঝ তুমি?'
আমি দু পা পিছিয়ে যাই।'আমার ছায়া পাও মানে?'-চোখ বড় বড় করে তাকাই আমি।প্রিয়ন্তি এড়িয়ে যায়।'প্লিজ,এখান থেকে চলো,ভাগ্যিস হাউজিং এর বাসা,অনেক পরিবার,তাই এখনো জানাজানি হয়নি'-প্রিয়ন্তির চোখে মুখে অস্থিরতা।
এ মুহুর্তে তাকে নিয়ে আমি কোথাও যাবার আগ্রহ নেই।অন্তত খুনের মামলায় আমি ফাসতে চাইনা।সুমনের দেহটা আরেকবার দেখি আমি।খুনের কোন ছাপ নেই।লাফিয়ে উঠি আমি।'প্রিয়ন্তি' বলে চিৎকার দিই।প্রিয়ন্তি আমার দিকে এগিয়ে আসে।
'কি হয়েছে?'
'ওকে মেরেছে কিভাবে?পুরো দেহতে খুনের ছাপ নেই'
'গলায় ওড়না পেচিয়ে মেরেছি'
'কেন মেরেছ?মানে আজই হটাথ?'
'বাকবিতন্ডা চলছিলো'
'কি নিয়ে?'
'ওসব বাদ দাও।এখন কি করবো?'
'বাচতে চাও?'-প্রিয়ন্তির কাধে হাত রেখে বলি আমি।
'হু'-প্রিয়ন্তি ঘাড় নাড়ায়।
ওদের গাড়ি বের করে পরিচিত ডাক্তারের হসপিটালে নিই।ঘুস দিয়ে সাধারণ মৃত্যুর একটা সনদ বের করি আমি।এরপর প্রিয়ন্তিকে বলি,'তোমাকে অভিনয় করতে হবে'। ঘাড় উচিয়ে জিগেস করে,'কি অভিনয়?'
'কান্নার অভিনয়'-স্বাভাবিক ভাবে বলি আমি।
এত সহজে একটা খুনের মামলা সমাধান করতে পারবো ভাবিনি।প্রিয়ন্তির স্বামীর স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে প্রিয়ন্তি সাদা শাড়ি পরে কান্নার অভিনয় করছে।বাড়ি ভর্তি মানুষ।প্রিয়ন্তিকে ইশারা দিয়ে বিদায় জানালাম।বেশ কাটখড় পোড়া একটা দিন গেলো আজ।
বাসায় ঢুকতেই নিদ্রির প্রশ্ন,'কোথায় গিয়েছিলে?'
স্বাভাবিক উত্তর,'বন্ধুর বাসায়'
'ছেলে বন্ধু না মেয়ে বন্ধু?'
'মেয়ে বন্ধু'
'কেন?'
'ওর স্বামী মারা গেছে'
নিদ্রি চুপশে গেল।আমিও আর কথা বাড়ালাম না।নতুন বউ,ওকে সময় দেয়া উচিত আমার।
নিদ্রি দাঁড়িয়ে আছে ব্যালকনী ধরে।আমার ভেতরের পুরুষত্ব কেপে কেপে উঠছিলো।আমি বউকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরি।নিদ্রি এখন আমাকে বুঝে চলতে শিখে গেছে আর সে যতই বুঝে চলতে শিখে যাচ্ছে আমি ধীরে ধীরে তাকে ভালোবেসে ফেলছি।
দিনগুলো বেশ ভালোই কেটে যাচ্ছিলো।নিদ্রির সাথে এখন আর আমার অসহ্য লাগছে না।মনে মনে ভাবছি মানুষের মন কত্ত বিচিত্র! ক'দিন আগেও যাকে আমার অসহ্য লাগছিলো এখন তাকে আমার ভালোই লাগে,হয়তোবা সামনে আরো ভালো লাগবে এবং একটা পর্যায়ে ওকে ছাড়া আমার চলাটা অসম্ভব হয়ে যাবে।
দুই বছর পর,হটাঠ একদিন আবারো প্রিয়ন্তির ফোনে আমার ঘুম ভাঙলো।
'তুমি কোথায়?'
'বাসায়'
'ও বউ এর আঁচলে?'
'না,ও ওর বাবার বাসায়'
'ভালোই হলো।আমি একটু আসবো,কাজ ছিলো'
'আসো'
প্রিয়ন্তি মুহূর্তে আমার বাসায় চলে আসে। কথাবার্তা হবার এক পর্যায়ে জানতে পারি তার আবার বিয়ে হয়েছে।হেসে হেসে বলি,'এটা কি তোমার অভ্যাসে পরিণত হলো নাকি?'
প্রিয়ন্তির কন্ঠ ভারী হয়ে আসে,চোখে আকূলতা।'আমি তোমাকে চাই'-প্রিয়ন্তি আমার দিকে ঘনিয়ে আসে আরো।এরপর...কি থেকে কি হয়ে গেলো!
আমি হাঁপিয়ে পড়লাম প্রিয়ন্তির দেহে।ঘামছি দরদর করে।প্রিয়ন্তি কথা বলতে পারছে না।শুধু আমার পিঠ আকড়ে ধরে আছে। ঘন্টাখানেক পর দুজন একে অপরের দিকে আশ্চর্য হয়ে চেয়ে আছি।কি থেকে কি হয়ে গেলো!
প্রিয়ন্তি আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে,'এমনতেরো হবার কথা ছিলোনা,আমি তো সারাজীবনের জন্য তোমাকে চেয়েছিলাম'।
'আমি তোমার হতে চেয়েছিলাম,তখন কেন ছাড়লে আমাকে?'
'তখন বাধা হয়েছিলো আমার পরিবার'
'বুঝি চলে আসা যেতো না আমার সাথে?'
'মাথায় ছিলো না'
'এখন যা করছি সবই তো ভূল,তোমার স্বামী আছে আর আমার বউ আছে'
'আমি ওসব শুনতে চাইনা,তুমি আমার'
'সবই ভূল'
প্রিয়ন্তিকে ওর বাসায় দিয়ে আসি।শুনলাম ওর নতুন সংসার জীবনের কথা।ও নাকি একের পর এক বিয়ে করেই যাবে আর ছেলেদের খুন করে যাবে।যদিও ও কথা গুলো হেসে হেসে বলছিলো তারপরও আমার কাছে ব্যাপারটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ লাগছে।যেই মেয়ে এক স্বামীকে খুন করতে পারে,সেই মেয়ে আরো পারবে।আমি প্রিয়ন্তিকে বুঝাই,'কি লাভ এসব করে?' ওর নেশা লাগানো উত্তর,'ওরা কেউ তোমার মত না'।
প্রিয়ন্তিকে বাসায় দিয়ে নিজ বাসায় ফিরেই আঁতকে উঠলাম।'তুমি?'-নিদ্রির দিকে আঙ্গুল উচিয়ে বলি আমি।
'চলে এসেছি,তোমাকে ছাড়া ভাল্লাগছিলো না'-মুখ গোমরা করে নিদ্রি বলে।বিছানার দিকে ভুরু কুচকে তাকায় নিদ্রি। 'বিছানা ওমন এলোমেলো কেন?'-প্রশ্ন করে আমাকে।
'আ আ আমি কি জানি? হয়তো রাতে ঘুমের ঘোরে গড়াগড়ি খেয়েছিলাম'-বোকা ভাব নিয়ে উত্তর দিই আমি।নিদ্রি মাথা নাড়ায়।'ঘুমের মধ্যে তুমি তো গড়াগড়ি খাও না!'-সন্দেহের আচড় লাগলো ওর মুখে।
বেশ ধমকে উত্তর দিই,'তুমি কি আমাকে সন্দেহ করছো নাকি?'বেশ সহজ সরল ভাবে উত্তর দেয়,'আমি কেন তোমাকে সন্দেহ করবো?কিন্তু বাসায় তো এমন কেউ নেই যে বিছানা এলোমেলো করবে'।
'আহা,হতেই পারে এলোমেলো,বাদ দাও না'-বিরক্তি নিয়ে বললাম নিদ্রিকে।নিদ্রি চুপ হয়ে যায়। 'চা খাবে?'- চিকন কন্ঠে বলে নিদ্রি।'হু খাওয়া যায়,আমি ক্লান্ত'-হ্যা সূচক জবাব দিই তাকে।
কাচের চুড়ি আর কাপের টুংটাং শব্দ ভেদ করে আমার মনে বাজছে তখন রাজ্যের চিন্তা।প্রিয়ন্তির এসব পূর্ব পরিকল্পনা নয় তো? কি এক অপবিত্র আবেগে জড়িয়ে পড়লাম আমি,ছিহ! ভাবতেই অবাক লাগছে ঠিক দু তিন ঘন্টা আগে কি হয়েছিলোয়াবার ভাবি,যদি নিদ্রি দু ঘন্টা আগে বাসায় আসতো? কি হতো আজ।সে যাকগে,যা হয়নি তা চিন্তা করে লাভ নেই।এখন আমার চিন্তা প্রিয়ন্তিকে নিয়ে,যদি আমাকে ফাসিয়ে দেয়!
দিন কয়েক যাবার পর শুনি প্রিয়ন্তির এ স্বামীকেও মেরে দিয়েছে।তাও অনেক দিনের পরিকল্পনা মাফিক মেরেছে।খাবারে বিষ দ্রব্য মিশিয়ে প্রিয়ন্তি ধীরে ধীরে বেচারার ফুসফুস অকার্যকর করে দিয়েছে।এ মেয়েটাকে দেখলে এমন লাগে না আর এ কথাটাও অবিশ্বাস্য যে মেয়েটা আমার জন্য,শুধু আমার জন্য পরপর দুটো ছেলেকে খুন করেছে।অন্তত আমার বিশ্বাস হয়না।
আমাকে বের করতে হবে আসল কাহিনী কি।ভার্সিটির সবচেয়ে আঁতেল বন্ধুটি পুলিশের গোপণ বাহিনীর শিক্ষানবিশ।ওর কাছে গেলে কিছু একটা সমাধান পাওয়া যেতেও পারে।যেই ভাবা,সেই কাজ।
'উদয় তুই ফ্রি আছিস?'-উত্তরের অপেক্ষা না করে ওর রূমে ঢুকলাম।ও আমাকে দেখে খুশিই হলো। সমস্যা খুলে বলার পর উদয়ের থুতনীতে হাত।দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,'নারে,মেয়েটা তোর জন্য এসব করছেনা,উল্টো দেখ তুই ও এমন কোন ফাদে পড়ে যাচ্ছিস,মেয়েটা তোকেও খুনের প্ল্যান করছে'।
চমকে উঠলাম আমি।'বলিস কি? প্রিয়ন্তি নিজ থেকে আমার সাথে শারীরিক সম্পর্ক করলো'।
'সেটাই তো ফ্যাক্ট,বন্ধু'-উদয়ের চোখে রাজ্যের কৌতুহল।
'এখন আমি কি করবো?'-উদয়ের কাধে হাত রেখে বলি।
'আমি জানি প্রিয়ন্তির পরবর্তী পরিকল্পনা কি'
'কি?'
'ও বলবে ওর গর্ভে তোর সন্তান আর এটা বলে আগে তোর সংসার ভাঙবে,তারপর তোকে বিয়ে করবে,তারপর তুই খুন'।
উদয়ের কথা আমার একবার বিশ্বাস যোগ্য মনে হয় আবার বিশ্বাস করিনা।মানসিক দোটানা।উদয় আমার অবস্থা বুঝতে পারছে। আমার কাছে এসে বললো,'দ্যাখ আমি যা বলেছি সবই অনুমান নির্ভর।প্রথমটা মিলে গেলেই আমার কাছে আসবি।'আমি খানিকটা স্বস্তি পাই।
পরক্ষণেই আরেকটা প্রশ্ন জন্মালো মনে,'তাহলে মেয়েটা এমন করছে কেন?'
'সেটাই আমাদের দেখার বিষয়।মেয়েটা কি জন্ম থেকেই ওমন?নাকি কোন আঘাতের কারণে?'-উদয় বেশ চিন্তা করে বললো।
জীবনটা অনেক কঠিন হয়ে গেছে আমার এখন।সব সময় আলাদা একটা আতংকে থাকি,কখন নিদ্রি সেদিনের কথা জেনে যায়।আধো নিভু সিগারেট টা পায়ে চাপা দিয়ে ওপাশ ফিরতেই নিদ্রিকে দেখা গেলো।বুকের ভেতর ধুপ করে উঠলো।নিদ্রির গা কাপছে।চোখ ছলছল করছে।আমাকে কিছু একটা বলতে চেয়েও পারছে না।
'নিদ্রি তুমি?'
'হুম'
'কিছু বলবে?'
'হুম'
'কি?'
'প্রিয়ন্তি কে?'
বুকে যেন কেউ ইট ছুড়ে দিয়েছে।বোবা হয়ে যাচ্ছি।তবে কি সব জেনে গেলো?তাও অনেক সাহস নিয়ে জিগেস করলাম,'কেন?'
'বলো,প্রিয়ন্তি কে?'
'ইয়ে...'
'তোমার পূর্ব প্রেমিকা তো?'
আমি থতমত খেয়ে যাই। নিদ্রি বুঝতে পারে।কেদে দেয়।কেদে কেদে জিগেস করে,'এখন তোমাদের যোগাযোগ হয়?' আমি ঘাড় নেড়ে না সুচক উত্তর দিই।
নিদ্রি কেদে দেয় হুহু করে।এক ঝাপে আমার বুকে।যেন পরম আকূলতা!'আমি তোমাকে হারাতে পারব না,আগে যাই ছিলো প্লিজ এখন তোমার জগতটা আমাকে দিয়ে দাও''-নিদ্রির কান্না যেন আকাশ শুনছে!
আমি কিছুটা স্বস্তি পাই যে নিদ্রি অন্য কোন ব্যাপার জানতে পারেনি হয়তো বা মোবাইলে প্রিয়ন্তির মেসেজ পেয়েছে,এই যা!
নিজের ভেতরের স্বত্ত্বটা যেন জেগে উঠলো।অপরাধ বোধে ভুগছি মারাত্মকভাবে।নিদ্রিকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কথা দিই ও ছাড়া আর কারো কথা চিন্তাও করবো না আমি। নিজের কাছে নিজে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই।
খুব ভালো একটা সকালের আশা করেছিলাম,খুব ছোট্ট একটা পৃথিবী আর আমার এক চিলতে সুখ।কিন্তু বিধাতা যেন আমাকে পূর্বকৃত দোষের মার প্যাচে ফেলতেই ভালোবাসে।
ফোনের কাপুনির সাথে যেন আমার গা টা ও শিরশির করে কেপে উঠলো।
'প্রিয়ন্তি?'
'একটা ভালো খবর আছে'
'আবার বিয়ে করলা নাকি?'-উপহাস করে বললাম।
'করিনি,তবে করতে হবে'
'এবার খুন করার পরিকল্পনা কি?'-আবারো উপহাসের ঢং নিয়ে বললাম।
'তোমাকে কিভাবে খুন করি বলো?'-প্রিয়ন্তি অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে।সমূহ যে বিপদের আশংকা আমার মনে জেগে উঠেছে সেই সাথে পশুবৃত্তি মনোভাব।প্রিয়ন্তির কথার অপেক্ষা করলাম না।গম্ভীর গলায় বললাম,'নষ্ট করে দাও আর সেদিনের কথা ভূলে যাও'।
সাপের মতো ফুসে উঠে প্রিয়ন্তি।'আমি তোমার সাথে এক্ষুনি দেখা করতে চাই,এক্ষুনি,আমি তোমার সুখের সংসারে আগুন লাগাতে চাচ্ছি না'-প্রিয়ন্তি বেশ রেগে যায়।
সংসার ভাঙ্গার ভয় দেখিয়েছে সে। আমার যেতে হবে এবং তার কথা শুনতে হবে।উদয়ের বলা কথা অক্ষরে অক্ষরে মিলে যাচ্ছে।আমার ভেতর ভয় হচ্ছে খুব।তবে কথাটা উদয় কে জানালাম না।ছেলেটার সেদিনের আচরণ বেশ সন্দেহজনক মনে হয়েছে আমার কাছে।প্রিয়ন্তিকে নিয়ে কথা বলায় কেমন যেন থতমত খেয়ে গেছিলো আমার বন্ধু।
জীবনটাকে নিয়ে একটা বাজী লাগালাম।দেখা যাক কি হয়।
'বলো কেন ডেকেছো?'
'আমার পেটে তোমার বাচ্চা'-প্রিয়ন্তি বেশ স্বাভাবিক ভাবে বলে।আমি হালকা বিষম খেয়ে বললাম,'প্রমাণ কি ঐ বাচ্চা আমার?তুমি তো বিবাহিতা।কেন খামাখা আমার উপর দোষ চাপাচ্ছো? সেদিনের সেই ঘটনা সম্পূর্ণ অনিচ্ছাকৃত।'
প্রিয়ন্তির মুখে চালাকীর ছাপ।ঠোটে আঙুল বুলিয়ে বলে,'তার মানে তুমি এ বাচ্চার দায়ভার নিচ্ছো না?'আমি উত্তর না দিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
প্রিয়ন্তি একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।আমাকে উপহাস করে বলে,'আফসোস,তোমার সুখের সংসারের হাড়ি ভাঙবে।'
জায়গাটা বেশ নির্জন ছিলো।ভাগ্যিস,আমি প্রিয়ন্তির মতো মানুষ খুন করতে পারিনা,না হলে শরীরে প্রবাহমান সব রক্ত মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিলো,ওকে ওখানেই মেরে রেখে যেতাম।
'তুমি তোমার আগের দুই স্বামীকে খুন করেছিলে কেন?'-প্রিয়ন্তির দিকে প্রশ্ন ছুড়ি আমি।'তারা কেউ আমাকে তোমার মতো ভালোবাসতে পারেনি'-প্রিয়ন্তির আকূলতা!
'এটা দুই দুইটা খুন করার কোন কারণ হতে পারেনা'
'তোমার ভালোবাসা আমাকে সাইকো বানিয়ে দিয়েছে'
'তাহলে হলে না কেন আমার?'
'তখন তোমার অবস্থা ভালো ছিলোনা,আমাকে বিয়ে করে খাওয়াতে কি শুনি?'
'এই তোমার ভালোবাসা?'
'আসলে তোমাকে হারানোর পর বুঝেছি,কতটা ভালোবাসি তোমাকে'
'আর এতেই পর পর দু জনকে খুন? তাও একজনকে অনেক দিনের পরিকল্পনায় খুন?'
'হুমমমম'-প্রিয়ন্তি আমার কাছে ঘনিয়ে আসে।
ঘটনার আকস্মিকতায় আমি কিংকর্তব্যবিমুড়।'প্লিজ,প্রিয়ন্তি নষ্ট করে দাও,আমি ওই সন্তানের বোঝা বইতে পারবো না'-ওকে মিনতি করে বলি।'তা তো হবেনা প্রেমিক সাহেব,আপনি বুঝে শুনেই সব করেছেন'-বলেই প্রিয়ন্তি ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে পকেট নাইভ বের করে।আমার পেটের কাছে এনে কয়েকবার ঘোরায়।'আমার তৃটিয় খুন হবে জান?'-প্রিয়ন্তি হেসে হেসে বলে।
কানের নিচ লাল হয়ে চিকন ঘাম বেরুচ্ছিলো ওর আচরণে।হাত নাড়িয়ে বললাম,'ওকে,ফাইন,কি চাও?''তোমাকে'-প্রিয়ন্তির চোখে মুখে উচ্ছলতা। মনে মনে কিছু চিন্তা করলাম।অন্তত আজকের দিনটা বাচতে হবে ওর হাত থেকে।সিরিয়াল কিলার হয়ে উঠছে মেয়েটা,বিশ্বাস করা যায় না ,মেরেও দিতে পারে।
'তুমি আমাকে বিয়ে করবে?'-কলার চেপে ধরে প্রিয়ন্তি।মিনমিন করে বলি,'আমাকে কিছুদিন সময় দাও'।প্রিয়ন্তি অনেক কষ্টে রাজী হয়। উদয়ের সাহাহ্য আমার খুব প্রয়োজন এখন। আমি আগ পিছ চিন্তা না করে ওর অফিসে যাই।
'তুই তোর বউকে নিয়ে দূরে কোথাও চলে যা,তোদের ঘোরাও হলো,এদিকে আমি দেখছি'-সব শোনার পর উদয় আমাকে খুব সহজে সমাধান দিলো।আমি সমাধান শুনে খুশি হলেও চিন্তা করলাম,'উদয় কি করবে?ও তো প্রিয়ন্তিকে চিনেই না!'
প্রশ্নটা উদয়কে করার পর সে একটা হাসি দিলো কিন্তু মনে হলো সে হাসির আড়ালে লুকিয়ে আছে হাজার রহস্য।'তুই প্রিয়ন্তিকে চিনিস?'-বেশ আগ্রহ নিয়ে ওকে জিগেস করলাম।উদয় আবার হাসে।'তুই কোন চিন্তা করিস না,তোর বউকে নিয়ে ঘুরে আয়,এসে দেখবি প্রিয়ন্তির কোন অস্তিত্ব নেই। আমি '-আমার পিঠে হাত দিয়ে বলে উদয়।
আমি খানিকটা ভয় পাই।খানিকটা রহস্যের গন্ধ পাই।রহস্য জিনিস্ টা কেমন?স্বাদ নেই,গন্ধ ও নেই তবে ঠিকই গন্ধ পাওয়া যায় সময় ও সুযোগ মতো।আমি ভাবতে ভাবতে বাসায় যাই।
বউকে কথা দিয়েছিলাম,বাকি জীবনটা শুধু তাকে নিয়ে কাটিয়ে দেব।হাসি মুখে ঘরে ঢুকি।বারবার ভূলতে চেষ্টা করি প্রিয়ন্তির গর্ভে আমার সন্তান কিন্তু মন থেকে উঠছেই না ব্যাপারটা ।এ অবস্থায় উদয়ের কথা মতো দূরে কোথাও গেলেও উপভোগ্য হবেনা জানি,তবুও জীবন বাচাতে ওর কথা শুনতে হবে এখন।
আমার বউ খুব কম সময় আমার হাসি মুখ দেখেছে।সে আমার হাসি মুখের কাঙ্গাল।রূমে ঢুকেই হেসে দিই আমি তবে ওকে বুঝতে দিইনা হাসিটা কৃত্রিম।
'চলো অনেক দূরে কোথাও থেকে ঘুরে আসি'
'তুমি সত্যি বলছো?'-বউ হেসে দেয় খুশিতে।
'হ্যা,অনেক দূরে,শুধু তুমি আর আমি'
নিদ্রি হাসছে।ওর হাসি যেন চুইয়ে চুইয়ে পড়ছিলো।একবার মুচকি হাসি দেয় আবার ঠোট প্রসারিত করে হাসছে।দু ভাবেই ওকে খুব মায়াবী লাগছে।নিজেকে নিজে প্রশ্ন করি,'তবে কি আমার সব আবেগ নিদ্রির জন্য কাজ করা শুরু করেছে?' আমি খুশি হই।ওকে আমি ভালোবাসতে চাই,ওকে ভালো বেসে অন্ধকার অতীত ভূলতে চাই।
বেশ কয়েকদিন পর,উদয়ের ফোন। বুক ধকপক করে উঠলো আমার।ছোত বেলায় পরীক্ষার ফলাফল দিলে যেমন টা করে ঠিক তেমন।
'তুই সিউর ওই বাচ্চাটা তোর?'
'না,আমি সিউর না'
'তোদের মধ্যে এমনতেরো কিছু ঘটেছে?'
আমি চুপ করে রইলাম।
'কি হলো বল?'
'হু'-নিজেকে বড্ড অপরাধী লাগছিলো।
উদয় আর কিছু বললো না।ফোন রেখে দিলো। আমার মনে তখনো ভয় ভয় লাগছিলো আর লাগাটাই স্বাভাবিক।
পিঠে কারো স্পর্শে আঁতকে উঠলাম।নিদ্রির সরল চোখে চিন্তার ছাপ।'তুমি কি কোন সমস্যায় আছো?'-নিদ্রি আমার দিকে মাথা উচু করে তাকায়।'না,না,কিসের সমস্যা?'-আমি নিজেকে লুকানোর বৃথা প্রয়াস চালাই।
নিদ্রি মেয়েটাকে দেখে অবাক হই।সরলতায় ভরা মেয়েটা।সেই সরল মেয়েরা মনে যখন খুব কষ্ট পায় তখন তাদের ভেতরটা জ্বলে পুড়ে যায়।
'আমি বাসায় যাবো,ভালো লাগছেনা'-নিদ্রির মুখ থেকে এমন কিছু শুনেই বুঝলাম ওর কান পর্যন্ত গড়িয়েছে কথা গুলো।আমি এ ও চিন্তা করতে পারছি স্বস্ত্রীর কানে যখন পরকীয়ার কথা ঢোকে তখন পৃথিবীর কোন মেয়ে সেটা সহ্য করতে পারবে না।
আমি ঘোরাঘোরি বাদ দিয়ে নিদ্রিকে নিয়ে বাসায় যাই।পুরোটা পথ সে আমার সাথে কথা বলেনি।আমি জানতাম,আমার জীবনে এমন কিছুই ঘটবে।এত বড় সত্য চাপা থাকেনা আর এত বড় অপরাধ করার পর আমার ন্যূনতম সুখ চাওয়াটাও বড্ড বোকামী হয়ে যাবে!
ভেজা বেড়াল সাজার চেষ্টা করছিলাম নিদ্রির কাছে।
'তুমি কি অসুস্থ্য নিদ্রি?'
'নাহ,আমি কেন অসুস্থ্য হবো?'
'মন খারাপ?'
'নাহ'
'কথা বলছো না কেন?'
'আমাকে কিছু সত্য কথা বলবে?'
আমি বুঝতে পারলাম নিদ্রির কান গড়িয়েছে আমার সকল অপরাধ।আর এটা করেছে প্রিয়ন্তি। ধারণা সত্যি হলো আর আমি নিদ্রির সামনে লজ্জ্বাবনত হয়ে দাঁড়িয়ে আছি।নিদ্রি হূহূ করে কেদে দেয়।'কেন করলে এ কাজ?'-আমাকে প্রশ্ন করে।আমি উত্তর দিইনি।জানি,আজকের পর থেকে নিদ্রি আমার সাথে থাকবেনা।
আমি কিছু না বলে বাসা থেকে বের হয়ে যাই।জীবনটা বেশ অর্থহীন লাগছিলো।তবে প্রতিশোধস্পৃহা কাজ করছিলো খুব।প্রিয়ন্তির শেষ দেখে ছাড়বো।সোজা গিয়ে ওর বাসায় হাজির হই আমি।
'বিয়ে করবানা আমাকে?'-প্রিয়ন্তিকে জিগেস করি। প্রিয়ন্তি দু চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।'কি? কথা বলছো না কেন? চলো তোমার সন্তানের পিতৃ পরিচয় দিই,চলো?'-প্রিয়ন্তির হাত ধরে হ্যাচকা টান দিই আমি।
প্রিয়ন্তি মেঝেতে বসে যায়।তার গাল বেয়ে পানি পড়ছে।'সব কিছুই ছিলো আমার কল্পনা'-প্রিয়ন্তি ধীর তালে কথা গুলো বলে।
'মানে কি?'-মাথায় হাত দিয়ে বলি আমি। 'আমি কখনোই মা হতে পারবোনা'-প্রিয়ন্তি দরজাটাকে আকড়ে ধরেছে,যেন সে অবলম্বনহীন।আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না,তবে বেশ রাগ হচ্ছিলো।রাগ হবার কারণ,আমার সংসার শেষ করেছে প্রিয়ন্তি।
চেঁচিয়ে বললাম,'তবে কেন আমাকে ফাঁসালে?' প্রিয়ন্তির হাতে তখনো পকেট ছুরি। ভাব ভঙ্গিমায় বোঝা যাচ্ছিলো সে আত্মহত্যা করবে।প্রিয়ন্তি ডুকরে কেদে উঠে,'একটা সত্য কথা বলবো?'নিজেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছিলাম রহস্যটা বের করার জন্য মাথা ঠান্ডা রাখতে।'হু' বলে প্রিয়ন্তির কথার উত্তর দিলাম।
'আমি তোমাকে কখনোই ভালোবাসতাম না'-প্রিয়ন্তির ঠোটের কোনে হাসি।আমার উত্তরের অপেক্ষা না করেই বললো,'আমার সব আবেগ,সব ভালোবাসা ছিলো উদয়ের জন্য'।মাথা ঘুরপাক খাচ্ছিলো।উদয় প্রিয়ন্তিকে ভালোবাসতো এটা আমি জানতাম না! প্রিয়ন্তিকে দেখে মনে হচ্ছিলো সে এখন কোন রকম মিথ্যে বলছেনা।আমিও বিশ্বাস করে গেলাম।
পরের প্রশ্ন করার আগেই বিল্ডিং কেপে উঠলো।সেকেন্ডে প্রিয়ন্তির বুকে রক্তক্ষরণ!পেছনে তাকিয়ে দেখি আমারই বন্ধু উদয় দাঁড়িয়ে আছে।সরকারী দুটো গুলি প্রিয়ন্তির বুকে ঢুকে গেলো মুহুর্তে।প্রিয়ন্তি একবার উঠতে চাইলো,কিন্তু পারলো না।
'ইনকাউন্টার'-উদয় দুষ্টূ হাসি দিয়ে বলে।
এসব স্বপ্ন না তো? আমি উদয়কে জিগেস করি পুরো ঘটনা।উদয় কিছু না বলে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বাচ্চা ছেলের মতো কান্না শুরু করলো।প্রিয়ন্তির সদ্য লাশ দেখিয়ে আমাকে বলে,'ওকে ভালোবাসতাম খুব,তোরা কেউ জানতি না,কারণ আমরা জানাইনি,একটা সময় জানতে পারি ওর মা হবার ক্ষমতা নেই তখন আমি পশুর মতো ওকে ছেড়ে দিই,যার মা হবার ক্ষমতা নেই,তার সাথে থাকব না। এরপর থেকেই মেয়েটা মানসিকভাবে অসুস্থ্য হয়ে পড়ে।একে একে তোর সাথে আরো অনেকের সাথে প্রেম বা বিয়ের সম্পর্ক গড়ে তুলে।তোর সাথেও যা করেছিলো সবই অভিনয়।পরে আমি বুঝতে পেরেছিলাম প্রিয়ন্তিকে ছাড়া থাকা সম্ভব না। কিন্তু তুই ওর সাথে প্রেম করার পরেই আমার তোর প্রতি খুব রাগ হয়েছিলো তাই আজ তোর সংসারটা আমিই ভেঙ্গেছি'।
উদয়ের সব গুলো কথা যেন কল্পনা মনে হচ্ছে।'আমার সংসারটা কেন ভাঙলি?'-উদয়কে রক্তচক্ষু নিয়ে জিগেস করি।
উদয় আমার দু বাহু আকড়ে ধরে।'না ভাঙ্গে নি,তোর বউ তোর বাসাতেই আছে,আমিই ভেঙ্গেছিলাম,আমিই জোড়া লাগিয়ে দিয়েছি নিজের ভালোবাসাকে খুন করে'-উদয় কেদে কেদে বলে।
উদয় নিদ্রিকে সব মিথ্যে বললো।আমার সাথে প্রিয়ন্তির কোন সম্পর্ক ছিলো না,সবই উদয়ের বানানো।উদয়কে জিগেস করলাম,'মিথ্যে কেন বললি?'তার একটাই উত্তর,'বন্ধুর জন্য আমি সব করতে পারি'।
আমার ভেঙ্গে যাওয়া সংসার জোড়া লাগিয়ে দিলো উদয়।সেদিন থেকে আরেকবার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই,আজ থেকে ধ্যান জ্ঞান সবই নিদ্রি,মেয়েটাকে আমি সত্যিই ভালোবেসে ফেলেছি।'
আরেকটা সুখের রাত কাটানোর পর যখন প্রথম কোন অনুভুতি নিয়ে বউ এর হাতের চা খেতে যাবো,পত্রিকা খুলে তখনই দেখি,'পুলিশের গোপণ বাহিনীর সদস্যের শিক্ষানবিশ উদয়ের আত্মহত্যা'।
বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো ।প্রিয় বন্ধুটা আর নেই।নিজেকে নিজে বুঝালাম,থাকবেই বা কেন?প্রিয় বন্ধুটার প্রিয় মানুষ ও যে আর নেই।
নিদ্রিও পত্রিকা দেখে হতভম্ভ হয়ে রইলো।অজানা কোন এক ভয়ে চায়ের কাপ রেখে আমার হাতটা শক্ত করে ধরে রেখেছে সে।