নওমীকে আমি প্রথম দেখি কলেজে ভর্তির দিন। আমার মতোই মনে হয় ঢাকার বাইর থেকে আসা। চেহারায় সেই সাধাসিধে ভাবটা ফুটে উঠেছিল। মনে হয় সাথে তার বাবা এসেছে।
সেদিন দেখেই আমি মোটামুটি ভিমড়ি খেয়ে গেছিলাম।সাদা একটা জামা পরে এসেছিল সে।চুলগুলো সিউর বাসার কেউ খোপা করে দিয়েছে। প্রথমে ভেবেছিলাম, মেয়েটা কাজল দিয়েছিল কিন্তু না মেয়েটার চোখের ভ্রু জোড়া এমনিই কালো। গাঢ় কালো!! হাতে একটা চিকন চুড়ি। আমি ঠিক বুঝলাম না,এত সাধাসিধে মেয়ে আমাদের দেশে খুব কম পাওয়া যায়।
কলেজ ক্যাম্পাসের বাইরে কড়া রোদ। ভর্তি হতে এখনো অনেক দেরী। আমার চোখ সরেই না তার দিক থেকে।
সময় কেটে গেলো তাকে দেখতে দেখতে। কপালের ঘাম গড়িয়ে পিচ ঢালা তপ্ত রাস্তার পিপাসা দূর করছে সেটা আমি খেয়ালই করিনি এতক্ষণ।
কলেজে ভর্তি হয়ে বাসায় চলে যাই। মেয়েটার কথা প্রায় ভূলেই যাই। অনেকদিন পর একদিন ল্যাব ক্লাসের সামনে দাড়িয়ে আছি। পরের পিরিয়ডে আমাদের ল্যাব ক্লাস। হুট করেই ল্যাব ক্লাসের ভেতর অদ্ভুত আওয়াজ শুনলাম। কাচ ভাঙ্গার আওয়াজ।
তাকিয়ে দেখি, এ তো প্রথম দিন দেখা ওই মেয়েটি। আমি একটু উৎসুক হয়ে ল্যাব ক্লাসে উকি দিলাম।
স্যার কড়া মুখে বললেন,
-এই মেয়ে এদিকে আসো।
-জ্বি স্যার
-তুমি যে এই জিনিসটা ভাঙ্গলে এর দাম কতো জানো?
-না স্যার।
-তা জানবে কেন? বড় লোকের মেয়ে,যাও এসি গাড়িতে, আসো এসি গাড়িতে,থাকো বিশাল ফ্ল্যাটে। এসব জানবা কিভাবে?
-স্যার আমার মা নেই। বাবা আরেকটি বিয়ে করেছেন.....
এরপর দেখলাম স্যার ও চুপ হয়ে গেলেন। স্যার ওকে তার জায়গায় যেতে বললেন।
আমি আর সেদিন ল্যাব ক্লাস করিনি। মেয়েটাকে আমার ভালো লেগেছিল। আজ তার সম্পর্কে জানার আমার ভীষণ ইচ্ছা হচ্ছে। মেয়েদের ল্যাব শেষ হবার পর তারা বেরুচ্ছিল ক্লাস থেকে। আমিও নওমীর পিছু নিই। কলেজ ক্যাম্পাস থেকে বের হয়ে অন্য মেয়েরা যখন পাশের রেস্টুরেন্টে যাবার কথা ভাবছিল তখন নওমী পার্স থেকে দশ টাকার নোট বের করে রাস্তার ধার থেকে দুটো সিঙ্গাড়া খেয়ে নিলো।
-এই যে
-আমাকে বলছেন?
-জ্বি
-ল্যাবে কি হয়েছিল?
-ভেঙ্গে ফেলেছি
-আপনার সাথে কথা বলবো একটু
-জ্বি বলেন।
-তখন আপনি স্যারকে বললেন আপনার মা.....
-জ্বি সত্য
-তাহলে কার কাছে থাকেন আপনি?
-আমার নানার বাসায়।
সেদিন এভাবেই পরিচয় হয় আমার আর নওমীর মধ্যে। নাম, ঠিকানা জানাজানি হয়। জানতে পারি পড়াশোনার খরচ সে নিজেই বহন করে। আমার বয়সী একটা মেয়ে টিউশানি করায় আর আমি এখনো অন্য স্যারের কাছে পড়ি!! ভাবতেই অবাক লাগে।
নওমীর মধ্যে আমি ইগো দেখিনি। চাপা স্বভাব দেখেছি। তবে সেটা বন্ধুত্ব গাড় হবার পর আর হয়নি। উল্টো নিজ থেকেই আমাকে বলতো। টিউশানির টাকা পেলে আমাকে একটা সিঙ্গাড়া খাওয়াতো সে। প্রতিমাসেই আমি তার থেকে একটা করে সিঙ্গাড়া খেতাম।
সাত মাস চলে যায় এভাবে। আমাদের বন্ধুত্ব অনেক গাঢ় হয়। নওমীর প্রতি আমার অন্য একটা টান আছে। কিন্তু আমি সেটা বলিনা। কারণ, এ মেয়ে স্বপ্ন দেখে না, এ মেয়ে বাস্তব কে স্বপ্ন বানাতে চায়। ভয় হয়, যদি বন্ধুত্ব টা ছুটে যায়।
তবুও আমরা তো মানুষ!! মনের কথা মনে চেপে রাখলেও মুখে তার প্রতিচ্ছবি দেখা যায় আর বিচক্ষণ ব্যাক্তিরা সেই মুখ দেখেই বলে দিতে পারবে আমাদের মনের কথা।
নওমী যদি বিচক্ষণ না হতো তাহলে সে সংগ্রাম করে নিজের জীবন চালাতো না। নওমীর সাথে দাড়িয়ে আছি ক্যান্টিনে।
-তোর সাথে আমার কথা আছে।
আমি মোটামুটি ভয় পেলাম।
-কিরে নওমী? কি হলো?
-বাইরে চল।
একটু নির্জনে যেয়ে দাড়ালো নওমী।"এ্যাই তুই আমাকে ভালোবাসিস,তাই না?"-- নওমী তার হাত দিয়ে আমাকে ঘুসি মারলো প্রায়!! আমি চুপ করে আছি।
-কি হলো বল
-কি বলবো?
-ভালোবাসিস কিনা?
-বাদ দে না
-না বল
-হুম, খুব বেশি।
-বিয়ে করতে পারবি আমায়?
-আর ইউ কিডিং? তোকে ভালবাসি সত্য। তুই আমার আবেগ নিয়ে ফাজলামি করতে পারিস না।
-আমি মোটেও ফাজলামি করছি না।
নওমীর চেহারায় ফাজলামির ছাপ নেই।আমি একটু ভয় পেলাম। জানতে চাইলাম কি হয়েছে তার? উত্তরে শুনি,তার বাসায় বিয়ের কথা চলছে।বললাম, "তো তাকেই নিয়ে কর!!" উত্তরে শুনি,ওই ছেলে নওমীকে আর পড়তে দিবে না ।
এবার বুঝলাম আসল কাহিনী। মেয়েরা যে নিজের স্বার্থ দেখে এটা আসলেই সত্য। কিন্তু নওমীর চেহারায় অন্য রকম কিছু দেখলাম আমি। চোখগুলো টলমল করছে তার। কিছুক্ষণের মধ্যেই কেদেও দিবে সে।
-এ্যাই,বলনা ভালোবাসিস কিনা?
-আগেই তো বলেছি।
-তাহলে প্লিজ আজই বিয়ে কর। আজই আমি চলে যাবো। নইলে বাবা টাকার লোভ সামলাতে পারবে না।
ভ্রু কুচকে বললাম,"টাকার লোভ মানে?" সে বললো,"তার বাবা প্রচুর টাকার বিনিময়ে ওই ছেলের সাথে তাকে বিয়ে দিচ্ছে। " ব্যাপারটা বুঝলাম।
আমি আবারো বললাম,"আচ্ছা নওমী, তুই যে আমার সাথে যাবি,তোর বাসা?" সে বললো সে তার নানুকে বলেছে সব।
আমি ভেবে পেলাম না কিছু। মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ার অবস্থা। আমার মা টা সহজ সরল। আমার সব ইচ্ছাই পূর্ণ করে। নওমীর কথা আমার মাকে প্রচুর বলি। এতটাই বলি যে আমার মাও নওমীর প্রেমে পড়ে যায়।
হুম। জীবনে কখনো ভালো কাজ করিনি। একটি অসহায়, পথভ্রষ্ট মেয়েকে একটু আলোর পথ দেখাই না!! সমস্যা কি? ভেবেই নওমীর দেয়া হটাৎ সিদ্ধান্তে সাই দিই আমি।
নওমীকে নিয়ে নতুন জীবন তখনো শুরু হয়নি আমার। আমি আমার মাকে সব বুঝিয়ে বলি। আমার মা সবই মেনে নিলেন। শুধু একটা দিক। বিয়ে এত তাড়াতাড়ি না। নওমীও নতুন আশ্রয় পেলো। কলেজ ট্রান্সফার করে সে ভর্তি হলো আমাদের এলাকার কলেজে।
আশ্চর্য লাগে, আমার পরিবার ওকে খুব সহজেই আপন করে নিয়েছে। সবার সাথে সে মিশে গেছে অল্প ক' দিনের মধ্যেই। নওমী ও উচ্ছল। নতুন জীবন পেয়েছে সে। বর্তমান সময়ের প্রেম ভালোবাসার মতো আমাদের সম্পর্কটা ছিল না। আমাদের কথা হতো দিনে একবার। আমরা কখনোই বলা লাগতো না,'আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবো না...ইত্যাদি ইত্যাদি।
কারণ আমরা জানি আমাদের কারোরই কাউকে ছাড়া থাকতে হবে না। আমিরা দুজন দুজনের হয়ে আছিই।
নওমী আমাদের এলাকায় থেকেই কলেজ জীবন শেষ করলো। এ দেড় বছরে তার বাবা তাকে একবারো খোজ করেনি। তাস্র মামার বাড়ি থেকে মাঝে মধ্যে খবর নিতো।
মেয়েরা নিজের প্রতি খুব কেয়ার নেয়। কলেজ জীবন শেষ না করতেই নওমী উঠে পড়ে লাগে ডাক্তারি পড়ার আশায়। মেডিকেলে পড়ার নেশায় বিভোর হওয়া মেয়েটি আমার সাথে সারাদিন বকাবকি করে। আমি নাকি নিজের ভবিষ্যত নিয়ে সিরিয়াস না!!
দিন চলে যাচ্ছিল এভাবে। নওমীর পরনে জামার উপর এপ্রন উঠে গেছে তার পরিশ্রম গূণে। অর্থাৎ কিছুদিন পরই সে ডাঃ নওমী হয়ে যাবে। আমি ছিলাম কোন এক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কোণে।
আমাদের আসল প্রেমটা জমে উঠে তখন ভালোবাসা আর মারামারির, ঝগড়ার পাশাপাশি আমাদের দুজনের মধ্যেই আসতে থাকে মানসিক পরিপক্কতা। আমরা বুঝতে শিখি ভালোবাসার সঙ্গাটা কি।
মেডিকেলে পড়ুয়া মেয়েরা সুন্দরী হয়!! নওমী ওখানে না পড়লে বুঝতাম না। নওমীকে যতবার দেখি আমি ততবার নতুন করে তার প্রেমে পড়ি। আমি ততবেশি তাকে ভালোবেসে ফেলি। তাকে নিয়ে হারিয়ে যেতে থাকি কল্পনায়।
পড়াশোনা প্রায় শেষের পথে। আমার মা নিজ থেকেই আমাদের বিয়ে দিলেন। আমরা হয়ে যাই আপনের চেয়েও বেশি কিছু।
মেয়েটির জন্য আমাদের বাসা নতুন কোন জায়গা নয়। একটা অনাশ্রিত মেয়েকে নতুন ঠিকানা খুঁজে দিতে পেরেছি বলে নিজেকে ধন্য মনে হয় মাঝে মাঝে। আবার ধন্য মনে হয় এমন একটা মেয়েকে নিজের করে পেয়েছি বলে।
বিয়ের রাতে আমার চিরচেনা নওমী লজ্জ্বায় তার মুখ লুকিয়েছে ঘোমটার আড়ালে। আমি চুপচাপ দাড়িয়ে আছি। সবাই ঘুমানোর পর তাকে নিয়ে ছাদে যাই আমি।
-যাক,এত দিন পর তুমি আমার বউ।
-এতদিন ছিলাম না?
-কাগজে কলমে আজ থেকে
-এই শোন,আমি কিচ্ছু করতে পারবো না। আমি বাসায় বসে থাকব সারাদিন। ডাক্তারি পড়েছি তোমার সেবা করার জন্য।
-আমিও পারবো না কিচ্ছু করতে।
-তাহলে খাওয়াবে কে?
-আমিই খাওয়াবো। তবে প্রতি মাসে একটা সিঙ্গাড়া।
নওমী আমার কথায় হাসেনি। চুপ হয়ে গেছে। আমি বুঝতে পারিনি তার এ কথায় অতীত মনে পড়বে। টুপ করে তার চোখে পানি নিচে পড়ছে। আমি হাতের তালু বন্দি করি সে পানি। আলতো করে মুছে দিই তার চোখের পানি। সে কেপে উঠে। হুহু করে কেদে দেয়।
আমাকে জড়িয়ে ধরে কাদে। আমাকে শক্ত করে ধরে। হয়তোবা এখনো তার নিজের কাছে নিরাশ্রিতা মনে হচ্ছে। কিন্তু তাকে কে বোঝাবে!! তার এ ঠিকানা কখনো হারাবে না।
মেয়েটাকে যে সত্যিই ভালোবাসি আমি।