“আমি কিচ্ছু শুনতে চাই না, তোমাকে আসতেই হবে”।
“আরে তুই আমার কথাটা তো শোন, এমন হুট করে কি ভাবে যাই বলত?”
“বাবা, তোমার একমাত্র মেয়ের বিয়ে। আর তুমি সেই বিয়েতে আসবে না? আমি কোন কথা শুনব না। তুমি আসছ। এটাই ফাইনাল। ব্যাস”
কথাটা বলেই মেঘনা ফোনটা কেটে দিল। আমাকে কিছু বলার সুযোগ পর্যন্ত দিল না। মেঘনা আমার একমাত্র মেয়ে। এক সপ্তাহ পর ওর বিয়ে। তাই আমাকে ফোন করে নিমতন্ন করল। ভাবছেন, মেয়ে বাবাকে বিয়ের নিমতন্ন করল কেন? বাবারই তো উদ্যগী হয়ে মেয়ের বিয়ে দেওয়ার কথা। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা একটু আলাদা। আসলে আজ থেকে ২৭ বছর আগে আমার আর মেঘনার মা নীলার বিয়ে হয়েছিল। আমার মায়ের খুব কাছের বান্ধবীর মেয়ে ছিল নীলা। ছোটবেলায় আমার বাবা মারা যাওয়াই, মা অনেক কষ্ট করে আমাকে মানুষ করেছিল। তাই বিয়ের সময় তার কথার অবাধ্য হতে পারিনি, যদিও অবাধ্য হওয়ার মতো কোন কারনও ছিল না। মা আর নীলাকে নিয়ে আমার সংসার জীবন খুব সুখেই কাটছিল। সাধারন মধ্যবিত্তদের মতো ছকে বাধা রুটিন হলে পরেও, নীলা আমার জীবনে আসার পর, চাকরীতে বেশ ভালই উন্নতি করতে থাকলাম। বিয়ের দুবছরের মাথায়, আমার নীলার ভালবাসার চিহ্ন হিসেবে, ছোট্ট পরী মেঘনার জন্ম হল। অফিসে কাজের চাপ থাকা সত্বেও, নিজের পরিবারের সাথে সময় কাটানোর চেষ্টা করতাম, কখন সেই চেষ্টা সফল হত, আবার কখন বা বিফল। কিন্তু কথায় বলে না, সুখের চাকা কখন এক ভাবে ঘোরে না। প্রবাদ মেনেই, সুখের উল্টো পিঠের দুঃখের সাথে আমার পরিচয় হল। বিয়ের ৭-৮ বছর পর, ছোট খাট বিষয় নিয়ে, আমার আর নীলার প্রচন্ড ঝগড়া বাঁধত। দুজনের কেউই, কাউকে বুঝতে চাইতাম না। একে অপরকে হারানোর খেলায় মেতে উঠেছিলাম। ছোট্ট মেঘনা তখন আমাদের ঝগড়া দেখে, ভয় পেয়ে গিয়ে, ঠাকুমার কোলে গুটিসুটি মেরে পরে থাকত। দেখতে দেখতে আমাদের দাম্পত্য কলহ, চরম পৌছে গেল। আর নীলা, আমাকে ছেড়ে, আমার বাড়ি ছেড়ে, আমার সংসার ছেড়ে নিজের বাপের বাড়ি চলে গেল। আমার মা ওকে অনেকবার বুঝিয়েছে, ফিরে আসার জন্য, কিন্তু ও আসেনি। আমার মাথায় তখন জেদ এতটাই চেপে ছিল যে, নীলকে জব্দ করার তাগিদে, আমি ওকে ফিরিয়ে আনতে যাইনি। কিংবা একবারের জন্যে হলেও ওকে বলেনি, প্লিজ নীলা, তুমি ফিরে এসো। আমার ভুল হয়েছে। দিন গেল, সপ্তাহ গেল, মাস গেল। তারপর একদিন, নীলার কাছ থেকে চিঠি পেলাম। ডিভোর্স লেটার। এই চিঠিটা দেখে, আমার মাথায় যেন আগুন জ্বলে গেল। মায়ের শতবাধা উপেক্ষা করে, নীলাকে চিরকালের মতো মুক্তি দিয়ে দিলাম। সেই সেদিন থেকে, আজ অবধি, আমি নীলা বা মেঘনা, কারো মুখ দেখিনি। জানি না, আমার সেই ছোট্ট পরিটাকে কেমন দেখতে। তখন বয়স কম ছিল, জেদের বসে অনেক গোঁয়ারতুমি করেছি। কিন্তু মন থেকে আজও আমি নীলাকে, অনেক ভালবাসি। আমার মেয়ে মেঘনাকে ভালবাসি। আজও আমার টেবিলে, আমাদের পঞ্চম বিবাহবার্ষিকীর দিন তোলা ছবিটা জ্বলজ্বল করে। যেখানে, আমি, মা, নীলা আর ছোট্ট মেঘনা রয়েছে, আমার কোলে। শুধু ছবিতেই, আমার কাছে ওরা কেউ নেই। মা মারা গেছে পনের বছর হয়ে গেছে। মা মারা যাওয়ার পর, দেশ ছেড়ে বিদেশে এসে, একটা মাল্টি ন্যাশেনাল কোম্পানিতে কাজ করে অনেক টাকা রোজগার করেছি। কিন্তু নিজের জন্য, একফোঁটা সুখ কিনতে পারিনি। মাঝেমাঝে মনে হয়েছে, নীলার সাথে যোগাযোগ করি, আমার ছোট্ট পরীটার খোঁজ নিই, কিন্তু পরক্ষনেই আবার ভেবেছি, নীলাও তো একবার আমার খোঁজ নিতে পারত। কই সে তো নেয়নি। হয়ত সে এখন অন্যকারো ঘরে গৃহিনী হয়েছে। আর আমার মেঘনা হয়ত, তাদের কাছে অনেক কষ্টেই আছে। ডিভোর্সের সময় কেন যে মেঘনাকে ছেরে দিলাম। আজ আমার মেঘনার ২৫ বছর বয়স, সমনের সপ্তাহে বিয়ে, আমাকে বলেছে, ওর বিয়েতে যেতে। জানি না, আমার নাম্বারটা কোথা থেকে পেল।
-“আমাকে ডেকেছিলেন স্যার”?
আমার সেক্রেটারি বিজনের কথায়, আমার যেন ঘোর কাটল। দিবাস্বপ্ন বন্ধ করে, বিজনকে বললাম
-“বিজন নেক্সট উইক আমাকে দেশে যেতে হবে। তুমি সব অ্যারেঞ্জ করতে পারবে?”
-“নেক্সট উইক!”
-“হ্যাঁ, আসলে একটা দরকারি কাজ পরে গেছে। আমাকে যেতেই হবে, বুঝলে। তুমি একটু ব্যবস্থা করে দাও।”
গল্পের পরবর্তী অংশ দ্বিতীয় পর্বে
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে এপ্রিল, ২০১৬ রাত ১:৫৭