এই পর্বে আমরা আলোচনা করব প্রচলিত পদ্ধতিতে নামাজ এ অংশ নেয়ার প্রতীক্ষিত প্রমাণগুলোর পরিপ্রেক্ষিত নিয়ে। এর আগের পর্বে ইমাম আবু হানিফা র.'র অত্যাবশ্যকীয় পরিচিতি ছিল। প্রথম পর্ব ছিল বিষয়ের অবতারণা।
অতি সংক্ষেপে গ্রহণীয় সিদ্ধান্তগুলোতে চোখ বুলিয়ে যাব।
একাধিক বিপরীত মত একই সাথে শুদ্ধ হতে পারে
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া আসহাবিহি ওয়াসাল্লাম মাত্র যুদ্ধ থেকে ফিরেছেন। তিনি সাহাবা রাদ্বিআল্লাহু আনহুমকে তখনি বানু কুরাইজা গোত্রের দিকে যাত্রা শুরু করতে বললেন। তারা মদীনার শহরতলীতে বসবাস করতো। লিখিত চুক্তি ভঙ্গ করায় তাদের উপর অবরোধ স্থাপনের উদ্দেশে। রাসূল দ. বললেন, বানু কুরাইযায় ছাড়া তোমরা আসরের নামাজ আদায় করবে না।
বানু কুরাইযার পথেই আসরের সময় চলে এল। আর পাঁচ ওয়াক্তের মধ্যে আসর সবচে সংক্ষিপ্ত। সাহাবাদের কয়েকজন এ সিদ্ধান্তে এলেন যে, দ্রুত বানু কুরাইযায় পৌছতে হবে, এই আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি আসর সেখানে পড়ার কথা বলেছেন। কিন্তু আসরের সময় চলে যাবার ফলে নামাজ কাযা হয়ে যাবে, এই উদ্দেশ্য তাঁর নয়। তাঁরা নামাজ আদায় করলেন।
আর কয়েকজন সাহাবা রা. সিদ্ধান্তে এলেন, কাযা হোক আর যাই হোক, রাসূল দ. যেহেতু বলেছেন, গন্তব্যে পৌছেই নামাজ আদায় করা হবে। এবং তাঁরা তা বাস্তবায়ন করলেন।
ফিরে এসে কারা সঠিক কাজ করেছেন প্রশ্ন করার পর রাসূল দ. জানালেন, উভয় পক্ষই পুরোপুরি সঠিক কাজ করেছেন।
(বুখারী শরীফ)
প্রজ্ঞাবান সিদ্ধান্তদাতা
সিদ্ধান্তদাতা যদি প্রজ্ঞাবান হয়ে থাকেন, এবং তিনি যদি যথাযথ চেষ্টা করে সঠিকটা খুঁজে বের করার পথে কোন ভুল করেন, তাহলে তাঁর জন্য একটি সৎকর্মের হিসাব সংরক্ষিত হবে। আর সঠিক করলে দুটি। আরবিতে শব্দটি হল, হাকীম।
(বুখারী শরীফ, দ্বিতীয় খন্ড, ১০৭৯ পৃ.)
এ কথাটি তাঁদের উপরই প্রযোজ্য হবে, যাঁরা যথাযথভাবে জানেন, ভালভাবে জানেন এবং সর্ব্বোচ্চ জানার চেষ্টার পর ভুল করেন। যারা নব আবিষ্কারের চেষ্টা করছে তাদের ক্ষেত্রে জঘন্যতম অপরাধের মতই হবে। কারণ, ধর্মীয় এমন কোন সিদ্ধান্ত নেই, যা প্রথম ছয় শতাব্দীর মধ্যে সমাধা হয়নি। এরপর যা বিশুদ্ধ এসেছে, তা ওই ছয় শতকের পূর্ব-প্রমাণিত বিষয়ের আলোকে।
তাই এই কথাগুলো মুজতাহিদ তথা ইমামদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
যে গ্রন্থগুলোয় পরবর্তীতে হাদিস সংরক্ষিত হয়েছিল
আমরা জানি, হানাফি মাযহাব একজন তাবিয়ি কর্তৃক নির্দেশিত হওয়ায় তাঁর সময়ে লিখিত হাদিস গ্রন্থ ছিল অত্যন্ত কম এবং এক হিসাবে অপ্রয়োজনীয়। কারণ তখনো সাহাবা রা. গণ বর্তমান থাকায় হাদিস সরাসরি প্রথম রাবী থেকেই শোনা যেত, বিশ্বাসযোগ্যতা ও অবিশ্বাসযোগ্যতার কোন বিষয় ছিল না।
কিন্তু পরবর্তীতে এই হাদিসগুলোর বেশিরভাগ বুখারী এবং মুসলিম শরীফ, ক্ষেত্রবিশেষে আবু দাঊদ শরীফে গ্রন্থিত হয়নি। এ বিষয়ে পরবর্তী পর্ব আসবে আশা করি। মূল কারণ ছিল এই যে, ইমাম বুখারী, ইমাম মুসলিম র.- এঁরা ছিলেন সরাসরি ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল আলাইহির রাহমার ছাত্র। এবং তাঁদের মাযহাবে নামাজের অথবা জীবনাচরণের হানাফি নিয়মগুলো ছিল না। তাই শুদ্ধ হবার পরও তাঁরা হাদীসগুলো গ্রন্থিত করেননি। তাঁরা শুদ্ধ হাদীস একত্র করছিলেন না, বরং একটা সুনির্দিষ্ট জীবনাচরণ তৈরি করার জন্য ওই প্রক্রিয়ার শুদ্ধ হাদিসগুলোই শুধু তালিকাবদ্ধ করছিলেন।
শরাহ্ মাআনিল আতহার, আযাওহারান নাক্বী, নাসবুর রায়াহ্ , ইলা আস সুনান, বাজলুল মাজহুদ, ফাতহুল মুলহীম, আওযাজুল মাসালিক, আতহারুস সুনান প্রভৃতি গ্রন্থে হানাফী মাজহাবের হাদিসগুলো বেশি এসেছে।
বিশুদ্ধ যে কোনভাবে নামাজ পড়লেই তো হল, মাজহাবের দরকার কী
নামাজের একটা পদ্ধতি আরেকটা পদ্ধতির সাথে জড়িত। যেমন, পুরুষ নামাজী রাফে ইয়াদাইন করলে (রুকুতে যাবার সময় এবং ওঠার সময় হাত তুললে) তাকে বুকে হাত বাঁধতে হবে। তিনি যদি হানাফী পদ্ধতির মত পেটে নাভিতে হাত বাঁধেন এবং হাম্বলী পদ্ধতির মত রাফে ইয়াদাইন করেন, তাহলে নামাজ শেষ। অর্থাৎ, যে মাজহাবের ইমাম নামাযের যে একটা পদ্ধতি গ্রহণ করেছেন, সেই পদ্ধতিতে নামাজ পড়ানোর সময় রাসূল দ. যেভাবে অযু করাতেন, যেভাবে যখন নামাজে দাঁড় করাতেন এবং যেভাবে পড়াতেন, তার পূর্ণটা ফলো করেছেন, যা নিজের ইচ্ছামত করলে অবশ্যই ভুল হবে।
যেমন,
হাম্বলী মাজহাব অনুসারে পরস্পর নামাজিদের পায়ের মধ্যে সামান্য দূরত্ব থাকবে।
শাফিয়ি মাজহাব অনুসারে, পদযুগলের মধ্যে দূরত্ব এক হাতের মত থাকবে।
মালিকি মাজহাব অনুসারে, দূরত্বটা মধ্যপন্থার হতে হবে। লাগিয়ে রেখে নয়, আবার খুব দূরেও নয়।
হানাফি মাজহাব অনুসারে, দুই মুসল্লীর পায়ের মধ্যে চার আঙুল মত দূরত্ব থাকতে হবে।
অথচ কোন মাজহাব স্বীকার করে না, এমন কিছু নতুন জন্ম নেয়া বিষয়, অর্থাৎ বিদআতি মতবাদ হল, পায়ের সাথে পা লেগে থাকবে। দেখা গেল, পায়ের সাথে পা লেগে থাকা, যা মুসলিম আদবের নিয়মের মধ্যে বেআদবী এবং চার-চারটি বৃহত্তম মাজহাবের কোথাও যা নেই অর্থাৎ হাজার বছর ধরে অনুসৃত ইসলামেই যার অবস্থান নেই, সেভাবে নামাজ পড়ার পদ্ধতি আবিষ্কার করা হয়েছে।
হ্যা, পায়ের সাথে পা মিলিয়ে দাঁড়ানোর একটা হাদিস রয়েছে। আনাস রা. বর্ণিত ওই হাদিস বুখারী শরীফে উপস্থাপন করার কারণ হিসাবে ইবনে হাজর আস্কালানী রহ. বলছেন, ইমাম বুখারী এই হাদীস এই কারণে আনেননি যে, পায়ের সাথে পা মিলাতে হবে। বরং তিনি সালাতের লাইন সোজা করে দাঁড়ানোর গুরুত্বের হাদীস হিসাবে তা এনেছেন যেখানে পায়ের সাথে পা মিলিয়ে দাঁড়ানো একটা গৌণ বিষয় ছিল। রাসূল দ. পায়ের সাথে পা মিলিয়ে দাঁড়ানো বলতে দুই নামাজীর মধ্যে উল্লেখ্য ফাঁকা অবস্থান না রাখা বুঝিয়েছেন কেননা সালফে সালিহিন এবং একটা ছাড়া কোন ক্ষেত্রেই জানা যায় না যে, কেউ পায়ের সাথে পা মিলিয়ে দাঁড়িয়েছেন। এই হাদিস আরো দুটি বিখ্যাত গ্রন্থে রয়েছে। আরো একটি রেওয়ায়েতে রয়েছে।
মূল কথাটা ছিল, রাসূল দ. জামাতের কাতার পূর্ণ সোজা করার জন্য জোর দিচ্ছেন। এবং ব্যক্তির সাথে ব্যক্তির ফাঁকা থাকার কারণে একতা ও সাম্যের যে বন্ধন, সেটা কমে যায় ফলে ফাঁকাতে শয়তান (বিভাজনের কু মন্ত্রণা ও প্রকৃত ইবলিশ শয়তান দুই অর্থেই) প্রবেশ করে।
এখানে বাঁচোয়া মাত্র একটা কথায়, তা হল, যে অর্থেই হোক, হাদিসে আছে।
রাফে ইয়াদাইন যদিও গ্রহণযোগ্য কাজ, কিন্তু তাঁরা যেভাবে প্রকৃতার্থে পায়ের সাথে পা চাপা দিয়ে পাশাপাশি দাঁড়ান, এটা কোন পদ্ধতি নয়। রাফে ইয়াদাইন যেখানে বহুল প্রচলিত, সেখানে এই পদ্ধতিটি নিতান্তই দুর্লভ, ইদানীংকার তথাকথিত আহলে হাদীস ছাড়া, যারা প্রচলিত কিছুই মানেন না, মানেন বইয়ের ইন্টারপ্রিটেশন। ফলে, বইয়ে যা লেখা আছে, তা লিটারালি ইন্টারপ্রেট করতে গিয়ে বিপরীতে সমস্ত পৃথিবীর সমস্ত মতবাদের সমস্ত মুসলিমের সমস্ত আমলকে সরাসরি অস্বীকার করেন। অথচ তাঁদের সূচনা সাহাবী-তাবিয়ী পর্যায়ে তো নয়ই, মাত্র তিন শতাব্দী পূর্বে।
এই মতবাদ সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য কারণ, রাসূল দ. বলেছেন, আমার উম্মাতের বেশিরভাগ কখনোই কোন অবস্থাতেই সম্পূর্ণ ভ্রান্ত আমল করতে পারে না।
যেখানে এই মতবাদ প্রকাশের সময় উম্মতের প্রায় শতভাগ পায়ে পা ফাঁকা রাখেন, সেখানে পায়ের সাথে পা মিলিয়ে দাঁড়ানো, এবং না দাঁড়ালে ভুল বলা প্রকারান্তরে কুফরিতে পরিণত হয়।
এটা কখনোই সম্ভব নয় যে, ইমাম আবু হানিফা, শাফি, মালিক ও হাম্বল রিদ্বওয়ানুল্লাহি আজমাইন স্বয়ং তাবিয়ী এবং তাবে তাবিয়ী হয়ে অসংখ্য সাহাবা রা. এবং তাবেয়ী র.'র পিছনে নামাজ পড়ে অভ্যস্ত হয়ে কখনো পায়ের সাথে পা লাগানোর সিদ্ধান্ত দিলেন না, বরং ফাঁকা রাখার সিদ্ধান্ত দিলেন আজীবন নামাজ নিয়ে গবেষণা করে, জীবনভর নিজের চোখে দেখে- আর অন্যদিকে রূপক কথাকে বাস্তব গ্রহণ করে এখন মানুষের নামাজ নষ্ট করার সিদ্ধান্ত নেয়া, তাও শুধু গ্রন্থের ইন্টারপ্রিটেশনে, যেখানে গ্রন্থেই লেখা আছে মূল ব্যাখ্যা- একেই ফিৎনা বলা যায়। যদিও পুরোপুরি ভুল বলা যায় না পায়ে পা লাগিয়ে দাঁড়ানোর পদ্ধতিটাকে।
তাহলে প্রচলিত নামাজের পদ্ধতির বিরোধীতা কেন?
যদিও বলা হয় যে, নব্য মতবাদ মূলত হানাফী নামাজের পদ্ধতির বিরোধীতা করছে, এবং বলা হয় যে, তারা মূলত হাম্বলির মত স্বত:সিদ্ধ নামাজের পদ্ধতি গ্রহণ করেছে এই কারণে যে ইমাম হাম্বল সবচে গ্রহণযোগ্য, আমরা দেখতে পাই চার মাজহাবের সমস্ত নিয়মের বাইরে গিয়ে এবং প্রচলিত পূর্ণ মুসলিম উম্মাহর বাইরে গিয়ে একটা পদ্ধতি নেয়া হয়েছে। এই পদ্ধতি নেয়ার কারণ মাত্র একটা, চার মাজহাবের স-ব প্রচলনের বিরোধীতা করা। সুস্পষ্ট ভিন্নতা আনয়ন।
এই ভিন্নতার উৎস ঘৃণা। আহলে হাদীস বা লা মাজহাবি বা সালাফি পদ্ধতি প্রণয়নের মাধ্যমে খুঁজে খুঁজে প্রতিটা এমন বিষয় আনা হয়েছে, যা প্রচলিত শিয়া-সুন্নি বা আর সব মতবাদের সমস্ত ইবাদাত এবং জীবনযাপনের পদ্ধতির বিপরীত হয়। অথচ তা যেন হাদীসেই থাকে।
এ প্রক্রিয়ার প্রায়োগিক শুরু কবে? অবাক বিষয়, সাহাবা রা. দের রীতি অনুযায়ী হানাফী মাযহাব শুরু হয় প্রথম হিজরীতেই, অন্য তিন মাজহাব এর শুরু দ্বিতীয় হিজরীতেই। সেখানে এই প্রচলনের প্রয়োগ শুরু হয় মাত্র ২৭০/২৮০ বছর আগে।
'কাউকে ফলো না করার প্রক্রিয়া' আদপে তাবেয়ী এবং তাবে তাবেয়ী বাদ দিয়ে মাত্র তিনশো বছর আগের এক যুদ্ধোন্মাদ, জোর পূর্বক তরুণদের মসজিদে নিয়ে গিয়ে হাতে কলমে সামরিক প্রশিক্ষণ দেয়া ব্যক্তির অনুকরণ-অনুসরণ। কাউকে ফলো না করার দল সব সময় মাত্র তিনশ বছর আগের একজনকেই ফলো করে। সেটা কাউকে ফলো করা হয় না। তার কিতাবুত তাওহীদ বইকে সর্ব্বোচ্চ মর্যাদা দেয় এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য তালিকাভুক্ত করে, তাতে তাকে ফলো করা হয় না! হা-হতোষ্মি! নিজেরাই আহলে হাদিস নাম গ্রহণ করে সমস্ত দলের অস্তিত্ব অস্বীকার করে অথচ আহলে হাদীস মানে হাদিসের দল। মাজহাবে আহলে হাদীস নাম গ্রহণ করে আবার বলে, মাজহাব বলতে কিছু নেই। মাসলাকে আহলে হাদীস নাম গ্রহণ করে বলে, ভিন্ন শুদ্ধ মতবাদ বলতে কিছু নেই, শুদ্ধ মতবাদ মাত্র একটা।
আমি হানাফী, এই পরিচয় বলা নাকি দোষদুষ্ট, কারণ তাতে মুসলমান বলা হয়নি কিন্তু তাদের আহলেহাদীস পরিচয় দেয়া ঠিক আছে। আহলে হাদীস শব্দটার মানে হল, গল্পের দল। লিটারারি মানে। এখানে কোথায় মুসলমান শব্দটা রইল? সালাফি মানে হলে তিনপ্রজন্মের দল। তিনপ্রজন্মের দল শব্দটার কোথায় মুসলমান লুকিয়ে রইল?
আর আপনি হানাফী নাকি মুসলিম এই কথাটা বলার মাধ্যমে সরাসরি ইমাম আবু হানিফা, যার নামের সাথে তারাও রহমতুল্লাহি আলাইহি বা রাহিমাহুল্লাহ যুক্ত করে, তাকে নবী সাব্যস্ত করছে।
আপনি রাসূল দ.'র দ্বীন অনুসরণ করছেন নাকি আবু হানীফা র.'র প্রশ্নের মাধ্যমে আবু হানীফাকে তাঁরা সম্মান করার বিনিময়ে এই স্বীকৃতি দিচ্ছেন যে, তিনি আলাদা ধর্ম প্রণয়ন করেছেন এবং তিনি একজন সম্মানিত- তার মানে মাত্র একটা, তাঁকে নবী বলা। অপবিত্র কথার শেষ পর্যায়।
এই মতবাদ প্রচলিত এমন একজনের দ্বারা, যে প্রচলিত সমস্ত বিশ্বাসের সমস্ত মতামতের এবং সমস্ত রীতি-নীতির পূর্ণ বিপরীত ছিল। আর সেই বৈপরীত্যের উৎস শুধুই জাতিগত ঘৃণা ও আন্ত-ধর্ম স্যাবোটাজ।